ভাষা আন্দোলন প্রবন্ধ রচনা | ২০ টি গুরুপ্তপূর্ণ পয়েন্ট

ভাষা আন্দোলন

বাংলা ভাষা ও বাংলা দেশ দুটোই আমরা সংগ্রাম করে অর্জন করেছি।  প্রিয় শিক্ষার্থীরা আজকে আমরা এসেছি “ভাষা আন্দোলন” প্রবন্ধ রচনা নিয়ে।  এই রচনাটিতে গুরুপ্তপূর্ণ ২০ টি পয়েন্ট ও অনেকগুলি প্রাসঙ্গিক কবিতা/উক্তি নিয়ে সাজানো হয়েছে। এই রচনাটি SSC/HSC শিক্ষার্থী সহ যারা বিসিএস ও অন্নান্য চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাদের জন্য অত্যান্ত সহায়ক হবে।  

ভাষা আন্দোলন

ভূমিকা

বাংলা ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ আন্দোলনের ফলে বাঙালি জাতি তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়। এছাড়াও, এ আন্দোলন বাঙালি জাতির মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।  আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ কথায়ঃ 

মাগো,,,ওরা বলে,

সবার কথা কেড়ে নেবে,,,

তোমার কোলে শুয়ে

গল্প শুনতে দেবে না।

বলো, মা, তাই কি হয়?

মৌলিক অধিকার রক্ষাকল্পে বাংলা ভাষাকে ঘিরে সৃষ্ট এ আন্দোলনের মাধ্যমে তদানীন্তন পাকিস্তান অধিরাজ্যের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণদাবির বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন কি?

“রফিক, সালাম, বরকত, আরো হাজার বীর সন্তান,

করলো ভাষার মান রক্ষা বিলিয়ে আপন প্রান ,

যাদের রক্তে রাঙ্গানো একুশ ওরা যে অম্লান,

ধন্য আমার মাতৃভাষা ধন্য তাদের প্রান।”

বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি যে আন্দোলন হয়, তাকে ভাষা আন্দোলন বলে। ১৯৪৭ সালে যখন দ্বি জাতি তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর থেকে পচ্শিম পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার কেড়ে নিতে চায়। বাঙ্গালীদের সব ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করা হয়। যখন পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষাকে বাদ দিয়ে উর্দু কে রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন বাঙালিরা রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে থাকে। বিভিন্ন শ্রেনি পেশার মানুষ আন্দোলনে যোগদান করেন। শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক,  জব্বার সহ অনেকেই। অবশেষে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। 

ভাষা আন্দোলনের সূচনা

বাংলা ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের পর। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ছিল বাঙালি, যারা বাংলা ভাষাতে কথা বলত। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে ঘোষণা করা হয়। এ সিদ্ধান্ত বাঙালিদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষের সৃষ্টি করে।

বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রথম বিক্ষোভ মিছিল করে। এ মিছিলে পুলিশের গুলিতে আবুল বরকত শহীদ হন। এ ঘটনার পর থেকে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন আরও জোরদার হয়।

ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক পটভূমি

ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ছিল বাঙালি, যারা বাংলা ভাষায় কথা বলত। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে ঘোষণা করা হয়। এ সিদ্ধান্ত বাঙালিদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষের সৃষ্টি করে। তারপর শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন।

বাংলা ভাষা নিয়ে প্রাথমিক বৈষম্য

বৈষম্যের ফলে বাঙালিদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটে। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালিরা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

বাংলা ভাষার প্রাথমিক বৈষম্য নিম্নরূপ:

রাষ্ট্রভাষা: পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলত। এ সিদ্ধান্ত বাঙালিদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষের সৃষ্টি করে।

সরকারি চাকরি: সরকারি চাকরিতে বাঙালিদের প্রতি বৈষম্য ছিল। বেশিরভাগ সরকারি চাকরি পাঞ্জাবি ও অন্যান্য অবাঙালিদের মধ্যে বিলিবদ্ধ ছিল।

শিক্ষা: সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উর্দুকে প্রধান ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এতে বাংলা ভাষায় শিক্ষা লাভের সুযোগ বাঙালিদের জন্য সীমিত ছিল।

সংস্কৃতি: সরকারি সংস্কৃতি চর্চায় বাংলা ভাষার ব্যবহার সীমিত ছিল। উর্দু ভাষাকেই প্রাধান্য দেওয়া হতো।

উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর, রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে বিরোধ শুরু হয়। পাকিস্তানের জনসংখ্যার প্রায় ৫৬% ছিল বাঙালি, যারা বাংলা ভাষায় কথা বলত। বাঙালিরা দাবি করে যে, বাংলা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। অন্যদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমানরা দাবি করে যে, উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ, পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর-জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে কার্জন হলে একটি ভাষণ দেন। তিনি এই ভাষণে ঘোষণা করেন যে, উর্দু এবং শুধু উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে। জিন্নাহর এই ঘোষণা বাঙালিদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে। তারা বাংলা ভাষার অধিকারের জন্য আন্দোলন শুরু করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, এই আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে, ঢাকায় ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। এই ঘটনায় অনেক ছাত্র নিহত হয়।

নানান দেশে  নানান ভাষা 

বিনে স্বদেশীয় ভাষা পুরে  কি আশা 

কত নদী সরোবর কিবা ফল 

চাতকীর,,,,

ধরা জল বিনে কভু ঘুচে কি তৃষা?” 

  • __রামনিধি গুপ্ত

বাংলা বর্নমালা মুছে ফেলার প্রয়াস

জিন্নাহর উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার পর পাকিস্তানি সরকার বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। এই পদক্ষেপগুলির মধ্যে রয়েছে:

  • বাংলা ভাষার ব্যবহার সরকারি কাজে নিষিদ্ধ করা।
  • বাংলা ভাষায় প্রকাশিত বই, পত্রিকা এবং অন্যান্য প্রকাশনা নিষিদ্ধ করা।
  • বাংলা ভাষায় শিক্ষাদান বন্ধ করা।

এই পদক্ষেপগুলির ফলে বাংলা ভাষার ব্যবহার ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। অনেক বাঙালি পরিবার তাদের সন্তানদের উর্দু ভাষায় শিক্ষা দিতে শুরু করে। বাংলা বর্নমালা মুছে ফেলার প্রয়াস ছিল পাকিস্তানি সরকারের একটি ভাষাগত বৈষম্যমূলক নীতি। এই নীতির ফলে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছিল।

বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক সরকারের পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাব আনা হয়, যাতে বলা হয় যে, উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এই প্রস্তাবের প্রতিবাদে পূর্ব বাংলার ছাত্ররা বিক্ষোভ শুরু করে। তারা দাবি করে যে, বাংলা ভাষাকেও পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া উচিত। বিক্ষোভের মুখে সরকার ১৯৫০ সালে একটি নতুন প্রস্তাব আনে, যাতে বলা হয় যে, উর্দু ও বাংলা হবে পাকিস্তানের সহ-রাষ্ট্রভাষা। এই প্রস্তাবও বাঙালিদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তারা দাবি করে যে, বাংলাকে উর্দুর সমপর্যায়ের মর্যাদা দেওয়া উচিত। 

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলার ছাত্ররা ঢাকায় এক বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলে যোগ দেওয়া ছাত্রদের উপর পুলিশ গুলি চালায়। গুলিতে সালাম, রফিক, জব্বার ও শফিউর রহমান নামের চারজন ছাত্র শহীদ হন। এ ঘটনার পর পূর্ব বাংলায় ভাষা আন্দোলন আরও জোরদার হয়।

“আবার ফুটেছে দ্যাখ কৃষ্ণচুড়া থরে থরে শহরের পথে কেবল নিবিড় হয়ে কখনো মিছিলে কখনও বা একা হেটে যেতে মনে হয়,ফুল নয় ওরা শহীদের ঝলকানিতে রক্তের বুদবুদ, স্মৃতি – গন্ধে ভরপুর একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের চেতনারই রঙ।”

– শামসুর রহমান।

ঐতিহাসিক মিছিল এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ:

মিছিলের দিন সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আমতলায় জড়ো হতে শুরু করে। তারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৪৪ ধারা ছিল সরকারের একটি আইন, যাতে বলা হয়েছিল যে, কোনো বিক্ষোভ মিছিল করার আগে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু ছাত্ররা সরকারের এই আইন অমান্য করে মিছিল বের করার সিদ্ধান্ত নেয়।

ঐতিহাসিক মিছিলের গুরুত্ব নিম্নরূপ:

এই মিছিলের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূচনা হয়।

এই মিছিলের ফলে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মিছিলের ফলে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১৪৪ ধারা ছিল একটি ঔপনিবেশিক আইন, যা বাঙালিদের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করছিল। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করার মাধ্যমে ছাত্ররা এই আইনের প্রতিবাদ জানায় এবং তাদের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করে।

