সময় হল জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। সময়ের কোনও দাম নেই, কিন্তু এর মূল্য অপরিসীম। সময়কে কাজে লাগাতে পারলে জীবনে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব। কিন্তু সময় নষ্ট করলে জীবনে ব্যর্থতা আসবে। প্রিয় শিক্ষার্থী আজকে আমার হাজির হয়েছি “সময়ের মূল্য” এই গুরুপ্তপূর্ণ রচনাটি নিয়ে, যা ২০ টি গুরুপ্তপূর্ণ পয়েন্ট লেখা হয়েছে। আশা করছি এই রচনাটি SSC, HSC, BCS সহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
সময়ের মূল্য
ভূমিকা:
ক্ষনিকের এই সময়ে মানুষ কত কিছুইনা করে৷ কেউ কষ্ট করে টাকা পয়সা রোজগার করে ধনী হওয়ার জন্য কেউবা কষ্ট করে নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত করার জন্য। যে যাই হতে চাক না কেন সব কিছুর জন্য প্রয়োজন সময়। কারন ক্ষনিকের এই পৃথিবীতে নিজেকে সফল করার জন্য প্রয়োজন সময়ের মূল্য দেয়া। নিজেকে সফল ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন সময়কে শ্রদ্ধা করা, সময়ের হিসেব করে চলা। পৃথিবীতে যত বড় বড় জ্ঞানী এবং বিখ্যাত ব্যক্তি বর্গ ইতিহাসের পাতায় অবিস্মরণীয় হয়ে আছে তারা সবাই ছিলেন সময়ের প্রতি অনেক নিষ্ঠাবান ছিলেন। কথায় আছে
“সময় এবং স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করেনা।”
নদীর পানি যেমন চলমান তেমনি সময়ও চলমান৷ সময় তার গতিতে চলে তাকে কখনো আটকে রাখা যায়না। এই পৃথীবিতে তারাই সফল হতে পারে বা জয়মাল্য তারাই পায় যারা সময়ের মূল্য বোঝে। সুতরাং, মহামূল্যবান এই সময়কে কখনো অবহেলা করা উচিৎ নয়।
সময়ের মূল্য:
“মহাকাল ছুটিছে অনন্ত ধায়
কেহ তারে ধরিতে নাহি হায়।”
যখন পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিল তার আগ থেকে সময় তার নিজের গতিতে চলছে তো চলছেই। তার যাত্রা অসীমে। সারা জীবন ধরে কেউ যদি অধ্যাবসায় করে তবু সময় কে তার গতি থেকে আলাদা করা সম্ভব নয়। কেউ সময়কে আটকে রাখতে পারবেনা।
সময় হচ্ছে অমূল্য একটি সম্পদ। যাকে কখনো কেউ কিনতে পারবেনা। পৃথিবীতে অনেক কিছু কেনা গেলেও এই অমুল্য সম্পদ কে কখনো কেনা সম্ভব নয়। অনেক কিছুর আর্থিক মূল্য নিরুপন করা গেলেও সময়ের যে মূল্য রয়েছে তা নিরুপন করা সম্ভব নয়। বহমান নদী যেমন সাবলীল এবং প্রবাহমান সময় ঠিক তেমনি। এক সেকেন্ডের জন্যেও তার স্থির হওয়ার অবকাশ নেই। মানুষ এবং এই পৃথীবির সব কিছু একদিন থেমে যাবে কিন্তু দুরন্ত এই সময় তার গতিতে চলতেই থাকবে। তাই কবি Banjamin Franklin লিখেছেন-
“You can’t keep today’s hour for tomorrow.”
