প্রিয় শিক্ষার্থীরা আমাদের আজকের রচনা ‘স্বদেশ প্রেম ‘। আজকের এই রচনাটি ২০ টি পয়েন্টে প্রায় ২৫০০+ শব্দে লেখা হয়েছে যেন পরীক্ষার্থীরা একবার পরেই নিজের মতো করে লিখতে পারে। রচনাটিতে প্রাসঙ্গিক অনেকগুলি উক্তি ও কবিতা ব্যবহার করা হয়েছে যা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় সর্বাধিক নম্বর অর্জনে সাহায্য করবে। রচনাটি সহ যে কোন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য অত্যান্ত গুরুপ্তপূর্ণ।
স্বদেশ প্রেম – রচনা
ভূমিকা
দেশের মাটির গন্ধে মেশানো আছে স্বদেশ প্রেমের অমৃত সুর। এই সুর যে কেবল কণ্ঠে গাওয়া হয় তা নয়, বরং প্রতিটি নিঃশ্বাসে, প্রতিটি অনুভবেই ঝংকৃত করে। আমাদের জীবনে স্বদেশের অবদান অপরিসীম, অপরিমেয়। এটি শুধু একটি ভৌগোলিক সীমানা নয়, এটি আমাদের অস্তিত্বের পরিচয়, আমাদের মনের মন্দিরে সর্বদা পূজিত প্রতিমা। ইতিহাস বুকে লেখা আছে, কীভাবে মানুষ স্বদেশের প্রেমে উন্মাদিত হয়ে জীবন উৎসর্গ করেছে। বাংলার ইতিহাসেও এমন বীরদের কাহিনী অসংখ্য। স্বাধীনতার স্বপ্নকে বুকে জড়িয়ে বাঙালি জাতি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তেমনি, ১৯৭১ সালেও একই গল্প। পাকিস্তানি বাহিনীর অমানুষিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে অস্ত্র তুলেছিল। স্বদেশের মাটির প্রতি শ্রদ্ধা, ভাষার প্রতি ভালোবাসা, মাতৃভূমির মুক্তির তৃষ্ণা – এই ত্রিশূল হাতে নিয়ে বাঙালি জাতি জিতেছিল ৯ মাসের যুদ্ধ, জিতেছিল স্বাধীনতার সোনালী সূর্য। স্বদেশের প্রতি প্রেমের এই নিতান্ত সত্য দিকটি এডুইন আর্নলেন্ডের ভাষায় চমৎকার ফুটে উঠে,
“জীবনকে ভালোবাসি সত্য, কিন্তু দেশের চেয়ে বেশি নয়।”
তাই স্বদেশপ্রেম একটি অন্তরের আহ্বান, একটি ঋণ, একটি অবিনাশী আগুন। এই আগুন জ্বালিয়ে রাখা আমাদের সবারই দায়িত্ব। কারণ, স্বদেশ ছাড়া আমাদের কোনো অস্তিত্ব নেই, কোনো পরিচয় নেই।
স্বদেশ প্রেমের স্বরূপ
স্বদেশপ্রেম হল নিজের দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও কর্তব্যবোধ। স্বদেশপ্রেম আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি আমাদের ঐক্যবদ্ধ করে, আমাদেরকে দেশপ্রেমিক করে তোলে।
স্বদেশ প্রেমকে বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। কেউ কেউ মনে করেন যে, স্বদেশপ্রেম হল দেশের ভৌগোলিক সীমানা, ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি ভালোবাসা। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, স্বদেশপ্রেম হল দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য কাজ করা। সে উপলব্ধি করে কবি লিখেছেন –
“মিছা মণি-মুক্তা হেম স্বদেশের প্রিয় প্রেম তার চেয়ে রত্ন নাই আর।”
স্বদেশ প্রেমের উৎস
স্বদেশপ্রেমের একক উৎস নেই, এটি একটি নদীর মতোই, বিভিন্ন উপনদীর সমন্বয়ে গঠিত। এটি একটি আত্মিক সংযোগ, পূর্বপুরুষের ইতিহাস, পরিবার ও সমাজের আদর্শ, দায়বদ্ধতা, এবং ভাষা ও সংস্কৃতির রঙে রাঙা হয়ে এই প্রেমের নদী প্রবাহিত হয়।
জন্মভূমির মাটির গন্ধ, মধুর ভাষা, পূর্বপুরুষের গৌরবময় ইতিহাস – এগুলোই স্বদেশপ্রেমের প্রথম ফোঁটা। তারপর শিক্ষার মাধ্যমে সেই ফোঁটাগুলো স্মৃতির সাগরে পরিণত হয়। দেশের প্রকৃতি ও পরিবেশ দেশপ্রেমের আরেক প্রধান উৎস, তাইতো কবি বলেছেন,
“সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে সার্থক জনম মাগো তোমায় ভালোবেসে। “
