যেকোনো দেশের উন্নয়নের জন্য সেই দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। একটি দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নই একটি দেশকে অন্যান্য অংশের সাথে যুক্ত করতে পারে। তাই প্রতিটি দেশ সব সময় নিজ দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়ন করার প্রতিষ্ঠায় থাকে। বাংলাদেশও সেই দিক থেকে পিছিয়ে নয়। আমাদের রয়েছে পদ্মা সেতু।
পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম সেতু হলো ডানইয়াং – কুনশান গ্র্যান্ড ব্রিজ এবং এটি চীনের বেইজিং শহরে অবস্থিত। আর আমাদের বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সেতুটি হল পদ্মা সেতু (Padma Bridge)। পদ্মা সেতু একটি বহুমুখী সেতু। দেশের উত্তরাঞ্চল কে দক্ষিণাঞ্চলের সাথে জুড়ে দিতে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রকল্পটির উদ্যোগ নেওয়া। যাতে দুই প্রান্তের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটে। কোনরকম বৈদেশিক সহায়তা ছাড়া শুধুমাত্র নিজস্ব অর্থায়নে বাংলাদেশ সরকার পদ্মা সেতুর প্রকল্পটি গ্রহণ করেছিলেন। এমনকি আমাদের দেশের পদ্মা সেতু দেখতে অসংখ্য দর্শনার্থী ভিড় জমাচ্ছে। আজ এই আর্টিকেল এর মাধ্যমে পদ্মা সেতু সম্পর্কে আপনাদেরকে বিস্তারিত সকল তথ্য জানাবো। তাই আর দেরি না করে সম্পূর্ণ আর্টিকেল পড়ুন-
পদ্মা সেতু কয়টি জেলাকে সংযুক্ত করবে
সেতুটি শরীয়তপুর, মুন্সিগঞ্জ ও মাদারীপুর জেলার মধ্যে অবস্থিত। তবে সেতুটির বেশিরভাগ অংশ রয়েছে শরীয়তপুর জেলায়। বাংলাদেশের পদ্মা নদীর ওপর নির্মাণ করা হয়েছে সেতুটি যা বর্তমানে দক্ষিণ অঞ্চলের উন্নতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
পদ্মা সেতু নির্মাণের ইতিহাস
পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা বাংলাদেশ সরকারের অনেক আগে থেকেই ছিল। পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের প্রস্তাব রাখা হয় ১৯৯৮ সালে। এবং প্রস্তাবটিতে তুলে ধরা হয়েছিল যে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হবে ১৯৯৯ সালে এবং ২০০৪ সালের মধ্যে কাজ শেষ করা হবে। কিন্তু পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য যে বাজেটের দরকার ছিল তা সরকারের কাছে মজুদ ছিল না। তাই প্রকল্পটি সম্পন্ন করা হয়নি স্থগিত রাখা হয়েছিল। অতঃপর বাংলাদেশ সরকার ২০০৭ সালের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করেন।
২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগ জানায় নির্বাচনে জয়ী হলে কিছুদিনের মধ্যেই পদ্মা সেতু নির্মাণের কার্যক্রম শুরু করবে। এবং পরবর্তীতে যখন ২০০৮ সালে নির্বাচনের জয়ী হলেন তখন পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি সম্পন্ন করার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণকে বাংলাদেশ সরকার জানায় ২০১১ সালের ভেতর পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করা হবে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে সেতু প্রকল্পের জন্য প্রাক যোগ্যতা দরপত্রের আমন্ত্রণ জানায়। তখন সবাই অনুমান করে যে ২০১১ সালের দিকেই হয়তো পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ শুরু হবে।
২০১৩ সাল নাগাদ পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করা হবে এটাই আশা করা হয়েছিল। কিন্তু পদ্মা সেতু প্রকল্পের সাথে নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। যার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য আর্থিক সহায়তা দিতে অস্বীকার করে। এরপর বাংলাদেশ সরকার নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করার প্রস্তুতি নেয়। পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়।
