প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা আজকে আমরা হাজির হয়েছি খুবই গুরু্বপূর্ণ একটা রচনা “শেখ রাসেল” নিয়ে। প্রয়োজনীয় উক্তি – কবিতা সহকারে রচনাটি ২০+ পয়েন্টে ২৫০০+ শব্দে লেখা, যেন শিক্ষার্থীরা একবার পড়েই রচনাটি মাথায় রাখতে পারে।
শেখ রাসেল – রচনা
ভূমিকা
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়। এই দিনে স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের শিকার হন বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলও। মাত্র ১০ বছর ১০ মাস বয়সেই তিনি নির্মমভাবে নিহত হন। শেখ রাসেল ছিলেন একজন প্রাণবন্ত ও উচ্ছ্বল শিশু। তিনি খুবই চঞ্চল ও দুরন্ত ছিলেন। শেখ রাসেল ছিলেন একজন অমিত সম্ভাবনাময় শিশু। তিনি যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে হয়তো বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিতেন। কিন্তু ঘাতকদের হাতে তার জীবনাবসান হয়। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ হারায়।
শেখ রাসেলের জন্ম
শেখ রাসেলের জন্ম ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর। তখন হেমন্তকাল। নবান্নের নতুন ফসলের উৎসবে আগমন নতুন অতিথির। ধানমণ্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর রোডের বাসায় শেখ হাসিনার (আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী) কক্ষেই রাত দেড়টায় জন্ম হয় শেখ রাসেলের। রাসেলের আগমনে পুরো বাড়িতে বয়ে যায় আনন্দের জোয়ার। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে শিশু রাসেল সর্বকনিষ্ঠ। রাসেলের যেদিন জন্ম হয় বঙ্গবন্ধু সেদিন ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে প্রচারে অংশগ্রহণের জন্য চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন।
শেখ রাসেলের নামকরণ
বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক ও মানবতাবাদী নেতা। তিনি সবসময়ই বিশ্বশান্তি ও সহাবস্থানের পক্ষে ছিলেন। এই আদর্শের অনুসারী হিসেবে তিনি বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত ছিলেন। বার্ট্রান্ড রাসেল ছিলেন একজন আন্তর্জাতিক যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনের নেতা। তিনি তার লেখনি ও বক্তৃতায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তার এই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তার কনিষ্ঠ পুত্রের নাম রাখেন শেখ রাসেল।
শেখ রাসেলের ছেলেবেলা
শিশু রাসেলের জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে বাবাকে ছাড়াই। কারণ তার বাবা রাজনৈতিক বন্দী হয়ে কারাগারে ছিলেন দীর্ঘদিন। বাবাকে দেখতে না পেয়ে মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে আব্বা বলে সম্বোধন করতেন রাসেল। এই চাপা কষ্ট যেমন অনুভব করতেন ছোট্ট শিশু রাসেল ঠিক তেমনি তার বাবা বঙ্গবন্ধুও। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে তাঁর ভেতরের কষ্টের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনের পর থেকেই রাজবন্দী হিসেবে জেলে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কারাগারে দেখা করার সময় রাসেল কিছুতেই তার বাবাকে রেখে আসবে না। এ কারণেই তার মন খারাপ থাকত। তার পড়াশোনা শুরু হয়েছিল ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল ও কলেজে । ১১ বছর বয়সে যখন তার মৃত্যু হয় তখন তিনি সেখানকারই চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন ।
শেখ রাসেলের চঞ্চলতা
শেখ রাসেল ছিলেন একজন দুরন্ত ছেলে। তার দুরন্তপনার সঙ্গী ছিল বাই-সাইকেল। তিনি রাষ্ট্রীয় প্রটোকল ছাড়াই সাইকেলে করে স্কুলে যেতেন পাড়ার আর দশজন সাধারণ ছেলের মতো।