ভাষা আন্দোলনের পুনর্জাগরণ 

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে এ আন্দোলন থেমে যায়নি। বরং, পরবর্তী বছরগুলোতে এ আন্দোলন নতুন শক্তি ও উদ্দীপনা নিয়ে পুনর্জাগরিত হয়। ১৯৫৬ সালের পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবায়নে সরকার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ফলে, বাংলা ভাষার মর্যাদা নিয়ে পূর্ব বাংলায় আবারও আন্দোলন শুরু হয়।

১৯৬২ সালের শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে উর্দুকে একমাত্র শিক্ষার মাধ্যম করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এ প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে পূর্ব বাংলায় তীব্র প্রতিবাদের সৃষ্টি হয়। ছাত্ররা ধর্মঘট ও মিছিল শুরু করে। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলা ভাষার দাবি আবারও উত্থাপিত হয়। ছয় দফার তৃতীয় দফায় বলা হয়, 

“পূর্ব বাংলার শিক্ষা ও সংস্কৃতির স্বাধীনতা ও বিকাশের জন্য বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে হবে এবং পূর্ব বাংলায় শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা প্রচলিত করতে হবে।”

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার দাবি আরও জোরদার হয়। গণঅভ্যুত্থানের পর সরকার ১৯৭২ সালের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পুনর্জাগরণের ফলে বাংলা ভাষার মর্যাদা আরও সুসংহত হয়। এ আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়: 

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। সেই সময় পাকিস্তানের ছিল দুটি অংশ – পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তান। প্রায় দুই হাজার কিলােমিটারের অধিক দূরত্বের ব্যবধানে অবস্থিত পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগােলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেকগুলাে মৌলিক পার্থক্য ছিল। গোটা পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষ  বাংলা ভাষায় কথা বলতো। পূর্ব বাংলা থেকে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের বৈঠকে ইংরেজি ও উর্দুভাষা ব্যবহারের পাশাপাশি বাংলা ভাষা ব্যবহারের অধিকার সংক্রান্ত এক সংশােধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন।  এ প্রস্তাবের কঠোর সমালােচনা করেন প্রধানমন্ত্রী  লিয়াকত আলী খান। যার কারনে  ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যে সংশােধনী প্রস্তাব দেন তা গৃহীত হয়নি।

সেই সময় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে গড়ে  তোলা হয়েছিল  তমদুন মজলিস ও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে ১৯৪৮ সালের ১০ই মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ধর্মঘট ডাকার সিদ্ধান্ত হয়। ১১ই মার্চ পালিত সেই ধর্মঘটে পিকেটিংয়ের সময়ে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এর কিছু দিন পরে ২১শে মার্চ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ ঢাকায় এক ভাষণে ঘােষণা করেন: “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। ২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে গিয়েও তিনি একই বক্তব্য রাখেন। যখন তিনি উর্দুর ব্যাপারে তার অবস্থানের কথা পুনরুল্লেখ করেন, উপস্থিত ছাত্ররা সমস্বরে না, না’ বলে চিল্কার করে ওঠে। তাক্ষণিকভাবে এ ঘােষণার প্রতিবাদে তারা বলে, উর্দু নয় বাংলা হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যেও গভীর ক্ষোভের জন্ম হয়। বাংলা ভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে।

ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়:

 তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন আবারও উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘােষণা দেন ১৯৫২ সালের ২৭শে জানুয়ারি। তখন পূর্ব বাংলার জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ২৯শে জানুয়ারি তারা  সিদ্ধান্ত নেন, ঢাকা শহরে তারা প্রতিবাদী মিছিল-সমাবেশ করবেন। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে আন্দোলনকারী সংগঠনগুলাে সম্মিলিতভাবে ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে সমগ্র পূর্ব বাংলায় প্রতিবাদ কর্মসূচি ও ধর্মঘটের আহ্বান করে। তখন আন্দোলন দমন করতে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে। ফলে দিনটিতে ঢাকা শহরে সকল প্রকার মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘােষিত হয়। কিন্তু এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন।

ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়( ১৯৫৩- ১৯৫৬) 

১৯৫৩ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ছিল ভাষা আন্দোলনের চুড়ান্ত পর্যায়। এই সময়কালে আন্দোলন আরও ব্যাপক ও জোরালো হয়ে ওঠে। ১৯৫৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে ঢাকায় এক বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে লাখো লোক অংশ নেয়। সমাবেশে উপস্থিত বক্তারা বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞতা ব্যক্ত করেন। 

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারের মধ্যে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবি ছিল। সরকার গঠনের পর যুক্তফ্রন্ট বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার জন্য কাজ শুরু করে। ১৯৫৬ সালের ১লা সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের সংবিধান গৃহীত হয়। সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়। এটি ছিল ভাষা আন্দোলনের একটি ঐতিহাসিক অর্জন।

