বর্তমানে সামাজিক অবক্ষয়, পারিবারিক অশান্তি ও অপরাধ বৃদ্ধির মূল কারণ হিসাবে ‘মাদকাসক্তি’ কে চিহ্নিত করেছে সরকার ও সমাজ বিজ্ঞানীরা। বাংলাদেশ ও সারাবিশ্বের যুব সমাজের মাঝে মাদকের ভয়াল তান্ডব চলছে। আমাদের আজকের এই “মাদকাসক্তি ও এর প্রতিকার” রচনায় গুরুপ্তপূর্ণ ২০ টি পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা করবো যা আমাদের প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুদের ব্যাক্তিগত জীবন ও পরীক্ষার জন্য গুরুপ্তপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
ভূমিকা
‘মাদক দ্বারা আসক্ত = মাদকাসক্ত’ বা মাদকাসক্তি নামটি ছোট হলেও এর প্রভাব ব্যপক। সমাজ ধ্বংসের অন্যতম একটি কারন হলো মাদকাসক্তি। মানুষ বহু বছর থেকেই এই নেশার মধ্যে বন্দি হয়ে আছে। মাদকদ্রব্য এমন একটি জিনিস যেটা ব্যবহার করলে একজন স্বাভাবিক মানুষের মধ্যে কোনো হিতাহিত জ্ঞান থাকেনা। যারা মাদকদ্রব্য ব্যবহার করে তারা সহজে নেশা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনা। মাদকদ্রব্য ব্যবহারকারী ব্যক্তির জীবনে নেমে আসে অন্ধকার।
“ছাত্র যুবক মাদক জালে
দিচ্ছে টাকা হাতে তুলে
ইয়াবার নেশাই মত্ত হলে
দেশ চালাবে কোন সে ছেলে।”
মাদক ও মাদকাসক্তি
মাদক বলতে এমন কোনো পদার্থকে বোঝায় যা মানবদেহে প্রবেশ করলে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন ঘটায়। এই পরিবর্তনগুলির মধ্যে আনন্দ, উদ্দীপনা, প্রশান্তি ইত্যাদি থাকতে পারে। মাদক সাধারণত উদ্ভিদ, প্রাণী বা রাসায়নিক পদার্থ থেকে তৈরি করা হয়।
মাদকাসক্তি বলতে মাদকের প্রতি আসক্তিকে বোঝায়। মাদকাসক্ত ব্যক্তি মাদক গ্রহণের জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা অনুভব করে এবং মাদক গ্রহণ না করলে শারীরিক ও মানসিক অস্বস্তি অনুভব করে। মাদকাসক্তি একটি জটিল রোগ যা শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করে।
মাদকাসক্তির প্রভাব
মাদকাসক্তি একটি জটিল সমস্যা যা শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করে। সারাবিশ্বে মাদকাসক্তি দিন দিন বেড়েই চলছে। যার কারনে মাদকাসক্তির ব্যপকতা জাতির জন্য আতংকের কারন হয়ে দাড়িয়েছে। সব বয়সী মানুষ এখন মাদকদ্রব্য ব্যবহার করছে। তবে তরুন এবং অল্প বয়সী ছেলে এমনকি মেয়েদের মধ্যেও মাদকদ্রব্য ব্যবহার করতে দেখা যায়। বিভিন্ন কারনে মানুষ মাদকদ্রব্য গ্রহন করে থাকে। যেমন হতাসা, বেকারত্ব, পারিবারিক জীবনে অশান্তি, দারিদ্রতা, প্রেমে ব্যর্থতা সহ অনেক কারন। মাদকদ্রব্য গ্রহনের ফলে মানুষের জ্ঞান থাকেনা। যার কারনে মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জরিয়ে পরে৷ মাদকদ্রব্য গ্রহনের কারনে শারীরিক ও মানসিক সমস্যাও দেখা যায়। সর্বোপরী বলা যেতে পারে যে, মাদকাসক্তি একটি গুরুতর সমস্যা যা ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর।
মাদকের উৎস
মাদকের উৎস এবং ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ ও প্রাণীর থেকে মাদক তৈরি করে আসছে। মাদক ব্যবহারের প্রাচীনতম প্রমাণ পাওয়া গেছে চীন, মিশর ও মেসোপটেমিয়াতে।
মাদক সাধারণত তিনটি উৎস থেকে পাওয়া যায়:
ক. উদ্ভিদ: মাদকের সবচেয়ে সাধারণ উৎস হল উদ্ভিদ। গাঁজা, আফিম, কোকেন, ইত্যাদি মাদক উদ্ভিদ থেকে তৈরি করা হয়।
খ. প্রাণী: কিছু মাদক প্রাণী থেকে তৈরি করা হয়, যেমন- মদ, আফিম, ইত্যাদি।
