Dreamy Media BD

ভাওয়াল রাজা, গাজীপুর

ভাওয়াল রাজা

প্রিয় পাঠক আমরা রূপকথায় এমন এমন কাহিনী শুনি যেগুলো শুনে আমরা খুব সহজেই বিমোহিত হয়ে পড়ি। সেই সব রূপকথার কাহিনীকে অচিরেই হার মানাবে গাজীপুরের জয়দেবপুরের ভাওয়ালের ‘মৃত’ রাজার সন্ন্যাসী হিসেবে আবির্ভাব হওয়া জমজমাট কাহিনী। চলুন শুরু করি মূল কাহিনী-

 

 

মারা যাওয়ার ১২ বছর পর হাজির হয়ে জমিদারের অংশ নিজের স্বীকৃতির দাবি তুললে পরিস্থিতি কেমন হতে পারে, ভাওয়ালের সন্ন্যাসী রাজার এমন কাহিনী না শুনলে তা অনুমান করা সম্ভব নয়।

 

মৃত রাজা দৃশ্যপটে উপস্থিত হতেই শুরু হয় রাজত্ব দখল করে বসে থাকা সুবিধা-বকিদের চক্রান্ত। তারা নিজেদের স্বার্থে রাজাকেই অস্বীকার করে বসে। অপরদিকে রাজা ও নিজের পরিচয় ও সত্যতা প্রমাণ করতে প্রাণপণ চেষ্টা চালান। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে রাজার স্ত্রী বিভবতীর ভূমিকা এই পরিস্থিতিকে আরো কঠিন থেকে কঠিনতর করে তোলে।

 

শুরু হয়ে যায় প্রাসাদের মধ্যে ষড়যন্ত্র। শুধু প্রাসাদের মধ্যেই নয়, রাষ্ট্র ষড়যন্ত্র সাধারণ মানুষ অর্থাৎ প্রজারাও দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে।

 

আদালতের উপর সত্য উদঘাটনের গুরু দায়িত্ব পড়ে। চূড়ান্ত ফয়সালায় পৌছাতে লেগে যায় বহু বহুবছর। ততদিনে ভাওয়ালের ক্ষয়িষ্ণু জমিদারি নয় শুধু, পুরো জমিদার প্রথায় বিলুপ্তির পথে। গত শতাব্দীর গোড়ার দিকের এই কাহিনী ঢেউ শুধুমাত্র ভাওয়াল পরগনা নয় এই পরগনা ছড়িয়ে ভারত এমনকি লন্ডনের টেমস নদীর শহরে গিয়েও আছড়ে পড়ে।

 

জন্ম হয় রূপকথার চেয়েও আশ্চর্যজনক নতুন গল্প কথার। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বিশেষ বুলেটিন বের করা হয়। শুরু হয় লেখালেখি গল্প, উপন্যাস ও পুথি পত্র। বিভিন্ন ভাষায় নির্মাণ করা হয় নাটক, যাত্রাপালা ও সিনেমা।

 

কাহিনী ছিল এমনঃ এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় ১৯০৯ সাল। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আবহাওয়া পরিবর্তনের জন্য ২৪ বছরের মেজকুমার রামেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরী পারিবারিক সিদ্ধান্তে ভারতের দার্জিলিং গিয়েছিলেন। তার সঙ্গী হন ২০ বছর বয়সের স্ত্রী মেজরানি বিভবতি দেবী, বিভবতী দেবীর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, পারিবারিক চিকিৎসক আশুতোষ দাশগুপ্ত ও ব্যক্তিগত কর্মচারী মিলে প্রায় ২৭ জন। ২৫ এপ্রিল মেজকুমার তার দলবল নিয়ে দার্জিলিংয়ে পৌঁছায়।

 

দার্জিলিং যাওয়ার পর মাত্র ১৫ দিন আগে মেজকুমার সালমা কাছারির কাছে জোলারপাড় জঙ্গলে রয়েল বেঙ্গল টাইগার শিকার করে তার একটি ছবি তুলেছিলেন। এই ছবিটিকে টাইগার ফটো হিসাবে অবহিত করা হয়। টাইগার ফটোটি উনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা ছবি হিসেবে বাংলাদেশের আর্কাইভ প্রদর্শনীতে স্থান পায়।