বিখ্যাত সাংবাদিক এ বি এম মূসার স্মৃতিকথায় রাসেল সম্পর্কে যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তাতে রাসেল চরিত্রের দুরন্তপনার একটি জীবন্ত চিত্র ফুটে উঠেছে। রাসেল বিকেলে লেকের পূর্বপাড়ে এতটাই দুরন্ত হয়ে উঠতেন যে তার মা উদ্বিগ্ন হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতেন।
রাসেলের জন্মের পর বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সময়ে নানা কারণে জেলবাস করেছেন। তাই শিশু রাসেলের বাবার সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ খুব কমই হয়েছে। রাসেলের সবচেয়ে প্রিয় সঙ্গী ছিলেন তার হাসুপা (মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা)। শৈশবে রাসেল যখনই বাবাকে কাছে পেত, সারাক্ষণ তার পাশে ঘোরাঘুরি করত। খেলার ফাঁকে ফাঁকে বাবাকে এক পলকের জন্য হলেও দেখে আসত। এরই মধ্যে জন্ম হয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের। জয়কে পেয়ে তো রাসেল মহাখুশি। সে তার খেলার নতুন এক সঙ্গী পেয়েছে। সারাটা সময় জয়ের সঙ্গে মেতে থাকত রাসেল। রাসেলের মাছ ধরার খুব শখ ছিল, কিন্তু সে মাছ ধরে আবার তা পুকুরেই ছেড়ে দিত। এতেই সে মজা পেত। বঙ্গবন্ধুর বাসায় একটি পোষা কুকুর ছিল টমি নামে। ছোট্ট রাসেল টমিরও সঙ্গে খেলত। এভাবে কেটে যাচ্ছিল শেখ রাসেলের দিনগুলো।
জেনারেল রাসেল ও তার বাহিনী
শেখ রাসেলের নেতৃত্ব সুলভ আচরন তার শৈশব থেকেই লক্ষ্য করা যায়। ঢাকায় তার খেলার সাথী তেমন একটা ছিল না। কিন্তু যখন তারা টুঙ্গিপাড়ায় বেড়াতে যেত, সেখানে তার খেলার সাথী ছিল অনেক। সে সেই বাচ্চাদের জড়ো করতো এক জায়গায়, তাদের জন্য খেলনা বন্দুক বানাতো আর সেই বন্দুক হাতেই তাদের প্যারেড করাতো। এটি তার নেতৃত্ব গুণের একটি স্পষ্ট প্রকাশ। রাসেলের খুদে বাহিনীর জন্য জামা-কাপড় ঢাকা থেকেই কিনে দিতে হতো। প্যারেড শেষে সবার জন্য খাবারের ব্যবস্থা থাকতো। এটি রাসেলের নেতৃত্ব গুণের আরেকটি প্রকাশ। তিনি ছিলেন একজন দায়িত্বশীল নেতা। তিনি তার বাহিনীর সদস্যদের খেয়াল রাখতেন।
রাসেলের পরিবেশটাই ছিল এমন। তিনি একজন নেতার সন্তান ছিলেন। তার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের জাতির পিতা। রাসেলের মা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবও একজন আদর্শ নারী ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন সমাজসেবক ও মানবতার দূত।
রাসেল যখন বড় হয়ে তুমি কি হবে?
এমন প্রশ্নের উত্তরে বলতেন,
“আমি অফিসার হবো”।
তিনি একজন দেশপ্রেমিক ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন একজন অফিসার হয়ে দেশের সেবা করতে।
রাসেলের জীবনে বঙ্গমাতার অবদান
বয়সে অনেক ছোট হলেও শেখ রাসেলের হৃদয়টা ছিল অনেক বড় ও উদার। বিশেষ করে সাধারণ মানুষের প্রতি ছিল তার প্রগাঢ় ভালোবাসা। শিশু বয়সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর মানসিকতা ছিল তার মধ্যে। রাসেলের এই গুণাবলীগুলির পেছনে বঙ্গমাতার অবদান ছিল অপরিসীম। বঙ্গমাতা ছিলেন একজন শিক্ষিত ও সচেতন নারী। তিনি তার সন্তানদেরকে ছোটবেলা থেকেই ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তিনি তাদেরকে নৈতিক শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি তাদেরকে শিখিয়েছেন কিভাবে ভালো মানুষ হতে হয়।
বঙ্গমাতা রাসেলের শিক্ষা ও দীক্ষায় একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন রাসেল একজন দেশপ্রেমিক, মানবতাবাদী ও ন্যায়পরায়ণ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠুক। বঙ্গমাতার অবদানের ফলে রাসেল আজও বাঙালি জাতির হৃদয়ে অম্লান হয়ে আছে। তার স্মৃতি আজও বাঙালি জাতির অনুপ্রেরণা।
শেখ রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু
কারাগারের রোজনামচায় ১৯৬৬ সালের ১৫ জুনের দিনলিপিতে রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না- যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতোই ‘আব্বা আব্বা’ বলে চিৎকার করছে। জেল গেট দিয়ে একটা মাল বোঝাই ট্রাক ঢুকেছিল। আমি তাই জানালায় দাঁড়াইয়া ওকে আদর করলাম। একটু পরেই ভিতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে ‘আব্বার বাড়ি’। এখন ধারণা হয়েছে এটা ওর আব্বার বাড়ি। যাবার সময় হলে ওকে ফাঁকি দিতে হয়।” ছোট থেকে বাবা শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগারে দেখতে দেখতে বড় হওয়া রাসেল অজান্তেই চাপা স্বভাবের হয়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে বিষয়ে বক্তৃতায় বলেন, ‘খুব চাপা স্বভাবের ছিল। সহজে নিজের কিছু বলত না। তার চোখে যখন পানি, চোখে পানি কেন জানতে চাইলে বলত, চোখে যেন কী পড়েছে। ওইটুকু ছোট বাচ্চা, নিজের মনের ব্যথাটা পর্যন্ত কীভাবে লুকিয়ে রাখতে হয় শিখেছিল।’
গৃহবন্দী শেখ রাসেল
১৯৭১ সালে রাসেল তাঁর মা ও দুই আপাসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ধানমণ্ডি ১৮ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে বন্দি জীবন কাটিয়েছেন। পিতা বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি এবং বড় দুই ভাই শেখ কামাল ও শেখ জামাল চলে গেছেন মুক্তিযুদ্ধে। পাকিস্থানি সেনারা সেই বাসায় বাঙ্কার বানিয়েছিল। রাসেল অত্যন্ত মেধাবী ছিল। পাকসেনারা তাদের অস্ত্রশস্ত্র পরিস্কার করত। ও জানালায় দাঁড়িয়ে সব দেখত। অনেক অস্ত্রের নামও শিখেছিল। যখন এয়ার রেইড হতো তখন পাকসেনারা বাংকারে ঢুকে যেত আর আমরা তখন বারান্দায় বের হওয়ার সুযোগ পেতাম। আকাশে যুদ্ধবিমানের ‘ডগ ফাইট’ দেখারও সুযোগ হয়েছিল। প্লেন দেখা গেলেই রাসেল খুশি হয়ে হাতে তালি দিত। মা ও আপাসহ পরিবারের সদস্যরা ১৯৭১ সালের ১৭ই ডিসেম্বর মুক্ত হন। রাসেল ‘জয় বাংলা’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। বাইরে তখন চলছে বিজয়-উৎসব।
আমাদের ছোট রাসেল সোনা
‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইয়ের ২১ পৃষ্ঠায় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাত করতে যাওয়ার বিষয়ে শেখ হাসিনা লিখেছেন, “আব্বার সঙ্গে প্রতি ১৫ দিন পর আমরা দেখা করতে যেতাম। রাসেলকে নিয়ে গেলে ও আর আসতে চাইত না। খুবই কান্নাকাটি করত। ওকে বোঝানো হয়েছিল যে, আব্বার বাসা জেলখানা আর আমরা আব্বার বাসায় বেড়াতে এসেছি। আমরা বাসায় ফেরত যাব। বেশ কষ্ট করেই ওকে বাসায় ফিরিয়ে আনা হতো। আর আব্বার মনের অবস্থা কী হতো, তা আমরা বুঝতে পারতাম। বাসায় আব্বার জন্য কান্নাকাটি করলে মা ওকে বোঝাতেন এবং মাকে আব্বা বলে ডাকতে শেখাতেন। মাকেই আব্বা বলে ডাকত।” ওই বইয়ে শেখ হাসিনা আরও লিখেছেন, আব্বা ওর জন্মের পরপরই জেলে চলে গেলেন।৬ দফা দেওয়ার কারণে আব্বাকে বন্দি করল পাকিস্তানি শাসকরা। রাসেলের বয়স তখন মাত্র দেড় বছরের কিছু বেশি। কাজেই তার তো সব কিছু ভালোভাবে চেনার বা জানারও সময় হয়নি। রাসেল আমাদের সবার বড় আদরের; সবার ছোট বলে ওর আদরের কোনও সীমা নেই। ও যদি কখনও একটু ব্যথা পায় সে ব্যথা যেন আমাদের সবারই লাগে। আমরা সব ভাইবোন সব সময় চোখে চোখে রাখি, ওর গায়ে এতটুকু আঁচড়ও যেন না লাগে। কী সুন্দর তুলতুলে একটা শিশু। দেখলেই মনে হয় গালটা টিপে আদর করি।
লিখেছেন তার জন্মের সময়ের কথা, রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিল ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা কাকা বাসায়। বড় ফুফু ও মেজ ফুফু মার সাথে। একজন ডাক্তার এবং নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আর জেগে ওঠে। আমরাও ঘুমে ঢুলঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমনবার্তা শোনার অপেক্ষায়।
