প্রিয় শিক্ষার্থীরা আমাদের আজকের রচনা ‘বই পড়ার আনন্দ’। আজকের এই রচনাটি ২০ টি পয়েন্টে প্রায় ২৫০০+ শব্দে লেখা হয়েছে যেন পরীক্ষার্থীরা একবার পরেই নিজের মতো করে লিখতে পারে। রচনাটিতে প্রসংগিক অনেকগুলি উক্তি ও কবিতা বেবহার করা হয়েছে যা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় সর্বাধিক নম্বর অর্জনে সাহায্য করবে। রচনাটি সহ যে কোন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য অত্যান্ত গুরুপ্তপূর্ণ।
বই পড়ার আনন্দ
ভূমিকা
মানুষের জীবনে আনন্দ অপরিহার্য। জীবনকে শুধু অর্থহীন ভোগ লিপ্সায় ডুবিয়ে রাখা কিংবা যান্ত্রিক ব্যস্ততায় বিষিয়ে তোলার কোনো মানেই হয় না। সজীব-সতেজ ও উপভোগ্য জীবনের জন্য চাই আনন্দের সংস্পর্শ। আর এ আনন্দটি অবশ্যই হতে হবে নিষ্পাপ, নিষ্কাম ও নিখাদ।
আর সেই আনন্দ হল বই পড়ার আনন্দ। তাইতো ভিনসেন্ট স্টারেট বলেছেন,
“আমরা যখন বই সংগ্রহ করি, তখন আমরা আনন্দকেই সংগ্রহ করি।”
বই পড়ার মাধ্যমে আমরা নতুন নতুন বিষয় জানতে পারি, নতুন নতুন জগৎ আবিষ্কার করতে পারি। বই আমাদের বিনোদন দেয়, আমাদের চিন্তাভাবনাকে প্রসারিত করে, আমাদের মনকে শান্ত করে। বই আমাদের জীবনকে আরও সমৃদ্ধ ও সুন্দর করে তোলে।
বইয়ের ও বই পড়ার ইতিহাস
বইয়ের ইতিহাস মানব সভ্যতার ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানুষের জ্ঞান ও সংস্কৃতির বিকাশের সাথে সাথে বইয়ের বিবর্তন ঘটেছে। প্রাচীনকালে মানুষ পাথর, মাটি, কাঠ, হাড় ইত্যাদি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের লেখার উপকরণ তৈরি করত। এসব উপকরণ দিয়ে লেখালেখির কাজ ছিল অত্যন্ত কঠিন ও সময় সাপেক্ষ। প্রাচীন মিশরে প্যাপিরাস নামক একটি উদ্ভিদ থেকে তৈরি কাগজের মতো উপকরণ আবিষ্কৃত হয়। প্যাপিরাস আবিষ্কারের ফলে লেখালেখির কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়। প্রাচীন গ্রীসে পাণ্ডুলিপি বা বই তৈরির প্রচলন শুরু হয়। পাণ্ডুলিপি তৈরির জন্য ভেড়া, ছাগল বা ভেড়ার চামড়া ব্যবহার করা হতো।
যদিও সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন
“বই কিনে কেউ কোনদিন দেউলিয়া হয় না।”
তবে এই সবময় বই তৈরির কাজ ছিল অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। সাধারণ মানুষ বই কিনতে গেলে আসলেই দেউলিয়া হয়ে যেত।
মধ্যযুগে বই তৈরির কাজ আরও সহজ হয়। এই সময় বই তৈরির জন্য ভেড়ার চামড়ার পরিবর্তে কাগজ ব্যবহার করা শুরু হয়।
১৫ শতকে জার্মানিতে মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়। মুদ্রণ যন্ত্রের আবিষ্কারের ফলে বইয়ের উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। মুদ্রণ যন্ত্রের আবিষ্কারের ফলে বই পড়ার সুযোগ সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯ শতকে বইয়ের প্রকাশনায় নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ঘটে। এই সময় থেকে বইয়ের উৎপাদন ও বিপণন আরও সহজতর হয়।
বই পড়ার ইতিহাসও বইয়ের ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রাচীনকালে মানুষ বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ, সাহিত্যকর্ম, ইতিহাস, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ের বই পড়ত।
মধ্যযুগে ইউরোপে চার্চের কর্তৃত্ব ছিল সর্বোচ্চ। এই সময় চার্চের নিয়মকানুন মেনে চলতে হতো। ধর্মীয় গ্রন্থ ছাড়া অন্য কোনো বই পড়া ছিল নিষিদ্ধ। তবে, বাগদাদ, পারস্য, চীন ও ভারতের নালান্দা তে মুক্তজ্ঞান চর্চা হত। ১৯ শতকে বইয়ের প্রকাশনায় নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ঘটে। এই সময় থেকে বই পড়ার সুযোগ সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