 

 

এপ্রিল মাস শেষে মে মাসের শুরুর দিকে মেজ কুমারের পেটে ব্যথা সহ নানা শারীরিক উপসর্গ দেখা দেয়। প্রতিদিনই দার্জিলিং থেকে জয়দেবপুরে তার বার্তার মাধ্যমে রাজার স্বাস্থ্যের খবরা খবর পাঠানো হতো।

 

প্রথম টেলিগ্রাম এ জানানো হয় রাজার ৯৯ ডিগ্রি জ্বর, তারপরের টেলিগ্রামে জানানো হয় জ্বর বৃদ্ধি হয়েছে এবং পেটে ভীষণ যন্ত্রণা তারপর সিভিল সার্জন সাহেব দেখে গেছেন এইসব খবর আস্তে থাকে। ৭ই মে সন্ধ্যার পর থেকে কুমারের অবস্থার আরো অবনতি হতে থাকে। ওষুধ খাওয়ার পরও বমি ও রক্ত মিশ্রিত পায়খানা হতেই থাকে।

 

তারপর ৮ই মে সন্ধ্যা সাতটা থেকে আটটার মধ্যে কোন এক সময় কুমারের মৃত্যু হয়েছে বলে খবর পাঠানো হয়। তারপর তার সাথে থাকা আত্মীয়-স্বজন খবর পাঠান তাড়াহুড়ো করে দার্জিলিংয়ের শ্মশানে রাজার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়েছে বলে জানানো হয়। তার দুইদিন পর ১০রা মে মেজরানি ও অন্যান্যরা জয়দেবপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা আরম্ভ করে। তারা ফিরে আসার পর ১৮ই মে রাজা মেজ কুমারের শ্রাদ্ধ করা হয়।

 

গতানুগতিকভাবে রাজার এই কাহিনী এখানেই সমাপ্ত হবার কথা ছিল। কিন্তু ভাওয়ালের রাজার জীবন মৃত্যুর কাহিনী এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটেনি।

 

শ্রাদ্ধের দিনই কানা গুঞ্জন উঠে রাজা মেজ কুমারের দেহের নাকি সৎকার করা হয়নি। ঐদিন শ্মশান ঘাটে মেজকুমারের লাশ নিয়ে যাওয়ার পর প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। তারপর লাশ ফেলে লোকজন শ্মশানঘাট থেকে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেন। ঝড় বৃষ্টি থামলে তারপর তারা শ্মশানে গেলে তারা আর সেখানে রাজার লাশটিকে দেখতে পাননি।

 

১২ বছর পরের কথাঃ হাজার ১৯২১ সালের চৌঠা মে ঢাকার বাকল্যান্ড বাঁধে আত্মপ্রকাশ ঘটে গেরুয়া বসন পড়া এক সন্ন্যাসীর। দেখতে নাকি অবিকল মেজ কুমারের মতই। এই স্থান থেকে ওই স্থান হতে হতে একসময় এই খবরটি জয়দেবপুর ও কাশিমপুরের জমিদার বাড়িতে এসে পৌঁছায়।

 

কাশিমপুরের জমিদার অতুল প্রসাদ রায়চৌধুরী সেই সন্ন্যাসীকে তার জমিদার বাড়িতে নিয়ে আসেন। সেখানে ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ, ছোট-বড় হাজার হাজার মানুষের ভিড় লেগে যায়। যারা মেজ কুমারের খুব কাছের লোক ছিল তারা তো এই সন্ন্যাসীকে দেখে অবাক। মানুষে মানুষে এতটা মিল কি করে সম্ভব!