গ. রাসায়নিক: কিছু মাদক রাসায়নিক পদার্থ থেকে তৈরি করা হয়, যেমন- ফেনসিডিলিন, ইত্যাদি।
মাদকদ্রব্যের সবচেয়ে প্রাচীন উৎস হলো আফিম। পপি ফুল থেকে আফিম তৈরি করা হয়।
মধ্যযুগে, মাদকের ব্যবহার আরও ব্যাপক হয়ে ওঠে। এই সময়ে, গাঁজা, আফিম, মদ, ইত্যাদি মাদক বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হতো।
উনিশ শতকে, মাদকের ব্যবহার চিকিৎসার ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হতে শুরু করে। এই সময়ে, আফিম ও কোকেন ব্যথানাশক হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
বিংশ শতকে, মাদকের ব্যবহার আরও বেশি বিস্তৃত হয়ে ওঠে। এই সময়ে, মাদক ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট সমস্যাগুলি সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং মাদক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করা হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মাদক দ্রব্যের ব্যবহার
উন্নত দেশগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদের দেশেও দিন দিন মাদকদ্রব্যের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। আমাদের যুবসমাজ মাদকগ্রহনের ফলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অসুস্থ এক সমাজ গঠিত হচ্ছে। বাংলাদেশে কি পরিমান মাদকদ্রব্য ব্যবহার করা হয় তার সঠিক সংখ্যা এখনো জানা যায়নি। পরিসংখ্যান হতে জানা যায়, এ দেশের মোট জনসংখ্যার ১৭ ভাগ মাদকদ্রব্য ব্যবহার করে বলে জানা যায়। বর্তমানে দেশে ৩৫০ টি বৈধ গাজার দোকান থাকলেও সারা বাংলাদেশে কয়েক হাজার অবৈধ গাজার দোকান আছে।
মাদকদ্রব্যের ব্যবহার
এখন বিভিন্নভাবে মাদকদ্রব্য ব্যবহার করা যায়। কোনো মাদকদ্রব্য নাকে টেনে ব্যবহার করা হয়, আবার কোনো মাদকদ্রব্য ধোয়ার সাথে পান করা হয়, কোনো মাদকদ্রব্য আবার গিলে খাওয়া হয়, কোনোটি ইঞ্জেকশন এর মত শরীরে প্রবেশ করাতে হয়। একটি জরিপ থেকে জানা গেছে যে, বাংলাদেশে বর্তমানে পনের লক্ষের বেশি মানুষ মাদকদ্রব্য ব্যবহার করছে। এই সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে৷ সব ধরনের পেশার মানুষ মাদকদ্রব্য ব্যবহার করছে। পেশাজীবি, শ্রমজীবী এমনকি ছাত্ররাও এখন মাদক দ্রব্য ব্যবহারে আসক্ত হয়ে পরেছে৷
মাদকদ্রব্যের ধরন
মাদকদ্রব্যের প্রভাব বা কার্যকারিতার ভিত্তিতে শ্রেণীবদ্ধ করা। এই শ্রেণীবিভাগ অনুযায়ী, মাদকদ্রব্যকে চার ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
১. উদ্দীপক মাদকদ্রব্য: এই ধরনের মাদকদ্রব্য মস্তিষ্কে অ্যাড্রেনালিন ও নরএড্রেনালিন হরমোনের নিঃসরণ বাড়ায়। এর ফলে শরীরে শক্তির সঞ্চার হয়, মনোযোগ বাড়ে এবং ক্লান্তি দূর হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কোকেন, অ্যামফিটামিন, ইত্যাদি।
২. ঘুমের ওষুধ: এই ধরনের মাদকদ্রব্য মস্তিষ্কে গ্লুটামেট নামক নিউরোট্রান্সমিটারের নিঃসরণ বাড়ায়। এর ফলে শরীরে শিথিলতা আসে এবং ঘুম আসে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হেরোইন, মদ, ইত্যাদি।
৩. অ্যানাশেটিক মাদকদ্রব্য: এই ধরনের মাদকদ্রব্য মস্তিষ্কে বেদনা অনুভূতির জন্য দায়ী নিউরনগুলিকে অবরুদ্ধ করে। এর ফলে শরীরে বেদনা অনুভূত হয় না। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কেটামিন, ইত্যাদি।