বর্তমানে বই পড়ার একটি উন্নত মাধ্যম হলো ই-বুক ও অডিও বুক।
বই পড়ার আনন্দ
বই পড়ার আনন্দ নিঃসন্দেহে অনন্য। বই হল জ্ঞান, শিক্ষা, বিনোদন, অনুপ্রেরণায় ভরপুর এবং তথ্যের একটি উৎস। বই আমাদেরকে নতুন কিছু শিখতে, অন্যদের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে, এবং আমাদের চিন্তাভাবনাকে প্রসারিত করতে সাহায্য করে। বই আমাদের আনন্দ দেয়, বিনোদন দেয়, এবং অনুপ্রাণিত করে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর ভাষায় বলতে পারি,
“বই পড়াকে যথার্থ হিসেবে যে সঙ্গী করে নিতে পারে,তার জীবনের দুঃখ কষ্টের বোঝা অনেক কমে যায়।”
বই পড়ার মাধ্যমে আমরা বিনোদন পাই। যেমন, আমরা গল্প, উপন্যাস, কবিতার বই পড়ে বিনোদিত হই। এই বিনোদন আমাদের মনকে শান্ত করে, আমাদের হতাশা দূর করে। বই পড়ার মত প্রিয় বই কেনার মাঝেও অসীম সুখ পাওয়া যায়। বিদ্যায়ের ছুটিতে, দুরের ভ্রমনে বই আমাদের প্রিয় সঙ্গী।
বই সেরা বন্ধু
“বইয়ের মত এত বিশ্বস্ত বন্ধু আর নেই”— আর্নেস্ট হেমিংওয়ের
বই সেরা বন্ধু – এই উক্তিটি অনেকেই বলে থাকেন। কিন্তু বই কেন সেরা বন্ধু? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমরা দেখতে পাই যে, বই আমাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করে।
বই আমাদের জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। বই পড়ার মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানতে পারি। যেমন, আমরা ইতিহাস, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সাহিত্য, দর্শন, ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ে জানতে পারি। এই জ্ঞান আমাদের জীবনকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে।
বই আমাদের বিনোদন দেয়। বই পড়ার মাধ্যমে আমরা নতুন নতুন চরিত্রের সাথে পরিচিত হই, নতুন নতুন গল্পের সাথে জড়িয়ে পড়ি। এই বিনোদন আমাদের মনকে শান্ত করে, আমাদের হতাশা দূর করে।
”বই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ আত্মীয়, যার সঙ্গে কোনদিন ঝগড়া হয় না,কোনদিন মনোমালিন্য হয় না।“- প্রতিভা বসু
বইয়ের সাথে আমাদের সেরা বন্ধু কারনঃ
- বই সর্বদা আমাদের সাথে থাকে। আমরা যেখানেই যাই, বই আমাদের সাথে নিতে পারি। বই আমাদেরকে একাকীত্ব থেকে রক্ষা করে এবং আমাদেরকে যেকোনো সময় এবং যেকোনো জায়গায় আনন্দ দেয়।
- বই আমাদেরকে ছিন্তাকে বিচার করে না। বই আমাদেরকে আমাদের মতাদর্শ, বিশ্বাস, বা আচরণের উপর কোন কিছু জোর করে চাপিয়ে দেয় না। বই আমাদেরকে আমাদের নিজের মতো করে থাকতে সাহায্য করে।
- বই আমাদেরকে আমাদের নিজের জীবন এবং বিশ্ব সম্পর্কে নতুনভাবে চিন্তা করতে সাহায্য করে। বই আমাদেরকে অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে এবং আমাদের নিজের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করতে সাহায্য করে।
এইসব কারনেই বইকে বলা হয় সেরা বন্ধু।
বই পড়ার প্রয়জনিয়তা
মানব জীবনে বই পড়ার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। বই পড়ার মাধ্যমে আমরা বিভিন্নভাবে উপকৃত হতে পারি। বিখ্যাত দার্শনিক – বার্ট্রান্ড রাসেল এর ভাষায়,
“একটি বই পড়ার দুটি উদ্দেশ্য থাকা উচিত একটি হল- বইটিকে উপভোগ করা অন্যটি হল- বইটি নিয়ে গর্ব করতে পারা।”
বই পড়ার প্রয়োজনীয়তা সমুহঃ
১. জ্ঞানের সাগর খুলে দেয়: বই আমাদের জ্ঞানের অসীম সমুদ্রে ডুব দিতে সাহায্য করে। বিজ্ঞান, ইতিহাস, সাহিত্য, দর্শন – সবকিছুই আমরা বইয়ের মাধ্যমে আয়ত্ত করতে পারি।
২. নতুন দিগন্তের পথ দেখায়: বই আমাদের সীমাবদ্ধ জগতকে ছাড়িয়ে নতুন দিগন্ত দেখায়। বিভিন্ন সংস্কৃতি, জীবনধারা, চিন্তাভাবনা – আমাদের জগতকে আরো বড় করে তুলে।
