২০০৩ সালের প্রথম দিকে বিদেশি সংবাদপত্রের (এজেডজি) একটি খবর চমকে দিয়েছিল অনেক সচেতন বাংলাদেশিদেরকেই। এই সংবাদটি খোদ আর্মেনিয়া থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল। সেই প্রতিবেদনে বিদেশি আরেক সংবাদ সংস্থার ‘আর্মেনিয়ান ওয়ান্টেড ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছিল, মাইকেল জোসেফ মার্টিন সম্ভবত বাংলাদেশের ঢাকায় বসবাসকারী একমাত্র আর্মেনীয়। তিনি সেখানে অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো ‘আর্মেনিয়ান চার্চ’ দেখাশোনা করছেন।
প্রতিবেদনটিতে এই প্রশ্ন করা হয়, ‘এমন কোনো আর্মেনীয় কি আছেন, যিনি বাংলাদেশে গিয়ে আমাদের প্রাচীন ও পবিত্র গীর্জাটিকে রক্ষার দায়িত্ব নেবেন?’
ঢাকায় আর্মেনীয়দের চার্চ দেখে আর্মেনিয়ায় নাগরিক এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী আর্মেনীয়রা বিস্মিত হয়েছিল। তাদের বিস্মিত হওয়ার পেছনে কারণ হয়তো রয়েছে। কিন্তু তারা যদি আরেকটু বিষদভাবে জানতেন তাহলে হয়তো তাদের বিস্ময়ের মাত্রাটা আরও প্রসারিত হতো নিশ্চই।
তবে চলুন আজ আর্মেনিয়ান চার্চ আর হারিয়ে যাওয়া সেই আর্মেনীয় জনগোষ্ঠী সম্পর্কে জেনে আসি
ঢাকার আর্মেনীয়রা, হারিয়ে যাওয়া এক জনগোষ্ঠী। পুরনো ঢাকার আর্মেনীটোলায় রয়েছে তাদের উপাসনালয় যেটি ‘আর্মেনিয়ান চার্চ’ (Armenian Church) হিসেবে পরিচিত। এটি ‘চার্চ অভ হোলি রেজারেকশন’ নামেও পরিচিত। এটি নির্মিত হয়েছিল ১৭৮১ সালে। ঢাকায় বসবাসরত আর্মেনীয়রা এটি নির্মাণ করেছিলো। উল্লেখ্য আর্মেনীটোলা বা আর্মানিটোলা নামটিও এসেছে আর্মেনীয়দের কারণে। এককালে বিত্তবান ক্ষমতাশালী আর্মেনিয়রা বাস করত আর্মানিটোলায়। ধারণা করা হয় এই গীর্জা নির্মাণের পূর্বে তাদের ছোট একটি উপাসনালয় ছিলো। গীর্জাটি এখন যে জায়গায় রয়েছে, সেখানে এক সময় আর্মেনিদের গোরস্থান ছিল। সেই সময় আগা মিনাস ক্যাটচিক নামক এক আর্মেনীয় গির্জা নির্মাণের জন্য গোরস্থানের আশেপাশের বিস্তৃত জমি দান করেছিলেন। লোক মুখে শোনা যায়, গীর্জাটি নির্মাণে সাহায্য করেছিলেন চারজন–মাইকেল সার্কিস, অকোটাভাটা সেতুর সিভর্গ, আগা এমনিয়াস এবং মার্কার পোগজ।
আর্মেনিয়ান চার্চ এর বিশদ বিবরণ:
আর্মেনিয়ান চার্চ কোথায় অবস্থিত?
বুড়িগঙ্গার তীরে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের পেছনে আর্মেনিয়ান চার্চ অবস্থিত। যদিও এটি নির্মিত হয়েছিল ১৭৮১ সালে তবে ঢাকায় আর্মেনিয়ানীয়দের বসবাস আরও আগে থেকে। পুরান ঢাকার আরমানিটোলা এলাকার প্রসাধনি ও সুগন্ধির পাইকারি বাজার পাশ কাটিয়ে আরমানিটোলা ও মিটফোর্ড হাসপাতালের মধ্যবর্তীস্থল চার্চ রোডের একটি গলি ধরে এগিয়ে গেলেই একটি ফটক দৃষ্টি কাড়বে। ঠিক সেখানেই অপেক্ষমাণ কয়েক শতাব্দী আগের আর্মেনী গির্জা। যার ফলকে লিখা আর্মেনীয়ান চার্চ-১৭৮১!
আর্মেনিয়ান চার্চ-এ কিভাবে প্রবেশ করবেন?
গীর্জা প্রবেশ দাড়ে একটি বড় তালা ঝোলানো। বাইরে থেকে লোহার শিকের ভেতর দিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয়ালে কলিং বেল অনেকক্ষণ ধরে টিপলে, মার্টিন মার্টিরোসেনের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধায়ক শঙ্কর বা গীর্জার প্রহরী হিনু দরোজা খুলে দেবে। অনুমতি নিয়ে চার্চের ভেতরে ঘুরে দেখার সুযোগ আছে।
কি কি দেখতে পাবেন আর্মেনিয়ান চার্চে?
