আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, অনেক সংগ্রাম ও অনেক রক্তের বিনিময়ে এসেছে। প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা, আজকে আমারা হাজির হয়েছি “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ” প্রবন্ধ রচনা নিয়ে। আজকের এই লেখায় রচনার ২০ টি গুরুপ্তপূর্ণ পয়েন্ট আলোচনা করা হয়েছে যা SSC, HSC, BCS সহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ
ভূমিকা
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরব উজ্জ্বল অধ্যায়। ১৯৭১ সালে ত্রিশ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। দীর্ঘ নয়মাস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে সংগ্রাম করে পূর্ব বাংলার মানুষ অর্জন করে স্বাধীন এবং সার্বভৌম একটি দেশ। স্বাধীনতা একটি জাতির কাছে আজন্ম লালিত স্বপ্ন। একটি জাতির কাছে সবচেয়ে গৌরবের ব্যাপার হলো স্বাধীন একটি দেশে বাস করা। পরাধীনতায় থাকে শুধু গ্লানি। তাই পরাধীন হয়ে কেউ কখনো বাঁচতে চায় না। বাঙালি জাতি বছরের পর বছর পরাধীন হয়ে বাস করে একসময় সংগ্রামী হয়ে ওঠে। তাই তারা শৃংখল ভেঙ্গে বেড়িয়ে পরেছিল আন্দোলনে, সোচ্চার হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম। লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে এবং বাঙালি নারীদের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল বাঙালীর স্বাধীনতা।
“এই স্বাধীন দেশে মানুষ যখন পেট ভরে খেতে পারবে,
পাবে মর্যাদাপূর্ণ জীবন
তখনই শুধু এই লাখো শহীদের
আত্না তৃপ্তি পাবে।”
-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি:
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি ছিল বিশ এবং অনেক জটিল। এর মূল কারণ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বঞ্চনা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ রাজনৈতিকভাবে বঞ্চিত ছিল। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী, একটি রাষ্ট্রে যত বড় বড় পদ থাকে তার সবই ছিল পশ্চিম পাকিস্থানীদের দখলে। বেশিরভাগই সুবিধা পেত পশ্চিম পাকিস্তানের লোকেরা, তারা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থকে উপেক্ষা করত। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে পাকিস্থানের জাতীয় পরিষদে ভোট দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হতনা। ছিলনা শিক্ষা, চিকিৎসার মত মৌলিক অধিকার। যার ফলে দিন দিন কঠিন হয়ে পরেছিল পূর্ব পাকিস্থানীদের জীবন। সামাজিক ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্থানের জনগণ বঞ্চিত ছিল। পূর্ব পাকিস্থানের উচ্চশিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং অন্যান্য সামাজিক সুযোগ-সুবিধা পশ্চিম পাকিস্থানের তুলনায় অনেক কম ছিল। পূর্ব পাকিস্থানের জনগণকে প্রায়শই পশ্চিম পাকিস্থানের মানুষদের দ্বারা অবহেলা এবং বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছিল।
সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও পূর্ব পাকিস্থানের জনগণ বঞ্চিত ছিল। পাকিস্থানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্থানের সংস্কৃতিকে পশ্চিম পাকিস্থানের সংস্কৃতির সাথে একীভূত করার চেষ্টা করেছিল। পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা, সঙ্গীত এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে অবহেলার চোখে দেখত পশ্চিম পাকিস্থানীরা। পূর্ব পাকিস্থানীরা নিজেদের সংস্কৃতিকে নিজের মত করে পালন করার সুযোগ সুবিধা পেতনা। এভাবে দীর্ঘ দিন অতবাহিত হওয়ার পর দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, নির্যাতন এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্থানের জনগণ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রতিটি বাঙালি একত্রিত হয়ে বলেছিল-
“আমরা স্বাধীনতার জন্য জীবন দেব, কিন্তু স্বাধীনতা ছাড়ব না।”
বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও বিকাশ:
বাঙালি জাতির রাজনৈতিক সচেতনতা ও জাতীয়তাবাদের উন্মেষ পূর্ব থেকে থাকলেও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় তা আরো বেশি জোরালো হয়। যখন পাকিস্তানের গর্ভনর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দু কে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন তখন বাঙালিরা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য আন্দোলন শুরু করে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেয়। ভাষা আন্দোলনের জন্য ঐদিন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার সহ অনেকেই শহীদ হন। বাঙ্গালীদের ভাষা ও সংস্কৃতিতে আঘাত করা মানে বাঙ্গালীদের অস্তিত্ব আঘাত করা। বাঙালিরা যখন তাদের সংকট বুঝতে পারে,তখন তারা মোকাবেলার জন্য এক জোট হয়। ১৯৫৪ এর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের জয় লাভ, ১৯৬২ তে গণবিরোধী শিক্ষা কমিশন রিপোর্টার বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬৬ তে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গন অভ্যুত্থান, এবং ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামীলীগের জয়লাভ, এই আন্দোলন গুলোর প্রত্যেকটি আন্দোলন বাঙালি জাতিকে দিয়েছে অসীম শক্তি এবং সাহস, যুগিয়েছে প্রেরণা। সেই প্রেরনা থেকেই ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার ফলে স্বাধীনতা অর্জন করে।
স্বাধীনতার ডাক:
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। কিন্তু তারপরেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর করতে রাজি হয়নি। তখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ষড়যন্ত্র শুরু করে। যার কারনে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেকসোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) প্রায় ১০ লক্ষ মানুষের সামনে স্বাধীনতার ডাক দেয়। লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে বজ্র কন্ঠে ধ্বনিত হয় –
“আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়,
বাংলার মানুষ স্বাধীনতা চায়,
বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।”
এরপরে গড়ে উঠে তীব্র অসহযোগ আন্দোলন। সকল বাঙালি তরুণ একসাথে হয়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করে। ছাব্বিশে মার্চ প্রথম প্রহরে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে স্বাধীনতার লিখিত ঘোষণা পত্র দিয়ে যান।
অপারেশন সার্চলাইট:
অপারেশন সার্চলাইট হলো ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত পরিকল্পিত গণহত্যা। এই গণহত্যা ছিল ১৯৭১ এর মার্চ ও এর পূর্ববর্তী সময়ে সংঘটিত বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করতে পাকিস্থান কর্তৃক পরিকল্পিত একটি সামরিক অভিযানের অংশ। অপারেশন সার্চলাইটের লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক ও সামরিক বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। এই লক্ষ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের সব বড় বড় শহর দখল করে নেয় এবং বাঙালিদের উপর নির্বিচারে হত্যা, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ চালায়।
অপারেশন সার্চলাইটের ফলে লক্ষ লক্ষ বাঙালি নিহত হয়। গণহত্যায় নিহতদের মধ্যে বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতা, ছাত্র-শিক্ষক, সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী, আমলা, কৃষক, শ্রমিকসহ সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষ ছিল।
অপারেশন সার্চলাইট বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেছিল। এই গণহত্যা বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে আরও বেগবান করে এবং বাঙালিদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। এই গণহত্যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়।
মুজিবনগর সরকার গঠন:
মুজিবনগর সরকার ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে গঠিত বাংলাদেশের প্রথম সরকার। এই সরকারের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকার কারণে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ২৭ মার্চ তিনি নিউইয়র্কের জাতিসংঘের অধিবেশনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি জানালে বিশ্ববাসী হতবাক হয়।
২৮ মার্চ নিউইয়র্কের জাতিসংঘের অধিবেশনে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিরা একটি সভায় মিলিত হন এবং বাংলাদেশে একটি অস্থায়ী সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। এই সভায় ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলায় (বর্তমানে মুজিবনগর) আম্রকাননে মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, আইনমন্ত্রী আবদুর রউফ, প্রতিরক্ষামন্ত্রী মেজর জেনারেল এম.এ.জি. ওসমানী সহ অনেকেই শপথ গ্রহন করেন। মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সরকারের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় সরকারের কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ও জনযুদ্ধ:
সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ও জনযুদ্ধ হল ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দুটি প্রধান অংশ। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পরিচালিত সামরিক সংগ্রাম, অন্যদিকে জনযুদ্ধ ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে পরিচালিত গণসংগ্রাম।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালালে বাঙালিরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই প্রতিরোধের অংশ হিসেবে বাঙালি ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিক ও অন্যান্য শ্রেণি-পেশার মানুষ সশস্ত্র মুক্তিবাহিনী গঠন করে। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করে। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত করে।
সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে জনযুদ্ধও পরিচালিত হয়। জনযুদ্ধে বাঙালিরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ, প্রতিরোধ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্মঘট, হরতাল, মিছিল, সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণ, ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করে। এই জনযুদ্ধ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে দেয় এবং মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ও জনযুদ্ধ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দুটি অঙ্গ। এই দুটি অংশ একে অপরের পরিপূরক ছিল। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, অন্যদিকে জনযুদ্ধ পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বিচ্ছিন্ন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা:
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, জনযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীরা সরাসরি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। তারা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয় এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। নারী মুক্তিযোদ্ধারা লড়াইয়ে অংশগ্রহণের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা ও চিকিৎসা, অস্ত্র ও গোলাবারুদ পরিবহন, তথ্য সংগ্রহ, প্রচারণা, ইত্যাদি কাজেও অংশগ্রহণ করে।
মুক্তিযুদ্ধে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন:
- বীরাঙ্গনা মিনারা চৌধুরী
- বীরাঙ্গনা বেনজির আহমেদ
- বীরাঙ্গনা কানিজ ফাতেমা
- বীরাঙ্গনা নার্গিস আহমেদ
- বীরাঙ্গনা বীণা দাস