৩. চিন্তার ক্ষমতা বাড়ায়: বই পড়া আমাদের চিন্তার ধারা তীক্ষ্ণ করে। প্রশ্ন করা, বিশ্লেষণ করা, নতুন সমাধান খুঁজা – এই সবই বই পড়ার মাধ্যমে অর্জন হয়।
৪. সৃজনশীলতা ব্রিধি পায়: বই পড়া আমাদের কল্পনাশক্তিকে বাড়িয়ে দেয়। নতুন চিন্তা, নতুন আইডিয়া, নতুন সৃষ্টি – বইয়ের পাতায় আমরা পাই সৃজনশক্তার অনুপ্রেরণা।
৫. মানসিক চাপ কমে: বই পড়া এক ধরনের মানসিক বিশ্রাম। কর্মমুখর দিনের পরে একটা ভালো গল্পে হারিয়ে যাওয়া, মানসিক চাপ কমাতে দারুণ কাজ করে।
৬. বাক্তিত্তবোধ করে: বই পড়া আমাদের জীবনধারা ভালোর দিকে পরিবর্তন করতে সাহায্য করে। নতুন জিনিস শেখা, ভুল সংশোধন করা, নিজেকে আরো ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা – এসবই বই পড়ার মাধ্যমে সম্ভব হয়।
বই আমাদের সারা জীবনের সেরা সঙ্গী। একাকীত্বে, অন্ধকারে আলোর মতো, বই আমাদের সাথে থাকে, সাহস দেয়, অনুপ্রাণা দেয়।
আনন্দে বই পড়ার উপযুক্ত সময়
বই পড়া এক মনোরম অভ্যাস, কিন্তু বাস্ত জীবনে খুব কমই সময় পাওয়া যায় বই পড়তে । শিক্ষার্থী কিংবা কর্মজীবীদের জন্য বই পড়ার সেরা সময়গুলো হলো:
ছুটির দিনগুলো: স্কুল বা অফিসের ছুটির সময়টা বই পড়ার জন্য প্রচুর সময় পাওয়া যায়।ঘরের কোনে কিংবা বাগানে বসে, পছন্দের বই হাতে নিয়ে দিনের বেশির ভাগ সময় কাটানো যায়।
দীর্ঘ যাত্রাপথ: ট্রেন, বাস বা বিমানের দীর্ঘ যাত্রায় সময় কাটাতে বইয়ের চেয়ে ভালো সঙ্গী আর হতে পারে না। একটা রোমাঞ্চকর থ্রিলার, হাসি-খুশির গল্প, কিংবা অনুপ্রেরণামূলক বই পড়ে যাত্রাপথকে আরও উপভোগ্য করা যায়।
ঘুমানোর আগে: ঘুমানোর আগের ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘন্টা সময় বই পড়ার জন্য বরাদ্দ রাখা যেতে পারে। এতে শরীরের সারাদিনের কাজের ক্লান্তি কমে, ঘুম আসতে সাহায্য করে। অনেক জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব, যেমন বিল গেটস, মার্ক জুকারবার্গ, বারাক ওবামা, ঘুমানোর আগে নিয়মিত বই পড়েন।
ট্রাফিক জ্যামে: ট্রাফিক জ্যামে আটকে, বিশেষত আমাদের ঢাকা শহরে, বই পড়ে সময় কাটানো যেতে পারে। এতে মানসিক চাপ কমে, মন ভালো থাকে ও বিরক্তিকর সময় কেটে যায়।
লাঞ্চ টাইম: অফিসের লাঞ্চ টাইমে ১০-১৫ মিনিট বই পড়ে মন ফ্রেশ করে নেওয়া যেতে পারে। অন্যান্য সময়গুলো: এভাবে আরও অনেকভাবে আমরা বই পড়ার সময় বের করতে পারি। যেমন, ডেন্টিস্টের ওয়েটিং রুমে, চুল কাটতে গিয়ে সেলুনে, কিংবা অন্য কোনো যায়গায় সিরিয়ালে অজাথা বসে না থেকে, নিষ্ক্রিয় সময়ে বই পড়ে সময় কাটানো যেতে পারে।
আসলে, বই পড়ার জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। যখনই হাতে একটুখানি সময় থাকে, সেটাই হল বই পড়ার জন্য সেরা সময়। তাই একটা পছন্দের বই হাতে নিয়ে, যে কোনো সময়েই মনের আনন্দে প্রিয় বই উপভোগ করা যায়।
বইয়ের পাতায় জাগে জাতীয় গর্ব, ফুটে ওঠে সংস্কৃতির মূল্য
স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের জাতীয় পরিচয়, সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে আঁকড়ে ধরা এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনে বইয়ের ভূমিকা অপরিসীম। আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কাহিনী, তাদের অদম্য সাহস ও ত্যাগের গল্প বইয়ের পাতায় লেখা থাকে। এই বইগুলো পড়ার মাধ্যমে আমরা আমাদের অতীতকে জানতে পারি, আমাদের স্বাধীনতার মূল্য বুঝতে পারি। ফলে, আমাদের ভেতরে জাতীয় গর্ব জাগে, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের অবদানকে আরো বেশি সম্মান করি।
আমাদের ঐতিহ্য, লোকজ সংস্কৃতি, রীতি-নীতি, ভাষা – সবকিছুই বইয়ের পাতায় লালিত হয়। এই বইগুলো আমাদের সংস্কৃতির ইতিহাস ধারন করে, আমাদের উত্তরাধিকারের প্রতি মমতা জাগায়।