৪. হেলুসিনোজেনিক মাদকদ্রব্য: এই ধরনের মাদকদ্রব্য মস্তিষ্কে সিগমা-১ নামক নিউরনগুলিকে উদ্দীপিত করে। এর ফলে দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাভাবনা ও অনুভূতির পরিবর্তন ঘটে।
মাদকাসক্তির কারণ
মাদকাসক্তি একটি জটিল মানসিক রোগ। এর নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই, তবে এর বিভিন্ন কারণ হতে পারে। মাদকাসক্তির জন্য সামাজিক ও পরিবেশগত কারণগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- পরিবারে মাদকদ্রব্যের ব্যবহার: পরিবারে যদি কারও মাদকাসক্তির ইতিহাস থাকে, তবে সেই পরিবারের সদস্যদের মাদকাসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
- বন্ধুবান্ধবদের প্রভাব: বন্ধুবান্ধবদের প্রভাবেও অনেকে মাদকাসক্ত হতে পারে।
- সামাজিক চাপ: সামাজিক চাপের কারণেও অনেকে মাদকাসক্ত হতে পারে।
- ব্যক্তিগত সমস্যা: অনেকেই ব্যাক্তিগত সম্পর্ক ভাঙ্গনের জন্য বা কোন কিছুতে ব্যর্থ হয়ে সাময়িক সময়ের কষ্ট ভুলতে মাদকে বেঁচে নেয়।
তরুণ প্রজন্মের মাদকদ্রব্যের ব্যবহার ও কুফল
“বাবা, গাঁজা, আফিম নিয়ে সবাই থাকে ব্যস্ত,
সিগারেটের টানে তারা সর্বদা অভ্যস্ত।
মদকে খাচ্ছে তারা মনে করে জল
আদর্শ সমাজ নষ্ট করতে, বাঁধছে তারা দল।”
তরুন প্রজন্ম হলো একটি জাতির ভবিষ্যৎ। এই প্রজন্মের উপর নির্ভর করে একটি জাতির উন্নতি ও অগ্রগতি। কিন্তু বর্তমান সময়ে তরুন প্রজন্মের মধ্যে মাদকদ্রব্যের ব্যবহার একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তরুন প্রজন্মে মাদকদ্রব্যের ব্যবহারের বিভিন্ন কারণ রয়েছে। বর্তমানে তরুন প্রজন্মের অনেকে সিনেমা ও টেলিভিশন থেকেও মাদকদ্রব্যের প্রতি আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। নাটক সিনেমার হিরো এবং হিরোইনদের অনুকরণ করে নিজেদের জীবনে অধ:পতন ডেকে আনছে। নিজের উজ্বল ভবিষ্যত নিজেরাই ধ্বংস করে দিচ্ছে। যার ফলে দেশের সামাজিক অবস্থা দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
মাদকাসক্তির ফলে পরিবারের অশান্তি
মাদকাসক্ত ব্যক্তির আচরণে পরিবর্তন আসে। তারা অস্থির, ঝগড়াটে ও সহিংস হয়ে ওঠে। তারা পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলতে চায় না, তাদের প্রতি মনোযোগ দেয় না। তারা পরিবারের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার অবনতি ঘটায়। মাদকাসক্ত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরাও মানসিকভাবে চাপগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তারা উদ্বিগ্ন ও হতাশ থাকে। তারা মাদকাসক্ত ব্যক্তির সুস্থতার জন্য চিন্তিত থাকে। তারা পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তিত থাকে।
মাদকাসক্ত ব্যক্তির আচরণগত পরিবর্তন পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি করে। তারা অস্থির, ঝগড়াটে ও সহিংস হয়ে ওঠে। তারা পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলতে চায় না, তাদের প্রতি মনোযোগ দেয় না।
মাদকাসক্ত ব্যক্তির অর্থনৈতিক অবক্ষয়: মাদকাসক্ত ব্যক্তির অর্থনৈতিক অবক্ষয় পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি করে। তারা পরিবারের আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটায়। তারা পরিবারের সদস্যদের জন্য আর্থিক বোঝা হয়ে ওঠে।