মেজ ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখব। ফুফু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালো চুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড়সড় হয়েছিল রাসেল।
শেখ রাসেলের নির্মম হত্যাকাণ্ড
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ঘটনায় মাত্র ১০ বছর বয়সী শেখ রাসেলও নির্মমভাবে নিহত হন। এই হত্যাকাণ্ডটি বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায়। শেখ মুজিবের নির্দেশে রাসেলকে নিয়ে পালানোর সময় ব্যক্তিগত কর্মচারীসহ রাসেলকে অভ্যুত্থানকারীরা আটক করে। আতঙ্কিত হয়ে শিশু রাসেল কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, “আমি মায়ের কাছে যাব”।
পরবর্তীতে মায়ের লাশ দেখার পর অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে মিনতি করেছিলেন “আমাকে হাসু আপার (শেখ হাসিনা) কাছে পাঠিয়ে দাও”।
ব্যক্তিগত কর্মচারী এএফএম মহিতুল ইসলামের ভাষ্যমতে,
“রাসেল দৌড়ে এসে আমাকে জাপটে ধরে। আমাকে বললো, ভাইয়া আমাকে মারবে না তো? ওর সে কণ্ঠ শুনে আমার চোখ ফেটে পানি এসেছিল। এক ঘাতক এসে আমাকে রাইফেলের বাট দিয়ে ভীষণ মারলো। আমাকে মারতে দেখে রাসেল আমাকে ছেড়ে দিল। ও (শেখ রাসেল) কান্নাকাটি করছিল যে ‘আমি মায়ের কাছে যাব, আমি মায়ের কাছে যাব’। এক ঘাতক এসে ওকে বললো, ‘চল তোর মায়ের কাছে দিয়ে আসি’। বিশ্বাস করতে পারিনি যে ঘাতকরা এতো নির্মমভাবে ছোট্ট সে শিশুটাকেও হত্যা করবে। রাসেলকে ভিতরে নিয়ে গেল এবং তারপর ব্রাশ ফায়ার।
শেখ রাসেল হোক শিশুদের অনুপ্রেরণা
শেখ রাসেলের এই ছোট্ট জীবন আমাদের জন্য অনেক শিক্ষণীয়। প্রথমত, আমাদের শিশুরা যদি শেখ রাসেলকে আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করে তার মতো বেড়ে ওঠে, তাহলে আমরা আদর্শ শিশু পাব। যাদের হাত ধরে বিনির্মিত হবে আগামী দিনের চেতনার নাগরিক। শিশুদের তাই শেখ রাসেলের ছোট্ট জীবনটা জানাতে হবে। যাতে শিশুরা অনাবিল সুন্দরের সৌন্দর্যে বেড়ে ওঠে, হাসতে পারে, খেলতে পারে, দুষ্টুমি করতে পারে, বন্ধুত্ব করতে পারে, গরিব মানুষকে ভালোবাসতে পারে। কবি দিপংকর দাশের কথায়,
প্রজাপতির মতো
শেখ রাসেলের মিষ্টি মুখে
রঙিন স্বপ্ন ভাসতো
সুখে দুঃখ ভুলে শত।
এভাবে যদি প্রতিটি শিশু বেড়ে ওঠে তাহলে এই শিশুরা বড় হয়ে আলোকিত মানুষ হতে পারে। এ কারণেই শেখ রাসেলের জীবন আমাদের জানাটা অত্যন্ত জরুরি।
শেখ রাসেল দিবস
শেখ রাসেলের সম্মানে প্রতি বছর তার জন্মদিন ১৮ অক্টোবর, শেখ রাসেল দিবস পালিত হয়। শেখ রাসেল দিবস পালনের উদ্দেশ্য হল শেখ রাসেলের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে শিশু-কিশোরদের কাছে তুলে ধরা। এই দিবসের মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে দেশপ্রেম, মানবতাবোধ, সৃজনশীলতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।
শেখ রাসেল দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে। শেখ রাসেলসহ ১৫ আগস্টে নিহত সব শহীদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ, ফাতেহা পাঠ, মিলাদ, দোয়া মাহফিল, চিত্রাঙ্কন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, র্যালি সহ বিচিত্র অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
শেখ রাসেল কে নিয়ে সাহিত্য কর্ম
বাংলা শিশুসাহিত্যের বড় একটি অংশজুড়ে আছে শেখ রাসেল। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মহান মুুক্তিযুদ্ধ এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যে রকম শিশুসাহিত্য রচিত হয়েছে ঠিক একইভাবে সাহিত্য রচিত হয়েছে শেখ রাসেলকে নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তার ছোট ভাইকে নিয়ে লিখেছেন- ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ নামে একটি বই। এছাড়াও শেখ রাসেল কে নিয়ে কিছু বই-
১। বঙ্গবন্ধু ও শেখ রাসেল- রঞ্জনা বিশ্বাস।