লালন, রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল মধুসূদন, জসীম উদ্দিন – এমন অসংখ্য সাহিত্যিকের রচনা আমাদের সংস্কৃতির দর্পণ। এই বইগুলো পড়ার মাধ্যমে আমরা আমাদের ভাষা, ঐতিহ্য, নৃত্য, সঙ্গীত, খেলাধুলা – সবকিছুর প্রতি মমত্ব অনুভব করি। ফলে, আমাদের সংস্কৃতির প্রতি গর্ব জাগে, আমরা আমাদের ঐতিহ্যকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি বদ্ধ হই।
বইয়ের পাতায় সভ্যতার বীজ, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জ্ঞানের ধারা
সভ্যতার ইতিহাসে বইয়ের অবদান অপরিসীম। হাজার হাজার বছরের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, আবিষ্কার – সবকিছুই বইয়ের পাতায় লেখা আছে। এই জ্ঞানের মশাল এক প্রজন্মের হাত থেকে অন্য প্রজন্মের হাতে ধারাবাহিক ভাবে উন্নত হয়েছে। যা আজকের আধুনিক সভ্যতার গোড়াপত্তন করেছে।
মধ্যযুগে আরবের পণ্ডিতরা চীন, গ্রীক, মিশরের জ্ঞানের সিন্ধুতে গভীর ডুব দেন। তারা সেই জ্ঞানকে পুঁজি করে, নতুন নতুন আবিষ্কার করেন এবং আরও বিকশিত করেন। ফলে, আরব জগত বিজ্ঞান, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসা – নানা ক্ষেত্রে অগণিত অবদান রাখে। এই জ্ঞানের ধারা পরবর্তীতে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। ইউরোপের পণ্ডিতরা আরবদের জ্ঞানের ভিত্তিতে গবেষণা করে আরও উন্নতি সাধন করেন। ফলে, নবজাগরণের সূচনা হয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিপুল সাফল্য অর্জন করা হয়।
আজকের আধুনিক সভ্যতার রুপ এই ঐতিহ্যেরই ধারাবাহিকতারই ফলাফল। বইয়ের পাতায় লেখা জ্ঞান আজও গবেষণা, উন্নয়ন ও নতুন আবিষ্কারের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
বইয়ের মাধেমেই এই ধারা চলতে থাকে,
“বই আমার প্রভু এবং আমার সহচর।”
_ যোসেফ হেল
আজও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বহু মানুষ বই পড়ে, জ্ঞান আহরণ করে, নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করে। এই অবিরাম জ্ঞানের প্রবাহই সভ্যতার মূল ভিত্তি।
ব্যাক্তিত্ব বিকাশে বইয়ের ভূমিকা
বইয়ের জগৎ এক অপরিসীম সমুদ্র, যেখানে জ্ঞানের তৃষ্ণা নিয়ে ডুব দিলে, ফিরে আসা যায় শক্তিশালী, মানবিক ও আদর্শবান ব্যক্তিত্ব হিসেবে। বই আমাদের কেবল তথ্য দিয়েই শেষ করে না, এটি আমাদের ব্যক্তিত্ব গঠনে, মানবিক মূল্যবোধ জাগাতে, এবং একজন নিখুঁত মানুষ হয়ে উঠতে অমূল্য ভূমিকা রাখে।
দার্শনিক অস্কার ওয়াইল্ড এর ভাষায়,
“একজন মানুষ ভবিষ্যতে কী হবেন সেটি অন্য কিছু দিয়ে বোঝা না গেলেও তার পড়া বইয়ের ধরন দেখে তা অনেকাংশেই বোঝা যায়।”
বই পড়া আমাদের চিন্তাভাবনা তীক্ষ্ণ করে, প্রশ্ন করার ক্ষমতা বাড়ায়, এবং সিদ্ধান্ত নিতে সাহস ও দৃঢ়তা প্রদান করে। এই গুণগুলো আমাদের ব্যক্তিত্বকে আরো দৃঢ় ও শক্তিশালী করে।
“বই পড়া আমাদের ভেতরে মানবিকতার আগুন জ্বালায়।” – মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র
বইয়ের গল্প, নাটক ও কবিতা আমাদের অনুভূতি, সহানুভূতি ও মানবিকতা জাগিয়ে তোলে। আমরা অন্যের দুঃখ বুঝতে শিখি, তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করি, এবং ন্যায়পরায়ণতার পথে হাঁটা শিখি।
বইয়ের পাতায় আমরা অসংখ্য চরিত্রের সাথে পরিচয় পাই, তাদের জীবনযুদ্ধ, সফলতা ও ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি। এই শিক্ষা আমাদের আরো সাফল্য লাভ করতে, ভুল সংশোধন করতে, এবং নিখুঁত মানুষ হওয়ার পথে এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা দেয়।