আমাদের দেশের প্রকৃতি অপরূপ সুন্দর। সুজলা-সুফলা, শস্যশ্যামলা এই দেশ যেন একটি স্বর্গরাজ্য। সবুজ শ্যামল মাঠ, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, সাগর-মহাসাগর, সবকিছুই আমাদের হৃদয়ে দেশপ্রেমের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে।
স্বদেশপ্রেমের উপায়
স্বদেশপ্রেম আমাদের অস্তিত্বের সাথে জড়িত এক গভীর অনুভূতি। এটি কেবল কথায় বললেই হবে না, কাজের মধ্যে ফুটে উঠতে হবে।
স্বদেশপ্রেমের উপায় সমূহ:
ক) দেশের আইন ও নিয়ম মেনে চলা: আমাদের দেশের আইন ও নিয়ম মেনে চলা আমাদের দেশের প্রতি শ্রদ্ধার প্রকাশ। এটি আমাদের দেশকে একটি শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনে সাহায্য করবে।
খ) জ্ঞান অর্জন: আমাদের দেশের ইতিহাস, ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা। এটি আমাদের দেশকে আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করবে এবং আমাদের দেশপ্রেমকে আরও শক্তিশালী করবে।
গ) সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ: দেশের দরিদ্র, অসহায় ও বঞ্চিত মানুষদের সাহায্য করা এবং সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করা আমাদের দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ একটি সেরা উপায়।
ঘ) দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষা করা: আমাদের দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষা করা এবং ভবিষ্যৎ ঙ) দেশের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চা করা: আমাদের দেশের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চা করা এবং সেগুলো বিশ্বের কাছে তুলে ধরা আমাদের দেশপ্রেমের প্রকাশের আরেকটি উপায়।
চ) দেশের পণ্য ব্যবহার করা: যতটা সম্ভব আমাদের দেশের তৈরি পণ্য ব্যবহার করা আমাদের দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে।
আমরা আরও নানান পন্থায় আমাদের দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারি এবং সেই সাথে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারি। স্বদেশপ্রেমের পথ চলা শেষ হয় না, এটি একটি অবিরাম যাত্রা। আমাদের প্রতিটি নিঃশ্বাসে, প্রতিটি পদক্ষেপে এই দেশের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা ফুটে উঠুক।
স্বদেশ প্রেমের শিক্ষা
স্বদেশপ্রেমের শিক্ষা হল একটি গাছের মতো, যার শেকড় দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে গভীরভাবে গেঁথে আছে। এই শিক্ষা কেবল দেশের প্রতি ভালোবাসা নয়, বরং সেই ভালোবাসাকে জীবনে কাজে লাগানোর উপায় বাতলে দেয়। এটি আমাদেরকে দেশের অতীত সম্পর্কে জানতে, বর্তমানে দায়িত্ব পালন করতে, এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথ তৈরি করতে উৎসাহিত করে।
আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পাতায় লেখা পূর্বপুরুষদের ত্যাগ, সংগ্রাম ও সাফল্য আমাদের হৃদয়ে দেশপ্রেমের বীজ বপন করে। শিক্ষা ও সংস্কৃতি সেই বীজকে গাছের রূপে গড়ে তোলে। সামাজিক মূল্যবোধের আলোকিত পথে এই গাছ বেড়ে ওঠে, আর পরিবেশ সচেতনতার সারে পুষ্ট হয়।
এই গাছের ফল আমাদের জীবনে সাফল্য রুপে ধরা দেয়।
তাই, স্বদেশপ্রেমের শিক্ষা হলো আমাদের জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি, ভবিষ্যৎ গঠনের শক্তি, এবং ব্যক্তিগত উন্নতির চালিকা শক্তি। এই শিক্ষাকে আমরা বুকে ধরে রাখি, জীবনে কাজে লাগাই, এবং আগামী প্রজন্মের হাতে তুলে দেই সুন্দর দেশ।
স্বদেশপ্রেম ও রাজনীতি