 

আগন্তকের নাই গেরুয়া বসন পরা আর মুখ ভর্তি দাড়ি থাকা সত্ত্বেও তারা নিশ্চিত ইনি তাদের মৃত মেজ কুমার। লোকজন আহ্লাদ ভোরে সে সন্ন্যাসীর হাত-পা-মুখ ছুঁয়ে দেখেন।

 

সন্ন্যাসী কাশিমপুরে কয়েকদিন থাকার পর তার দলবল নিয়ে রাজবাড়ীর অদূরে মাধব বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। এই রাজবাড়ীতে এসে দেখা করেন মেজকুমারের বোন জ্যোতির্ময় দেবী। প্রথম দেখার পরেই জ্যোতির্ময় দেবীর চোখ কপালে উঠে যায়। এতো পুরোটাই তার ভাইজান মেজ কুমারের প্রতিচ্ছবি। তারপর তিনি সে সন্ন্যাসীকে তার স্বামীর বাড়িতে নিয়ে যান। সবকিছুই তার ভাইয়ের মতই হাত-পা, নাক-মুখ, গায়ের রং গলার স্বর, পায়ের ক্ষত, সবকিছুই।

 

জ্যোতির্ময়ী ভালো করে খেয়াল করেন তার ভাইয়ের মতই সেই সন্ন্যাসীর ও খাওয়ার সময় ডান হাতের তর্জনী বেঁকে যায়।, জিহ্বাটা সামনের দিকে বেরিয়ে আসে। জ্যোতির্ময়ই তার ভাইয়ের আগের একটি ছবি সন্ন্যাসীর সামনে এনে ধরেন। তারপর দুইজনের চোখ দিয়েই অঝোরে পানি পড়তে থাকে।

 

উপস্থিত হওয়া আত্মীয়-স্বজন ও কৌশলী মানুষজন সন্ন্যাসীর পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য রীতিমতো পরীক্ষা নিতে শুরু করেন। জমিদার পরিবারের খুঁটিনাটি সকল বিষয়- তার বাবার নাম, মায়ের নাম, এমনকি ধাই মার কাছে মেজো কুমার বড় হয়েছেন তার নাম পরিচয় কিছুই বাদ যায়নি। সন্ন্যাসী নিজের পরিচয় আত্মপ্রকাশ এর পরীক্ষায় রীতিমতো উত্তীর্ণ হন। যত দিন যায় ততদিন সন্ন্যাসীকে ঘিরে লোকজনের কৌতুহল ও উদ্দীপনা বাড়তে থাকে। বিভিন্ন ধরনের গুজবের ডালপালাও মিলতে থাকে।

 

কিন্তু যাকে নিয়ে এত চঞ্চল্য সেই সন্ন্যাসীর মুখ থেকে কথা বের হয় অনেক কম। নিজের পরিচয় প্রশ্ন তিনি প্রচন্ডরকম নির্লিপ্ততা প্রকাশ করেন। লোকজনের কৌতূহল প্রতিদিন লাফাতে লাফাতে বাড়তে থাকে। তারপর অনেকটা হয়রান হওয়ার পর তিনি তার সতীর্থ সন্ন্যাসীদের নিয়ে চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ তীর্থে চলে যান। তারপর কিছুদিন কাটার পর আবার ফিরে আসে ঢাকার বাকল্যান্ড বাঁধে। কিন্তু তারপরও লোকজনের উৎসাহে ভাটা পড়ছে না। বরং তার মনে হচ্ছে বিস্ফোরক অবস্থা।

 

কাশিমপুর জমিদার বাড়ির জমিদার অতুল প্রাসাদ রায়চৌধুরী সন্ন্যাসীকে আবার তার বাড়িতে নিয়ে যান। তারপর হাতিযোগে সন্ন্যাসীকে নিয়ে ছুডেন জয়দেবপুরের রাজবাড়ীর উদ্দেশ্যে। তাদের বহরের পিছু ছুটতে থাকে উৎসাহী জনতা। জয়দেব পর্যন্ত আস্তে আস্তে কাফেলা রীতিমতো জনস্রোতে ভরপুর হয়ে যায়।

 