বইয়ের পাতায় রয়েছে অসীম জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সমুদ্র। এই সমুদ্রে ডুব দিয়ে আমরা নিজেকে আরো শক্তিশালী, সৎ, মানবিক ও নিখুঁত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি।
বিখ্যাত ব্যাক্তিদের বই পড়ার অভ্যাস
বইয়ের পাতায় জীবনের রস, জ্ঞানের শিখা আর অনুপ্রেরণার ঝর্ণা। বিখ্যাত মানুষ থেকে সাধারণ মানুষ – সবার জীবনেই বইয়ের অপরিসীম গুরুত্ব।
ক) বিল গেটস: মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস বইয়ের একজন বইপোকা। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন,
“আমি প্রতিদিন অন্তত এক ঘণ্টা বই পড়ি। এটা আমার জগতকে প্রসারিত করে, নতুন চিন্তাভাবনা করতে শেখায় এবং আমাকে আরো ভালো একজন মানুষ হতে সাহায্য করে।”
তিনি প্রতিদিন বিভিন্ন বিষয়ের বই পড়তে ভালবাসেন, বিশেষ করে জীবনী, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও ব্যবসায় – নানা ধরনের বই পড়ে নিজের জ্ঞানের গভীরতা বাড়ান এবং একজন সফল বাক্তি।
খ) উইনস্টন চার্চিল: ইতিহাসের আরেক বিখ্যাত ব্যক্তি চার্চিলের বইয়ের প্রতি আকর্ষণ ছিল অপার। তিনি বলেন,
“আমি শিখতে থাকি, কারণ জীবন খুব সংক্ষিপ্ত, আর শেখার ক্ষেত্র অসীম।”
ইতিহাস, জীবনী, সাহিত্য – সব ধরনের বইয়েই তিনি পড়তেন। ঘুমের আগে, ট্রেনে, এমনকি মন্ত্রিসভায়ও তাকে বই হাতে দেখা যেত।
গ) মাইকেল জর্ডান: খেলার মাঠে অদম্য জর্ডান বই পড়ার ক্ষেত্রেও ছিলেন একজন চ্যাম্পিয়ন। নানা বিষয়ের বই পড়ে তিনি নিজেকে মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে আরো শাণিত করতেন।
ঘ) মার্ক জুকারবার্গ: ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা জুকারবার্গ তিনি প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে একটি বই পড়েন। তিনি বলেন, এক বছরে ৫২টি বই পড়ার চ্যালেঞ্জ! নিন, এটা আপনার জ্ঞান বাড়াতে, নতুন চিন্তাভাবনা করতে এবং বিশ্বকে আরো ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করবে।
এই বিখ্যাত ব্যক্তির গল্প আমাদের শেখায়, বই পড়ার অভ্যাস জীবনকে আরো সুন্দর, সফল ও সমৃদ্ধ করে। তাই বই হাতে নিয়ে, ডুব দিন জ্ঞানের অসীম সমুদ্রে!
সত্যের সন্ধানে বই
জীবনের পথ চলায় আমরা অনেক দ্বিধা, দ্বন্দ্বে পড়ি। কোন পথ বেছে নেব, কোন সিদ্ধান্ত ঠিক, কোনটি ভুল – এই প্রশ্নগুলো আমাদের মনকে ঘিরে ফেলে। এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে বইয়ের হাত ধরে আমরা পেতে পারি জীবনের সঠিক পথের দিশা। তাই কথায় আছে ‘Reading makes a man perfect.
বইয়ের পাতায় রয়েছে অসংখ্য মানুষের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, শিক্ষা। এই জ্ঞানের আলো আমাদের জীবনের পথ আলোকিত করে। বিভিন্ন পরিস্থিতি, সমস্যা ও তাদের সমাধানের পথ সম্পর্কে জানতে পারি আমরা। বই আমাদের একাকী চিন্তা থেকে বের করে নিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দেখার সুযোগ দেয়। একই সমস্যাকে নানা চোখে দেখার এই অভিজ্ঞতা আমাদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
বইয়ের পাতায় আমরা শুধু গল্প পাই না, পাই জীবনের সঠিক পথের দিশা।
বইয়ে ইতিহাসের ঘটনা, মানুষের ভুল ও সাফল্যের কাহিনী লেখা থাকে। এই কাহিনী থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা নিজের জীবনের ভুল এড়াতে পারি, সঠিক পথে চলার প্রেরণা পাই।
বই আনন্দের বৈচিত্রময় উৎস
জীবনে খুশি থাকার অপার পথ আছে। কিন্তু, কখনো কি ভেবেছেন, বইয়ের পাতায়ও লুকিয়ে থাকে অসীম আনন্দ? জীবনের ক্লান্তি, দুশ্চিন্তা আর একঘেয়েমি থেকে মুক্তি খুঁজছেন? বহু দূরে যেতে হবে না, হাত বাড়িয়ে নিন আপনার পাশেই থাকা অপার আনন্দধারা কাছে – বইয়ের পাতায়। বই কেবল জ্ঞানের সাগর নয়, এটি আনন্দের অসীম উৎস, জীবনে সুখের রং ছড়ানোর এক জাদুর কাঠি।