মুক্তিযুদ্ধে নারীরা মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের দেখাশোনা করে, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা ও চিকিৎসা করে, এবং শরণার্থীদের সেবা করে। নারীরা মুক্তিযুদ্ধের প্রচারণায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালিদের অবদান:
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রবাসী বাঙালিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন গড়ে তোলে, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করে, এবং শরণার্থীদের সাহায্য করে।
প্রবাসী বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা বিভিন্ন দেশের সরকার, রাজনৈতিক দল, এবং জনমতকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়।
প্রবাসী বাঙালিরা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন গড়ে তুলতে। তারা মিছিল, সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণ করে, বিক্ষোভ প্রদর্শন করে, এবং পত্র-পত্রিকায় প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলে। প্রবাসী বাঙালিদের আন্দোলনের ফলে বিভিন্ন দেশের সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, এবং চীনসহ বিভিন্ন দেশ মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে।
প্রবাসী বাঙালিরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা বিভিন্ন দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করে। এছাড়াও, তারা বিভিন্ন দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করে। প্রবাসী বাঙালিদের সহায়তায় মুক্তিবাহিনী প্রশিক্ষিত ও সজ্জিত হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সক্ষম হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্যাতনের ফলে লাখ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়। প্রবাসী বাঙালিরা এসব শরণার্থীদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। তারা বিভিন্ন দেশে শরণার্থী শিবির স্থাপন করে শরণার্থীদের খাদ্য, বস্ত্র, ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করে।
মুক্তিযুদ্ধে শিল্পী সাহিত্যিক – বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা:
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শিল্পী, সাহিত্যিক, এবং বুদ্ধিজীবীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাগ্রত করতে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে, এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও উদ্দীপনা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
শিল্পী, সাহিত্যিক, এবং বুদ্ধিজীবীরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাগ্রত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা বিভিন্ন মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ছড়িয়ে দেয়।
শিল্পীরা মুক্তিযুদ্ধের ছবি, ভাস্কর্য, এবং গান তৈরি করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাগ্রত করে। সাহিত্যিকরা মুক্তিযুদ্ধের উপর কবিতা, গল্প, উপন্যাস, এবং নাটক রচনা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাগ্রত করে। বুদ্ধিজীবীরা বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি, এবং রেডিও-টিভিতে বক্তৃতা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাগ্রত করে।
শিল্পী, সাহিত্যিক, এবং বুদ্ধিজীবীরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলে।
শিল্পীরা মুক্তিযুদ্ধের উপর চিত্র প্রদর্শনী, ভাস্কর্য প্রদর্শনী, এবং সঙ্গীত অনুষ্ঠানের আয়োজন করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলে। সাহিত্যিকরা মুক্তিযুদ্ধের উপর বই, ম্যাগাজিন, এবং পত্রিকার প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলে। বুদ্ধিজীবীরা বিভিন্ন দেশে মিছিল, সভা-সমাবেশ, এবং পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলে।
মুক্তিযুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব:
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিলো একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, যা শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, আন্তর্জাতিক বিশ্বেও গভীর প্রভাব ফেলেছিলো। যুদ্ধের শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতার আহ্বান জানানো হচ্ছিলো।
যুদ্ধের প্রথম দিকে, বেশিরভাগ দেশই পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। কারণ, পাকিস্তান তখন একটি ইসলামী দেশ হিসেবে পরিচিত ছিলো এবং পশ্চিমা বিশ্বের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো। কিন্তু যুদ্ধের ক্রমবর্ধমান ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা আন্তর্জাতিক বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ফলে, ধীরে ধীরে অনেক দেশই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানাতে শুরু করে।
ভারত ছিলো মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সরাসরি হস্তক্ষেপের ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরাজয় নিশ্চিত হয়। এছাড়াও, ভারতীয় সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করে।
সোভিয়েত ইউনিয়নও বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সমর্থক ছিলো। সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেওয়ার প্রথম দেশ। এছাড়াও, সোভিয়েত ইউনিয়ন জাতিসংঘে বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দেয়। যুক্তরাষ্ট্রও শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেয়। যুদ্ধের শেষের দিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে তার সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। এছাড়াও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ভোট দেয়।
মুক্তিযুদ্ধ আন্তর্জাতিক বিশ্বের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এ যুদ্ধের ফলে বিশ্বের মানচিত্রের একটি নতুন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ। এ যুদ্ধ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি আরও বেশি সচেতন করে তোলে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা:
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে বাঙালি জাতির স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য ত্যাগ, সংগ্রাম, অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবতাবোধকে বোঝায়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতি পাকিস্তানি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে। এই সংগ্রামে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের ফসল হিসেবে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কিছু মুল বিষয় রয়েছে। যেমন-
- মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি তাদের দীর্ঘদিনের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি লাভ করে। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল বিষয় হলো স্বাধীনতা।
- মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি গণতন্ত্রের পক্ষে তাদের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটায়। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম বিষয় হলো গণতন্ত্র।
- মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাদের ঐক্য ও সংহতির বার্তা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরে। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অসাম্প্রদায়িকতা।
- মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি মানবতাবোধের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম দিক হলো মানবতাবোধ।
ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ:
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত জনসভায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত ভাষণটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক ভাষণ। এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন। এই ভাষণের মাধ্যমে তিনি বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ ও সংগ্রামী করে তোলেন।
ভাষণের শুরুতে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরেন। তিনি বলেন,
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে এক অগ্নিঝরা প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। এই ভাষণের পর বাঙালি জাতি পাকিস্তানি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আরও ঐক্যবদ্ধ ও সংগ্রামী হয়ে ওঠে। এই ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের পথপ্রদর্শক হিসেবে আবির্ভূত হন।
স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক যাত্রা:
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। ভাষণের পর পাকিস্তানি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে এবং গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর গণহত্যা শুরু করে। এই গণহত্যা বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরও প্রবল করে তোলে।
১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। এই সরকারের অধীনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালিত হয়। ১৯৭১ সালের ২৭শে এপ্রিল ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সাফল্য অর্জন করে।
স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক যাত্রা নিম্নরূপ:
- ৭ই মার্চ, ১৯৭১: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ।
- ২৫শে মার্চ, ১৯৭১: পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর গণহত্যা।
- ১০ই এপ্রিল, ১৯৭১: মুজিবনগর সরকার গঠন।
- ২৭শে এপ্রিল, ১৯৭১: ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি হস্তক্ষেপ।
- ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১: পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আত্মসমর্পণ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যমের ভূমিকা:
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যমের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গণমাধ্যমের মাধ্যমে পাকিস্তানি সামরিক শাসনের নির্যাতন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির প্রতিবাদের কথা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা হয়েছিল। এছাড়াও, গণমাধ্যমের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ঘটনা ও পরিস্থিতি বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা হয়েছিল।
গণমাধ্যমের মাধ্যমে পাকিস্তানি সামরিক শাসনের নির্যাতন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির প্রতিবাদের কথা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণটি গণমাধ্যমের মাধ্যমে সারা বিশ্বে প্রচারিত হয়। এই ভাষণের মাধ্যমে পাকিস্তানি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির প্রতিবাদের তীব্রতা বিশ্ববাসী উপলব্ধি করতে পারে। গণমাধ্যমের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ঘটনা ও পরিস্থিতি বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা হয়েছিল। গণমাধ্যমের মাধ্যমে বাঙালি জাতির মধ্যে ঐক্য ও সংহতি বৃদ্ধি পায়। মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা ও তাৎপর্য সম্পর্কে গণমাধ্যমের মাধ্যমে বাঙালি জাতি সচেতন হয়।
পেশাজীবীদের ভূমিকা:
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পেশাজীবীদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পেশাজীবীরা মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছেন।