রাজবাড়ির সামনে কামিনী গাছের নিচে গিয়ে বসেন সন্ন্যাসী। হাজার হাজার লোকের কৌতূহল উদ্দীপনা সেই সন্ন্যাসীকে ঘিরে। সমবেত হওয়া লোকজনের সামনে রাজবাড়ীর চিকিৎসক আশুতোষ দাশগুপ্ত সন্ন্যাসীকে তাদের দার্জিলিং অবস্থানকালীন একটি ঘটনার বিষয়ে প্রশ্ন করেন। সন্ন্যাসী সঠিক জবাব দিয়ে তার দাবির পক্ষে জোরালো প্রমাণ দেন।

 

কিন্তু প্রমাণ যত অকাট্যই থাক, মেজ কুমারকে মেনে নেওয়া গুটিকয়েক স্বার্থলোভী লোকের জন্য সম্ভব ছিল না। এদের মধ্যে অন্যতম কুমারের স্ত্রী বিভবতীর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর।

 

এর কারণ হচ্ছে, তিনি ইতোপূর্বেই মেজকুমারের জীবন বিমার ৩০ হাজার টাকা উঠিয়ে আত্মসাৎ করে নিয়েছেন। এছাড়াও মেজ কুমারের স্ত্রী হিসেবে বিভবতি জমিদারের পক্ষ থেকে বাৎসরিক লক্ষাধিক টাকার যে ভাতা পেতেন তার পুরোটাই গ্রহন করতেন মেজকুমারের শালা সত্যেন্দ্রনাথ। এজন্যই মেজকুমারের ফিরে আসা সত্যেন্দ্রনাথের জন্য ছিল অশনি সংকেত।

 

ভাইয়ের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়া বিভাবরির জন্য ছিল অসম্ভব। বিভতির কথা শুনলেই এর কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। মেজ কুমারের কথিত মৃত্যুর তিন দিন পর অর্থাৎ ১১ই মে জ রনিকে নিয়ে সত্য বাবু জয়দেবপুরে ফিরে আসেন। তারপর সত্য বাবু একদিন বোনের সঙ্গে দেখা করতে গেলে বিভবতি মুখ ফিরিয়ে বলেন, “দাদা তুমি আমাকে রানি করেছিলে, আবার তুমি আমাকে ভিখারিনী বানালে”।

 

মেজ কুমারের কথিত মৃত্যুর আট বছর আগে তার বাবা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী ও তার দুই বছর আগে মা বিলাসমণি মারা যান। বড় ভাই রনেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরী মারা গেছে মেজ কুমারের দার্জিলিং থেকে অন্তর্ধানের এক বছর পরে।

 

সন্ন্যাসীর আগমনের সময় জমিদার বাড়ির উত্তরসূরীর মধ্যে শুধুমাত্র ছোট কুমার রবীন্দ্র নারায়ণ রায় বেঁচে ছিলেন। তিনি সন্ন্যাসীর পরিচয় নিয়ে বিতর্ক হওয়ার ঘটনায় নিরবতা পালন করেন।

 

সত্যেন্দ্র নিজের স্বার্থ রক্ষায় উঠে পড়ে লাগলেন সন্ন্যাসীকে প্রতারক প্রমাণ করার জন্য। তিনি ছুটে গেলেন দার্জিলিংয়ে। মেজ কুমারের মৃত্যুর সনদ ও কিছু সাক্ষ্য প্রমাণ নিয়ে ঢাকা এসে কালেক্টর জে এইচ লিন্ডসের সাথে দেখা করে সন্ন্যাসী কে প্রতারক ঘোষণার দাবি জানান।

 

কালেক্টর সাহেব এই সাক্ষ্য প্রমাণ এ প্রবাহিত হয়ে সন্ন্যাসীকে প্রতারক উল্লেখ করে নোটিশ জারি করেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে এই নোটিশের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।

 

নোটিশ জারি করার সময় কালিয়াকৈরের নিকটে মির্জাপুর নামক স্থানে পুলিশের সাথে জনতার সংঘর্ষ বেঁধে যায়। এই সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান জুনুব আলী নামের এক প্রজা। এই সময় প্রজারা রাজস্ব আদায়ের সময় রশিদে মেজকুমারের নাম লিপিবদ্ধ করার দাবি উত্থাপন করেন। এক পর্যায়ে প্রজারা খাজনা দিতে অস্বীকার করেন।