অর্থাৎ আজকের কাজ কালকের জন্য রেখনা। আজ যে কাজটি করবে বলে কালকের জন্য রেখে দিবে কাল সেই কাজ করার সময় ও সুযোগ নাও পেতে পার। প্রকৃতির নিয়মে সময়ের সাথে সাথে আমাদের কাজও শেষ করা উচিৎ। কিন্তু সেটা অবহেলায় যদি কালকের জন্য ফেলে রাখি তাহলে এই সেই কাজ কখনোই সম্পন্ন করা হবেনা। এক সময় অন্য কাজের নিচে চাপা পরে যাবে। তাই সময়ের কাজ সময়ে করা উচিৎ।
সময়ের মূল্য নিয়ে ধর্ম যা বলে
মহান আল্লাহতালা বলেছেন,
“সময়ের আদি এবং অন্ত নেই, আমিই সময়।”
আল্লাহতালা সব কিছুর জন্য সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। মুসলিমরা দিনে যে পাচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন। সেই নামাজের জন্যেও সময় বেধে দেয়া আছে। ফজরের নামাজ যেমন জোহরে পরলে হবেনা, তেমনি জোহরের নামাজও ফজরে পরলে হবেনা।
ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) সময়ের ব্যপারে অনেক সচেতন ছিলেন। তিনি সব সময় সঠিক সময়ে নামাজ আদায় করতেন, তার সব কাজ সঠিক সময়ে করতেন। হযরত মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন, “যদি কোনো মুমিন অন্য কোনো মুমিনের সঙ্গে নির্দিষ্ট সময়ে সাক্ষাতের ওয়াদা করে এবং সময়মত হাজির না হয় তবে তার উপর খোদার লানত বর্ষিত হতে থাকে ততক্ষণ, যতক্ষণ সে ঐ মুমিনকে অপেক্ষায় রাখে।”
সময়ের সঠিক মূল্যায়ন করা
বাংলার লোক – কবির কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে এ হাহাকার –
“এপার গঙ্গা ওপর গঙ্গা, মধ্যখানে চর “
অর্থাৎ এপার বলতে কবি বুঝিয়েছেন জন্ম, ওপার বলতে কবি মৃত্যুকে বুঝিয়েছেন এবং মধ্যখানে চর বলতে জীবনের সীমাবদ্ধ সময় কে বুঝিয়েছেন। এই ছোট্ট এবং সীমাবদ্ধ সময়ে নিজেকে সফল ব্যক্তি এবং স্বপ্ন পূরন করতে চাইলে প্রয়োজন সময়ের সঠিক মূল্যায়ন। নির্দিষ্ট সময়ের কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করা। তবেই নিজেকে ব্যক্তিত্ববান মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারব। যুগ যুগ ধরে বিখাত মনিষী, বিজ্ঞানী, জ্ঞানী ব্যক্তিরা তাই করে গেছেন। তাই তারা ইতিহাসের পাতায় চির স্বরনীয় হয়ে আছেন।
সময়ের বৈশিষ্ট্য
কবি বলেছেন,
“সময় হলো এক অমোঘ সত্য যা আমাদের সবাইকে একদিন ছাড়িয়ে যাবে।“
অর্থাৎ সময় তার নিজস্ব গতিতে চলে। সে আপন গতিতে চলে কারো জন্য থামেনা।
সব কিছুর যেমন নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে ঠিক তেমনি সময়েরও রয়েছে নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য। সময়ের বৈশিষ্ট্য হলো এর গতিশীলতা। সময় কে জগতের কোনো নিয়মে বাধায় সম্ভব না। কেউ সময় কে তার নিয়ন্ত্রনে আনতে পারবেনা। কেয়ামত পর্যন্ত সময় তার নিজের গতিতে চলবে তার অস্তিত্ব বিরাজমান থাকবে। ঘড়ির কাটা সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে সময় অতীত কে আরো ভারী করে তোলে। আল্লাহ ছাড়া সময়কে ধরে রাখার ক্ষমতা আর কারো নেই। এখন যে সময় চলে যাচ্ছে একটু পর এই সময় অতীত হয়ে যাবে। ভবিষ্যৎ হলো মরিচীকার মত। কখনোই ভবিষ্যৎ কে হাতের মুঠোয় পাওয়া যায়না।