ক. সাংবাদিক: সাংবাদিকরা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ঘটনা ও পরিস্থিতি বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারা পাকিস্তানি সামরিক শাসনের নির্যাতন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির প্রতিবাদের কথা বিশ্ববাসীর কাছে জানান।
খ. শিক্ষক: শিক্ষকরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাগ্রত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারা ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করেন।
গ. চিকিৎসক: চিকিৎসকরা মুক্তিযুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারা অনেক ক্ষেত্রে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করেন।
ঘ. আইনজীবী: আইনজীবীরা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারা পাকিস্তানি সামরিক শাসনের নির্যাতন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করেন।
ঙ. ব্যবসায়ী: ব্যবসায়ীরা মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন।
মুক্তিযুদ্ধে পেশাজীবীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। পেশাজীবীদের অবদানের ফলে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছিল।
জাতিসংঘের ভুমিকা:
জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, যেমন ইউনিসেফ, রেড ক্রিসেন্ট, ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম ইত্যাদি বাংলাদেশের যুদ্ধবিধ্বস্ত জনগণকে মানবিক সহায়তা প্রদান করে। এই সহায়তায় যুদ্ধবিধ্বস্ত জনগণকে খাদ্য, বস্ত্র, ওষুধপত্র, ও আশ্রয় প্রদান করা হয়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদ পাকিস্তান ও বাংলাদেশের প্রতি যুদ্ধবিরতির জন্য আহ্বান জানায়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে পাকিস্তানের অর্থনীতিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করলে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৭২ সালের ২৭ মার্চ বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান:
বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেয়। এই শরণার্থীদের খাদ্য, বস্ত্র, ওষুধপত্র, ও আশ্রয় প্রদানে ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই যুদ্ধে ভারত মিত্রবাহিনীর নেতৃত্ব দেয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহায্যে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ভারতের স্বীকৃতির ফলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। ভারতের অবদান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের জন্য অপরিহার্য ছিল।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ:
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করে। এই আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় সংঘটিত হয় এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।
ভারতের হস্তক্ষেপে পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হয়। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থাও পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আহ্বান জানায়। আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের সংগ্রাম সমাপ্ত হয়। এই আত্মসমর্পণের ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়।
মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক তাৎপর্য:
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি তাদের দীর্ঘদিনের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি লাভ করে। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি নিজেদের সার্বিক ক্ষমতা ও সম্ভাবনার পরিচয় দিয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির মধ্যে এক অভূতপূর্ব ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টি করেছিল। এই যুদ্ধে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল।
“আমি বাংলায় কথা কই, আমি বাংলার কথা কই
আমি বাংলায় ভাসি, বাংলায় হাসি, বাংলায় জেগে রই।”
মুক্তিযুদ্ধের খেতাব:
বাংলার দামাল ছেলেরা যারা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পরেছিল তাদের বিভিন্ন খেতাবে ভুষিত করা হয়েছিল।
“আমি এক বাংলার মুক্তি সেনা
মৃত্যুর পথ চলিতে
কভু করি না ভয় করি না।”
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসিকতা ও বীরত্ব প্রদর্শনকারী মুক্তিযোদ্ধাদেরকে বিভিন্ন খেতাবে ভূষিত করা হয়। এই খেতাবগুলি হল:
১. বীরশ্রেষ্ঠ: মুক্তিযুদ্ধে সর্বোচ্চ খেতাব হলো বীরশ্রেষ্ঠ। এই খেতাব তারা পেয়েছিল যারা
যুদ্ধক্ষেত্রে অসীম সাহসিকতা ও বীরত্ব প্রদর্শন করেছে।
২. বীর উত্তম: বীরশ্রেষ্ঠের পরে মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেতাব হলো বীর উত্তম। এই খেতাব তারাই পেয়েছিল যারা যুদ্ধক্ষেত্রে বিশেষ সাহসিকতা ও বীরত্ব প্রদর্শন করেছিল। যার ত্যাগের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল।
৩. বীর বিক্রম: বীর উত্তমের পরে মুক্তিযুদ্ধের তৃতীয় সর্বোচ্চ খেতাব হলো বীর বিক্রম।
৪. বীর প্রতীক: বীর বিক্রমের পরে মুক্তিযুদ্ধের চতুর্থ সর্বোচ্চ খেতাব হলো বীর প্রতীক।
মুক্তিযুদ্ধে সর্বমোট ৩১৯ জন মুক্তিযোদ্ধাকে খেতাবে ভূষিত করা হয়। এর মধ্যে ৩ জনকে বীরশ্রেষ্ঠ, ১৭ জনকে বীর উত্তম, ৬৮ জনকে বীর বিক্রম, এবং ১৫৩ জনকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়।
উপসংহার:
“এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার সাধিনতা আনলে যারা আমরা তুমাদের ভুলবো না।”
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, যা বিশ্বের ইতিহাসে এক অনন্য স্থান দখল করে আছে। এই যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি তাদের দীর্ঘদিনের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির অহংকার। যাদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছি তাদের ত্যাগ কখনো ভোলা যাবেনা।