ভাষা কাকে বলে এবং মূল উপাদান গুলো কি কি ?
মনের ভাব প্রকাশের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হল ভাষা। মানব সভ্যতার আদি সময় থেকে আবিষ্কার হয়েছে অনেক কিছু যার মধ্যে ভাষার আবিষ্কার অন্যতম। ভাষা না থাকলে মনের ভাব প্রকাশ করা অনেক কঠিন হয়ে যেত। এক মিনিটের জন্য আমরা যদি কল্পনা করি ভাষা ছাড়া আমাদের নিত্যনৈমিতিক জীবন সেটি যেন শ্বাসরুদ্ধকর মনে হবে। ভাষার ব্যবহারের মাধ্যমে মানব সভ্যতার বিকাশ সাধন হয়েছে। ইতিহাস, সাহিত্য ও আধুনিকতায় ভাষা ছাড়া অচল অঙ্গন। আজকের এই আর্টিকেলে আমরা আলোচনা করব ভাষা কাকে বলে, ভাষার প্রকারভেদ, বৈশিষ্ট্য সহ অন্যান্য আলোচনা।
ভাষা কাকে বলে
মানুষের মনের ভাব প্রকাশের সবচেয়ে সহজ উপায় বা মাধ্যম হলো ভাষা। এই ভাষার মাধ্যমে আমরা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকি। সহজার্থে বলা যায় যে মনের ভাব প্রকাশের জন্য বাকযন্ত্রের সাহায্যে মানুষ যেসব অর্থবোধক ধ্বনি উচ্চারণ করে, তাকেই ভাষা বলে। বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় সাত হাজারেরও বেশি ভাষা রয়েছে। তবে প্রতিটি ভাষাভাষী মানুষের ভাষা ভিন্ন হয় ও ভাব প্রকাশের ধরনও ভিন্ন হয়। ভাষা শুধুমাত্র মৌখিকভাবে মনের ভাব প্রকাশের জন্য নয় বরং লিখিতভাবে অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমেও মনের ভাব প্রকাশ করা যায় যা ভাষার আরেকটি রূপ।
ভাষার সংজ্ঞা
ভাষা কাকে বলে এর সংজ্ঞা নিয়ে বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং ভাষাবিজ্ঞানীগণ নানা রকমের সংজ্ঞা দিয়েছেন। তাদের মতন অনুযায়ী ভাষা যেমন –
ভাষাকে সংজ্ঞায়িত করে ড. মুহাম্মদ এনামুল হক বলেন, ” মানুষ বাগযন্ত্রের মাধ্যমে সমাজভুক্ত জনগণের বোধগম্য হয়ে যে সকল ধ্বনি বা ধ্বনি সমষ্টি উচ্চারণ করে, সে সকল ধ্বনি বা ধ্বনি সমষ্টিকে ভাষা বলা হয় “।
ভাষাকে সংজ্ঞায়িত করে ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ” মানুষ যেসব ধ্বনি বা ধ্বনি সমষ্টির সাহায্যে মনের ভাব প্রকাশ করে থাকে তাকেই ভাষা বলা হয়। “
ভাষাকে সংজ্ঞায়িত করে ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন, ” মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য বাকযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনির মাধ্যমে নিষ্পন্ন, কোন বিশেষ জনসমাজের জন্য ব্যবহৃত, স্বতন্ত্রভাবে অবস্থিত, বাক্যে প্রযুক্ত শব্দ সমষ্টিকেই ভাষা বলা হয়।”
ড. সুকুমার সেন ভাষাকে সংজ্ঞায়িত করে বলেছেন,
” মানুষের করা উচ্চারিত অর্থবহ বহুজনবোধ্য ধ্বনি সমষ্টি হল ভাষা। “
ভাষাবিজ্ঞানী স্টারটেভান্ট বলেছেন,
“মানুষ যখন কিছু শব্দ বা ধ্বনির সাহায্যে পারস্পরিক মনের কথা বুঝতে পারে তখন তাকে ভাষা বলা হয়। “
ভাষার মূল উপাদান গুলো কি কি
ভাষার মূল উপাদান হলো ধ্বনি। ধ্বনিকে ভাষার ক্ষুদ্রতম একক বলা হয়। সাধারণত কণ্ঠ উচ্চারিত ও নিঃসৃত অর্থবোধক ধ্বনির সমষ্টি হল ভাষা। আর ধ্বনির লিখিত উপাদানই হলো বর্ণ। যে কোন ভাষার চারটি মৌলিক উপাদান রয়েছে। সেগুলি হল-
- ধ্বনি
- শব্দ
- বাক্য
- অর্থ
এছাড়াও একটি ভাষার ব্যাকরণের মৌলিক অংশ হলো চারটি। যেমন- ধ্বনিতত্ত্ব, শব্দতত্ত্ব, বাক্যতত্ত্ব ও অর্থতত্ত্ব।
ভাষার বৈশিষ্ট্য সমূহ
নিজে ভাষার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো-
- বাকযন্ত্রের মাধ্যমে কণ্ঠ নিঃসৃত হয়ে ধ্বনির সাহায্যে যে শব্দ সৃষ্ট হয় তাকে ভাষা বলে।
- ভাষা একপ্রকার ধ্বনির সমষ্টি।
- যেকোনো শব্দসমষ্টি বা ধ্বনি ভাষা নয়। শুধুমাত্র অর্থপূর্ণ শব্দ বা ধ্বনি ভাষা।
- প্রতিটি ভাষারই রয়েছে নিজস্ব সার্বভৌম ও স্বাধীন অবস্থান।
- ধ্বনি, পদ, শব্দ,বাক্য ইত্যাদির অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক গঠনকে ভাষা রক্ষা করে।