সময়ের সদ্ব্যবহার
ফকির লালন সাই বলে গেছেন তার গানে-
“সময় গেলে সাধন হবেনা
দিন থাকিতে দিনের সাধন কেন করলেনা।“
এই গানটির মাধ্যমে লালন সাই বোঝাতে চেয়েছেন যে সময় কে তুমি আজ অবহেলা করছ, যে কাজ ফেলে রাখছ পরের দিন করার জন্য সেই সময় কখনো ফিরে পাওয়া যাবেনা। যদি আমরা সময়ের সদ্ব্যবহার না করি তাহলে আমাদের সকল স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে, কোনো আশা পূরন হবেনা। আমাদের সাধনা কখনোই স্বার্থক হবেনা। ” দিন থাকিতে দিনের সাধনা কেন করলেনা ” এই লাইনটির মানে হচ্ছে মানুষ যখন সময় কে অবহেলা করে সময় ফুড়িয়ে ফেলে আফসোস করতে থাকে, সেই কান্না এবং আফসোস বৃথা। কারন সময় থাকতে সময়ের মর্ম না বুঝে আফসোস করা বোকামি। জীবনের লক্ষ্য পূরনের জন্য সময় থাকতে সময়ের কাজ শেষ করতে হবে, তবেই আমাদের স্বপ্ন পূরন হবে। লালন সাই এই গানের মাধ্যমে এই মুল্যবান কথাটিই বোঝাতে চেয়েছেন।
সময়ের সদ্বব্যবহার করে অনেক মানুষ তাদের স্বপ্ন পূরন করেছেন। বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনষ্টাইন মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে আপেক্ষিকতা তত্বের আবিষ্কার করেন। তার জীবনী থেকে জানা যায় সময়ের ব্যপারে অনেক সতর্ক ছিলেন। তাইতো মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে এমন জটিল একটি তত্ব আবিষ্কার করতে পেরেছেন।
সময়ের কাজ সময়ে করার গুরুত্ব
কথায় বলে,
“সময়ের এক ফোড় অসময়ের দশ ফোড়।”
পৃথিবীর যত উন্নত দেশ আছে তাদের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় সে দেশের মানুষ সময়ের প্রতি অনেক সচেতন এবং সময়ের সদ্ব্যবহার করেন। কারন তারা বিশ্বাস করেন সময়ের কাজ অসময়ে করলে কখনোই সেটি সফলতা এনে দিতে পারেনা। সফল হতে চাইলে সঠিক সময়ে কাজ করতে হবে। তাই আমরাও সময়ের ব্যপারে সচেতন হয়ে নিজেকে উন্নত করার পাশাপাশি আমাদের দেশকে উন্নত করতে পারি।
ছাত্রজীবনে সময়ের মূল্য
ছাত্রজীবন কে বলা হয় জীবন সংগ্রামের প্রস্ততির সময়। এই সময় আমরা নিজেকে যেভাবে পরিচালিত করব ভবিষ্যতে ঠিক সেরকম ফলাফল পাব। এই সময় যে বীজ বপন করা হয় ভবিষ্যতে ঠিক তেমন ফল পাওয়া যায়। ছাত্রজীবনে অধ্যায়ন হচ্ছে প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য। প্রতিদিনের পড়া পরবর্তী সময়ের জন্য ফেলে না রেখে প্রতিদিন শেষ করার মানসিকতা থাকতে হবে৷ ছাত্রজীবনে পাঠাভ্যাসের পাশাপাশি শরীরচর্চা, চরিত্রগঠন এবং