স্বদেশপ্রেম ও রাজনীতির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব আমাদের স্বাধীনতার এক জ্বলন্ত উদাহরণ। তিনি রাজনৈতিক সংগ্রামের মাধ্যমেই আমাদের মাতৃভূমিকে স্বাধীন করে দিয়েছেন। তাই, স্বদেশপ্রেমের প্রকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট থাকা। কিন্তু, বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই রাজনীতির প্রতি উদাসীন। তাদের ধারণা, রাজনীতি হলো দুর্নীতি ও ক্ষমতার খেলা। কিন্তু, এই ধারণা ভুল। রাজনীতি আসলে হলো আমাদের সমাজ ও দেশকে গঠন করার একটি প্রক্রিয়া। এটি আমাদের অধিকার, সুযোগ-সুবিধা, এবং নীতি-নৈতিকতা নির্ধারণ করে দেয়।
রাজনৈতিক সচেতনতার অর্থ কেবল শুধুমাত্র ভোট দেওয়া নয়। আমাদের সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক আলোচনায় ও বিতর্কে অংশগ্রহণ করা উচিত। আমাদের সরকারের কাছে আমাদের চাহিদা ও অভিযোগ তুলে ধরা উচিত। তাই, আসুন, সবাই মিলে রাজনীতির প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করি। রাজনীতিকে আমাদের দেশ গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে গ্রহণ করি।
ছাত্র জীবনে স্বদেশ প্রেমের শিক্ষা
ছাত্রজীবন স্বদেশপ্রেমের শিক্ষা গ্রহণের সুবর্ণ সময়। এটি কেবল নিজের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের সময় নয়, দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ভিত্তি তৈরিরও সময়। এই মূল্যবান সময়ে স্বদেশপ্রেমের শিক্ষা আমাদেরকে কেবল ভালো মানুষই নয়, দায়িত্বশীল ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে।
ইতিহাস ও ঐতিহ্য অধ্যয়ন, শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চা, সামাজিক সেবায় অংশগ্রহণ, এবং নৈতিকতা বজায় রাখা – এই পথে হাঁটতে হাঁটতে আমরা দেশের প্রতি আবেগ জাগিয়ে তুলি এবং দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারি। ফলে আমরা সহনশীল, দায়িত্বশীল নাগরিকে পরিণত হতে পারি।
নেলসন ম্যান্ডেলা, মহাত্মা গান্ধী, শেখ মুজিবুর রহমান – এঁরা সবাই ছাত্রজীবনেই রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন এবং তাদের দেশের জন্য অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। তাই, আসুন, সবাই মিলে ছাত্রজীবনে স্বদেশপ্রেমের শিক্ষাকে গুরুত্ব দিই। নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার পাশাপাশি আমরা যদি দেশের উন্নয়নে নিজেদের নিবেদন করি, তাহলে আমাদের দেশ হয়ে উঠবে আরও সুন্দর, আরও উন্নত, আরও সম্রিধ।
সাহিত্যের আয়নায় স্বদেশপ্রেম
সাহিত্য স্বদেশপ্রেমের আয়না। ঠিক যেমন আয়না আমাদের চেহারা প্রতিফলিত করে, সাহিত্যও আমাদের মাতৃভূমির প্রতি অনুভূতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, এবং সংস্কৃতিকে জীবন্ত করে তোলে। বই, উপন্যাস, গল্প, কবিতা, নাটক – সবই আমাদের মনের গভীরতম স্তরে স্বদেশপ্রেমের বীজ বপন করে এবং সেই বীজকে ফুটতে সাহায্য করে।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প, কবিতায়, উপন্যাসে তিনি বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মানুষের জীবনযুদ্ধ, এবং স্বদেশপ্রেমের তীব্র অনুভূতি ফুটিয়ে তুলেছেন। “আমার সোনার বাংলা” আমাদের জাতীয় সংগীত, তিনি লিখেছেন। তার এক কবিতায় তিনি লিখেছেন,
ও আমার দেশের মাটি,
তোমার পরে ঠেকাই মাথা।
তোমাতে বিশ্বময়ীর
তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।
- কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় স্বদেশপ্রেমের আগুন জ্বলে।
