বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ রচনা | ২০ টি পয়েন্ট | উক্তি সহকারে ২৫০০+ শব্দ | pdf download

প্রিয় শিক্ষার্থীরা আমাদের আজকের রচনা বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ।  আজকের এই রচনাটি ২০ টি পয়েন্টে প্রায় ২৫০০+ শব্দে লেখা হয়েছে যেন পরীক্ষার্থীরা একবার পরেই নিজের মতো করে লিখতে পারে। রচনাটিতে প্রাসঙ্গিক অনেকগুলি উক্তি ও কবিতা ব্যবহার করা হয়েছে যা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় সর্বাধিক নম্বর অর্জনে সাহায্য করবে। রচনাটি সহ যে কোন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য অত্যান্ত গুরুপ্তপূর্ণ। 

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ রচনা

 

ভূমিকা

বাংলাদেশের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা। তিনি হলেন সেই মহান নেতা, যার অদম্য নেতৃত্বে আমরা আমাদের স্বদেশ, বাংলাদেশ অর্জন করেছি। তার অবদান ছাড়া আজকে আমরা যে স্বাধীন বাংলাদেশে বাস করছি, তা কল্পনাও করা কঠিন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বাংলাদেশ এমন দুটি অবিচ্ছেদ্য নাম, যাদের আলাদা করে ভাবা কঠিন। তারা একে অপরের সমার্থক, একে অপরের পরিপূরক। 

তাই তো কবি বলেছেন, 

যত দিন রবে পদ্মা মেঘনা 

গৌরী যমুনা বহমান

 তত দিন রবে কীর্তি তোমার 

শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধু ছাড়া বাংলাদেশের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না, আর বাংলাদেশ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর মহান অবদানের পূর্ণতাও আমরা অনুধাবন করতে পারতাম না।

বঙ্গবন্ধুর ছেলেবেলা

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার নিভৃত পল্লীতে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে  শেখ লুতফুর রহমান ও সায়েরা খাতুনের ঘরে  ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে তিনি পিতা-মাতার তৃতীয় সন্তান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শেখ বংশের গোড়াপত্তনকারী শেখ আউয়াল দরবেশ আল-বগদাদী সাহেবের বংশধর। শেখ আউয়াল দরবেশ আল-বগদাদী সাহেব ছিলেন একজন ধর্মীয় নেতা ও পণ্ডিত। তিনি ১৩শ শতাব্দীতে বঙ্গদেশে আসেন এবং ফরিদপুর জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে বসবাস শুরু করেন। 

বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাজীবন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ও কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন। তিনি তার শিক্ষাজীবনে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন, যা পরবর্তীতে তার নেতৃত্বের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শিক্ষা জীবন

  • ১৯২৭ সালে সাত বছর বয়সে গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু।
  • ১৯২৯ সালে গোপালগঞ্জ পাবলিক বিদ্যালয়ে ভর্তি।
  • ১৯৩১ সালে মাদারীপুর ইসলামিয়া বিদ্যালয়ে ভর্তি।
  • ১৯৩৪ সালে বেরিবেরি ও গ্লুকোমা রোগে আক্রান্ত হয়ে চার বছর বিদ্যালয়ের পাঠ চালিয়ে যেতে পারেননি।
  • ১৯৩৮ সালে গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন স্কুলে ভর্তি।
  • ১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ।
  • ১৯৪৪ সালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে আই.এ. পাশ।
  • ১৯৪৭ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ।
  • ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে ভর্তি।
  • ১৯৪৯ সালে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবি-দাওয়ার প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনে উস্কানি দেয়ার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার।

বঙ্গবন্ধুর উপাধি সমূহ 

 বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার অসাধারণ নেতৃত্বের গুণাবলী ও বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদানের জন্য বিভিন্ন উপাধি লাভ করেন। মা-বাবার আদরের ‘খোকা’, রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের সুপ্রিয় ‘মুজিব ভাই’, সমসাময়িকদের প্রিয় ‘শেখ সাহেব’ থেকে মুক্তিকামী বাঙালির ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে অর্জন করেন ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি, শেষত হয়ে ওঠেন জাতির অবিসংবাদিত নেতা-‘জাতির পিতা’, ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’। 

বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সাথে তার নাম একাকার হয়েছে। এ তো শুধু একটি নাম নয়, বাঙালির জাতীয় মুক্তির ইতিহাস। যে জন্য বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক। 