২০১৪ সালে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ সরকার বিখ্যাত চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানির সাথে হয়। বাজেট মিলিয়ে বাংলাদেশ সরকার চায়না কোম্পানিকে পদ্মা সেতু নির্মাণের দায়িত্ব দেয়। পদ্মা সেতু প্রকল্প নির্মাণের জন্য যখন ২০১০ সালে দরপত্র চাওয়া হয়েছিল তখন ৪০ টির বেশি কোম্পানি অংশগ্রহণ করে। কিন্তু পরবর্তীতে বিশ্ব ব্যাংক যখন আর্থিক সহায়তা দিতে না জানায় তখন চায়না রেলওয়ে গ্রুপ রেলওয়ে কোম্পানি বাংলাদেশের পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য আর্থিক প্রস্তাব জমা দেয়।
সেতু রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায়ের জন্য কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে কর্পোরেশন ও চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডকে ২০২২ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিযুক্ত করা হয়। এবং পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য চীনের মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশনকে যুক্ত করা হয়। নদী শাসনের কাজটি করেছিল চীনের সিনোহাইড্রো কর্পোরেশন। ও দুইটি সংযোগ সড়ক অবকাঠামো নির্মাণের দায়ভার দেওয়া হয় বাংলাদেশের আব্দুল মোমেন লিমিটেডকে। এরপর পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ চলতে থাকে। যেহেতু নিজ দেশের অর্থায়নে সে দুটি নির্মাণ হয়েছে তাই বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের অর্থ এখানে যুক্ত রয়েছে।
পদ্মা সেতুর ডিজাইনার কে
এসমেক ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের হয়ে নকশা প্রণয়নে ব্যবস্থাপক হিসাবে কাজ করেন অস্ট্রেলিয়ার কেন হুইটলার। আর কানাডার ব্রুস ওয়ালেস নদী শাসনের নকশা তৈরি করেছিলেন।
পদ্মা সেতুর অর্থায়ন করেছে কোন দেশ
২০০৯ সালে বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে ১২০ কোটি মার্কিন ঋণ দিতে রাজি হয়।
কিন্তু ২০১২ সালে অভিযোগের কারণে ঋণের চুক্তিটি প্রত্যাখ্যান করে বিশ্ব ব্যাংক। তবুও আমাদের বাংলাদেশ সরকার থেমে থাকে নি। তিনি তার প্রতিশ্রুতি সম্পন্ন করেছেন। নিজ দেশের অর্থ দিয়ে নিজেদের সম্পদ গড়ে তুলেছেন। বাংলাদেশের সর্ব বৃহত্তম সেতু পদ্মা সেতু।
পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য কত কিলোমিটার
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সেতুটি হচ্ছে পদ্মা সেতু এবং এটি বহুমুখী একটি সেতু। পদ্মা সেতুর মোট দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার। পদ্মা সেতুকে কেন বহুমুখী সেতু বলা হয় জানেন? কারণ পদ্মা সেতুর উপরে রয়েছে চার লেনের সড়ক যা গাড়ি চলাচলের জন্য ব্যবহার করা হয়। এবং ট্রেন চলাচলের জন্য নিচে রয়েছে রেলওয়ে।
পদ্মা সেতুর প্রস্থ কত কিলোমিটার
পদ্মা সেতুর মোট প্রস্থ ১৮.১০ মিটার। দুই স্তর বিশিষ্ট ইস্পাত ও কংক্রিট দিয়ে সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে। পদ্মা সেতুতে ব্যবহার করা হয়েছে ৭৬০ মিলিমিটার ব্যাসের গ্যাস ট্রান্সমিশন লাইন এবং ১৫০ কিলোমিটার ব্যাসের টেলিফোন ফাইবার অপটিক্যাল সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে।
পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তের দৈর্ঘ্য
পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তের দৈর্ঘ্য হল ১.৬১ কিলোমিটার। রয়েছে চার লেনের ডুয়েল ক্যারেজওয়ে। ২৭.৬ মিটার হল মোট রাস্তা পরিমাণ। পাশাপাশি ২. ১৪ কিলোমিটার সার্ভিস রোড রয়েছে অপরপ্রান্তে। এবং স্থানীয় সড়কের দৈর্ঘ্য ০.৬৮ কিলোমিটার। পাশাপাশি রয়েছে পুলিশ স্টেশন, টোল প্লাজা, ইমারজেন্সি রেসপন্স এরিয়া, ওয়ে স্টেশন, এরিয়া ১ ইত্যাদি।
পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তের দৈর্ঘ্য
পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তের মোট দৈর্ঘ্য ১০.৫০ কিলোমিটার। জাজিরা প্রান্তেও রয়েছে চার লেনের ডুয়েল ক্যারেজওয়ে। ২৭.৬ মিটার হলো রাস্তার পরিমাণ। রয়েছে ২০ টি কালভার্ট, ৫ টি সেতু, ৮ আন্ডারপাস সংযোগ। আরো রয়েছে ১২ কিলোমিটার সার্ভিস রোড, টোল প্লাজা, পুলিশ স্টেশন, ওয়ে স্টেশন, ইমারজেন্সি রেসপন্স এরিয়া, তিন কিলোমিটার স্থানীয় সড়ক ইত্যাদি।
পদ্মা সেতুর মোট পিলার সংখ্যা
পদ্মা সেতুতে মোট পিলারের সংখ্যা ৪২ টি। প্রতিটি পিলারের ডেকের দৈর্ঘ্য ১৩.৬ মিটার এবং প্রস্থ ২২ মিটার। এবং ২.৫ মিটার এর একটি শক্ত অংশ রয়েছে উভয়দিকেই। এবং পদ্মা সেতুর প্রতি পিলারে রয়েছে ছয়টি করে পাইল। প্রতিটি পিলারের দৈর্ঘ্য ১২৮ মিটার ও রেডিয়াস ৩ মিটার। হিসাব করলে দেখা যায় পদ্মা সেতুতে মোট পাইলের সংখ্যা রয়েছে ২৭২টির মতো। পাইলে ব্যবহার করা হয়েছে ৪০ মিলিমিটার কংক্রিট। পদ্মা সেতুতে মোট কংক্রিটের সংখ্যা হল ১৩২ টি।
পদ্মা সেতুর স্প্যান সংখ্যা
পদ্মা সেতুতে মোট ৪১ টি স্প্যান রয়েছে। পদ্মা সেতুর প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার এবং প্রস্থ হল ২২.৫ মিটার। মাওয়া প্রান্তে রয়েছে মোট ৩৯ টির মতো স্প্যান। এবং জাজিরা প্রান্তে রয়েছে মোট ৪২ টির মত স্প্যান। মাওয়া প্রান্তের স্প্যানের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৪৭৮ মিটার। এবং জাজিরা প্রান্তের স্প্যানের দৈর্ঘ্য ১৬৭০ মিটার। ৮১টির মত স্প্যান রয়েছে মোট সড়ক ভায়াডাক্টে যার সর্বমোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৩১৪৮ মিটার। এছাড়াও জাজিরা ও মাওয়া প্রান্তে রয়েছে রেল ভায়াডাক্ট আর এতে রয়েছে প্রায় ১৪ টির মত স্প্যান। এবং এর সর্বমোট দৈর্ঘ্য হল ৫৩২ মিটার।
পদ্মা সেতুর উচ্চতা কত
পানির স্তর থেকে পদ্মা সেতুর উচ্চতা রয়েছে ৬০ ফুট। এবং সেতুটির ওপরে শুধুমাত্র যানবাহন চলাচলেরই সুযোগ নয় বরং রেল চলাচলের সুযোগও রয়েছে। নিজ দেশের অর্থায়নে এত বড় ও সুন্দর সেতু তৈরি হয়েছে যা প্রতিটি বাঙালির জন্য গর্বের বিষয়।
পদ্মা সেতুর পাইলিং গভীরতা কত
পদ্মা সেতুর পাইলিং গভীরতা ৩৮৩ ফুট। নিজের টাকায় নিজের সম্পদ নির্মাণের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি উন্নত জাতি হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
পদ্মা সেতুর ভূমিকম্প সহনীয় মাত্রা কত
প্রায় আট মাত্রার ভূমিকম্প সহনীয় পদ্মা সেতু রিখটার স্কেলে। সেতুটি জাহাজের ধাক্কা সামলাতে পারবে চার হাজার ডেড ওয়েট টনেজ (ডিডব্লিউটি) ক্ষমতার।
পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট কত টাকা খরচ হয়েছে
পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য ২০০৭ সালে অর্থ নির্ধারণ করা হয় ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। পরবর্তীতে ২০১১ সালে যখন পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয় তখন পদ্মা সেতু নির্মাণের ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। কিন্তু আবারো ২০১৬ সালে বাজেট বাড়ানো হয়। আরো ৮ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়। এবং পদ্মা সেতু নির্মাণের টোল ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকার মতো। কিন্তু ২০১৮ সালে আবার নির্মাণ ব্যয় সংশোধন করা হয়। নির্মাণ ব্যয় আরো ১৪০০ কোটি টাকা বৃদ্ধি করা হয়। এবং অবশেষে নির্মাণ ব্যয় দাঁড়ায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। এবং পদ্মা সেতু নির্মাণে সর্বমোট খরচ করা হয় ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো।
পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহন
আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া ব্যবস্থাপনা নেওয়া হয়েছিল। পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য অসংখ্য জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছিল। এবং এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল প্রায় ২২,৫৯৩ একটি পরিবার। এবং এই সকল পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০,০০০ এর বেশি। সরকার প্রতিটি পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিয়েছে এবং পুনর্বাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে। শরীয়তপুর মাদারীপুর ও মুন্সীগঞ্জ জেলা মিলিয়ে মোট জমির অধিগ্রহণ করা হয় ২৬৯৩ হেক্টরের মত এবং বরাদ্দ প্রায় ২৬৯৮ হেক্টর। প্রায় ৩ হাজার ৪৬ কোটি টাকা সরকার ব্যয় করেছে জমি অধিগ্রহণের জন্য। পদ্মা সেতু নির্মাণের মোট বাজেট ছিল ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ জমি অধিগ্রহণের জন্য সরকার প্রায় ১০ ভাগ নির্মাণ খরচ ব্যয় করে দিয়েছে।
পদ্মা সেতু কবে উদ্বোধন করা হয়
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সেতু পদ্মা সেতু উদ্বোধন করা হয় ২০২২। সালে ২৫ জুন। আমাদের দেশরত্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং নিজে মাওয়া প্রান্তে টোল প্রদান করে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতু উদ্বোধন করে। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সর্বপ্রথম পদ্মা সেতুতে স্প্যান। এরপর দেশের সকল জনগণের প্রচেষ্টায় পদ্মা সেতুর সকল কাজ সম্পন্ন হয়। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের অংশগ্রহণ করেছিল ৩৫০০ জনের মতো আমন্ত্রিত অতিথি। সেখানে বিভিন্ন পেশার কর্মকর্তারা ছিলেন। বিদেশি রাষ্ট্রদূত থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতারা, সরকারি আমলা, প্রকৌশলীসহ আরো নানা পেশার মানুষজন। এমনকি বিদেশে যে সকল মানুষজন পদ্মা সেতুর নির্মাণে ভূমিকা রেখেছেন সকলেই উপস্থিত ছিলেন।
পদ্মা সেতু এশিয়ার কততম সেতু
বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম সারিতে যে বড় বড় সেতুগুলো স্থান পেয়েছে তাদের তালিকায় এখন পদ্মা সেতুর নাম রয়েছে। এশিয়ার মধ্যে পদ্মা সেতুর স্থান বেশ উপরের দিকে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে পদ্মা সেতুর অবস্থান সর্বপ্রথমে রয়েছে। এশিয়ার মধ্যে চিনি বেশ কয়েকটি বড় বড় সেতু রয়েছে। এবং তারপরেই যে সেতুটি সবচেয়ে বড় সেটি হলো পদ্মা সেতু।
পদ্মা সেতু বিশ্বের কততম সেতু
পৃথিবীর বৃহত্তম সেতু গুলোর মধ্যে পদ্মা সেতুর অবস্থান ২৫তম। সকল দিক বিবেচনায় পদ্মা সেতুর অবস্থান বিশ্বে ১২২ তম।
পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক গুরুত্ব