“কারো দানে পাওয়া নয়, রক্ত দিয়ে কেনা এই বাংলা ভাষা।”

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী সকাল ৯টা থেকে সরকারি আদেশ উপেক্ষা করে ঢাকা শহরের স্কুল-কলেজের হাজার হাজার ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত হয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রশ্নে পুরাতন কলাভবন প্রাঙ্গণের আমতলায় ঐতিহাসিক ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্ররা পাঁচসাতজন করে ছােটো ছােটো দলে বিভক্ত হয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসতে চায়। তারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে স্লোগান দিতে থাকে। পুলিশ অস্ত্র হাতে সভাস্থলের চারদিক ঘিরে রাখে। বেলা সােয়া এগারােটার দিকে ছাত্ররা একত্র হয়ে প্রতিবন্ধকতা ভেঙে রাস্তায় নামার প্রস্তুতি নিলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে ছাত্রদের সতর্ক করে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তখন পুলিশকে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ বন্ধ করতে অনুরােধ জানান এবং ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ত্যাগের নির্দেশ দেন। কিন্তু ক্যাম্পাস ত্যাগ করার সময়ে কয়েকজন ছাত্রকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অভিযােগে পুলিশ গ্রেফতার করলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এরপর আরাে অনেক ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের উপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ আরাে অনেকে। শহিদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শােকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব বাংলায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।

একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন 

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই ২১শে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতীয়তাবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে উদযাপিত হয়ে আসছে। ১৯৫৩ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এক বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে লাখো লোক অংশ নেয়। সমাবেশে উপস্থিত বক্তারা বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞতা ব্যক্ত করেন।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারের মধ্যে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবি ছিল। সরকার গঠনের পর যুক্তফ্রন্ট বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার জন্য কাজ শুরু করে। ১৯৫৬ সালের ১লা সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের সংবিধান গৃহীত হয়। সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়। ১৯৫৬ সালের পর থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারি আরও ব্যাপক ও জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদযাপিত হতে থাকে। এই দিনটিতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন ও রাজনৈতিক দল বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এসব অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষার মর্যাদা ও মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। 

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ২১শে ফেব্রুয়ারি আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই দিনটিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৯৭২ সালের সংবিধানে ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।  আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হলও একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গসহ সমস্ত বাংলাভাষী অঞ্চলে পালিত একটি বিশেষ দিবস, যা ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বরে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী পালন করা হয়। এটি শহীদ দিবস হিসাবেও পরিচিত। এ দিনটি বাঙালি জনগণের ভাষা আন্দোলনের মর্মন্তুদ ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত একটি দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ১৯৫২ সালে এইদিনে (৮ ফাল্গুন, ১৩৫৮, বৃহস্পতিবার) বাংলাকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকায় আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে অনেক তরুণ ছাত্র শহীদ হন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়। এদিন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পুরস্কার বিতরণ, শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন ইত্যাদি কর্মসূচি পালিত হয়। এছাড়াও, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়।

রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি 

রাষ্ট্রভাষা হল একটি দেশের সরকারি ও আইনি কাজের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ভাষা। একটি দেশের রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ করা হয় সেই দেশের সংবিধানে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা”। এটি একটি সাংবিধানিক স্বীকৃতি।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পুনর্নির্বাচিত করা হয়।

২১শে ফেব্রুয়ারি-পরবর্তী আন্দোলন:

 ২১শে ফেব্রুয়ারির ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ২২শে ও ২৩শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র, শ্রমিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সাধারণ জনতা পূর্ণ হরতাল পালন করে এবং সভা-শােভাযাত্রা সহকারে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। ২২শে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহিদ হন শফিউর রহমান শফিক। ২৩শে ফেব্রুয়ারি ফুলবাড়িয়ায় ছাত্র-জনতার মিছিলেও পুলিশ অত্যাচার-নিপীড়ন চালায়। শহিদদের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতে ওইদিন বিকেল থেকে রাত অবধি কাজ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হােস্টেল প্রাঙ্গণে ছাত্ররা নির্মাণ করে ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহিদ মিনার। ২৪শে ফেব্রুয়ারি শহিদ মিনারটি উদ্বোধন করেন বাইশে ফেব্রুয়ারি শহিদ হওয়া শফিউর রহমানের পিতা। ২৬শে ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে শহিদ মিনারটি উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক জনাব আবুল কালাম শামসুদ্দীন।