কীভাবে বই আনন্দের সেরা উৎসঃ
- বইয়ের পাতায় আমরা ভিন্ন এক জগতে হারিয়ে যাই। যার সীমা রাজকীয় কল্পনার প্রাসাদে, মহাকাশের অসিমে, অথবা গভীর সমুদ্রের গহ্বরে – কল্পনার রথে চড়ে আমরা অভাবনীয় আনন্দ অনুভব করি।
- বইয়ে মানবিক গল্প, চরিত্রের আবেগ, সংবেদন লেখা থাকে। এসব পড়ার মাধ্যমে আমাদের অনুভূতি জাগে, আনন্দ, বেদনা, উত্তেজনা – নানা রকম অনুভূতির ঢেউয়ে আমরা ভাসতে থাকি।
- বইয়ের পাতায় অসংখ্য মানুষের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, শিক্ষা লেখা থাকে। এই জ্ঞান আত্মবিশ্বাস বাড়ায়, নতুন কিছু শেখার আনন্দ দেয়।
- হাস্যরসাত্মক বইয়ের পাতায় হাসির ঝলকানি। এই হাসি ক্লান্তি দূর করে, মনকে হালকা করে, জীবনে আনন্দের স্পন্দন জাগায়।
- বই পড়ার নীরবতা, একাকীত্বের মধ্যে এক অন্য রকম শান্তি পাওয়া যায়। এই শান্তি চিন্তাকে স্বচ্ছ করে, জীবনের চাপ কমিয়ে আনন্দ দেয়।
যেমন, জিবনান্দ কিংবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় প্রকৃতির বর্ণনা, মানবিকতার বার্তা, প্রেমের সুর – এসব পড়ার মাধ্যমে পাঠক মনোমুগ্ধ হয়ে আনন্দ অনুভব করেন। আবার সুকুমার রায়ের, মুজতাবা আলির, বা শিবরামের গল্পে হাসির ঝরনা, মজার চরিত্র, গল্পের মোড় – এগুলি পড়ে পাঠকের মুখে হাসি ফুটে ওঠে, আনন্দ ছড়িয়ে যায়।
বইয়ের পাতায় আনন্দ খুঁজতে দ্বিধা নেই। বইয়ের পাতায় হারিয়ে যাওয়া আনন্দ, এক নিরিব, শুদ্ধ, প্রকিত আনন্দ।
ইন্টারনেটের যুগে বই পড়ার যৌক্তিকতা
তথ্যপ্রযুক্তির ঊষালগ্ন এই সময়ে আমাদের হাতে রয়েছে অজস্র তথ্যের এক মহাসমুদ্র যার নাম – ইন্টারনেট। এখন ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটারের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলো মুহূর্তে খবর, জ্ঞান, বিনোদনের ঝড় বয়ে আনে। তাই অনেকেরই মনে প্রশ্ন জাগে, এই যুগে আর বই পড়ার দরকার কী? বই কি হয়ে গেল অপ্রাসঙ্গিক?
না, একেবারেই না!
A reader lives a thousand lives before he dies. The man who never reads lives only one.” – George R.R. Martin
প্রথমত, ইন্টারনেটের অঢেল তথ্যপ্রবাহের মধ্যেও বইয়ের গুরুত্ব অটুট রয়েছে। কারণ, ইন্টারনেটে তথ্য ঢালাওভাবে দেওয়া থাকে , সেগুলো সংক্ষিপ্ত, খণ্ডিত, এবং মিথ্যে হওয়াড় সম্ভাবনা থাকে। অন্যদিকে, বইয়ে কোন বিষয় বিশ্লেষণাত্মকভাবে উপস্থাপন করা হয়, যা গভীর জ্ঞান অর্জনে সাহায্য করে।
দ্বিতীয়ত, ইন্টারনেটের নোটিফিকেশন, লিংকের জঙ্গলে একটানা মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন। কিন্তু বই পড়ার সময় আমরা বহির্দুনিয়ার কোলাহল ভুলে গিয়ে প্রয়জনিয় বিষয়টিতে পুরোপুরি ডুব দিতে পারি।
তৃতীয়ত, বইয়ের বিস্তারিত বর্ণনা আমাদের কল্পনাশক্তিকে জাগিয়ে তোলে। আমরা চোখে দেখি, অনুভব করি গল্পের ঘটনা, চরিত্র। ইন্টারনেটের সংক্ষিপ্ত তথ্যে এই অনুভূতি পাওয়া যায় না।
চতুর্থত, ইন্টারনেটের অবিরাম অনেক বেশি তথ্যপ্রবাহ আমাদের মনকে অস্থির করে তুলতে পারে। বই পড়ার সময় আমরা এই কোলাহলের বাইরে চলে যাই, মানসিক শান্তি ও স্থিরতা লাভ করি।
অপরদিকে,
ইন্টারনেটেরও অনেক সুবিধা আছে। যেকোনো বিষয়ে তাৎক্ষণিক তথ্য পাওয়ার জন্য ইন্টারনেটের বিকল্প নেই, বইয়ের মত এতো অপেক্ষা করতে হয় না। আবার, ইন্টারনেটে বিশ্বের সবচেয়ে বিচিত্র বিষয়ে তথ্য এক যায়গায় পাওয়া যায়। বইয়ের তথ্যের ভাণ্ডার সীমিত, এক বই থেকে তাই সব বিষয়ে জানা সম্ভব নয়।
