জাতীয় সংগীত | অনুচ্ছেদ-১: পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণীর জন্য
জাতীয় সংগীত হলো রাষ্ট্রীয় ভাবে স্বীকৃত এক অথবা তার বেশি দেশপ্রেমমুলক গান। তবে বেশিরভাগ দেশে জাতীয় সংগীত হিসেবে একটি গান বেছে নেয়া হয়। আমাদের দেশের জাতীয় সংগীত হলো রবীন্দ্রনাথ রচিত আমার সোনার বাংলা গানটি। ১৯৭২ সালের ১৩ই জানুয়ারী এই গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। বাংলাদেশের এই সংগীতকে স্বাধীনতার পর সাংবিধানিক ভাবে জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষনা করা হয়। বাংলাদেশের এই সংগীতটির মাধ্যমে মাতৃভূমির প্রতি গভীর মমত্ববোধ প্রকাশ পেয়েছে। এই গানের প্রতিটি চরনে ফুটে উঠেছে একজন দেশপ্রেমিকের গভীর মায়া মমতা ও আকুলতা। একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক তার দেশের জন্য যে গভীর অনুভূতি মনের মধ্যে পোষণ করে রাখে সেই আবেগই ফুটে উঠেছে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতে। গানটিতে বারংবার বলা হয়েছে “ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।” মন্ত্রী সভার প্রথম বৈঠকে এই গানটির দশ লাইন জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে। এই সংগীত বাংলাদেশের সরকারী বেসরকারী প্রতিটি অনুষ্ঠান বা সভাতে পরিবেশন করা হয়। স্কুল, কলেজে প্রতিদিন সকালে যে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় তখনএটি পরিবেশন করা হয়। যখন সরকারী বা বেসরকারী অনুষ্ঠান, সভা বা মিটিং এর আয়োজন করা হয় তখন এটি দিয়ে সেই অনুষ্ঠানের সূচনা করা হয়। এই সংগীত পরিবেশনের সময় দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত সমস্বরে গাইতে হয়। বাংলাদেশের জতীয় সংগীত বাউল গানের সুরে রচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশে যখন কোনো জাতীয় দিবস পালন করা হয় তখন পতাকা উত্তলন করার সময় এই সংগীত পরিবেশন করে। বিজয়, স্বাধীনতা দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারীতেও জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু করা হয়। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত প্রেমময় সুর ও ভাষা দিয়ে রচনা করা হয়েছে। এই সংগীতে কোনো মহৎ ব্যক্তিকে নিয়ে গুণগান করা হয়নি বরং প্রকৃত দেশপ্রেমিকের দেশের প্রতি যে মনের গভীর ভালবাসা সেটি প্রকাশ পেয়েছে। এই গান যদি গভীর ভাবে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করা যায় তাহলে এই গানের মাধ্যমে প্রকাশ পাবে বাংলাদেশের সবুজ শ্যামল মায়াবী রুপ। ছয় ঋতুর বাংলাদেশ অঘ্রান মাসের সোনালী ধানে কি রুপ ধারন করে সেই কথা বর্ননা করা হয়েছে এই গানে। এই গানের মাধ্যমে মানুষ জানতে পারে আমাদের দেশের সংস্কৃতি ও সৌন্দর্য সম্পর্কে।
জাতীয় সংগীত | অনুচ্ছেদ-২: এসএসসি (নবম – দশম শ্রেণী) পরীক্ষার জন্য
জাতীয় সংগীত হলো একটি দেশের জনগণের ঐক্য ও গৌরবের প্রতীক। প্রতিটি দেশের নিজস্ব জাতীয় সংগীত থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ভিন্ন নয়। আমাদের দেশেরও জাতীয় সংগীত রয়েছে। এটি হলো একধরনের উচ্চাঙ্গ সংগীত। যা উচ্চ স্বরে গাওয়া হয়। একটি দেশের জাতীয় সংগীত সে দেশের সরকার ও জাতীয় পরিষদের সদস্যরা বাছাই করে থাকে। একটি দেশের জনগণের জন্য অহংকারের প্রতীক হলো জাতীয় সংগীত। জাতীয় সংগীত গাওয়া হলে একটি দেশের জনগণের মধ্যে ঐক্য ও অভিন্নতা বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হলো “আমার সোনার বাংলা”। এই গানটি ১৯৭১ সালের ১ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গাওয়া হয়। এই গানটি বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ঐক্য ও অভিন্নতা বৃদ্ধি করে এবং তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে অনুপ্রাণিত করেছিল। “আমার সোনার বাংলা” গানটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেন। গানটিতে বাংলাদেশের সুন্দর প্রকৃতি, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বর্ণনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত দেশ প্রেম ও গৌরবের একটি চিহ্ন। এই সংগীতের প্রতিটি লাইনে জন্মভুমির প্রতি অকৃত্তিম ভালবাসা প্রকাশ পেয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় ১৯৭২ সালের ১৩ই জানুয়ারী জাতীয় সংগীত হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে। গানটির প্রতিটি লাইনে বাংলাদেশের আকাশ, বাতাস, মাটির প্রতি গভীর ভালোবসার কথা প্রকাশ পেয়েছে। একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিকের মনে চিরদিন দেশের প্রতি ভালবাসা অক্ষুণ্ণ থাকে সেই কথাই বলা হয়েছে এই গানটিতে। এই সংগীত প্রতিদিন স্কুল কলেজে গাওয়া হয়। এছাড়াও সরকারী বেসরকারী যে কোনো ধরনের অনুষ্ঠান এবং সভায় এটি গাওয়া হয়। যে কোনো ধরনের অনুষ্ঠান শুরুর সময় এটি পরিবেশনের মাধ্যমে সেই অনুষ্ঠান শুরু হয়। এই সংগীত পরিবেশনের সময় দেশের সম্মানে সবাইকে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করতে হয়। আমাদের দেশে একসময় শুধু শহরে জতীয় সংগীত গাওয়া হতো কিন্তু বর্তমানে গ্রামেও জাতীয় সংগীত পরিবেশন কর হয়। এখন দেশের আন্তর্জাতিক ক্রিড়া অনুষ্ঠানেও এই সংগীত পরিবেশন করা হয়। যদি আমাদের দেশের ফুটবল, ক্রিকেট বা অন্যান্য খেলার কোনো দল অংশগ্রহণ করে। আমাদের দেশ এবংএটিকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য আগে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করে তারপর খেলা শুরু করা হয়। জাতীয় সংগীতের অনেক ব্যবহার রয়েছে। যেমন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি যদি কোনো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করে তাহলে সেখানে তাদের আগমনের সময় সে অনুষ্ঠানে এটি পরিবেশন করা হয়। যখন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠান থেকে প্রস্থান করে তখনও এই সংগীত পরিবেশন করা হয়। যখন কোনো বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানের সম্মানে বা রাষ্ট্রপতিকে কোনো পুরষ্কার বা অনার প্রদান করে তখন জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়।
জাতীয় সংগীত | অনুচ্ছেদ-৩: এইচএসসি ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য
“আমার সোনার বাংলা” – বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবি কণ্ঠে ধরা এই দেশাত্মবোধক গানটি প্রতিটি বাংলাদেশির হৃদয়ে সোনার সুর বাজিয়ে যায়। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের উত্তাপে জন্ম নেওয়া এই গানটি আজকে আমাদের স্বাধীনতার স্পন্দন, প্রকৃতির সৌন্দর্য, ঋতুর বৈচিত্র্য এবং মাতৃভূমির প্রতি নিঃশব্দ ভালোবাসার নিখুঁত অভিব্যক্তি। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ স্বাধীন বাংলার কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে ৩ মার্চ ঢাকায় পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় এই গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ঘোষণা করা হয়। মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে এই গানটি প্রথম জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গাওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সুরকার অজিত রায় গানটির বর্তমানে প্রচলিত যন্ত্রসুর করেন। ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকার গানটির প্রথম দশ লাইন জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গাওয়ার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যন্ত্রসঙ্গীতে ও সামরিক বাহিনীতে ব্যবহার করা হয় প্রথম চারটি লাইন। একই বছর গানটির স্বরলিপি বিশ্বভারতী সংগীত বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত করা হয়। জাতীয় সংগীতের প্রথম দুই লাইনেই মুখর হয়ে ওঠে দেশের প্রতি গভীর অনুরাগ। চিরদিনের প্রতিশ্রুতি ঝরে পড়ে আকাশ, বাতাস ও মাটির প্রতি ভালোবাসার সুরে। সবুজ বনে ঘুরে বেড়ানো, নদীর তীরে নৌকা চালানোর আনন্দে দেশের অপরূপ সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। জাতীয় সংগীতে সোনা শব্দটি প্রিয় অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এটি বাংলার অপরূপ সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যের প্রতি রবীন্দ্রনাথের গভীর ভালোবাসা প্রকাশ করে। ঋতুর বৈচিত্র্যে রাঙানো বাংলাদেশকে গানটি ধারণ করেছে ফাগুনের আমের ঘ্রাণে পাগল করা নেশা থেকে অগ্রহায়ণের পূর্ণ ক্ষেতের মিষ্টি হাসিতে। বটের মূলে ছায়া বিছিয়ে থাকা মাতৃভূমির বুক, সেই বুকের মলিনতা দেখলে যে নয়ন জলে ভাসবে, এই নিবিড় অনুভূতিই জাগিয়ে তোলে গানটি। শহীদ জহির রায়হান ১৯৭০ সালে তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেওয়া’-এ “আমার সোনার বাংলা” গানটিকে প্রথমবারের মতো চলচ্চিত্রায়ন করেন। ২০১৪ সালের ২৬ মার্চ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে, ঢাকার প্যারেড ময়দানে একসঙ্গে ২৫৪,৫৩৭ জন মানুষ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত “আমার সোনার বাংলা” গেয়ে গিনেস বিশ্ব রেকর্ড গড়েন। ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ২০৫টি দেশের জাতীয় সংগীতের তুলনামূলক বিচারে গার্ডিয়ান পত্রিকা, উরুগুয়ের জাতীয় সংগীতের পরেই এটিকে দ্বিতীয় সেরা ঘোষণা করে। এছাড়াও বিবিসি বাংলার সেরা বিশটি বাংলা গানের তালিকায় এর শীর্ষস্থান দখল করে। আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়, প্রতিটি দেশ তাদের জাতীয় সংগীত গেয়ে খেলা শুরু করে। এটি জাতীয় ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি উপায়। এসময় খেলোয়াড় এবং দর্শক উভয়ই দাঁড়িয়ে থাকেন। রাষ্ট্রীয় সকল গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি, যেমন: স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, জাতীয় সংসদের অধিবেশন, রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান, প্রধানমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান, বিচারপতিদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান, সামরিক বাহিনীর প্রধানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান ইত্যাদির সূচনায় জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। প্রাতঃকালে স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে “আমার সোনার বাংলা” বাজলে প্রতিটি বাংলাদেশির হৃদয়ে জাগ্রত হয় দেশপ্রেম ও ঐক্যবদ্ধতার ভাব। মাতৃভূমির ইতিহাস ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে এই গান, যা শুধু জাতীয় সংগীতই নয়, প্রতিটি বাংলাদেশির আত্মপরিচয়ের গভীরতম সুর।