সংযমের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এক জন ছাত্র তার ছাত্রজীবনে যত পরিশ্রম করবে তার কর্মজীবন তত সফল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর এই সাফল্য নির্ভর করে একজন ছাত্রের সময়ের সঠিক মূল্যায়নের উপর। সুতরানফ, শৈশব থেকে সময়ের প্রতি সবার শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিৎ। ছাত্রজীবনে যারা সময় নষ্ট করেনা, দৈনন্দিন কর্মসূচিকে অবহেলা করেনা তারাই ছাত্রজীবনে সোনার কাঠির পরশ পায়। তাইতো এ প্রসঙ্গে উইলিয়াম শেক্সপিয়ার বলেছেন,
” সময়ের প্রতি যাদের শ্রদ্ধা নেই, তারাই পৃথিবীতে নি:স্ব, বঞ্চিত ও পরমুখাপেক্ষী। “
জাতীয় জীবনে সময়ের মূল্য
ছাত্রজীবনের মত জাতীয় জীবনে সময়ের মূল্য অপরিসীম। যে জাতি কর্মতৎপর নয় সে জাতি কখনো এগিয়ে যেতে পারেনা। তাদের জীবনে শুধু পতন আছে কোনো উত্থান থাকেনা। একটি জাতি আলস্য, ঔদাসীন্য, অনিয়মানুবর্তিতার কারনে চিরতরের জন্য একটি সভ্যতা থেকে মুছে যেতে পারে। আমাদের দেশের সাথে যদি উন্নত দেশ গুলোর তুলনা করি তাহলে দেখা যাবে তারা সময়ের ব্যপারে অনেক সচেতন, সবাই প্রচন্ড অধ্যাবসায়ী। কিন্তু জাতি হিসেবে আমরা সবার কাছেই অলস হিসেবে পরিচিত৷ কারন আমাদের কোনো সময় জ্ঞান নেই। পরনিন্দা, পরচর্চা করে আমরা আমাদের সময়কে হেলায় নষ্ট করি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারনে জাপান একদম নি:স্ব হয়ে গিয়েছিল কিন্তু তাদের সময়নুবর্তীতার কারনে আজ তারা উন্নতির চরম শিখরে পৌছে গিয়েছে। আজ তারা বিশ্ব দরবারে মাথা উচু করে দাড়িয়েছে। তাই আমরা যদি আমাদের দেশের উন্নতি করতে চাই জাতি হিসেবে নিজেদের জাপানিদের মত উন্নত করতে চাই তাহলে অবশ্যই সময়কে গুরুত্ব দিতে হবে এবং সময়ের কাজ সময়ে করতে হবে। তাইতো স্পানিশ দার্শনিক ব্যালটাজার গার্সিয়ান বলেছেন,
“যার হাতে কিছুই নেই, তার হাতেও সময় আছে। এটাই আসলে সবচেয়ে বড় সম্পদ”
সময়ই শ্রেষ্ঠ সম্পদ
মানব জীবন গঠিত কতকগুলো মুহূর্তের সমষ্টি নিয়ে। তাই প্রতিটি মুহূর্তই মানুষের জন্য মহামূল্যবান। অনেকে সময়কে ক্ষুদ্র বলে অবমূল্যায়ন করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে সময়ের ক্ষেত্রে সামান্য বলে কোনো কিছু নেই। সময় হচ্ছে অসামান্য জিনিস। জীবনে এক সেকেন্ডের অপচয় করলেও জীবন থেকে অনেক সম্ভাবনাময় জিনিস মানুষ হারিয়ে ফেলে। যদি কেউ সময় কে জীবনে কাজে লাগায় তাহলে সেই ব্যক্তি তার জীবনে সফলতা অর্জন করতে পারে। সময় কে ভালভাবে কাজে লাগাতে পারলে ধন- সম্পদ, বিদ্যা- বুদ্ধি, যশ – খ্যাতি সব কিছু অর্জন করা সম্ভব। তাইতো ফিলিপ ষ্ট্যানহোপ বলেছেন-
“সময়ের সত্যিকার মূল্য দাও। প্রতিটি মূহুর্তকে দখল করো, উপভোগ করো। আলস্য করো না। যে কাজ আজ করতে পারো, তা কালকের জন্য ফেলে রেখো না”
সময়ের অবহেলার পরিনাম