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পদ্মা সেতু নতুন দ্বার উন্মোচন করবে। কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য, কৃষি আধুনিকায়ন, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, শিল্পায়ন, পর্যটন, বেকারত্ব হ্রাস, দরিদ্রতা মোচন ইত্যাদি সমস্যা সমাধানে পদ্মা সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। প্রায় ১.২৩ শতাংশ অবদান রাখবে দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে। এবং প্রায় ২.৩ শতাংশ জিডিপি বাড়বে দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলে। পদ্মা সেতুতে রয়েছে রেল সংযোগ, গ্যাস লাইন, অপটিক্যাল ফাইবার লাইন যা প্রযুক্তিগত দিক থেকেও দক্ষিণবঙ্গ কে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবে। এবং এটি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখবে।
পদ্মা সেতুর ফলে দেশের পর্যটনেও উন্নয়নমূলক সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। শরীয়তপুরসহ আশেপাশের জেলাগুলোতে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা তৈরি হবে। চলাচলের সুব্যবস্থা জন্য কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, সুন্দরবনের পর্যটকদের ভিড় বাড়বে। এবং বাংলাদেশ সরকারের পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তের শেষ দিকে এয়ারপোর্টে নির্মাণেরও একটি পরিকল্পনা রয়েছে। এটি নির্মাণ করা হলে বিদেশি পর্যটকরা পদ্মা সেতু দেখার জন্য আসবে পাশাপাশি সাগর কন্যা কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত ও সুন্দরবনের ভ্রমণ করতেও পর্যটকদের আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণ অঞ্চলে দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়লে পর্যটন খাত থেকে আয়ের পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে। এতে করে বাংলাদেশের জিডিপি আরো বেশি সম্প্রসারিত হবে।
বর্তমানে ঢাকার রাজধানীতে শিল্প কারখানার পরিমাণ অনেক বেশি। পদ্মা সেতুর কারণে ঢাকায় শিল্প কারখানার চাপ কমবে। এবং পদ্মা সেতুর পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে যা বেকারত্ব দূর করবে। সাতক্ষীরা জেলা চিংড়ি চাষের জন্য শীর্ষে রয়েছে। চিংড়ির চাষ করে দ্রুত ঢাকায় পাঠাতে চাষিরা সক্ষম হবে এবং এতে করে আগের থেকে ভালো দামও পাবে। গলদা ও বাগদা চিংড়ির বড় বাজার করা হবে বাগেরহাটে। আগে নদী পথের কারণে ঢাকা থেকে মানুষজন খুব একটা যাওয়া আসা করতো না। এখন সেতু হওয়ার ফলে খুব সহজেই ঢাকা থেকে পদ্মার পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে যাওয়া যাবে। এবং দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে তাজা চিংড়ি সহজেই পৌঁছানো যাবে। এবং পিরোজপুরে রয়েছে ভাসমান পেয়ারা বাগান এটি ভিমরুলিতে অবস্থিত। এখানে প্রচুর পরিমাণে পেয়ারা উৎপাদিত হয়। এবং এশিয়া মহাদেশের বিখ্যাত পেয়ারা বাগান হল স্বরূপকাঠির আটঘর কুরিয়ানা। এখন পরিবহনের সময় অল্প হওয়ায় খুব সহজেই পেয়ারা দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নেয়া যাবে এবং ব্যবসা করা যাবে।