 

অপরদিকে মেজ কুমারের খুব্ধ সমার্থকরা জয়দেবপুরে ইতিমধ্যেই ভাওয়াল তালুকদার ও প্রজা সমিতি গঠন করেন। এই আন্দোলনের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন হারবাইদের জমিদার দিগেন্দ্র নারায়ন ঘোষ।জনতারা সন্ন্যাসীকে নিয়ে এসময় জয়দেবপুরে ১৫ই মে এক বিরাট জনসভার আয়োজন করে। রাজবাড়ীর মাঠে ওই বিশাল জনসভায় কমপক্ষে দশ হাজার নারী পুরুষ সমাবেত হন।

 

সেইদিন এমন পরিস্থিতি হয়েছিল যে, রেল কোম্পানিকে স্পেশালভাবে ট্রেনের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল এবং বাজারের চিড়ার দাম বেড়ে গিয়েছিল কয়েকগুণ।

 

কাপাসিয়ার বারিষাব জমিদারীর বড় তালুকদার আদিনাথ চক্রবর্তী এই জনসভায় সভাপতিত্ব করেন। সেই দিন সাধারণ মানুষেরাই নিজেদের চাঁদা দিয়ে এই তহবিল গঠন করেছিলেন। পথনাটক, যাত্রাপালা, পুঁথি পাঠ, জারি গান, গল্প বুলেটিন পত্রিকায় ছেপে বিশাল জনমত তৈরি করেছিলেন। কিন্তু অপরপক্ষও বসে ছিল না। তারা বই ছাপেন ‘ভাওয়ালের ভূতের কান্ড’ নামে।

 

১৯২২ সালে মেজ কুমারের ঠাকুরমা রানি সত্যভামা দেবী মেজ কুমারের সঙ্গে ঢাকায় বসবাস করতে লাগলেন। ওই বছরের ১৫ ডিসেম্বরসত্যভামা দেবী মারা গেলেন। সত্যভামা দেবী মারা গেলে সেই সন্ন্যাসী তার মুখাগ্নি করেন।

 

১৯২৪ সালের আগস্ট মাসে কলকাতার ভবানীপুরের হরিশ মুখার্জির একটি বাড়িতে অবস্থানরত অবস্থায় বড় রানী অর্থাৎ মেজ কুমারের বড় ভাই রনেন্দ্র নারায়ণের স্ত্রী সূর্যবালা দেবী সেই সন্ন্যাসীকে দেবর বলে চিনতে পারেন। এছাড়াও মেজরানের কয়েকজন আত্মীয় মেজ কুমার কে চিনতে পারেন এবং তার পক্ষেই সাক্ষী দেন।

 

আইনজীবী ও স্থানীয় জমিদারদের সঙ্গে নিয়ে সন্ন্যাসী স্ব শরীরে ঢাকা বোর্ড অফ রেভিনিউতে হাজির হয়ে তার পরিচয় উদ্ঘাটনের জন্য ১৯২৬ সালের ৮ই ডিসেম্বর আবেদন জানান। কিন্তু সে আবেদন অগ্রাহ্য হয়।

 

সেই আবেদনে সন্ন্যাসী উল্লেখ করেন, দার্জিলিংয়ের যাওয়ার পর তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললে তার সহযাত্রীরা ভাবেন তিনি মারা গেছেন। দুর্যোগপূর্ণ সেই রাতে স্থানীয় শ্মশানে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করার জন্য তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি হওয়ার কারণে তারা সেই শ্মশানে তাকে ফেলে চলে যায়।

 

তারপর স্থানীয় নাগাসন্ন্যাসীরা তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলেন। এর মধ্যবর্তী বছরগুলোতে তিনি সন্ন্যাস ব্রতে দীক্ষিত হয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তিনি জানান জমিদারের বিষয়ে তার কোন আগ্রহ নেই। কিন্তু কিছু স্বার্থ লোভী মানুষ তাকে প্রতারক প্রমাণে সচেষ্ট হওয়ায় এখন পরিচয় প্রকাশের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

