ডায়াবেটিস কত হলে বিপদ
বর্তমানে গবেষণায় দেখা গিয়েছে শতকরা পাঁচ জনের মধ্যে একজন ডায়াবেটিস রোগের শিকার। ডায়াবেটিস আমাদের সাধারণ লাইফ স্টাইলটাই বদলে দিয়েছে। যারা এখনো এই রোগের শিকার হননি তারা সব সময় ভয়ে ভয়ে দিনযাপন করতে থাকেন কখন না জানি এ রোগের পরবর্তী শিকার আপনি না হয়ে পড়েন।
প্রিয় দর্শক আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু হলো ডায়াবেটিস কত হলে বিপদ। নিয়ন্ত্রণহীন জীবনযাপন, মানসিক দুশ্চিন্তা, হাবিজাবি খাওয়ার অভ্যাস, আলসেমী এগুলো থেকেই শরীরে ডায়বেটিস দানা বাঁধতে শুরু করে।
আমরা অনেকেই জানি না সুস্থ শরীরে কত পার্সেন্ট রক্তে শর্করা ধরা পড়লে ডায়বেটিস হয়েছে বলে মনে করা হয়। আশাকরি সম্পূর্ণ আর্টিকেলেটি মনোযোগ সহকারে পড়ে কিছু ধারণা নিতে পারবেন। চলুন শুরু করা যাক।
ডায়াবেটিস কি?
এক কথায় ডায়াবেটিস একটি এমন রোগ যখন শরীর নিজে থেকে ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না। ইনসুলিন হচ্ছে মানব দেহের কোষগুলিতে শর্করা প্রবেশ নিয়ন্ত্রণে রাখে। মাঝে মাঝে মানবদেহ ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না যার ফলে রোগীর শরীরের গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়। তাই জন্য ইনসুলিন ব্যবহার করতে হয়। ইনসুলিন মানব দেহের চাবি হিসেবে কাজ করে। এতে শরীরের চিনি, শর্করা, গ্লুকোজ রক্তের সাথে মিশে প্রবাহিত হয়ে কোষের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে।
কোষ সেই গ্লুকোজের দ্বারা শরীরের শক্তি উৎপাদন করে। মূলত ইনসুলিন তৈরি হয় অগ্ন্যাশয়ের বিশেষ এক ধরনের কোষ দিয়ে তৈরিকৃত হরমোন আই-লেটস থেকে। ইনসুলিনের অভাবে যখন শরীরে ডায়াবেটিস দেখা দেয়, তখন রোগের জন্য রোগীর শরীর অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দেয়।
ডায়াবেটিসের ধরন
সাধারণ চোখে ডায়াবেটিস ২ ধরনের। কিন্তু এই দুই প্রকার ছাড়াও আরো অনেক ধরনের আছে যেমন-
- গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস।
- নিওনাটাল ডায়াবেটিস।
- জেসটেসানাল ডায়াবেটিস।
আর বাকি যে ২ ধরনের বললাম তার প্রথমটা হলো রোগীর দেহের মধ্যকার সব ইনসুলিন নষ্ট হয়ে যাওয়া। এই ধরনের রোগীর মানুষের তৈরিকৃত ইনসুলিন না দিলে প্রাণের আশঙ্কাও থাকে। বর্তমানে এই ধরনের রোগীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবার আসি দ্বিতীয় ধরনের ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর কথাই। এই ধরনের ডায়াবেটিসে শরীরে ইনসুলিন থাকলেও সেগুলো অক্ষম কিংবা নষ্ট হয়ে গেছে। যার ফলে রোগীর গ্রহণ করা খাবার সেটি গ্লুকোজের রূপে শরীরে জমা হয়ে থাকে।
ডায়াবেটিসের লক্ষণ
দুই ধরনের ডায়াবেটিসের ধরনের কথাই আগেই বলছি। এতক্ষনে ধারনা দিয়েছি এবার বিস্তারিত পড়ুন-
১ নং ধরনের ডায়াবেটিসের লক্ষণ
- অতিরিক্ত পানির পিপাসা পাওয়া।
- ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া।
- দ্রুত ওজন কমে যাওয়া।
- ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া।
- সবসময় শরীর ক্লান্ত থাকা।
- শরীরে অস্বাভাবিক অনুভূতি।
- চোখে ঝাপসা দেখা।
- বমি বমি ভাব।
- পেটে হালকা ব্যথা।
- নাকে অবাঞ্চিত দুর্গন্ধ পায়।
- চুলকানি ইত্যাদি।
২ নং ধরনের ডায়াবেটিসের লক্ষণ
- হাতে ও পায়ে ঝিনঝিন অনুভব।
- তৃষ্ণার চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া।
- বগলে বা ঘাড়ে কালো দাগ।
- চুলকানি সৃষ্টি হওয়া।
- প্রস্রাবের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া।
- অকারনে দুর্গন্ধ অনুভব করা।
- মেজাজ খারাপ হওয়া।
- চোখে একটু ঝাপসা দেখা।
- মাথা ঝিমঝিম করা।
- মাথা যন্ত্রণা।
- মূত্রনালী সংক্রমন ইত্যাদি।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের ৯০ ভাগ ২ নং ডায়বেটিসের শিকার হয়। এই ডাইবেটিসকে প্রাপ্তবয়স্ক ডায়াবেটিস ও বলা হয়। কারন, এটি সাধারণত ৩৫ বছর বয়সের পর দেখা দেয়। তবে বর্তমানে কারোর কারোর এই বয়সসীমার আগেও হচ্ছে। ২ নং ডায়বেটিসের শিকার হওয়া ব্যক্তিরা তাদের ইনসুলিন তারা তৈরি করতে সক্ষম। কিন্তু প্রায় এটা পরিমানে ঠিক হয় না কিংবা কোষ যথাযথ ভাবে কাজ করে না। এই ধরনের ডায়াবেটিস হয় যারা নিয়মিত ব্যায়াম না করে তাদের।
এক নাম্বার দুই নাম্বার দুই ধরনেরই ডায়াবেটিসের উপসর্গ একই রকম হলেও এর মধ্যেও একটি পার্থক্য রয়েছে। এক নম্বর ডায়াবেটিস দ্রুত হলেও দ্বিতীয় নাম্বার ডায়াবেটিস ধীরে ধীরে হয়।
ডায়াবেটিসের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
১ নং ডায়াবেটিসের চিকিৎসা
এক নম্বর ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করা হয় ইনসুলিন নিয়ে। ইনসুলিন পুশ করলে শরীরের ভেতরে কোষে শর্করা যাতায়াতের সহযোগিতা করে এবং শরীরের ভেতরের কোষে গ্লুকোজ যাতায়াত করে। তবে সব থেকে কঠিন কাজ হলো ইনসুলিন নেওয়া। কতটা পরিমাণ নিতে হবে এটা একটি চ্যালেঞ্জ এর মত। এগুলো অনেকটা কারনের ওপর নির্ভর করে যেমন-
- খাদ্যাভাস।
- ব্যায়াম।
- মানসিক চাপ।
- এবং আবেগ।
ইনসুলিনের ডোজ সঠিক না হলেও বিপদ। স্কুলের পরিমাণ যদি বেশি হয়ে যায় তখন রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে গিয়ে রোগীর ভয়াবহ অসুস্থতা দেখা দিতে পারে। রক্ত শর্করার মাত্রা বেড়ে গেলেও কোষগুলোতে শর্করার অভাব দেখা দিতে পারে। এর ফলে রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে ও পারে। তাই অবশ্যই ইনসুলিনের ডোজ পরিমাপ মতো দেওয়া উচিত।
২ নং ডায়াবেটিসের চিকিৎসা
এই ধরনের ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করতে রোগীর রক্তের শর্করা স্বাভাবিক মাত্রায় আনার জন্য শরীরের মধ্যে তৈরিকৃত ইনসুলিন ভালোভাবে কাজ করে তাই জন্য বের করা হয়। এ এক্ষেত্রে চিকিৎসকরা রোগীর খাদ্য, ব্যায়াম এবং ওজন হ্রাসের ব্যাপারে জোর দেয়। এরপরও যদি রোগীর রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি পায় তাহলে শরীরে ইনসুলিন বেশি ব্যবহার করতে হবে।
ডায়াবেটিস হলে কি কি খাওয়া বর্জন করবেন?