বল বীর।
চির উন্নত মম শির,
শির নেহারি আমারি নত শির ঐ শিখর হিমাদ্রীর।
“বিদ্রোহী” কবিতায় তিনি স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের আহ্বান জানান, তার কবিতা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ও মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের প্রেয়না যুগিয়েছে।
- জীবনানন্দ দাস কবিতায় বাংলার প্রকৃতির ছবি এঁকেছেন। যা পড়ে আমাদের দেশপ্রেম জাগরিত হয়। কবি দেশপ্রেমে বিমোহিত করে লিখেছেন,
বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি,
তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো, এবং এই সব সময়ই লেখকরা তাদের সৃষ্টির মধ্য দিয়ে স্বদেশপ্রেমের শিখা জ্বালিয়ে এসেছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, আল মাহমুদ, সুফিয়া কামাল, বন্দে আলি মিয়া, সামসুর রহমান সহ শত শত কবি সাহিত্যিকগন আছেন এই তালিকায়।
বাঙালির স্বদেশপ্রেম
বাঙালির স্বদেশপ্রেমের ইতিহাস গৌরবময়। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তিতুমীরের দুর্বার প্রতিরোধ থেকে পলাশির যুদ্ধে সিরাজুদ-দৌলার বিজয়গর্জন, সবই প্রমাণ করে, বাঙালি জাতি স্বাধীনতার জন্য সবসময়ই লড়াই করেছে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রবল অত্যাচারের মধ্যেও বাঙালিদের দৃঢ়তা ম্লান হয়নি। লাখ লাখ শহীদের রক্তে তৈরি এই স্বাধীনতা আমাদের হৃদয়ে চিরকাল স্মরণীয় থাকবে।
এই ইতিহাস শুধু পুরনো কাহিনী নয়, বাঙালির স্বদেশপ্রেম বর্তমানেও প্রতিদিন প্রকাশ পায়। দুর্নীতি, দারিদ্রতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখেও আমরা একসঙ্গে লড়াই করি, এগিয়ে যাই। এই সংহতি, আত্মনির্ভরতা, লড়াই করার দৃঢ়তা আমাদের মাতৃভূমির প্রতি নিষ্ঠারই প্রমাণ।
স্বদেশ প্রেম ও জাতীয় চেতনা
স্বদেশপ্রেম ও জাতীয় চেতনা দুটি একই জিনিসের দুটি দিক। স্বদেশপ্রেম হলো মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা, আর জাতীয় চেতনা হলো সেই ভালোবাসার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এক ধরনের আত্মপরিচয়।
স্বদেশপ্রেম থেকে জাতীয় চেতনার সৃষ্টি হয়। আমরা যখন আমাদের মাতৃভূমির ইতিহাস, সংস্কৃতি, ও ঐতিহ্যের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করি, তখন আমরা নিজেদেরকে সেই মাতৃভূমির সঙ্গে একাত্ম বোধ করি। এই একাত্মবোধ থেকেই জাতীয় চেতনার উদ্ভব হয়।
জাতীয় চেতনা স্বদেশপ্রেমকে আরও শক্তিশালী করে। জাতীয় চেতনা আমাদেরকে আমাদের মাতৃভূমির জন্য লড়াই করার জন্য অনুপ্রাণিত করে। এটি আমাদেরকে আমাদের মাতৃভূমির উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য উদ্বুদ্ধ করে।
সুতরাং, স্বদেশপ্রেম ও জাতীয় চেতনা একে অপরের উপর নির্ভরশীল।
স্বদেশপ্রেম থেকে জাতীয় চেতনা সৃষ্টি হয়,
আর জাতীয় চেতনা স্বদেশপ্রেমকে আরও শক্তিশালী করে।
এক কথায়, স্বদেশপ্রেম হলো একটি জাতির জন্মের ভিত্তি, আর জাতীয় চেতনা হলো সেই ভিত্তি রক্ষার শক্তি।
মাতৃভুমির প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য
মাতৃভূমির প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য কেবল কথায় নয়, কাজে নিহিত। এটা এক আন্তরিক অনুভূতি, যা ছোট ছোট কাজের মাধ্যমে ফুটে ওঠে। দেশের প্রতি আমাদের কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্যঃ
- আইন মান্য করা, নৈতিকতা বজায় রাখা, এবং সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখা।