 

কিন্তু কর্তৃপক্ষ এ আবেদনেও ও কর্ণপাত না করায় ১৯৩০ সালে ২৪শে এপ্রিল ঢাকার অতিরিক্ত জজ আদালতে নিজের স্বীকৃতি ও জমিদারের অংশ দাবি করে মামলা করে সেই সন্ন্যাসী।

 

মামলার শুরুতেই প্রতিপক্ষের মূল ব্যক্তি অর্থাৎ সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি দার্জিলিংয়ের সিভিল চারজনের কাছ থেকে সংগ্রহ করা মেঝ কুমারের মৃত্যু সনদ আদালতে উথাপন করেন। এছাড়াও দার্জিলিং আবহাওয়া কেন্দ্র থেকে মেজ কুমারের মৃত্যুর দিনের আবহাওয়ার রিপোর্ট সংগ্রহ করে আদালতে দাখিল করেন। এই আবহাওয়ার রিপোর্টের মাধ্যমে সত্যেন্দ্রনাথ প্রমাণ করার চেষ্টা করেন মেজ কুমারের মৃত্যুর দিনের আবহাওয়া স্বাভাবিক ছিল।

 

এই রিপোর্ট আদালতের সাময়িক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করলেও পরপরই প্রমাণ হয় রিপোর্ট সংগ্রহের ক্ষেত্রে দুর্নীতি করা হয়েছে। আবহাওয়া অফিসের রক্ষিত তথ্যপত্র কাটাছেরা। দীর্ঘ ছয় বছর ধরে দুই পক্ষের মধ্যে সাক্ষ্য প্রমাণ চলে।

 

এরপর বিচারক পান্না পাল বসু ২৪ আগস্ট ১৯৩৬ সালে ৫৩২ পৃষ্ঠার রাই দেন। উভয় পক্ষ থেকে সাক্ষ্য দেন ১৫৪৮ জন। এর মধ্যে বাদী পক্ষ থেকে সাক্ষ্য দেন ১০৬৯ জন। তারপর প্রমাণ হয় আলোচিত সন্ন্যাসী ভাওয়ালের মেজকুমার রমেন্দ্রনারায়ণ রায়।

 

এই রায়ে এর জয়লাভের পর মেজ রাজা জয়দেবপুরের রাজবাড়ি মাঠে বিশাল একটি রাজ ভোগের আয়োজন করেন। হাজার হাজার সাধারণ মানুষ প্রজারা জমায়েত হয় এই মাঠে। কিন্তু খাবার দেওয়ার কিছু মুহূর্ত আগে কিছু সন্ত্রাসী লাঠি হাতে ধর ধর বলে ধাওয়া শুরু করে। রাজা নিষ্পলক দৃষ্টিতে হাতির পিঠে শান্ত হয়ে বসে থাকেন। এ ঘটনা ঘটার পর রাজা কলকাতায় চলে যান।

 

আবার বিবাদী পক্ষ কলকাতার হাইকোর্টের রায় চ্যালেঞ্জ করে আপিল করে। ১৯৪০ সালের ২৯ বিচারপতি লিয়নার্ড ক্যাস্টোলো পূর্বের রায় বহাল রেখে আদেশ জারি করেন। এই আপিলে হারার পর বিবাদীপক্ষ আবার লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে পুনরায় আপিল করেন। তারপরও কোন লাভ হয়নি। ৩০ জুলাই ১৯৩৬ সালের প্রিভি কাউন্সিলে উ যে রায় ঘোষণা করা হয় তাতে মেজ রাজার অনুকূলেই যায়।

 

ভাওয়ালের রাজার মামলা এত প্রসিদ্ধ লাভ করেছিল যে, ভারতবর্ষের বিখ্যাত মামলাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি দিল্লিতে গত শতাব্দীর সৃষ্টিকারী অন্যতম শ্রেষ্ঠ মামলা হিসেবে স্থান পেয়েছিল।

 