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের উপাখ্যান 

বাংলাদেশের ইতিহাস স্বাধীনতার গৌরবগাঁথা, আর এই গাঁথার মূলনায় রয়েছে বাঙালি জাতির অদম্য মুক্তিপিপাসা এবং স্বাধীনতা আকাঙ্ক্ষা। এই উপাখ্যান শুরু হয় সুদীর্ঘ দিনের আক্রোশ আর অবিচারের গর্ভ থেকে। বাঙালি জাতি সব সময় স্বাধীনতার স্বপ্ন বুকে লালন করেছে। বারবার দমন-পীড়নের শিকার হয়েও তাদের মন থেকে মুক্তির আগুন নেভেনি। ৭১ সালে, সেই আগুনই এক ভয়াবহ যুদ্ধের রূপ নেয়। পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার দাবি সোচ্চার হয়ে উঠে। কিন্তু স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করতে প্রয়োজন এক মহান নেতৃত্বের, এক পথনির্দেশকের। সেই নেতৃত্বই দেন শেখ মুজিবুর রহমান, আমাদের বঙ্গবন্ধু, যার হাত ধরেই আমরা পেয়েছি মুক্ত বাংলাদেশ।

 

রাজনৈতিক জীবনে হাতেখড়ি

শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের গুঁড়ি গিয়ে লাগে ১৯৩৯ সালে। মিশনারি স্কুলে পড়ার সময় তিনিই ছিলেন সেই ছেলে যে একদল ছাত্র নিয়ে বিদ্যালয়ের ছাদ সংস্কারের দাবি নিয়ে তৎকালীন  শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং খাদ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীর কাছে যান। এরপর কলেজ জীবনেও তার রাজনৈতিক সক্রিয়তা বাড়তে থাকে। মুসলিম ছাত্রলীগ, মুসলিম লীগে যোগদান, বিভিন্ন সম্মেলন আয়োজন — একের পর এক ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে তিনি নিজেকে তৈরি করেন একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ হিসেবে। হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীর মতো রাজনৈতিক গুরুর ছত্রছায়ায় লাভ করে, আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে গড়ে তোলেন নেতৃত্বের গুণ। এই সবকিছু মিলেই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের শুরু, যেই শুরু পরবর্তীতে বাংলাদেশের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে নিয়ে যায় আমাদের কাঙ্খিত স্বাধীনতার দিকে। 

 

ভাষা আন্দোলনে যোগদান

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই গভীরভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৪৮ সালের প্রথম ধাপ থেকেই তিনি আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তিনি বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বিভিন্ন মিছিলে ও সমাবেশে নেতৃত্ব দেন। এমনকি, পাকিস্তানি পুলিশ তাকে গ্রেফতারও করে।

২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে, ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত দিনে বঙ্গবন্ধু কারাগারে বন্দী ছিলেন। কিন্তু, কারাগারের ভেতরে থেকেও তিনি আন্দোলনের নৈতিক সমর্থন দেন। তিনি তার সহকর্মীদের উৎসাহিত করেন এবং বাংলা ভাষার জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে বলেন। তার এই অবদান ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয়।

৬ দফা, ঊনসত্তরের গনুভভুথান ও মুক্তির পথে অগ্রযাত্রা 

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতির স্বাধিকার চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল। এরপর থেকেই বাঙালিরা স্বাধীনতার জন্য ক্রমশ এগিয়ে যেতে থাকে। এই পথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। তার নেতৃত্বে বাঙালিরা একের পর এক আন্দোলন করে স্বাধীনতার স্বপ্নকে আরও বাস্তবায়নের কাছাকাছি নিয়ে আসে।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি ঘোষণা করেন। এই ছয় দফা দাবি ছিল বাঙালিদের স্বাধিকার আন্দোলনের একটি মাইলফলক। ছয় দফা দাবিতে বাঙালিদের জন্য স্বায়ত্তশাসন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দাবি উত্থাপিত হয়েছিল। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এই দাবিকে মেনে নেয়নি। ফলে বাঙালিরা ছয় দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন শুরু করে।

ছয় দফা আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতির স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালিরা তাদের স্বাধীনতা চেতনা আরও প্রবল করে তোলে।

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন এবং বঙ্গবন্ধু উপাধি পান। মুক্তির আরও কাছাকাছি চলে আসে বাংলাদেশ। 

৭০ এর নির্বাচনে বিজয়

১৯৭০ সালের পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসনে জয়লাভ করে। এটি ছিল পাকিস্তানের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব জয়। আওয়ামী লীগের এই বিশাল জয় প্রমাণ করেছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ স্বায়ত্তশাসন ও ন্যায়সঙ্গত শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আগ্রহী। তবে, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের জয় মেনে নিতে পারেনি। তারা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার গঠনকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে।

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বিজয় ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

ঐতিহাসিক ৭ মার্চ

ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন। এদিন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিপুল জনসংগমের সামনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার অমোঘ ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথে দিক নির্দেশনা দেন। এই ভাষণকে স্বাধীনতার পূর্ব ঘোষণা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

কেন ৭ মার্চ এতো গুরুত্বপূর্ণ ছিলঃ  

ক) স্বাধীনতার আহ্বান: বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে স্পষ্টভাবে স্বাধীনতার আহ্বান করেন। তিনি বলেন, 

