শব্দ কাকে বলে ! শব্দ কয় প্রকার ও কি কি?
বাক্য গঠনের মূল উপাদান হচ্ছে শব্দ। আজকে আমাদের এই লেখায় আমরা জানবো, শব্দ কাকে বলে এর প্রকারভেদ এবং শব্দ সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়গুলি নিয়ে।
শব্দ কাকে বলে
ব্যাকরণের সংজ্ঞা অনুসারে, শব্দ হল এমন একটি ধ্বনি সমষ্টি যা অর্থবোধক এবং উচ্চারণ যোগ্য। অর্থাৎ, যদি কোনো ধ্বনি সমষ্টির অর্থবোধকতা থাকে এবং তা উচ্চারণ করা যায়, তাহলে তাকে শব্দ বলা হয়।
শব্দ কয় প্রকার ও কি কি?
শব্দের নির্দিষ্ট কোন প্রকারভেদ নেই বিভিন্ন বিষয়ের ভিত্তিতে শব্দকে নানাভাবে ভাগ করা যায় , নিচে তাদের মধ্যে অন্যতম কিছু প্রকারভেদ এর সংজ্ঞা ও উদাহরণ দেওয়া হলো।
বাংলা ব্যাকরণ অনুসারে শব্দের প্রকারভেদ
বাংলা ব্যাকরণ অনুসারে, শব্দকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়:
- মৌলিক শব্দ: যেসব শব্দ স্বয়ংক্রিয়ভাবে অর্থবোধক হয়, তাদেরকে মৌলিক শব্দ বলে। যেমন: “মা”, “বাবা”, “ঘর”, “গাছ”, “পানি” ইত্যাদি।
- সাধিত শব্দ: যেসব শব্দ অন্য শব্দের সাথে যুক্ত হয়ে অর্থবোধক হয়, তাদেরকে সাধিত শব্দ বলে। যেমন: “শিক্ষক”, “ছাত্র”, “ঘরবাড়ি”, “গাছপালা”, “পানিতে” ইত্যাদি।
শব্দের অর্থগত দিক অনুসারে শব্দের প্রকারভেদ
অর্থগত দিক থেকে বাংলা শব্দকে ৪ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
- যৌগিক শব্দ: যেসব শব্দ দুই বা ততোধিক সরল শব্দের সমন্বয়ে গঠিত হয়, তাদেরকে যৌগিক শব্দ বলে। যেমন: “শিক্ষক”, “ছাত্র”, “ঘরবাড়ি”, “গাছপালা”, “পানিতে” ইত্যাদি।
- রূঢ় বা রূঢ়ি শব্দ: যেসব শব্দের অর্থ তাদের ব্যুৎপত্তিগত অর্থের সঙ্গে অভিন্ন থাকে, তাদেরকে রূঢ় বা রূঢ়ি শব্দ বলে। যেমন: “মা”, “বাবা”, “ঘর”, “গাছ”, “পানি” ইত্যাদি।
- যোগরূঢ় শব্দ: যেসব শব্দের অর্থ তাদের ব্যুৎপত্তিগত অর্থের সঙ্গে ভিন্ন হয়, তাদেরকে যোগরূঢ় শব্দ বলে। যেমন: “সোনালী”, “রূপালী”, “নীলচে”, “লালচে” ইত্যাদি।
- নবসৃষ্ট বা পরিশব্দ বা পারিভাষিক শব্দ: যেসব শব্দ নতুনভাবে সৃষ্ট হয়, তাদেরকে নবসৃষ্ট বা পরিশব্দ বা পারিভাষিক শব্দ বলে। যেমন: “কম্পিউটার”, “ইউনিভার্সিটি”, “টেলিভিশন”, “ইন্টারনেট” ইত্যাদি।
গঠন অনুসারে শব্দের প্রকারভেদ
শব্দের গঠন অনুসারে, শব্দকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়:
- সরল শব্দ: যেসব শব্দ এক ধরনের ধ্বনিসমষ্টি দিয়ে গঠিত হয়, তাদেরকে সরল শব্দ বলে। যেমন: “মা”, “বাবা”, “ঘর”, “গাছ”, “পানি” ইত্যাদি।
- যৌগিক শব্দ: যেসব শব্দ একাধিক ধরনের ধ্বনিসমষ্টি দিয়ে গঠিত হয়, তাদেরকে যৌগিক শব্দ বলে। যেমন: “শিক্ষক”, “ছাত্র”, “ঘরবাড়ি”, “গাছপালা”, “পানিতে” ইত্যাদি।
শব্দের ব্যুৎপত্তি অনুসারে শব্দের প্রকারভেদ
শব্দের ব্যুৎপত্তি অনুসারে, শব্দকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়:
- দেশী শব্দ: যেসব শব্দ বাংলা ভাষার নিজস্ব শব্দ, তাদেরকে স্বদেশী শব্দ বলে। যেমন: “মা”, “বাবা”, “ঘর”, “গাছ”, “পানি” ইত্যাদি।
- বিদেশী শব্দ: যেসব শব্দ অন্য ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় এসেছে, তাদেরকে বিদেশী শব্দ বলে। যেমন: “স্কুল”, “কলেজ”, “টেলিভিশন”, “কম্পিউটার”, “ইংরেজি” ইত্যাদি।
শব্দের উৎপত্তি অনুসারে শব্দের প্রকারভেদ
শব্দের উৎপত্তি অনুসারে, শব্দকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়:
- কৃত্রিম শব্দ: যেসব শব্দ মানুষ কৃত্রিমভাবে তৈরি করেছে, তাদেরকে কৃত্রিম শব্দ বলে। যেমন: “শিক্ষক”, “ছাত্র”, “ঘরবাড়ি”, “গাছপালা”, “পানিতে” ইত্যাদি।
- প্রাকৃতিক শব্দ: যেসব শব্দ প্রকৃতি থেকে এসেছে, তাদেরকে প্রাকৃতিক শব্দ বলে। যেমন: “মা”, “বাবা”, “ঘর”, “গাছ”, “পানি” ইত্যাদি।
এছাড়াও, শব্দের অন্যান্য বৈশিষ্ট্য অনুসারে শব্দকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়।
বাংলা শব্দ ভান্ডার কে কয়টি ভাগে ভাগ করা যায়?
বাংলা শব্দ ভান্ডারকে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য অনুসারে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। তবে, উৎপত্তি অনুসারে বাংলা শব্দ ভান্ডারকে ৫টি ভাগে ভাগ করা হয়:
১. তৎসম শব্দ: যেসব শব্দ প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা বা সংস্কৃত ভাষা থেকে সরাসরি বাংলা ভাষায় এসেছে এবং অবিকৃত রূপে বাংলা ভাষায় টিকে আছে সেই সমস্ত শব্দ কে তৎসম শব্দ বলা হয়। যেমন:- পিতা, মাতা, শিক্ষালয়, আচার্য, শিক্ষক, সকল, পদ, ঘাস প্রভৃতি হল বাংলা শব্দ ভান্ডারের তৎসম শব্দের উদাহরণ।
২. অর্ধতৎসম শব্দ: যেসব শব্দ প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা বা সংস্কৃত ভাষা থেকে সরাসরি বাংলা ভাষায় এসেছে কিন্তু আংশিকভাবে বিকৃত হয়েছে সেই সমস্ত শব্দ কে অর্ধতৎসম শব্দ বলা হয়। যেমন:- রাত্রি > রাত্রির, কৃষ্ণ > কেষ্ট, নিমন্ত্রন > নেমন্তন্ন ইত্যাদি হল বাংলা শব্দ ভান্ডারের অর্ধতৎসম শব্দের উদাহরণ।
৩. তদ্ভব শব্দ: যেসব শব্দ সংস্কৃত শব্দ থেকে প্রাকৃত ভাষার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষায় এসেছে সেই সমস্ত শব্দ কে তদ্ভব শব্দ বলা হয়। যেমন:- একাদশ > এগার, সূর্য > সূর্য, মিত্র > মিত্র, লতা > লতা ইত্যাদি হল বাংলা শব্দ ভান্ডারের তদ্ভব শব্দের উদাহরণ।
৪. দেশী শব্দ: যেসব শব্দ বাংলা ভাষার নিজস্ব শব্দ এবং অন্য কোনো ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় আসেনি সেই সমস্ত শব্দ কে দেশী শব্দ বলা হয়। যেমন:- মা, বাবা, ঘর, গাছ, পানি ইত্যাদি হল বাংলা শব্দ ভান্ডারের দেশী শব্দের উদাহরণ।