কথায় আছে :
“সময়ে যে না দেয় চাষ
তার দু:খ বার মাস।”
ক্ষনিকের এই জীবনে আমরা যে সময় পাই তা যদি হেলায় নষ্ট করি, আলসেমি করে মূল্যবান সময় নষ্ট করি তাহলে সেটা সময়ের অপচয় মাত্র। সময় অপচয় আমাদের জীবনে মারাত্নক দু:খ কষ্ট বয়ে আনে। তখন সারাদিন বুকফাটা আর্তনাদ করেও লাভ হয়না। হাজার চোখের জল কিংবা অনুতাপের অন্তর্দাহে সেই আলস্যে অতিবাহিত সময় আর কখনো ফিরে পাওয়া যায়না।
সময়ানুবর্তিতার অন্তরায়
সময় অন্তকাল চলতে থাকবে কিন্তু মানুষের আয়ু খুবই সীমিত। তাই সময়ের দিকে চেয়ে না থেকে তাকে বাধাগ্রস্ত করে ব্যবহার করো।
– রেদোয়ান মাসুদ
সঠিক সময়ে কিছু করতে গেলে অনেক সময় আমরা বাধাগ্রস্ত হই৷ অধৈর্য আর আলস্য হচ্ছে সময়ের প্রধান অন্তরায়। কথায় আছে, “অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।” অলস মস্তিষ্কের কাজ হচ্ছে কাজের প্রতি অনীহা সৃষ্টি করা, মনের ভিতর কুচিন্তার অনুপ্রবেশ করানো। সুতরাং নিজের লক্ষ্যে পৌছাতে হলে আলস্য শব্দটিকে নিজের জীবন থেকে সযত্নে পরিহার করে স্ব স্ব আবশ্যকীয় কর্ম সম্পাদন করার মাধ্যমে জীবনের প্রতিতি মুহূর্তকে প্রানবন্ত করে তুলতে হবে। তাইতো কবি বলেছেন-
“জীবন বদলানোর জন্য সবাই সময় পায়। কিন্তু সময় বদলানোর জন্য আর জীবন পাওয়া যায় না।”
জীবনে রোগ ব্যধি জরা সময়ানুবর্তী হওয়ার পথে বাধা দিতে পারে। কিন্তু যথাযথ শিক্ষা, সাধনা এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে সময়ের সাথে তাক মিলিয়ে চলতে পারার মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছানো সম্ভব।
সময়কে কাজে লাগানোর উপায়
জীবনে সঠিক জায়গায় পৌছাতে হলে বহু রকমের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয় এটাই প্রকৃতির নিয়ম। অনেকের কাছেই জীবনের নির্দিষ্ট পরিসীমার মধ্যে এত দায়িত্ব কর্তব্য পালন করা অসম্ভব ব্যপার হয়ে পরে। কিন্তু কোনো ব্যক্তি যদি তার কাজের পরিমান অনুযায়ী তার সময়কে ভাগ করে নেয়, দৈনন্দিন জীবনে সময় কে শ্রদ্ধা করে, তাহলে ঠিক সময়ে কাজ শেষ করা যেতে পারে। শুধু কাজ করলে হবেনা নিজের জন্য অবসর সময়ও রাখতে হবে। তাহলে কাজে নতুন উদ্দীপনা আসে।
কথায় আছে,
“সঠিক দিক ও সঠিক সময়ের জ্ঞান না থাকলে, উদীয়মান সূর্যকেও অস্ত যাওয়ার মতো মনে হয়।”
ওয়াটারলুর যুদ্ধে নেপোলিয়ন এর যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার কারন তার সৈন্য বাহিনী সঠিক সময়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পৌছাতে পারেনি। যার কারনে জীবনে প্রথমবারের মত তিনি হেরে গিয়েছিলেন। এই কারনে সম্রাটকে পরাজয়ের গ্লানি বহন করতে হয়।
জগতে সময়ের সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে জীবনে কীর্তিমান হওয়া সম্ভব। উপযুক্ত সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে হবে এবং সে অনুযায়ী পরিচালিত করলে কাঙ্খিত সাফল্য অর্জন করা সম্ভব।