ভাষা আন্দোলনের অর্জন: 

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলন ভাষা কেন্দ্রিক হলেও তা পুরাে বাঙালি জাতিকে অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে। এর ফল হিসেবে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল ব্যবধানে মুসলিম লীগকে পরাজিত করে। একুশের চেতনাকে ধারণ করে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনি ইশতেহার ছিল ২১ দফা সম্বলিত। ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে ১৯৫৪ সালের ৭ই মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৫৫ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার জন্য বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন, মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘােষণা করে, যা বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে গভীর শ্রদ্ধা ও যথাযােগ্য মর্যাদার সাথে উদযাপিত হয়। দিবসটির এই আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করতে কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।

ভাষা আন্দোলনভিত্তিক সাহিত্যরাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নতুন গতি লাভ করে। রচিত হয় ভাষা আন্দোলন-কেন্দ্রিক অনেক কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস। ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় একুশের প্রথম সাহিত্য সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয়। একই বছর মুনীর চৌধুরী কারাগারে বসে কবর নাটক রচনা করেন। আবদুল গাফফার চৌধুরী লেখেন গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানাে একুশে ফেব্রুয়ারি। কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি কবিতা রচনা করেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী শামসুর রাহমান রচনা করেন বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা; আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ রচনা করেন মাগাে, ওরা বলে কবিতা। জহির রায়হান একুশকে নিয়ে রচনা করেন উপন্যাস ‘আরেক ফায়ূন (১৯৬৯)। এছাড়া ওই সময়পর্ব থেকে বর্তমান পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বাংলা সাহিত্য চর্চার অন্যতম অনুপ্রেরণা।

ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য

 রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রধান তাৎপর্য এই যে, বাঙালি জাতি তার জাতীয়তাবােধ ও অধিকার সম্পর্কে প্রথম সচেতন হয়। ভাষার প্রশ্নে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। এর ফলে পূর্ব বাংলায় গড়ে ওঠে একটি সচেতন মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এরপর যত আন্দোলন সগ্রাম হয়েছে তার পেছনে কাজ করেছে ভাষা আন্দোলনের উজ্জ্বল স্মৃতি। ভাষা আন্দোলনের প্রেরণায় ১৯৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬-র ছয় দফা এবং ১৯৬৯-র গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয় অর্জিত হয়েছে। তবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা ছিল ভাষা আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য। এখনও সেই লক্ষ্য পুরােপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।

স্বাধীনতা যুদ্ধে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে গভীর প্রভাব ফেলে। এ আন্দোলনের ফলে বাঙালি জাতির মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা ও ঐক্য বোধের বিকাশ ঘটে। এ আন্দোলনের শহীদরা বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য আত্মত্যাগ করেন। তাদের আত্মত্যাগের ফলে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করার প্রেরণা পায়।

ভাষা আন্দোলনের প্রভাব স্বাধীনতা যুদ্ধে নিম্নরূপ:

ক. জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ: ভাষা আন্দোলনের ফলে বাঙালি জাতির মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটে। এ আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালিরা বুঝতে পারে যে, তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রয়েছে। এ আন্দোলন বাঙালি জাতির মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

খ. স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের প্রেরণা: ভাষা আন্দোলনের শহীদরা বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য আত্মত্যাগ করেন। তাদের আত্মত্যাগের ফলে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করার প্রেরণা পায়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালিরা ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে বীরোচিত সংগ্রাম করে এবং অবশেষে স্বাধীনতা অর্জন করে। ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ আন্দোলনের ফলে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করার প্রেরণা লাভ করে এবং অবশেষে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে। 

মোদের গর্ব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা।

বাংলাদেশের সোনার ছেলে ভাষা শহীদের দল,

জীবন দিয়ে এনে দিলো বাংলা ভাষার ফল,

তাদের দানে আজকে আমরা স্বাধীন ভাবে বাংলা বলি,

সেই সোনার ছেলেদের ত্যাগের কথা কেমন করে ভুলি !”

উপসংহার: 

একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জাতিসত্তার পরিচয় নির্দেশক দিন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বীর ভাষা-শহীদদের অবদান জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। তবে তাঁদের আত্মদান তখনই সার্থক হবে, যখন বাংলাদেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন করা সম্ভব হবে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি প্রত্যেকের দায়িত্ব রয়েছে। ভাষা আন্দোলনের ভাষা শহীদেরা চিরদিন বেঁচে থাকবে আমাদের মাঝে, কেননাঃ 

“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি” 

Scroll to Top