৫. বিদেশী শব্দ: যেসব শব্দ অন্য ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় এসেছে সেই সমস্ত শব্দ কে বিদেশী শব্দ বলা হয়। যেমন:- স্কুল, কলেজ, টেলিভিশন, কম্পিউটার, ইংরেজি ইত্যাদি হল বাংলা শব্দ ভান্ডারের বিদেশী শব্দের উদাহরণ।
উপরোক্ত ৫টি ভাগের মধ্যে তৎসম শব্দের সংখ্যা সবচেয়ে কম। তদ্ভব শব্দের সংখ্যা বেশি। দেশী শব্দের সংখ্যা বেশি। এবং বিদেশী শব্দের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
নতুন শব্দ কিভাবে সৃষ্টি
নতুন শব্দ সৃষ্টির বিভিন্ন উপায় রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি প্রধান উপায় হল:
- অন্য ভাষা থেকে: নতুন শব্দ সৃষ্টির একটি প্রধান উপায় হল অন্য ভাষা থেকে ঋণ করা। উদাহরণস্বরূপ, “স্কুল”, “কলেজ”, “টেলিভিশন”, “কম্পিউটার” ইত্যাদি শব্দ ইংরেজি ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় ঋণ করা হয়েছে।
- নতুন শব্দের সৃষ্টি: নতুন শব্দ তৈরির আরেকটি উপায় হল নতুন শব্দের সৃষ্টি। উদাহরণস্বরূপ, “তথ্যপ্রযুক্তি”, “স্মার্টফোন”, “ইন্টারনেট” ইত্যাদি শব্দ নতুন করে তৈরি করা হয়েছে।
- শব্দের অর্থ পরিবর্তন: শব্দের অর্থ পরিবর্তনের মাধ্যমেও নতুন শব্দ তৈরি করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, “কম্পিউটার” শব্দটি প্রথমে “হিসাবযন্ত্র” অর্থে ব্যবহৃত হত। কিন্তু পরবর্তীতে এর অর্থ পরিবর্তিত হয়ে “ইলেকট্রনিক যন্ত্র যা তথ্য প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ ও যোগাযোগ করে” হয়ে যায়।
- শব্দের বিবর্তন: শব্দের বিবর্তনের মাধ্যমেও নতুন শব্দ তৈরি হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, “মা” শব্দটি প্রাচীনকালে “মাতা” শব্দ থেকে এসেছে।
নতুন শব্দ সৃষ্টির ক্ষেত্রে ভাষা ব্যবহারকারীদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা ব্যবহারকারীরা নতুন পরিস্থিতি, ধারণা বা প্রযুক্তির প্রয়োজনে নতুন শব্দ তৈরি করে থাকেন।
শব্দ সম্পর্কিত প্রশ্নাবলী – FAQ
প্রশ্নঃ অন্ন কি তৎসম শব্দ?
উত্তর: হ্যাঁ, অন্ন একটি তৎসম শব্দ। এটি সংস্কৃত শব্দ “অন্ন” থেকে এসেছে। সংস্কৃত ভাষায় অন্ন শব্দের অর্থ হল “খাদ্য”। বাংলা ভাষায়ও অন্ন শব্দের অর্থ হল “খাদ্য”।
প্রশ্নঃ সহজ কথায় ব্যাকরণ কাকে বলে?
উত্তর: সহজ কথায়, ব্যাকরণ হল ভাষার নিয়মকানুন। যে শাস্ত্রে কোনো ভাষাকে বিশ্লেষণ করে তার স্বরূপ, আকৃতি ও প্রয়োগনীতি বুঝিয়ে দেওয়া হয়, তাকে সেই ভাষার ব্যাকরণ বলে।
প্রশ্ন: শব্দের অর্থবোধকতা কী?
উত্তর: শব্দের অর্থবোধকতা হল শব্দের এমন গুণ যা দ্বারা শব্দের অর্থ বোঝা যায়। অর্থাৎ, যে শব্দের অর্থ বোঝা যায়, সেই শব্দের অর্থবোধকতা আছে। যেমন, “মা”, “বাবা”, “ঘর”, “গাছ”, “পানি” ইত্যাদি শব্দের অর্থবোধকতা আছে। আবার, “কককক”, “হুই”, “টুপটুপ” ইত্যাদি শব্দের অর্থবোধকতা নেই।
প্রশ্ন: শব্দের অর্থের পরিবর্তন হয় কেন?