মাদকাসক্ত ব্যক্তির সামাজিক অবক্ষয়: মাদকাসক্ত ব্যক্তির সামাজিক অবক্ষয় পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি করে। তারা পরিবারের সামাজিক অবস্থার অবনতি ঘটায়। তারা পরিবারের সদস্যদের জন্য সামাজিক কলঙ্ক হয়ে ওঠে।
মাদকাসক্তি একটি গুরুতর সমস্যা যা পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি করে। পরিবারে অশান্তি রোধে পরিবারের সদস্যদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য সাহায্য করা প্রয়োজন।
মাদকাসক্তির ফলে শারীরিক ও মানসিক সমস্যা
মাদক গ্রহণের ফলে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন- মাদক গ্রহণের ফলে রক্তচাপ, হৃদস্পন্দন, শ্বাস-প্রশ্বাসের হার বেড়ে যেতে পারে। এছাড়াও, মাদক গ্রহণের ফলে রক্তনালীর ক্ষতি, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সার, মস্তিষ্কের ক্ষতি, যৌন অক্ষমতা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে মাদক গ্রহণের ফলে মৃত্যুও হতে পারে।
মাদক গ্রহণের ফলে বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন- মাদক গ্রহণের ফলে মস্তিষ্কের ক্ষতি হয় এবং এর ফলে বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা প্রায়ই বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, আত্মহত্যার প্রবণতা, স্মৃতিভ্রংশ, চিন্তাভাবনার সমস্যা ইত্যাদি সমস্যায় ভোগেন।
বিশ্বব্যাপী মাদকদ্রব্যের ব্যবহার ও প্রতিক্রিয়া
বিশ্বব্যাপী মাদক দ্রব্যের ব্যবহার একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী প্রায় ২৬০ মিলিয়ন মানুষ মাদক দ্রব্য ব্যবহার করেছে। এর মধ্যে ১১০ মিলিয়ন মানুষ মাদকাসক্ত। মাদকদ্রব্যের ব্যবহার বিশ্বের সব দেশেই দেখা যায়, তবে কিছু দেশে এটি তুলনামূলকভাবে বেশি। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১৫.৯% মানুষ মাদকদ্রব্য ব্যবহার করেছে।
মাদকদ্রব্যের ব্যবহার রোধে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- মাদকদ্রব্যের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি: মাদকদ্রব্যের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা মাদকদ্রব্যের ব্যবহার রোধের একটি কার্যকর উপায়।
- মাদকদ্রব্যের সরবরাহ ও বিপণন নিয়ন্ত্রণ: মাদকদ্রব্যের সরবরাহ ও বিপণন নিয়ন্ত্রণ করা মাদকদ্রব্যের ব্যবহার রোধের জন্য অপরিহার্য।
- মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন: মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন করা মাদকদ্রব্যের ব্যবহার রোধের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
পরিনাম
মাদকাসক্তির কারনে সমাজের অবক্ষয় হচ্ছে। একটি দেশের সামাজিক উন্নয়ন থেকে শুরু করে সবকিছুই তরুন প্রজন্মের উপর নির্ভর করে। কিন্তু যখন তরুন প্রজন্ম মাদকে আসক্ত হয়ে পরে তখন নিজের ভাল মন্দ বোঝেনা। সমাজের বিভিন্ন ধরনের অসামাজিক কার্যক্রমে লিপ্ত হয়। পড়াশোনা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে৷ সারাদিন রাত নেশায় মগ্ন থাকে৷ যার কারনে দেশে শিক্ষার মান কমে যায়। নিজের ভবিষ্যত নষ্ট হয়ে যায়। পরিবারে অশান্তি দেখা দেয়। শুধু তাই নয় মাদকাসক্ত ব্যক্তির পরিবারের সামাজিক সুনাম নষ্ট হয়৷ দেশে বিভিন্ন ধরনের অরাজকতা সৃষ্টি হয়। মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা রাস্তা ঘাটে মেয়েদের ইভটিজিং করে, চুরিছিনতাই,খুনের মত জঘন্য কাজ করে৷