সময়ের গুরুত্ব
আমাদের জীবন ক্ষনস্থায়ী। কিন্তু কাজের মাধ্যমে যে গৌরব অর্জন করি তা ক্ষনস্থায়ী। মানব জীবনে অফুরন্ত শিক্ষা রয়েছে, রয়েছে অপরিমেয় কর্তব্য, আর কর্ম জগতের পরিধি ক্রমবর্ধমান। তাই সময় কে সঠিক ভাবে কাজে লাগিয়ে জীবনের কাঙ্খিত লক্ষে পৌছানো উচিৎ। সঠিক সময়ে ফসলের বীজ বপন করলে যেমন শস্যের উৎপাদন ভাল করা যায়, রোগে আক্রান্ত হলে যেমন সঠিক সময়ে ওষুধ খেতে হয়, তেমনি সঠিক দায়িত্বের মাধ্যমে নিয়মিত পাঠাভ্যাসের মাধ্যমে পরীক্ষায় কাঙ্খিত ফলাফল লাভ করা যায়। তাইতো কবি বলেছেন,
“সময়ের গুরুত্ব বুঝে করা যারা কাজ। তারা আজ স্মরনীয় জগতের মাঝ।”
সময়ের মূল্যায়ন ও জীবনে সাফল্য
সময় গতিশীল তাই তাকে কখনো থামিয়ে রাখা যায়না। সময় কে কোনো কিছু দিয়ে আটকে রাখা সম্ভব নয়। সে কোনো লোভ বা ভয়ের পরোয়া করেনা। সময় প্রকৃতিগত ভাবেই নিষ্ঠুর ও নির্মম। অথচ সময়কে সঠিক ভাবে কাজে লাগিয়ে জীবনে সফলতা অর্জন করা সম্ভব। যারা সময়কে সঠিক ভাবে কাজে লাগায় তারাই জীবনে সফল হয়। কিন্তু তারা সময় কে অবহেলা করে, হেলা করে তাদের জীবনে সম্ভাবনার সকল দ্বার বন্ধ হয়ে যায়, জীবনে ভয়াবহ পরিনতি ডেকে আনে। কবির ভাষায়-
“নিতান্ত নির্বোধ যেই শুধু সেই জন
এ অমূল্য সময় করে বৃথায় যাপন।”
সময়নিষ্ঠ ব্যক্তি ও জাতির উদাহরণ
জগতে যারা ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করছে তাদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তারা সময়ের প্রতি অনেক নিষ্ঠাবান ছিলেন। তারা কেউ সময়ের ব্যপারে উদাসীন ছিলেন না। তারা জীবনের প্রতিটি মূহুর্ত কে মেপে মেপে ব্যবহার করেছেন। কোনো জড়তা বা অলসতা তাদের গ্রাস করতে পারেনি। আব্রাহাম লিংকন সামান্য শ্রমিক থেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন সময় কে কাজে লাগিয়ে। ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) তার জীবনের প্রতিটি সময় কে কাজে লাগিয়েছেন। এরিষ্টটল আলেকজেন্ডারের গৃহশিক্ষক থেকে সময়কে কাজে লাগিয়ে হয়েছিলেন বিখ্যাত দার্শনিক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শেরে বাংলা ফজলুল হক, আইনস্টাইন এবং টমাস আলভা এডিসন সহ বিখ্যাত ব্যক্তিগন তাদের সময়কে কাজে লাগিয়ে আজ চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।
সময়নিষ্ঠ জাতি হিসেবে ইংরেজ, আমেরিকান, জাপানি, ভিয়েতনামি, চাইনিজ এরা বিশ্ব দরবারে মাথা উচু করে আছে। সময়কে কাজে লাগিয়ে যে উন্নতির চরম শিখরে পৌছানো যায় এই জাতি গুলো তা দেখিয়েছেন। আমাদের মত অউন্নত দেশের কাছে তারা আজ রোল মডেল।
বাঙালির সময় জ্ঞান
নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসু বলেছেন,