বরিশালের আমড়া কতটা বিখ্যাত তা আমরা সকলেই জানি। বরিশালের আমড়া সারাদেশে পাওয়া যায়। আগে পরিবহনে অনেক সময় লাগত এবং আমড়ার গুণগত মান ঠিক থাকতো না। কিন্তু এখন খুব অল্প সময়ে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পাঠানো যায় পদ্মা সেতুর মাধ্যমে। ফলে চাষীদের আমড়া চাষের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অধিক চাষ করার মাধ্যমে চাষিরা অনেক লাভবান হতে পারছে। ভোলা জেলা হলো বাংলাদেশের কুইন আইল্যান্ড। এখানে প্রচুর পরিমাণ সুপারি উৎপাদিত হয়। বরগুনা জেলার নারিকেল ফলন অনেক বেশি ভালো। বরগুনা জেলা থেকে অধিকাংশ নারিকেল সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে যায়। ফরিদপুরে রয়েছে প্রচুর ধান, কম এবং পাটের সমাহার।
গোপালগঞ্জে বিখ্যাত হল বাদাম তরমুজ। যা কৃষি অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখছে। পরিবহন সুবিধার জন্য সহজেই এই সকল শস্য এবং ফল উপাদান দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে এতে করে চাষীদের আয়ের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষিতে উন্নতির সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এবং এটি সম্পূর্ণই হচ্ছে পদ্মা সেতুর কল্যাণে। পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে নিয়মিত পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ সরকার। কোন বিনিয়োগ থেকে যদি ১২ শতাংশ রিটার্ন পাওয়া যায় তবে তাকে বলা হয় আদর্শ বিনিয়োগ। আর ধরা যায় পদ্মা সেতু থেকে বিনিয়োগ প্রচুর পরিমাণে বাড়বে। পদ্মা সেতুর ফলে যে সব বিনিয়োগ ঘটবে তাতে ১৯ শতাংশ রিটার্ন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
একটি দেশের মোট জাতীয় আয় ও জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারের মাধ্যমে ওই দেশের অর্থনীতির অবস্থা জানা যায়। যদি এগুলো বৃদ্ধি পায় তবে অর্থনীতির উন্নয়নও অগ্রসর হয়। এবং বেকারত্ব সমস্যা দূর হয় জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন হয। সরকার ও দেশের জনগণ আশাবাদী যে পদ্মা সেতুর ফলে এই সকল কিছুই বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের মানুষের জীবনযাত্রা পাল্টে যাবে। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটবে। পদ্মা সেতুর গুরুত্ব ঠিক কতটা তা বর্তমানে মানুষজন উপলব্ধি করতে পারছে বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষেরা। এখন পণ্য আনা নেওয়ার ক্ষেত্রে সময়ের অনেকটাই সাশ্রয় হচ্ছে। দেশের মানুষের ভাগ্যের চাকা ঘুরে যাচ্ছে পদ্মা সেতুর কল্যাণে। অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
শিক্ষা বিস্তারে পদ্মা সেতুর গুরুত্ব
শুধু যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই পদ্মা সেতু গুরুত্ব কোন ভূমিকা রাখছে তাই নয় বরং শিক্ষা ক্ষেত্রেও পদ্মা সেতু বিশাল অবদান রাখছে। ভবিষ্যতে আরো পরিবর্তন দেখা যাবে বলে আশা করা যায়। দেশের দক্ষিণ অঞ্চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আগে তেমন একটা সুযোগ সুবিধা ছিল না। দেখা যেত যাতায়াতের অসুবিধার জন্য অনেকে দক্ষিণাঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুযোগ পেয়েও পড়তে যেতে চাইতো না। কিন্তু পদ্মা সেতু হওয়ার ফলে এখন যাতায়াত অনেকটাই সহজ হয়ে গিয়েছে।
দক্ষিণ অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা আরো বেশি বৃদ্ধি পাবে। ঢাকা কিংবা অন্যান্য জেলার শিক্ষার্থীরা দক্ষিণাঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গিয়ে পড়াশুনা করার সুযোগ পাবে। পদ্মা সেতুর শিক্ষা বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছে।
এছাড়াও শিক্ষা সরঞ্জামগুলো সহজেই ঢাকা থেকে দক্ষিণ অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গিয়ে পৌঁছাতে পারবে। পদ্মা সেতুর কল্যাণের সবকিছুই এখন সহজ হয়ে গিয়েছে। যা শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও কল্যাণ বয়ে আনছে।