বিশ্বজুড়ে মাদক বিরোধী আন্দোলন বনাম বাংলাদেশ
বিশ্বজুড়ে মাদক বিরোধী আন্দোলন দীর্ঘদিন ধরে চলছে। জাতিসংঘের মাদকদ্রব্য ও অপরাধবিষয়ক কার্যালয় (UNODC) দ্বারা পরিচালিত মাদকবিরোধী আন্দোলনের লক্ষ্য হলো মাদকদ্রব্যের উৎপাদন, সরবরাহ ও ব্যবহার কমানোর মাধ্যমে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহারের ক্ষতিকারক প্রভাবগুলি হ্রাস করা। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য, UNODC বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে।
বাংলাদেশও মাদক বিরোধী আন্দোলনে জড়িত। বাংলাদেশ সরকার মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার রোধে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে:
- মাদকদ্রব্যের উৎপাদন ও সরবরাহ রোধে আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
- মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার রোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা।
- মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।
বিশ্বজুড়ে মাদক বিরোধী আন্দোলন একটি দীর্ঘদিনের আন্দোলন, কিন্তু বাংলাদেশের মাদক বিরোধী আন্দোলন অপেক্ষাকৃত নতুন।
বিশ্বজুড়ে মাদক বিরোধী আন্দোলনে বিভিন্ন দেশের সরকার, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বেসরকারি সংস্থাগুলি জড়িত, কিন্তু বাংলাদেশের মাদক বিরোধী আন্দোলনে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলির ভূমিকা এখনও যথেষ্ট নয়।
মাদকের নেশা দ্রুত প্রসারের কারন:
মাদকের নেশা দ্রুত প্রসারের বিভিন্ন কারণ রয়েছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে অনেক মানুষ মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, শিক্ষার অভাব, পারিবারিক কলহ ইত্যাদি কারণে অনেক মানুষ মাদকের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে।
মাদকের সহজ প্রাপ্যতা: মাদকের সহজ প্রাপ্যতাও মাদকের নেশা দ্রুত প্রসারের একটি অন্যতম কারণ। বর্তমানে মাদকদ্রব্য খুব সহজেই পাওয়া যায়। এতে অনেক মানুষ মাদক গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
মাদকের প্রচারণা: মাদকের প্রচারণাও মাদকের নেশা দ্রুত প্রসারের একটি কারণ। বর্তমানে মাদকের প্রচারণা বিভিন্ন মাধ্যমে করা হচ্ছে। এতে অনেক মানুষ মাদকের নেশার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে।
মাদকের নেশার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতার অভাব: মাদকের নেশার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে অনেক মানুষের সচেতনতা নেই। এতে অনেক মানুষ মাদক গ্রহণের ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়।
মাদকের নেশা দ্রুত প্রসারের জন্য সমাজের সকলকে সচেতন হতে হবে। মাদকের নেশার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। মাদকদ্রব্যের সহজ প্রাপ্যতা রোধ করতে হবে। মাদকের প্রচারণা বন্ধ করতে হবে।
মাদকাসক্তি প্রতিরোধের চিন্তা
মাদকাসক্তি প্রতিরোধে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। ব্যক্তিগতভাবে, প্রত্যেকের মাদকদ্রব্যের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং মাদক গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে। পরিবারের সদস্যদের মাদক গ্রহণ থেকে বিরত রাখতে পরিবারের সকলের সচেতনতা ও সহযোগিতা প্রয়োজন। সামাজিকভাবে, মাদকদ্রব্যের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে। মাদকদ্রব্য রোধ করার জন্য সচেতনতামূলক বিভিন্ন নাটক এবং সিনেমা তৈরি করার মাধ্যমে মাদকাসক্তদের সচেতন করা যেতে পারে।