“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। “

 এই সরাসরি ঘোষণা জনগণকে মুক্তি যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করে।

খ) একাত্মতা গড়ে তোলা: ভাষণে বঙ্গবন্ধু সারা বাংলাদেশের মানুষকে একত্রিত করেন। তিনি বিভিন্ন পেশা, ধর্ম ও জাতির মানুষকে একই মঞ্চে এনে স্বাধীনতার লক্ষ্যে একাত্মতা গড়ে তোলেন।

গ) প্রস্তুতির আহ্বান: বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে সবাইকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি নিতে আহ্বান করেন। তিনি প্রতিটি গৃহে, প্রতি গ্রামে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা বলেন।  

সুতরাং, ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পথে প্রধান পদক্ষেপ। এটি জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে, তাদের একাত্মতা গড়ে তোলে এবং স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করে। এই ভাষণকে বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে।

স্বাধীন বাংলাদেশ

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা শুরু করে। এটি ছিল একটি পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ, যার লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমন করা। গণহত্যায় হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। সেদিন রাতেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করেন। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তিনি তার বাসভবন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এই ঘোষণা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা। শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রটি ছিল নিম্নরূপ:

“এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক। জয় বাংলা।”

শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা করে। এই ঘোষণার পরই বাঙালিরা পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল একটি দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারত ও বাংলাদেশের যৌথবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পরও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। বিশ্ব মাতৃকার চাপের মুখে ১৯৭২ সালের ২২ ডিসেম্বর তাকে মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তি পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় মুহূর্ত।

৮ জানুয়ারি প্রথমে লন্ডনে গিয়ে বিশ্ব নেতাদের সাথে সাক্ষাত করেন তিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা তুলে ধরে সমর্থন আদায় করেন। এরপর ভারতের রাজধানী দিল্লি গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাত করেন এবং পুনর্নির্মাণে ভারতের সহায়তা চান।

অবশেষে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকায় ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু। রাস্তায় লক্ষ লক্ষ মানুষ তাকে স্বাগত জানাতে জমায়েত হয়। রামনা রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি পুনর্নির্মাণের প্রতিশ্রুতি করেন এবং সবাইকে একসাথে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।

বাংলাদের সেবায় বঙ্গবন্ধু

স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমে অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি দেশের পুনর্গঠনের জন্য উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি হাতে নেন।

  • ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়ন ছিল তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এই সংবিধানে তিনি গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে বাংলাদেশের মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করেন।
  • তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। তিনি তাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করেন। এছাড়া তিনি ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করেন।
  • তিনি শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের জন্যও অনেক কাজ করেন। তিনি প্রাথমিক শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে এবং মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত নামমাত্র মূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করেন। এছাড়া তিনি ১১,০০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
  • তিনি যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্যও কাজ করেন। তিনি নতুন রাস্তাঘাট নির্মাণ করেন এবং রেল ও বিমান পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন করেন।
  • তিনি দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের জন্যও কাজ করেন। তিনি পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত ব্যাংক, বীমা এবং শিল্প কারখানা জাতীয়করণ করেন। এছাড়া তিনি নতুন শিল্প স্থাপন করেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ মাত্র পাঁচ বছরে অনেক দূর এগিয়ে যায়। 

বাংলার বুকে বঙ্গবন্ধুর খুন

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার স্থপতি, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সহধর্মিণী ফজিলাতুন্নেছাকে এক দল সেনা কর্মকর্তা রাষ্ট্রপতির বাসভবন আক্রমণ করে নির্মমভাবে হত্যা করে। এছাড়াও এ হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছেন ফজিলাতুন্নেছার দশ বছরের ছেলে শেখ রাসেল, তার বাকি দুই ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, পুত্রবধূগন সহ ১৭ জন। ওই সময় বিদেশে থাকার কারণে শুধুমাত্র তার কন্যাদ্বয় শেখ হাসিনা ওয়াজেদ এবং শেখ রেহানা প্রাণে রক্ষা পান। কবির কণ্ঠে শোকের মাতম, 

যদি রাত পোহালে শোনা যেত,

বঙ্গবন্ধু মরে নাই।

যদি রাজপথে আবার মিছিল হতো,

বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই।

তবে বিশ্ব পেত এক মহান নেতা,

আমরা পেতাম ফিরে জাতির পিতা।

পরের দিন ১৬ আগস্ট শেখ মুজিবের মরদেহ জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায় হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সামরিক তত্ত্বাবধানে দাফন করা হয়। অন্যান্যদেরকে ঢাকার বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।