ডায়াবেটিকস আক্রান্ত রোগীকে খাওয়ার বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। অতিরিক্ত খাওয়া দাওয়া ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর শরীরের পক্ষে অত্যন্ত খারাপ। চলুন জেনে নেওয়া যাক কি কি খাবার বর্জন করতে হবে-
- শর্করা বেশি থাকে এমন ধরনের খাবার বা তরল পানিও বর্জন করতে হবে।
- খাদ্যে অতিরিক্ত কাঁচা লবণ খাওয়া বর্জন করতে হবে।
- ভাজাপোড়া অর্থাৎ তৈলাক্ত কোন খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
- অতিরিক্ত মাত্রায় চা কফি পান করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
- ফ্যাট আছে এমন ধরনের খাবার যেমন- দুধ কিংবা দুধ দিয়ে তৈরি কোন খাবার খাওয়া যাবেনা।
- শর্করা থাকে এমন ধরনের খাবার যেমন- ভাত, আলু, কলা ইত্যাদি রোগীর শরীরের পক্ষে খারাপ তাই এগুলো খাওয়া নিয়ন্ত্রণে রাখতে করতে হবে।
উপরোক্ত খাদ্যগুলো নিয়ন্ত্রণ রাখলে আপনি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন।
ডায়াবেটিস হলে কি কি ফল গ্রহণ করতে হবে?
ডায়াবেটিসে কি কি খাবার বর্জন করতে হয় সেগুলো সম্পর্কিত জেনেছি চলুন এবার জেনে নেওয়া যাক কি কি ফল গ্রহণ করতে হবে-
- ডায়াবেটিসের জন্য আপেল খুবই কার্যকরী একটি ফল। তাই বেশি বেশি আপেল খেতে হবে।
- অ্যাভোকাডো ও খেতে হবে।
- পেঁপে খেতে হবে।
- নাশপাতি খেতে হবে।
- কমলালেবু খেতে হবে।
- কামরাঙ্গা খেতে হবে।
- বেরি খেতে হবে।
এই সাতটি ফল ডায়াবেটিসের জন্য খুবই উপকারী
পথ্য হিসেবে কাজ করে। তাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীকে এগুলো বেশি করে খেতে হবে।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কাদের বেশি?
মধ্য বয়সী কিংবা বৃদ্ধ বয়সেও ডায়বেটিসের শিকার হতে পারে। বয়সের থেকে অধিক ওজন বৃদ্ধি অর্থাৎ মোটা মানুষের ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি রয়েছে। এছাড়া যারা অলস জীবন যাপন করে শুয়ে বসে থাকে তাদের ও ডায়াবেটিস আক্রমণ করতে পারে। শোনা যায় দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের ডায়াবেটিসের আশঙ্কা বেশি থাকে। গর্ভবতী মায়ের যখন তার সন্তানের জন্য দেহ প্রয়োজনীয় ইনসুলিন তৈরি করতে সক্ষম না হয় তখন ডায়াবেটিস দেখা দেয়।
পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কারোর থাকলেও ডায়বেটিস হতে পারে। মানসিক চাপ, অতিরিক্ত ধূমপান, ডাক্তারের পরামর্শ বিহীন ওষুধ সেবন করা, চা, কফি, অতিরিক্ত মিষ্টি জাতীয় খাবার খেলে ডায়াবেটিসের আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। এই গুলো থেকে সতর্ক হয়ে জীবন যাপন করলে ডায়াবেটিস রোগ এড়ানো সম্ভব।
সুগার এবং ডায়াবেটিসের মধ্যে পার্থক্য কি?