“অলস জাতি কখনো উন্নতি করতে পারেনা।”
বাঙালি অলস জাতি হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত। আমাদের যে সময় জ্ঞান অনেক কম তা বলাই বাহুল্য। এর প্রধান কারণ হচ্ছে প্রাচীনকাল থেকেই বাঙ্গালী জাতি আরাম আয়েশ এবং স্বাচ্ছন্দ্য পছন্দ করে। শুরু থেকেই বাঙালির জীবন ব্যবস্থা ছিল গ্রাম কেন্দ্রিক। আর গ্রামের মানুষের জীবনে কোন জটিলতা থাকেনা। অল্প পরিশ্রমে উর্বর মাটিতে সোনার ফসল ফলতো। এজন্য প্রচুর অবসর মিলতো। আর তাইতো বারো মাসে তেরো পার্বণ হতো। সারাদিন আনন্দ বিনোদন নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। বাইরের জগৎ যে প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে সেদিকে কোন খেয়ালই ছিল না। কিন্তু যখন ইংরেজ বাংলাদেশে শাসন করতে আসলো তখন ইংরেজদের সময় জ্ঞান এবং উন্নতি দেখে তাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হয়। তখন থেকে বাঙালিরা নিজেদের সময়কে কাজে লাগিয়ে নিজেকে উন্নত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এখনো পুরোপুরি সচেতন হয়ে উঠতে পারেনি বাঙালি জাতি । বাঙালিকে নিয়ে নিয়ে আগে থেকে যে ঠাট্টা বিদ্রুপ চলত এখনো তা মোচন করতে পারিনি আমরা। বাঙালি সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন,
“অলসতাই জাতির পতন ডেকে আনে।”
সময়ের অবব্যবহার ও আমাদের কর্তব্য
“আপনি যা কিছু ব্যয় করেন, তার মধ্যে সময়ই বেশী মূল্যবান।”
– থিওফ্রেসটাস।
সময় কে সঠিক ভাবে কাজে না লাগালে সময়ের মূল্য না দিলে জীবনাকাশ ঘনকালো মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। ওয়াটারলু যুদ্ধে নেপোলিয়ন সেনাপতি নিয়ে দেরীতে হাজির হওয়ায় প্রথমবারের মত তিনি চরম ভাবে পরাজিত হন। এ জন্যই কথায় আছে, “সময়ের এক ফোড়, অসময়ের দশ ফোড়।” জীবনে অনেক সময় সারাজীবনের কাঙ্খিত জিনিস হাতের মুঠোয় ধরা দিতে আসে কিন্তু অলস ব্যক্তিরা অলসতা করে সেটি লুফে নিতে পারেনা। তাই পরে যখন নিজের ভুল বুঝতে পারে তখন হাহাকার করা ছাড়া আর কিছু করার থাকেনা। কিন্তু যারা প্রকৃতপক্ষে সময়ের ব্যপারে নিষ্ঠাবান তারা জীবনে কখনো হেরে যায়না, ঠকে যায়না। কারন তারা সময়ের ব্যপারে সচেতন থাকে৷ তাই সফলতাই তাদের জীবনে অবশ্যম্ভাবী। সময় কে কাজে লাগিয়ে অনেক ব্যক্তি তাদের জীবনে সফল হয়েছেন। যেমন : মার্ক জাকারবার্গ, এলন মাস্ক, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি সহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ।
জীবনের প্রতিটি মূহুর্ত অনেক মূল্যবান। সময়ের কোন মুহূর্ত অনেক মূল্যবান কোন মুহূর্ত কম তা কেউ বলতে পারবেনা। তাই আমাদের উচিৎ সময় কে সঠিক ভাবে কাজে লাগানো। যদি আমরা সময়লে অবহেলা করি তাহলে নিজেদের জীবনকে অবহেলা করা হবে।