সমাজের কর্তব্য
সমাজের সকলকে মাদকদ্রব্যের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং মাদক গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে। পরিবারের সদস্যদের মাদক গ্রহণ থেকে বিরত রাখতে পরিবারের সকলের সচেতনতা ও সহযোগিতা প্রয়োজন। সামাজিকভাবে, মাদকদ্রব্যের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে।
সমাজের নেতারা মাদকদ্রব্য বন্ধ করার জন্য নিজ নিজ অবস্থান থেকে পদক্ষেপ নিতে পারেন। যদি কোনো এলাকার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তার নিজের এলাকায় মাদকদ্রব্য ব্যবহার কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ করে দেন তাহলে সে এলাকার মাদকদ্রব্য ব্যবহার কারী ব্যক্তির সমস্যা কমে যাবে।
আইনপ্রণয়ন ও প্রয়োগকারী সংস্থার ভূমিকা
আইন প্রণয়নের মাধ্যমে মাদকদ্রব্যের উৎপাদন, সরবরাহ ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। মাদকদ্রব্যের উৎপাদন ও সরবরাহের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি বিধান করা হলে মাদকদ্রব্যের উৎপাদন ও সরবরাহ কমে আসতে পারে। মাদকদ্রব্যের ব্যবহারের বিরুদ্ধেও কঠোর শাস্তি বিধান করা হলে মানুষ মাদক গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে পারে।
আইনপ্রণয়নের পাশাপাশি প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির কার্যকর তৎপরতাও মাদকদ্রব্য প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োগকারী সংস্থাগুলিকে মাদকদ্রব্যের উৎপাদন, সরবরাহ ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান পরিচালনা করতে হবে। মাদকদ্রব্যের উৎপাদন, সরবরাহ ও ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে আইনের আওতায় আনতে হবে।
মাদকদ্রব্য রোধে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগকারী সংস্থার ভূমিকা নিম্নরূপ:
মাদকদ্রব্যের উৎপাদন, সরবরাহ ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি বিধান করা।
মাদকদ্রব্যের উৎপাদন, সরবরাহ ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান পরিচালনা করা।
মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার রোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করা।
আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কার্যকর তৎপরতার মাধ্যমে মাদক দ্রব্যের ব্যবহার কমিয়ে আনা সম্ভব।
আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্তব্য
বিশ্বের সকল দেশ কে মাদকদ্রব্য ব্যবহার রোধ করার জন্য এগিয়ে আসা উচিৎ। কারন দ্রুত মাদকদ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রনে না আনলে বিশ্ব অনেক বড় সমস্যার সম্মুখীন হবে। মাদকদ্রব্যের উৎপাদন, বিপনন ও পাচার রোধ করার জন্য সকল দেশ এক হয়ে কাজ করতে পারে। তাহলে দ্রুত মাদকদ্রব্য ব্যবহার রোধ করা যাবে। দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় একযোগে কাজ করা শুরু করলে মাদকদ্রব্যের ব্যবহার অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব।
মাদকাসক্তির কুফল