উত্তর: শব্দের অর্থের পরিবর্তন বিভিন্ন কারণে হতে পারে। এর মধ্যে কয়েকটি প্রধান কারণ হল:
- সমাজের পরিবর্তন: সমাজের পরিবর্তনের সাথে সাথে শব্দের অর্থও পরিবর্তিত হতে পারে। যেমন, “কৃষক” শব্দটি পূর্বে “ক্ষেত চাষকারী” অর্থে ব্যবহৃত হত। কিন্তু বর্তমানে “কৃষক” শব্দটি “কৃষি কাজের সাথে জড়িত ব্যক্তি” অর্থে ব্যবহৃত হয়।
- ভাষার পরিবর্তন: ভাষার পরিবর্তনের সাথে সাথে শব্দের অর্থও পরিবর্তিত হতে পারে।
- শব্দের ব্যবহারের প্রসঙ্গ: শব্দের ব্যবহারের প্রসঙ্গের কারণেও শব্দের অর্থ পরিবর্তিত হতে পারে। যেমন, “মা” শব্দটি সাধারণত “মাতৃতা” অর্থে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু “মা” শব্দটি “মাতৃভূমি” অর্থেও ব্যবহৃত হতে পারে।
প্রশ্ন: শব্দের শ্রেণীবিভাগ এর উদ্দেশ্য কী?
উত্তর: শব্দের শ্রেণিবিভাগের উদ্দেশ্য হল শব্দের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যকে সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারা। শব্দের শ্রেণিবিভাগের মাধ্যমে আমরা শব্দের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে পারি। এছাড়াও, শব্দের শ্রেণিবিভাগের মাধ্যমে আমরা শব্দের ব্যবহার সম্পর্কেও জানতে পারি।
প্রশ্ন: “শব্দতত্ত্ব” শব্দের সংজ্ঞা কী?
উত্তর: “শব্দতত্ত্ব” শব্দের সংজ্ঞা হল “শব্দের উৎপত্তি, গঠন, অর্থ ও ব্যবহার সম্পর্কে আলোচনাকারী ভাষাতত্ত্বের শাখা”। শব্দতত্ত্বের মাধ্যমে আমরা শব্দের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে পারি। এছাড়াও, শব্দতত্ত্বের মাধ্যমে আমরা শব্দের ব্যবহার সম্পর্কেও জানতে পারি।
প্রশ্ন: “ব্যাকরণ” শব্দের ব্যুৎপত্তি কী?
উত্তর: “ব্যাকরণ” শব্দের ব্যুৎপত্তি হল “বক” + “রণ”। “বক” শব্দের অর্থ হল “বলা”, “কথা বলা”। “রণ” শব্দের অর্থ হল “নিয়ম”, “বিধি”। সুতরাং, “ব্যাকরণ” শব্দের অর্থ হল “বলার নিয়ম”। অর্থাৎ, ভাষার ব্যবহারের নিয়মকানুন।
প্রশ্ন: “বাক্য” কাকে বলে?
উত্তর: ব্যাকরণ অনুসারে, বাক্য হল এক বা একাধিক শব্দের সমষ্টি যা একটি পূর্ণাঙ্গ অর্থ প্রকাশ করে। অর্থাৎ, যদি এক বা একাধিক শব্দ একত্রিত হয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ অর্থ প্রকাশ করে, তাহলে তাকে বাক্য বলা হয়।
শেষ কথা
প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা আমাদের আজকের লেখায় আমরা জানলাম শব্দ কাকে বলে এর প্রকারভেদ ও শব্দ সম্বন্ধীয় যাবতীয় তথ্য। বাংলা ব্যাকরণ এর যাবতীয় গুরুপ্তপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমাদের ব্লগে নিয়মিত লেখা প্রকাশ করা হয়। তাই নিজেকে সমৃদ্ধ করতে নিয়মিত চোখ রাখুন আমাদের ব্লগে। ধন্যবাদ।
Also read: ভাষা কাকে বলে