সময়ের অপচয়ের কারন
দৈনন্দিন জীবনে অনেক কারনেই আমরা সময় অপচয় করি৷ তারমধ্যে প্রধান কারন গুলো হচ্ছে অলসতা, বিলাসিতা, সৃজনশীলতার অভাব, ভুল সিদ্ধান্ত।
অলস ব্যক্তিরা তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজ করতে চায়না। পরিশ্রম ছাড়াই তারা সফল হতে চায়। কিন্তু তারা জানেনা যে পরিশ্রম ছাড়া কিছু অর্জন করা যায়না। আবার বিলাসী ব্যক্তিরা সময়ের ব্যপারে শ্রদ্ধাশীল হয়না। অতিরিক্ত আরাম আয়েশের কারনে তারা সময় জ্ঞানের কথা ভুলে যায়। যার কারনে তারা তাদের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। অনেকে আবার ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে সময় অপচয় করে ফেলে। জীবনে সাফল্য অর্জন করতে চাইলে সঠিক পথে সময় দিতে হয়। এটা অনেকেই বুঝতে পারেনা। তাইতো শেক্সপিয়ার বলেছেন,
“আমি নষ্ট সময়কে করেছি, আর এখন সময় আমাকে নষ্ট করছে।”
সময়ের অপচয়ে ক্ষতিকর প্রভাব
টমাস আলভা এডিসন বলেছেন, “সবকিছুর জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় রয়েছে।” অর্থাৎ সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করতে পারা। যখন সময় ও সুযোগ আসে তখন সময়কে কাজে না লাগিয়ে অবহেলা করে জীবনকে ধ্বংসের মুখে ফেলে দেই। যার কারনে জীবনের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হই। জীবনে হয়তো অনেক সুযোগ সুবিধা নিয়ে আসে সময় কিন্তু অবহেলার কারনে সেই সুযোগও হাতছাড়া হয়ে যায়। যার কারনে আমরা ব্যক্তিগত জীবন ও সামাজিক জীবনে অন্যদের দ্বারা হেয় প্রতিপন্য হই।
সময়ের মুল্য বুঝতে পারার উপায়
সময়ের মূল্য বোঝার জন্য সফল ব্যক্তিদের জীবনী পড়তে হবে। তাহলে সময়ের ব্যপারে নিজেকে সচেতন করতে পারব। এছাড়াও সময়ের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে জানতে হবে এবং সময়কে কিভাবে সঠিক ভাবে কাজে লাগানো যায় সেই ব্যপারে জানতে হবে।
সময় লক্ষ্যে পৌছাতে সাহায্য করে
সময় আমাদের সঠিক লক্ষ্যে পৌছাতে সাহায্য করে। এর জন্য শুধু প্রয়োজন সাহস এবং পরিশ্রম। সময়কে কাজে লাগিয়ে কেউ কখনো ব্যর্থ হয়নি।
“সময় যেমন আসে আবার চলেও যায়। তবে যখন সময় থাকবে, তখন আপনি তার কাছে যা চাইবেন, আপনি তাই পাবেন।”
তাই সময় ও সুযোগ যখন আসবে তখন অবহেলা করা যাবেনা।
উপসংহার
“বড় হতে চাইলে, সর্বপ্রথম সময়কে মূল্য দেওয়া শিখতে হবে।”
ছোট্ট এই জীবনে উন্নতি করতে চাইলে সময়ের মূল্য দেয়ার বিকল্প কিছু নেই। আমাদের জীবনকে মহিমান্বিত করতে পারে সময়ের সঠিক ব্যবহার। মানুষের জীবন মহামূল্যবান তাই মহামূল্যবান এই জীবনকে সময় অপচয় করে নষ্ট হতে দেয়া উচিৎ নয়। অতীতে যারা সফল ব্যক্তি হিসেবে সারাবিশ্বে পরিচিতি পেয়েছে তারা সবাই অনেক নিষ্ঠাবান ছিলেন। ভবিষ্যতেও তারাই সফল হবেন যাদের সময় জ্ঞান আছে।