- ভাষা বক্তব্যের অন্তর্নিহিত রূপকে প্রকাশ করে।
- ভাষা মানুষের স্বভাব বৈশিষ্ট্য , সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে প্রকাশ করে।
- দেশ,জাতি, পরিবেশ ও কালভেদে ভাষা পরিবর্তন হয়ে থাকে।
- সকল ভাষার শব্দ ও বাক্যের গঠন রীতি প্রায় অনুরূপ।
- ভাষা হল মানুষের ইচ্ছাকৃত অভ্যাস ও আচরণের সমষ্টি।
- মনের ভাব আদান-প্রদানের উত্তম মাধ্যম হল ভাষা।
- একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মাঝে ভাষা ভাব প্রকাশের জন্য ব্যবহৃত হয়।
সর্বোপরি বলা যায় ভাষা কাকে বলে জানার সাথে বৈশিষ্ট্যগুলো জানা গুরুত্বপূর্ণ। এ সকল বৈশিষ্ট্য গুলি প্রতিটি ভাষাতেই পরিলক্ষিত করা যায়।
ভাষার প্রকারভেদ
সাধারণত ভাষার দুইটি রূপ রয়েছে। যথা-
- কথ্যভাষা বা মৌখিক ভাষা
- লেখ্য ভাষা বা লিখিত ভাষা
কথ্য ভাষা বা মৌখিক ভাষা
আমরা পাক যন্ত্রের সাহায্যে যে ভাষায় কথা বলি, একে অপরের সাথে ভাব বিনিময়, আবেগ অনুভূতি শেয়ার করে থাকি তাকে মৌখিক ভাষা বা কথ্য ভাষা বলা হয়। মৌখিক ভাষা আবার দুই প্রকার-
- আঞ্চলিক ভাষা
- সার্বজনীন ভাষা
লিখিত বা লেখ্য ভাষা
আমরা যে ভাষায় বিভিন্ন প্রতীক, সাংকেতিক চিহ্ন, বিভিন্ন বর্ণমালা ব্যবহার করে চিঠি পত্র, বই-পুস্তক, অথবা অন্যান্য ভাব ও তথ্য লিখে প্রকাশ করা হয় ভাষা বা লিখিত ভাষা বলা হয়। লিখিত ভাষার প্রকারভেদ দুই প্রকার। যথা-
- সাধু ভাষা ও সামিহা
- চলিত ভাষা
ভাষার কাজ কি
- ভাষার প্রধান কাজ হচ্ছে মনের ভাব প্রকাশ করা এছাড়াও ভাষার আরো অনেক কাজ রয়েছে। যেমন –
- ভাষার সাহায্যে সংস্কৃতির সম্প্রসারণ করা যায় ও সমন্বয়ে ঘটে।
- ভাষার মাধ্যমে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করা যায়।
- ভাষার সাহায্যে একটি জাতির সংস্কৃতি ও সভ্যতা তুলে ধরা যায়।
- ভাষা মানুষের ধর্ম জাতি দেশ ইত্যাদি পরিচয় বহন করে।
- সাহিত্যচর্চা,জ্ঞান অর্জন ও তথ্য রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি প্রয়োজনে ভাষা অপরিহার্য।
উপসংহার
জীবনযাপনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো ভাষা। আমাদের নিত্য নৈমিতিক জীবনে ভাষা ছাড়া কোন কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারবো না। হোক সেটি লিখিত মৌখিক বা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে। বিশ্বের সকল মানুষেরই নির্দিষ্ট আঞ্চলিক ভাষা বা মাতৃভাষা রয়েছে এবং এই ভাষার মাধ্যমেই তারা তাদের মনের ভাব আদান প্রদান করে এবং যোগাযোগ স্থাপন করে ও তাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজগুলি সম্পাদন করে। আজি এই আর্টিকেলে আমরা আলোচনা করেছি ভাষা কাকে বলে, ভাষার প্রকারভেদ, ভাষার কাজ কি এবং বৈশিষ্ট্য সমূহ। আশা করা যায় ভাষা সম্পর্কে আপনার একটা ভালো ধারণা পাবেন আর্টিকেলটি পড়লে।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন
১. ভাষা কাকে বলে?
উত্তর: মনের ভাব প্রকাশের জন্য বাকযন্ত্রের সাহায্যে মানুষ যেসব অর্থবোধক ধ্বনি উচ্চারণ করে, তাকেই ভাষা বলে। বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় সাত হাজারেরও বেশি।
২. ভাষার প্রকারভেদ কি কি?
উত্তর: সাধারণত ভাষার দুইটি রূপ রয়েছে। যথা-
- কথ্যভাষা বা মৌখিক ভাষা
- লেখ্য ভাষা বা লিখিত ভাষা
৩. ভাষার বৈশিষ্ট্য গুলি কি কি?
উত্তর: বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করা হলো-
- বাকযন্ত্রের মাধ্যমে কণ্ঠ নিঃসৃত হয়ে ধ্বনির সাহায্যে যে শব্দ সৃষ্ট হয় তাকে ভাষা বলে।
- ভাষা একপ্রকার ধ্বনির সমষ্টি।
- যেকোনো শব্দসমষ্টি বা ধ্বনি ভাষা নয়। শুধুমাত্র অর্থপূর্ণ শব্দ বা ধ্বনি ভাষা।
- প্রতিটি ভাষারই রয়েছে নিজস্ব সার্বভৌম ও স্বাধীন অবস্থান ইত্যাদি।
Also Read: প্রমিত ভাষা কাকে বলে?