বঙ্গবন্ধু পরবর্তী বাংলাদেশ

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশ এক অন্ধকার যুগে প্রবেশ করে। এরপর ক্ষমতায় আসেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। খন্দকার মোশতাক আহমেদ ছিলেন একজন স্বৈরশাসক। তিনি দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করেন। তার শাসনামলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করত। ১৯৭৬ সালের খন্দকার মোশতাক আহমেদকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতায় আসে জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনি দেশে সামরিক শাসন জারি করেন। ১৯৭৭ সালে তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে হত্যা করে ক্ষমতায় আসে মেজর জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এরশাদও ছিলেন একজন স্বৈরাচারী শাসক। তিনি দেশে স্বৈরাচারী শাসন জারি করেন। তার শাসনামলে দেশে গণতন্ত্রের অবসান ঘটে। ১৯৯০ সালের ২১ আগস্ট গণআন্দোলনের মুখে এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর ক্ষমতায় আসে নির্বাচিত সরকার। 

বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চেতনা 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন ও জন্মভূমির প্রতি নিষ্ঠার অবিচ্ছেদ্য গাঁথুনি। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসনের অবিচার দেখে তার হৃদয়ে জেগে ওঠে স্বাধীনতার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। তিনি বিশ্বাস করতেন, বাঙালি জাতি একটি স্বতন্ত্র জাতি, যাদের নিজেদের ভাগ্য নিজে নির্ধারণের অধিকার রয়েছে।

সারা জীবন তিনি এই স্বপ্নকেই ধারণ করেছেন। গণতন্ত্র, ভাষা ও সংস্কৃতির মর্যাদা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা – এই মূল্যবোধগুলোকে উজ্জীবিত করে তিনি বাঙালি জাতির আত্মবিশ্বাস ও দাবিকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছেন। তার ৬ দফা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে তিনি বারবার প্রমাণ করেছেন, সত্যের পথে হাঁটলে একদিন অবশ্যই বিজয় আসবে। আর তারই অক্লান্ত পরিশ্রম ও ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্বের ফলেই ১৯৭১ সালে জন্ম হয় স্বাধীন বাংলাদেশ। মুজিবকে নিয়ে বলতে গিয়ে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন-

‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি।ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনি হিমালয়ের মতো’।

 

আজও বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জাতীয় চেতনার মূর্ত প্রতীক। তার আদর্শ ও মূল্যবোধ দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়। 

বঙ্গবন্ধুর পুরষ্কার ও সম্মাননা 

বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় পুরস্কার হল স্বাধীন বাংলাদেশ। তার নেতৃত্বে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা অর্জন করে। এই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তিনি তার জীবনের অনেকটা সময় সংগ্রাম করেছেন। তিনি বারবার কারাবরণ করেছেন, নির্যাতিত হয়েছেন। কিন্তু তিনি কখনই তার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হননি।

এছাড়াও, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার অসামান্য কর্মের জন্য অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:

  • জুলিও ক্যুরি শান্তি পুরস্কার (১৯৭৩): বিশ্ব শান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে এই পুরস্কারে ভূষিত করে। এই পুরস্কারটি ছিল বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম আন্তর্জাতিক পদক।
  • স্বাধীনতা পুরস্কার (২০০৩): বাংলাদেশ সরকার বঙ্গবন্ধুকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে। এই পুরস্কারটি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা।
  • গান্ধী শান্তি পুরস্কার (২০২০): ভারত সরকার বঙ্গবন্ধুকে এই পুরস্কারে ভূষিত করে। এই পুরস্কারটি বিশ্বের শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য কাজ করা ব্যক্তিদেরকে দেওয়া হয়।

উপসংহার 

বাংলাদেশের মাটিতে জন্মেছিলেন এক মহান নেতা, যার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষার মর্যাদা আর মাটির ভালোবাসা, ছিল তার দুটো চোখের তারা। সেই ভালোবাসাই তাকে নিয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে, যেখানে বাঙালির রক্তে লেখা হলো স্বাধীনতার গান। কারাগারের দেয়াল ভেদ করে বেরিয়ে এল সেই সোনালী আলো, যাতে জেগে উঠলো বাংলা, মুখে হাসি ফুটলো ক্ষুধার্ত মানুষের। সেই কথার প্রতিধ্বনি হলঃ 

 মুজিব মানেই বাংলাদেশ, 

আমার লাল-সবুজ পতাকা 

মুজিব মানেই মুক্তি, 

মুজিব মানেই স্বাধীনতা

তাই, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ – দুটি নাম, একই স্বপ্ন, একই নিঃশ্বাস। যেন একে অপরের পরিপুরক, এমন এক সম্পর্ক যা চিরকাল ধরে থাকবে, বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় সুবর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ রচনা পিডিএফ 

প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা, তোমাদের সুবিধার্থে, রচনার পিডিএফ কপিটি দেওয়া হল। এখনই ডাউনলোড করে তোমারদের ফোনে/পিসিতে রেখে দাও। 

 

Scroll to Top