মাদকাসক্তির ফলে যে শারীরিক কুফল হতে পারে:
স্বাস্থ্যহানি: মাদকাসক্তির কারণে শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন- লিভার ও কিডনির সমস্যা, হৃদরোগ, মস্তিষ্কের ক্ষতি, ত্বকের সমস্যা, ইত্যাদি।
মৃত্যু: মাদকাসক্তির কারণে মৃত্যুও হতে পারে।
মনোবৈকল্য: মাদকাসক্তির কারণে বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন- উদ্বেগ, হতাশা, বিভ্রান্তি, ইত্যাদি।
আত্মহত্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি: মাদকাসক্তদের মধ্যে আত্মহত্যার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে।
পারিবারিক সমস্যা: মাদকাসক্তির কারণে পরিবারে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন- পারিবারিক কলহ, দাম্পত্য বিচ্ছেদ, সন্তানদের মধ্যে সমস্যা, ইত্যাদি।
সামাজিক সমস্যা: মাদকাসক্তরা নানাবিধ সামাজিক সমস্যার কারণ হতে পারে, যেমন- অপরাধ, দুর্নীতি, ইত্যাদি
অর্থনৈতিক ক্ষতি: মাদকাসক্তির কারণে ব্যক্তি ও পরিবারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে।
মাদকাসক্তির প্রতিকার
মাদকাসক্তি একটি জটিল মানসিক রোগ। মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি পেতে হলে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। মাদকাসক্তির প্রতিকারের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গুলো গ্রহণ করা যেতে পারে:
ব্যক্তিগত পর্যায়ে
- মাদকদ্রব্যের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
- মাদকদ্রব্য গ্রহণের কারণগুলি চিহ্নিত করা এবং সেগুলি দূর করার চেষ্টা করা।
- মাদকদ্রব্য গ্রহণের ইচ্ছা দমন করার কৌশলগুলি শিখতে হবে।
- মাদকদ্রব্য গ্রহণের পরিবর্তে অন্য কার্যকলাপগুলিতে মনোনিবেশ করা।
পারিবারিক পর্যায়ে
- মাদকাসক্ত ব্যক্তির সাথে কথোপকথন করে তার সমস্যাগুলি বোঝার চেষ্টা করা।
- মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে সহায়তা ও সমর্থন প্রদান করা।
- মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য উৎসাহিত করা।
সামাজিক পর্যায়ে
- মাদকদ্রব্যের অপব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা।
- মাদকদ্রব্যের উৎপাদন, সরবরাহ ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা।
- মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য সহায়তা প্রদান করা।
মাদকাসক্তির প্রতিকারের জন্য বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে। মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে তার শারীরিক ও মানসিক সমস্যাগুলি সমাধানের জন্য এই চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলির সাহায্য নেওয়া উচিত।
উপসংহার
“প্যাথিড্রিন, হেরোইন, নেশার আস্তানা,
দুমড়ে মুচড়ে দিতে ধরো হাতখানা
চলো প্রতিরোধ গড়ে তুলি প্রতিবিশ্বের প্রান্তর জুড়ে
মরণ আসে যদি তবু পিছু ফেরোনা।”
মাদকদ্রব্যের ব্যবহার এখন সারাবিশ্বে জাতীয় একটি সমস্যা। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী, মুনাফালোভী, ক্ষমতাধারী রাজনীতিবিদ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা এরাই মাদকদ্রব্য ভয়াবহ আকারের জন্য দায়ী। যদি সবাই সচেতন হয়ে এদের বিরুদ্ধে দাড়ায় তাহলে মাদকদ্রব্য প্রতিরোধ করা সম্ভব। সবাই মিলে একসাথে কাজ করলে তবেই মাদকদ্রব্য পুরোপুরি ভাবে নির্মুল করা সম্ভব।