আমাদের শরীরে অতিরিক্ত শর্করা বা চিনির মাত্রা বেড়ে গেলে ব্লাড সুগার দেখা দেয়। যেহেতু এই শর্করা আমাদের গ্রহন করা খাদ্য থেকে আসে এবং এটি শরীরের শক্তির উৎস জোগায় তাই এটি আমাদের শরীরে অনেক প্রয়োজনীয় একটি জিনিস। আমাদের শরীরে শক্তির খাত পূরণের জন্য, রক্ত শরীরের প্রত্যেকটি কোষে গ্লুকোজ বহন করে থাকে। ডায়বেটিস হলো এমন একটি রোগ যখন আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে শর্করার মাত্রার সামঞ্জস্যতা বজায় থাকে না।
রক্তে সুগারের মাত্রা কত হলে ডায়বেটিস হয়? এবং কত হলে বিপদ?
ডাক্তারি পরামর্শ অনুযায়ী বলা যেতে পারে, খালি পেটে আপনার শরীরে রক্তে সুগারের মাত্রা যদি ৭ পয়েন্টের উপরে অবস্থান করে সেটাকে ডায়বেটিস বলা হয়। কিন্তু ভরা পেটে বা খাবার খাওয়ার দুই ঘণ্টা পর যদি এর মাত্রা ১১.১(mmo1/1) পয়েন্টের উপরে উঠে তাকেও ডায়বেটিস ধরা হবে। যদি খালি পেটে রক্তে সুগারের মাত্রা ৭০ পয়েন্ট এবং ভরা পেটে ৪৭০ হয় তাহলে দেরি না করে তখনই চিকিৎসা গ্রহণ করুন। আসলে নতুন এবং পুরোনো ডায়বেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন মাপকাঠি। নতুন ডায়বেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে মাত্রা অনুযায়ী চিকিৎসা এবং পুরোনো রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসা মাত্রা কমবেশি
রক্তে সুগারের মাত্রা কত হলে ডায়বেটিস নরমাল?
সাধারণত আমরা অনেকেই আছি যারা বাড়ীতে বা ফার্মেসিতে গিয়ে আঙ্গুলের মাথায় গ্লুকোমিটারের সাহায্যে রক্ত নিয়ে ডায়বেটিসের মাত্রা পরীক্ষা করি। আবার বড় বড় হাসপাতালগুলোতে নানান ধরনের আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে শিরা থেকে রক্ত নিয়ে ল্যাবে ব্লাড সুগার পরীক্ষা করা হয়। এই দুই ধরনের পরীক্ষার মধ্যে গ্লুকোমিটারের পরীক্ষা সামান্য তারতম্য হতে পারে। কিন্তু এই দুই রকম ভাবেই আপনি পরীক্ষা করতে পারেন।
শেষ কথা
প্রিয় পাঠক দেখতে দেখতে আর্টিকেলের শেষে এসে পড়েছি। আমি এই আর্টিকেলের মাধ্যমে ডায়াবেটিস কত হলে বিপদ এর একটি সুনিপুণ ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। ডায়াবেটিস আমাদের সবার পরিবারের এক জনের হলেও আছে। তাই আপনিও যেনো তাদের মধ্যে একজন না হন সেই জন্যই আগে থেকেই সচেতন হতে হবে। আর আপনি যদি আগে থেকেই এই রোগের শিকার হন তাহলে উপরিউক্ত বিষয়াবলী মেনে চললে এই রোগের থেকে আপনার তাড়াতাড়ি মুক্তি মিলবে।
Also Read: পাইলস থেকে চিরতরে মুক্তির উপায়