পদ্মা সেতুর ভবিষ্যৎ ও সম্ভাবনা
বাংলাদেশের জন্য পদ্মা সেতু একটি গর্বিত অর্জন। পদ্মা সেতুর জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক বেশি উন্নত হয়েছে। এমনকি কুয়াকাটা ও আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে পর্যটকদের বেশ ভিড় দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি দেশি বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ইতিমধ্যেই পটুয়াখালীর পায়রা বন্দর এবং তার আশেপাশের অঞ্চল গুলিতে গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। এমনকি বিনিয়োগ করা শুরু করে দিয়েছে।
পাশাপাশি ২০২২ সালে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকেই দক্ষিণ অঞ্চলের জমির দাম বেড়ে গেছে কয় গুণ। তাছাড়া ইতিমধ্যেই পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তে বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সেতুর চারপাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সিটি, হাইটেক পার্ক, অলিম্পিক ভিলেজ আরো বিভিন্ন প্রজেক্ট বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ সরকার। সেতুর আশেপাশে বিভিন্ন কলকারখানা এবং শিল্প প্রতিষ্ঠান নির্মাণেরও পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। নির্মাণ করা হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ উন্নত মানের হোটেল। আশা করা যায় ২০২৫ সালের মধ্যেই পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে যানবাহনের চলাচলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে ২৭,৮০০ এর মত। পদ্মা সেতুর নির্মাণের ফলে উন্নতি ঘটবে ২১ টি জেলার জনসাধারণের।
ধারণা করা হয় প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ ২০৩০ সালের মধ্যে নতুন কর্মসংস্থানে কাজ করার সুযোগ পাবে। এতে করে বেকারত্ব অনেকটাই দূর হয়ে যাবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির সাথে সাথে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে জিডিপির হার বাড়বে ২.৩ শতাংশের মতো। এবং দারিদ্রতা দূর হবে প্রায় ০.৮৪ শতাংশ। এছাড়াও বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা হলো পদ্মা সেতু এশিয়ান হাইওয়ের পথ হিসেবে ব্যবহার করা হবে। তাই ধরা যায় পদ্মা সেতুর সম্ভাবনা বাংলাদেশে এক বিরাট ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশ পদ্মা সেতুর কল্যাণে ধীরে ধীরে উন্নতি লাভ করবে। পাশাপাশি দেশের মানুষ জনের ভবিষ্যৎ বেশ সুন্দর বলেই আশা করা যায়।
পদ্মা সেতু নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উক্তি
পদ্ম সেতু আমাদের অহঙ্কার, আমাদের গর্ব: প্রধানমন্ত্রীর
সবশেষে,
বাংলাদেশ সরকারের নিজ প্রচেষ্টায় নির্মাণ করা হয়েছে পদ্মা সেতু। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের অধীর আগ্রহ এবং প্রত্যাশার প্রতিফলন হল আমাদের এই পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকেই দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন দেখা যাচ্ছে গড়ে উঠছে অসংখ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান ও গার্মেন্টস। হয়তো পদ্মা সেতুকে ঘিরেই আগামীতে উন্নতির নতুন শিকড় উন্মোচন হবে। আশা করি আর্টিকেলটি আপনাদের ভালো লেগেছে। আমাদের সাথে থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
আরো পড়ুন –