সর্বোপরি, ইন্টারনেট এবং বই – দুটোই আমাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইন্টারনেটের দ্রুত তথ্যপ্রাপ্তির সুবিধা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তবে, গভীর জ্ঞান আহরণ, কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে বিস্তারিত শিখালাভের জন্য বইয়ের বিকল্প কেবল বই।
পিডিএফ, হার্ডকভার নাকি অডিও বুক
বইয়ের গন্ধ, কাগজের শব্দ, পাতা ওল্টানোর আনন্দ – এসব এক অন্যরকম মায়াময় অভিজ্ঞতা। কিন্তু আজকের ডিজিটাল দুনিয়ায় বইয়ের রূপ বহুমাত্রিক হয়েছে। হার্ডকভার, পিডিএফ, অডিওবুক – একই গল্প, তিনটি ভিন্ন রূপে আমাদের সামনে। একজন পাঠক হিসেবে আমাদের জন্য কোনটি বেশি সুবিধাজনক বের করা এই সময়ে কঠিন হয়ে গেছে।
হার্ডকভার বই
হার্ডকভার বা স্বাভাবিক বই, আমাদের সব ইন্দ্রিয়কেই (দৃষ্টি, ঘ্রাণ, স্পর্শ ) জাগিয়ে তোলে। কাগজের মসৃণতা, শব্দের আকার, বই হাতে নিয়ে পড়ার আনন্দ – এই সব মিলে এক অনন্য অভিজ্ঞতার সঞ্চার করে।
এখানে, কোনো নোটিফিকেশন, লিংক নেই, শুধু পাঠক আর বই। এই একাগ্রতা গভীরভাবে গল্পের মধ্যে ডুব দিতে সাহায্য করে। হার্ডকভার বইয়ের সবকিছুই সাজানো – কাগজের মান, ফন্ট, বিন্যাস, চিত্র। এই সমগ্র জিনিস পাঠকের মনের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রাখে। বই পড়া বেশি সুখকর হয়।
পিডিএফ বই
ইন্টারনেটের যুগে বিনামূল্যে বা অল্প খরচে অসংখ্য পিডিএফ বই পাওয়া যায়। যেকোনো সময়ে, যেকোনো জায়গায় আপনি পড়ার আনন্দ উপভোগ করতে পারেন। একই ডিভাইসে বিভিন্ন বই একসাথে রাখা, নোট লেখা, হাইলাইট করা – পিডিএফ বইয়ের সেরা সুবিধা।
অডিও বুক বা শ্রুতি বই
কাজে যাতায়াত, রান্নাবানা, অন্য কাজ করার সময়ও আমারা অডিওবুক শুনতে পারি। এভাবে অতিরিক্ত সময় কাজে লাগিয়ে জ্ঞান অর্জন ও বিনোদন দুই-ই সম্ভব হয়। কারও, চোখের সমস্যা বা দুর্বলতা থাকলে অডিওবুক একটি চমৎকার সমাধান। বই পড়ার আনন্দ না হারিয়েও জ্ঞান অর্জন করা যায়।
আসলে, কোনটি বেছে নেব, তা পাঠকের চাহিদা ও অভ্যাসের উপর নির্ভর করে। হার্ডকভার বইয়ের গভীর মনোযোগ, পিডিএফের সুবিধা ও অডিওবুকের সময় সাশ্রয় – প্রতিটিরই নিজের সুন্দর দিক আছে। তাই, শুধু একটিকে বেছে না নিয়ে, প্রয়োজন অনুযায় সবগুলোই ব্যবহার করা যেতে পারে। যেভাবেই হোক, বইয়ের জগতে ডুব দিন, আনন্দ নিন, জ্ঞান অর্জন করুন।
বই ও পাঠকের সম্পর্ক
বই আমাদের জীবনে অপরিসীম মূল্যবান। এটি কেবল কাগজের পাতায় লেখা শব্দ নয়, এটি জ্ঞানের ভাণ্ডার, বন্ধুত্বের উষ্ণ হাত, এবং গুরুর নির্দেশ।
Reading is to the mind what exercise is to the body.” – Joseph Addison
বই শিক্ষকের মতো:
বই শিক্ষকের আমাদের সামনে জ্ঞানের অসীম সমুদ্র খুলে দেয়। বিজ্ঞানের গভীরতা, ইতিহাসের গল্প, সাহিত্যের সৌন্দর্য, দর্শনের চিন্তা – সবই আমরা বইয়ের মাধ্যমে আয়ত্ত করতে পারি। বই আমাদের সীমাবদ্ধ জগতকে ছাড়িয়ে নতুন দিগন্ত দেখায়। বিভিন্ন সংস্কৃতি, জীবনধারা, এবং চিন্তাধারার সংস্পর্শে আসি আমরা।
বই একজন গুরুর মতো আমাদের জীবনের পাঠ শেখায়। সফলতা, ব্যর্থতা, আনন্দ, দুঃখ – সবকিছুই বইয়ের পাতায় লেখা থাকে। আমরা শিখি, বুঝি, এবং নিজের জীবনে প্রয়োগ করি।
বই বন্ধুর মতো:
বই আমাদের সারাক্ষণের সাথী। একাকীত্বের অন্ধকারে বই হয়ে ওঠে আলোর প্রদীপ। চিন্তার ভারে আমরা যখন ক্লান্ত, বই হয়ে ওঠে মনের বোঝা কমানোর উপায়। গল্প, কবিতা, রসিকতায় – আমাদের মনকে হালকা করে দেয় বই।
বই আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, পরম আত্মীয় সেরা বন্ধু ও প্রিয় শিক্ষক।
বইয়ের সাথে কথা বলা
বইয়ের সাথে কথা বলা? অবিশ্বাস্য, হলেও সত্যি। শব্দে, গল্পে, চিন্তায় তৈরি এই সাগরে ডুব দিয়ে, লেখকের সাথে আমাদের মাঝে আলাপ চলতেই থাকে। তাই ত, দেকার্ত বলেছেন,
“ভালো বই পড়া মানে গত শতাব্দীর