- বনাঞ্চল সংরক্ষণ, পরিবেশ দূষণ রোধ, এবং পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন করা।
- মাতৃভাষা চর্চা, উৎসব পার্বণ পালন, এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা।
- নিজেকে গড়ে তুলে দক্ষ নাগরিক হওয়া, জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখা।
- দুর্নীতি, অন্যায়, এবং অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং সবাইকে সৎ পথে পরিচালিত করা।
- ধর্ম, জাতি, গোত্রের ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের উন্নয়নে কাজ করা।
- সৎ প্রার্থীকে নির্বাচন করা এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে জবাবদিহিতা আদায় করা।
- দেশের অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশের ভবিষ্যৎ গঠনে কাজ করা।
- প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ বা অন্য কোনো বিপদকালে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেশের জন্য কাজ করা।
এই কয়েকটি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে আমরা প্রত্যেকেই মাতৃভূমির জন্য অবদান রাখতে পারি এবং একে আরও সুন্দর, আরও উন্নত রুপে গড়ে তুলতে পারি।
স্বদেশ প্রেমের দৃষ্টান্ত
বাংলাদেশের ইতিহাসে রয়েছে অসংখ্য স্বদেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এমন কিছু মহান ব্যক্তিত্বের গল্প ইতিহাসে লেখা আছে, যা আমাদের শিক্ষা দেয় কীভাবে দেশকে ভালোবাসা উচিত।
শেখ মুজিবুর রহমান: বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং তার নেতৃত্বে আমরা ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। তিনি সারা জীবন বাংলাদেশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং সাম্যবাদের জন্য লড়াই করেছেন, জিবনের বেশিরভাগ সময় জেলে কাটিয়েছেন।
ভাষা সৈনিকরা: ১৯৫২ সালে বাংলাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দাবিতে বাংলাদেশের ছাত্র, শিক্ষক, সাধারণ মানুষ আন্দোলন করেন। এই আন্দোলনে নিহত হন সালাম, রফিক, বরকত সহ আরো অনেক শহীদ। দেশের জন্য ও দেশের ভাষার জন্য যে প্রান দেওয়া যায়, সেটা সারা পৃথিবীর দৃষ্টান্ত রেখে জান তারা।
মুক্তিযোদ্ধারা: বীরত্বপূর্ণ স্বাধীনতা যুদ্ধে অসংখ্য নাম না জানা, অচেনা বীরের রক্ত ঝরেছে। তারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে দেশকে স্বাধীন করেছেন।
এছাড়াও ইংরেজের সাথে তিতুমির, সিরাজ উদ দুলা, নেতাজি সুভাষ, মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা দেশকে ভালবাসার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। এদেরকে নিয়েই ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বলেছেন-
‘স্বদেশের শাস্ত্র মতে, চল সত্য ধর্ম পথে।
সুখে কর জ্ঞান আলোচন।
বৃদ্ধি কর মাতৃভাষা,
পুরাও তাহার আশা।
দেশে কর বিদ্যা বিতরণ।
এই কয়েকটি উদাহরণের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে স্বদেশপ্রেম কীভাবে প্রকাশ করা হয়।
স্বদেশ প্রেমের অভিব্যক্তি
স্বদেশপ্রেম একটি গভীর অনুভূতি, যা কেবল ভালোবাসা নয়, বরং দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও মানুষের প্রতি এক অটুট বন্ধন। এটি ফুটে ওঠে বিভিন্ন কাজে, তা ছোট হোক বা বড়। একজন তরুণ ছাত্র যখন সকালে স্কুলে পতাকা উত্তোলন করে, তখন সে তার স্বদেশপ্রেম প্রকাশ করে। একজন সামাজ কর্মী যখন জনগণের জন্য সেবা করে, তখন সেও দেশের প্রতি তার ভালোবাসা দেখায়। একজন কৃষক যখন কঠোর পরিশ্রমে ফসল ফলায়, একজন শিল্পী যখন দেশের ঐতিহ্য তুলে ধরে, এমনকি একজন সাধারণ নাগরিক যখন আইন মেনে চলে – তারা সবাই তাদের নিজের পথে স্বদেশপ্রেমের অভিব্যক্তি ঘটায়।