মামলাটি ১৯৩০ সালের শুরু হয়ে শেষ হয়েছিল ১৯৪৬ সালে। আদালতে প্রকাশ্যে বিচারকার্য আরম্ভ হয় ১৯৩৩ সালের নভেম্বরের ২৭ তারিখে। ১৯৩৬ সালের ২১ শে মে পর্যন্ত আদালতে শুনানি চলে। সেখানে উভয় পক্ষ থেকে মোট ১৫৪৮ জন সাক্ষ্য প্রদান করেন। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহণ করার জন্য বিলেতেও কমিশন বসে।

 

এই মামলা চলার সময় ঢাকার চারটি পত্রিকা বিবরণ প্রকাশ করতো এবং ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা বিকালে বিশেষ সংস্করণ বের করত।

 

প্রিভিয়ারস কাউন্সিলের রায়ের পর শুধুমাত্র তিন দিন বেঁচে ছিলেন মেজ কুমার রাজা। কিন্তু মেজ কুমারের মৃত্যুর খবরটি পাঁচই আগস্ট জয়দেবপুরে পৌঁছায়। যেন মনে হয় মামলার চূড়ান্ত রায়ের জন্যই তার অপেক্ষা ছিল। কারণ, এই রায়ের সঙ্গে জড়িত ছিল একজন জমিদারের মান সম্মান, ইজ্জত ও আপামর জনতার ভালোবাসা।

 

কসময় ভাওয়াল পরগনার সমস্ত শাসন কার্য পরিচালিত হতো গাজীপুরের জয়দেবপুরের ভাওয়াল রাজবাড়ী থেকে। .৩৬০ কক্ষ বিশিষ্ট এই রাজবাড়ীটি বর্তমানে গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। ইতিহাস ও ঐতিহ্যবাহী ভাওয়াল রাজবারের সাথে জড়িয়ে রয়েছে ভাওয়াল রাজা নারায়ণ রায় চৌধুরীর কথিত মৃত্যু এবং ১২ বছর পর পুনরায় ফিরে আসার শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনী।

Related Post

মৃত্যু নিয়ে উক্তি

150+মৃত্যু নিয়ে উক্তি, বাণী, ক্যাপশন 2024

মৃত্যু নিয়ে উক্তি জন্মিলে মরিতে হবে আর এটাই সত্যি। মৃত্যু হচ্ছে সবচেয়ে চিরন্তন সত্যি। পৃথিবীতে প্রতিটি প্রাণীর মৃত্যুর স্বাদ অনুভব করতে হবে। সবসময় মৃত্যুর জন্য

Read More »
খুশির স্ট্যাটাস

200+ স্টাইলিশ খুশির স্ট্যাটাস | হাসি নিয়ে ক্যাপশন

খুশির স্ট্যাটাস | হাসি নিয়ে ক্যাপশন জীবনের সুন্দর খুশির মুহূর্ত আমরা সবাই বাঁধাই করে রাখতে চাই। আর এই খুশির মুহূর্তকে ধরে রাখার সবচেয়ে সহজ উপায়

Read More »

স্টাইলিশ ভালোবাসার ছন্দ | রোমান্টিক ছন্দ | Love Status Bangla

❤❤ভালোবাসার ছন্দ | ভালোবাসার ছন্দ রোমান্টিক | ভালোবাসার ছন্দ স্ট্যাটাস❤❤ ভালোবাসা হলো এক অন্যরকম অনুভূতির নাম, যা শুধুমাত্র কাউকে ভালবাসলেই অনুভব করা যায়। আমরা বিভিন্নভাবে

Read More »
মন খারাপের স্ট্যাটাস

মন খারাপের স্ট্যাটাস, উক্তি, ছন্দ, ক্যাপশন, কিছু কথা ও লেখা

মন খারাপের স্ট্যাটাস মন খারাপ – এই কষ্টের অনুভূতি কার না হয়? সবারই কখনো না কখনো সবারই মন খারাপ হয়। জীবনের ছোটোখাটো অঘটন থেকে শুরু

Read More »

Leave a Comment

Table of Contents