মহৎ লোকের সাথে আলাপ করা”- দেকার্ত
লেখকের শব্দে আমাদের চিন্তা সাড়া দেয়। গল্পের নাটকীয় মোড়ে, কবিতার ছন্দে, দর্শনের গভীরতায় – আমাদের চিন্তা আর লেখকের চিন্তা মিলে যায়। কথা হয় বইয়ের সাথে। বইয়ের প্রতি পাতায় প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই আমরা। জীবনের জটিলতা, সমাজের বাস্তবতা, নিজের মনের গভীরতা – বই আমাদের সামনেই তুলে ধরে , তার নিজের ভাষায়। একাকীত্বের অন্ধকারে আলোর মতো, বই হয়ে ওঠে নিঃশব্দ বন্ধু, কথা হয় অন্তরে অন্তরে।
বইয়ের সাথে কথা বলা মনে হয় অসম্ভব নয়। বইয়ের প্রতি পাতায় শুধু শব্দ লেখা নেই, লেখা আছে আলাপন, এবং বন্ধুত্ব।
বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে করনীয়
বই পড়া শুধু শখ নয়, জ্ঞানের সাগরে সাঁতার কাটা। কিন্তু, অনেকের কাছেই নিয়মিত বই পাঠ করা একটু কঠিনও মনে হতে পারে। নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে আমাদের করনীয়:
১. প্রথমে নিজের পছন্দ অনুযায়ী বই বেছে নিতে হবে।
২. শুরুতেই দিনে ১-২ ঘণ্টা বই পড়ার চেষ্টা করা যাবে না। ১৫-২০ মিনিটের ছোট্ট লক্ষ্য তৈরি করে, ধীরে ধীরে বারাতে হবে।
৩. পড়ার জন্য শান্ত জায়গা বেছে নিতে হবে। সেখেত্রে লাইব্রেরি, পার্ক, বা নিজের ঘরও হতে পারে এই আদর্শ জায়গা।
৪.অডিওবুক ও ই-বুক পড়ে ভালো অভ্যাস গড়ে তোলা সম্ভব।
৫. আপনি যে বই পড়ছেন, তার রিভিউ ফেসবুক, টুইটার বা বইয়ের বিভিন্ন গ্রুপে লিখুন। এতে অন্যদের উৎসাহিত করা হবে এবং নিজের পড়া আনন্দ বাড়বে।
৬. অনলাইন বা অফলাইন, আপনার পছন্দের ধরনের বই পড়ার ক্লাবে যোগ দিন।
৭.কিছু মোবাইল অ্যাপসের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে:
- Goodreads: বইয়ের রেটিং, রিভিউ দেখা, রিডিং লিস্ট তৈরি করা যায়।
- LibriVox: বিনামূল্যে অডিওবুক শোনা যায়।
- Forest: বই পড়ার সময় ফোন ব্যবহার না করার জন্য টাইমার দেওয়া যায়।
৮. বই পড়ার সময় কোন সামাজিক মিডিয়া ব্যাবহার করা যাবে না।
এগুলি বেশ কিছুদিন চর্চা করলে সহজে দ্রুত খুব ভালো নিয়মিত বই পাঠক হওয়া সম্ভব।
বই নির্বাচনে সতর্কতা
বই পড়া জ্ঞানার্জনের সেরা উপায়, কিন্তু সঠিক বই বেছে না নিলে তা বিপথগামী করতে পারে। তাই বই পড়ার আগে কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকলে আমরা নিজেদের ভুল পথে চলা ঠেকাতে পারি। থ্রিলার, রোমান্স, ইতিহাস, দর্শন – কী ধরনের বই পড়তে আপনার আনন্দ হয়? সেই ধরনের বই বেছে নিন। বইটি কেমন, লেখা কেমন, অন্য পাঠকদের অভিজ্ঞতা কেমন – এসব জানতে অনলাইন রিভিউ ও রেটিং দেখুন। এতে বুঝতে পারবেন বইটি আপনার উপযুক্ত কিনা। বইয়ের বিষয়বস্তু, গল্পের মূল কাহিনী বুঝতে সারসংক্ষেপ পড়া খুবই কার্যকরী উপায়। বই বেছে নেয়ার আগে এই বিষয়গুলি মাথায় নিলে আমরা নিজেদের বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারব। বই পড়া হবে আরও অনন্দময়।
উপসংহার
বই এক অমূল্য সম্পদ, যা আমাদের জীবনকে অর্থবহ ও সার্থক করে তোলে। প্রতিটি বই আমাদের জন্য এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয়, আমাদের ব্যক্তিত্বকে গড়ে তোলে, এবং মানবিক মূল্যবোধ শিক্ষা দেয়। বইয়ের পড়ার আনন্দ অন্য সব আনন্দের থেকে আলাদা, তাই ত ওমর খৈয়াম বলেছেন, .
“রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে
প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে
বই, সেতো অনন্ত যৌবনা”
সুতরাং, আমরা যদি আমাদের জীবনে নির্মল আনন্দ লাভ করতে চাই তাহলে অবশ্যই বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। তাই, বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন, নিজের জীবনকে আরো সুন্দর ও সমৃদ্ধ করুন।