স্বদেশপ্রেমের আছে বিভিন্ন মাত্রা। এটি দেশের জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া হতে পারে, অথবা নিজের কাজের মধ্যে দিয়ে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখা হতে পারে। এটি বড় কোনো কীর্তি না হয়েও, প্রতিদিনের ছোট ছোট কাজেও ফুটে উঠতে পারে। আসুন, আমরা সবাই মিলে হাতে হাত রেখে, স্বদেশপ্রেমের মশাল জ্বালিয়ে রাখি, আমাদের মাতৃভূমিকে গর্বিত করি।
ধর্মে স্বদেশপ্রেমের তাগিদ
স্বদেশপ্রেম, বা মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা, প্রতিটি প্রধান ধর্মেই একটি মহান গুন হিসাবে বিবেচিত হয়। বিভিন্ন ধর্ম বিভিন্ন উপায়ে এই গুঙ্কে উৎসাহিত করে।
ক) ইসলাম ধর্মে:
দেশপ্রেমের উজ্জ্বল বহিঃপ্রকাশ আমরা নবী করীম (স.) এর মধ্যে দেখতে পাই, দেশকে ভালোবেসে তিনি বলেছিলেন-
হে মাতৃভূমি তোমার লোকেরা যদি আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র না করত তবে আমি কখনই তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।
খ) হিন্দু ধর্মে:
হিন্দুধর্মে, “মাতৃভূমি” বা “পুণ্যভূমি” একটি পবিত্র ধারণা। হিন্দুরা বিশ্বাস করে যে তাদের জন্মস্থান তাদের পূর্বপুরুষদের দ্বারা পবিত্র করা হয়েছে এবং এটি তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হিন্দুরা তাদের দেশের প্রতিটি জিনিস, নদী এবং পাহাড়কেও পবিত্র মনে করে।
এছাড়াও খ্রিস্টান ধর্মে, বৈদ্য ধর্মে, জৈন ধর্মে দেশের প্রতি ভালবাসার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এসব উদাহরণ থেকে দেখা যায় যে প্রতিটি ধর্মই স্বদেশ প্রেম কে উৎসাহিত করে।
স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেমের মধ্যে সম্পর্ক
স্বদেশপ্রেম এবং বিশ্বপ্রেম, দুটি ধারণা যা একে অপরের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে রয়েছে। স্বদেশপ্রেম হল আমাদের মাতৃভূমির প্রতি গভীর ভালোবাসা, আর বিশ্বপ্রেম হল সমগ্র মানবজাতির প্রতি সমমরমিতা ও বোঝাপড়া। স্বদেশপ্রেম আমাদেরকে আমাদের দেশের প্রতি দায়বদ্ধ করে তোলে। এটি আমাদের আইন মান্য করতে, সংস্কৃতি রক্ষা করতে, উন্নয়নে অবদান রাখতে উৎসাহিত করে।
কিন্তু এই দায়বদ্ধতা কোনো সংকীর্ণ সীমানার মধ্যে আবদ্ধ নয়। আমরা যখন আমাদের দেশকে ভালোবাসি, তখন আমরা অন্য দেশের মানুষকেও সম্মান করতে শিখি। আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের মতোই তারাও তাদের দেশকে ভালোবাসে, তার উন্নতি চায়। এই বোঝাপড়া থেকেই জন্ম নেয় বিশ্বপ্রেম।
বিশ্বপ্রেম আমাদেরকে অন্য দেশের মানুষের সাথে সহযোগিতা করতে, তাদের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে, শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য কাজ করতে উৎসাহিত করে। এটি আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আমরা সবাই একই বিশ্বের নাগরিক, একই মানবিক মূল্যবোধের অংশীদার।
স্বদেশপ্রেম এবং বিশ্বপ্রেম একে অপরের পরিপূরক। একটি ছাড়া অন্যটি অসম্পূর্ণ। যখন আমরা আমাদের দেশকে ভালোবাসি, তখন আমরা বিশ্বকেও ভালোবাসতে শিখি। এই দুই মূল্যবোধকে সাথে নিয়ে চললেই আমরা গড়ে তুলতে পারি একটি শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ ও সহনশীল বিশ্ব, যেখানে প্রতিটি মানুষের মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত।