২। বাঙ্গালির হৃদয়ে শেখ রাসেন- ড আনু মাহমুদ।
৩। শেখ রাসেলের জন্য ভালোবাসা- নুহু আব্দুল্লাহ
৪। তাসেল তার আব্বুর হাত ধরে হেঁটে যায়- আনোয়ারা সৈয়দ হক।
৫। রাসেলের জন্য অপেক্ষা- সেলিনা হোসেন
৬। শেখ রাসেল কে লেখা চিঠি- লুতফর রহমান রিটন
বাংলা সাহিত্যে ইতোমধ্যে প্রায় দুই শতাধিক বই শেখ রাসেলকে নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। শেখ রাসেল বিশ্ব শিশুর প্রতীক। শেখ রাসেলকে স্মরণ করা মানে বিশ্বের প্রতিটি শিশুকে স্মরণ করা।
শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব
শেখ রাসেলকে স্মরণীয় করে রাখতে বাংলাদেশ সরকার ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে “শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব” প্রকল্পের উদ্যোগ নেয়। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সারাদেশে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও মাদ্রাসা বা তদূর্ধ্ব পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ও ভাষা প্রশিক্ষণ ল্যাব স্থাপন করা হয়।
শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবগুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য কম্পিউটার, প্রজেক্টর, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, লাইব্রেরি, ইন্টারনেট সংযোগ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম প্রদান করা হয়। এই ল্যাবগুলোতে শিক্ষার্থীরা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।
শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আইসিটি শিক্ষার প্রসার ঘটছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা আইসিটি দক্ষতা অর্জন করে ভবিষ্যতে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে উঠতে পারছে।
শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্র
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে একটি উজ্জ্বল নাম শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্র। শেখ রাসেলের স্মৃতিকে চিরন্তন করে রাখতে এটি গঠিত হয়। তার খেলাধুলার প্রতি ভালোবাসাকে ধারণ করেই এই ক্রীড়াচক্র গড়ে উঠেছে।শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্র শুধু একটি ক্লাব নয়, এটি শেখ রাসেলের স্বপ্নেরই ধারক। এই ক্লাব বিভিন্ন জাতীয় পর্যায়ের খেলায় অংশগ্রহণ করে যাচ্ছে, বিশেষ করে ক্রিকেট, ফুটবল ও হকি খেলায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। তরুণ প্রতিভাদের উন্নয়নে কাজ করে এই ক্লাব ক্রীড়াঙ্গনে, ভবিষ্যৎ তারকাদের তৈরি করছে।
শেখ রাসেল ফান্ড
শেখ রাসেলের স্মৃতি চিরন্তন করে রাখার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় শেখ রাসেল ফান্ড। মাত্র ১০ বছর বয়সে অকালমৃত্যু গ্রাস করলেও রাসেলের স্বপ্ন ও মানবতার প্রতি দায়বদ্ধতা এই ফান্ডের মাধ্যমে চিরস্থায়ী হয়ে আছে।
এই অলাভজনক সংস্থাটি সুবিধাবঞ্চিত শিশু, এতিম, দুঃস্থ মানুষ এবং সমাজের অবহেলিতদের হাতছানি হয়ে এসেছে। তাদের কাজের ক্ষেত্রে রয়েছে:
- এতিম শিশুদের পুনর্বাসন: আশ্রয়স্থল, শিক্ষা ও জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করে অবহেলিত শিশুদের জীবনে আলো ছড়ানো।
- দুঃস্থ পরিবারের সহায়তা: আর্থিক সহায়তা, খাদ্য সরবরাহ, চিকিৎসা সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে তাদের দুঃখের হাতছানি করা।
- শিক্ষা সহায়তা: মেধাবী ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বৃত্তি প্রদান, শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করে তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়ার পথ উন্মোচন করা।