উগ্র স্বদেশপ্রেম
স্বদেশপ্রেম, যদিও একটি মহৎ অনুভূতি, কখনও কখনও বিপথগামী হয়ে উগ্র রূপ ধারণ করতে পারে। ইতিহাস জুড়ে আমরা দেখেছি, এই উগ্র স্বদেশপ্রেম কীভাবে ধ্বংসযজ্ঞ এবং দুঃখের জন্ম দেয়। হিটলারের জার্মানি, চেঙ্গিস খানের মঙ্গোল সাম্রাজ্য, জাপানের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অংশগ্রহণ, এমনকি বর্তমান রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ, সবই উগ্র স্বদেশপ্রেমের ভয়াবহ ফলাফলের উদাহরণ।
এই উদাহরণ গুলিতে, নেতারা নিজেদের জাতিকে শ্রেষ্ঠ মনে করে অন্যান্য জাতিকে হেয় করেছেন। তাঁরা নিজেদের স্বদেশের সীমানা বাড়ানোর নেশায় অন্যান্য দেশের আগ্রাসন করেছেন। এই আগ্রাসনের ফলে কোটি মানুষ নিহত হয়েছেন, সংস্কৃতি ধ্বংস হয়েছে, শান্তি বিরাজ করার পরিবর্তে বিশ্বে ছড়িয়েছে যুদ্ধের আগুন।
অবশ্যই স্বদেশপ্রেম গুরুত্বপূর্ণ। এটি আমাদের দেশের উন্নয়ন, সংস্কৃতি রক্ষা এবং আইন মান্য করার অনুপ্রেরণা দেয়। কিন্তু এই অনুভূতির মধ্যে থাকতে হবে উদারতা, সহনশীলতা এবং বিশ্বপ্রেমের ছায়া। আমাদের নিজেদের দেশকে ভালোবাসার পাশাপাশি অন্যান্য দেশের মানুষের প্রতিও শ্রদ্ধা দেখাতে হবে। শুধু তবেই আমরা এমন একটি বিশ্ব গড়ে তুলতে পারব যেখানে সবাই নিরাপদে বাস করতে পারবে এবং শান্তি বিরাজ করবে।
স্বদেশপ্রেম হীনতার পরিণতি
স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায়
হে কে বাঁচিতে চায়
দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে
কে পরিবে পায়।
রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা এই কবিতাটি আমাদের দেশপ্রেম হীনতার পরিনিতি দেখিয়ে দেয়। কেননা, স্বদেশ প্রেমের অভাব একটি দেশের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। যদি নাগরিকরা নিজেদের দেশের প্রতি উদাসীন হয়, তাহলে তারা দেশের উন্নয়নে, সুরক্ষায় এবং ঐক্য বজায় রাখতে ভুমিকা রাখতে পারে না। এই উদাসীনতা দেশেকে সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দুর্বল করে দেয়, যার ফল অভ্যন্তরীণ বিভাজন, আক্রমণের ঝুঁকি, এবং শেষ পর্যন্ত দেশের স্বাধীনটা বিলুপ্তি হয়।
ইতিহাস জুড়ে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে যেখানে স্বদেশপ্রেমের অভাবে অনেক দেশ বিদেশী শক্তির দ্বারা দখল হয়েছে। ভারতের বিভাজন, রোমান সাম্রাজ্যের পতন, এবং অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি এমনই কিছু উদাহরণ।
উপসংহার
স্বদেশপ্রেম একটি জাতির অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য। এটি একটি জাতির ঐক্য, শক্তি এবং সংহতির ভিত্তি। এটি একটি জাতিকে একত্রিত করতে পারে এবং বড় অর্জন করতে অনুপ্রাণিত করতে পারে। কিন্তু আমাদের মাতৃভূমিরও যত্ন এবং ভালোবাসার প্রয়োজন। তাই তো কবি বলেছেন,
স্বদেশের উপকারে নাই যার মন
কে বলে মানুষ তারে পশু সে জন।
তাই আসুন, সবাই মিলে এই স্বদেশপ্রেমের গান গাই। স্বদেশের মাটির প্রতি শ্রদ্ধা দেখাই, ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধারণ করি, দেশের উন্নয়নে অবদান রাখি। এটাই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা, আমাদের কর্তব্য।
স্বদেশ প্রেম রচনা পিডিএফ
প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা, তোমাদের সুবিধার্থে, রচনার পিডিএফ কপিটি দেওয়া হল। এখনই ডাউনলোড করে তোমারদের ফোনে/পিসিতে রেখে দাও।