- স্বাস্থ্য সেবা: দুঃস্থ এলাকায় বিনামূল্যে চিকিৎসা শিবির, স্বাস্থ্য সচেতনতা कार्यक्रम পরিচালনা করে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবার দুয়ার খোলা রাখা।
- প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা: প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ, পুনর্বাসন কাজে সহায়তা করে দুঃসময়ে পাশে দাঁড়ানো।
শেখ রাসেল ফান্ড দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তাদের কার্যক্রম ছড়িয়ে দিয়েছে। তাদের কাজের স্পর্শে জীবন আলোকিত হয়েছে অনেক সুবিধাবঞ্চিত শিশু, এতিম ও দুঃস্থ মানুষের। শেখ রাসেলের স্মৃতি অনুসরণ করে সমাজের উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এই ফান্ড।
শেখ রাসেল পদক
শেখ রাসেলের নামে প্রতিবছর ১৮ অক্টোবর তার জন্মবার্ষিকীতে অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়সী বাংলাদেশী শিশু-কিশোর এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহকে উৎসাহ ও উদ্দীপনা যোগানো এবং স্বীকৃতি প্রদানের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে “শেখ রাসেল পদক” প্রদান করা হয়। পদক হিসেবে দেওয়া হবে এক ভরি ওজনের স্বর্ণ।
পদক প্রাপ্তির বিষয় সমুহঃ
- শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
- ক্রীড়া
- বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু-কিশোর
- শিল্পকলা ও সংস্কৃতি
- খুদে প্রোগ্রামার
- খুদে উদ্ভাবক
- খুদে লেখক
- ডিজিটাল স্কুল
- ডিজিটাল এক্সিলেন্স
এই পদকপ্রাপ্ত শিশু-কিশোররা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব দিবে। তারা তাদের মেধা, প্রতিভা ও সাফল্যে দেশের জন্য গৌরব বয়ে আনবে।
আজকে যদি রাসেল বেচে থাকত
যদি শেখ রাসেল বেঁচে থাকতেন, তাহলে আজ তিনি একজন প্রবীণ নেতা ও রাজনীতিবিদ হতেন। বেঁচে থাকলে আজ শেখ রাসেলের বয়স হতো ৬০ বছর। তিনি হয়তো তার বাবার মতোই একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হতেন। তিনি হয়তো বাংলাদেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতেন।
শেখ রাসেল নিজেকে কীভাবে গড়ে তুলত, তা বলার উপায় নেই। তবে পারিবারিক ঐতিহ্য, আদর্শের উত্তরাধিকার তার চরিত্র গঠনে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত, তাতে সন্দেহ নেই। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, অন্তত এই দেশ, দেশের মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ থাকত তার অন্তর ও চেতনাজুড়ে। পরিণত হয়ে উঠত দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য। তার আগ্রহের বিষয়গুলো আয়ত্ত করে সেখানে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখতে পারত। সেটিই স্বাভাবিক ছিল তার জন্য। আজ রাসেল থাকলে একজন মেধাবী মানুষ বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার সংগ্রামে থাকত প্রথম সারিতে।
উপসংহার
শেখ রাসেলের জীবন ছিল অল্পায়ু, কিন্তু অসীম উজ্জ্বল। যেন ঝলমলে একটি শিখা, দ্রুত জ্বলে উঠে আবার নিবে গেছে। কিন্তু সেই নিবে যাওয়ার আগেই, সে ছড়িয়ে দিয়েছে এমন আলো, যা আজও বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের অনুপ্রেনিত করে। তার শারীরিক উপস্থিতি হয়তো আর নেই, কিন্তু তার স্মৃতি আছে। কবির কথায়,
নিষ্পাপ মুখ জড়িয়ে থাকে স্মৃতির ভাঁজে ভাঁজে,
শেখ রাসেলের জন্যে মনে ব্যথার সুরই বাজে।
তাই, আমি ১৯৭৫ সালের আগস্ট ইতিহাসের জঘন্যতম নির্মম হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানাই এবং শিশু রাসেলসহ সেই হত্যাকাণ্ডের সব শহিদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি।
শেখ রাসেল রচনা পিডিএফ
প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা, তোমাদের সুবিধার্থে, রচনার পিডিএফ কপিটি দেওয়া হল। এখনই ডাউনলোড করে তোমারদের ফোনে/পিসিতে রেখে দাও।