লম্বায় সাড়ে সাতশো ফুট এই গীর্জাটিতে রয়েছে চারটি দরজা, সাতটি জানালা। এই গির্জায় দেখা মিলবে একটি প্রাচীন কবরস্থান। যেখানে ৩৫০ জনের কবর আছে। আর নির্মাণটির ভেতর মেঝে তিনভাগে বিভক্ত, আছে রেলিং দিয়ে ঘেরা একটি বেদী এবং মাঝখানের অংশে আছে দু’টি ফোল্ডিং দরজা। তৃতীয় ভাগটি বেষ্টনী দিয়ে আলাদা করা মহিলা এবং শিশুদের বসার জন্য। এর উপরে আছে আবার
একটি গ্যালারী। গির্জাটির মূল উপাসনালয়ে প্রবেশ করলেই হাতের বাম পাশে দেখা মিলবে দোতলায় উঠে যাওয়া একটি প্যাঁচানো সিঁড়ি। যার শেষ মাথায় সুউচ্চ বেদী। বেদীর উপর রয়েছে যিশুখৃষ্টের তৈলচিত্র এবং ধাতব ক্রুস। একটি ছোট মঞ্চাসন রয়েছে বেদীতে উঠার আগে। এখানে দাঁড়িয়ে আগতদের উদ্দেশ্যে পবিত্র বাণী পাঠ করা হয়। তাছাড়াও পুরো কক্ষ জুড়েই রয়েছে সারিবদ্ধভাবে সাজানো আসন। এছাড়াও চার্চের ভেতরে, রক্ষিত আর্মেনীয় ভাষায় লিখিত বাইবেল দেখতে পাবেন। বর্তমানে অধিকাংশ সময় গির্জাটি বন্ধ থাকে।
কীভাবে আর্মেনিয়ান চার্চ টি নির্মাণ করা হয়েছিল?
ধর্মবিশ্বাসে আর্মেনীয়রা ছিলেন অর্থডক্স বা গ্রিক চার্চের অনুসারী খ্রিস্টান। যেখানেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আর্মেনীয় বসতি স্থাপন করেছেন, সেখানেই তারা গির্জা নির্মাণ করেছেন। তাই আর্মেনীটোলায় স্থির হয়ে বসার পর আর্মেনীরা এখানে নির্মাণ করেছিলেন তাঁদের গীর্জা। তবে চার্চের স্থানে প্রথমে নির্মাণ করা হয়েছিল একটি ছোট্ট চ্যাপেল বা উপাসনালয়। সেখানেই প্রার্থনা ও সমাধিস্থ করা হত। পরে ১৭৮১ সালে বর্তমান চার্চটির নির্মাণ কাজ শুরু এবং ১৭৯৪ সালে শেষ হয়। আর এই চার্চটি নির্মাণে ১৩ বছর লেগে যায় । এই চার্চটি নির্মাণ পূর্বে আর্মেনীয়রা প্রার্থনার জন্য তেজগাঁওয়ের রোমান ক্যাথলিক চার্চে যেত এবং চার্চের পার্শ্বে আর্মেনীয়দের সমাধিস্থ করা হতো। ১৭৯৪ সাল থেকে আর্মেনীয়দের নিজস্ব প্রার্থনা শুরু হয় আরমানিটোলার এই চার্চে।
চার্চটি তৈরির পর স্থানীয় লোকদের কাছে এর ঘড়িটি একটি আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। ১৮৩৭ সালে গির্জার পশ্চিম পার্শ্বে এই ঘড়ির জন্য একটি ক্লক টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছিল। জোহানস কারু পিয়েত সার্কিস এটি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। কথিত আছে, এই ঘড়ির ঘণ্টাজ্ঞাপক ধ্বনি প্রায় চার মাইল দূর পর্যন্ত শোনা যেত। ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ঘড়িটি বন্ধ হয়ে যায়। আর ১৮৮০ সালে আর্থিক অনটনের দরুণ গির্জার ঘণ্টাটিও বাজানো বন্ধ করে দেয়া হয়। যা ছিলো তৎকালীন সময়ে নগরে বসবাসরত সকল মানুষের সময় গণনার একমাত্র মাধ্যম। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে টাওয়ারটি ভেঙে পড়ে। সেই সময় আর্মেনীয়রা অনেকেই ঢাকা ছাড়ছিলেন। যে কারণে টাওয়ারটি পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
আর্মেনিয়ান চার্চ প্রাঙ্গণ:
আর্মেনিয়ান চার্চটির ভেতরে ঢুকতেই সার সার কবর। কবরের একপাশে উপাসনাগৃহ। মূলত আর্মেনী গীর্জার চতুর্দিকের প্রাঙ্গণের পরিসর ছোট হওয়ার কারণে গীর্জাটির গোটা প্রাঙ্গণ এমনকি বারান্দার মেঝেতেও প্রচুর সমাধিফলক চোখে পড়বে। কবরগুলো শ্বেতমর্মর, কষ্টিপাথর, বেলেপাথর ও লোহার পাতে বাঁধানো।
অধিকাংশ এপিটাফ বা স্মৃতিফলকে ধর্মগ্রন্থের বাণী উদ্ধৃত রয়েছে। উল্লেখ্য কবরগুলোর পরিচিতি বেশির ভাগই আর্মেনীয় ভাষায় লেখা। কিছু কিছু ইংরেজী ও আর্মেনীয় ভাষার সংমিশ্রণে লিখিত সেই এপিটাফে উঠে এসেছে মৃতব্যক্তির স্বজনদের শোঁকগাথা, জন্ম-মৃত্যুর বৃত্তান্ত এবং কর্মপরিধি নিয়ে কিছু কথা। উদাহরণস্বরূপ, ১৮৭৩ সালে ২৭ বছর বয়সী এক মেয়ের কবরে লেখা রয়েছে, ‘উইপ নট ফর মি। লেমেন্ট নো মোর। আই অ্যাম নট লস্ট, বাট গন বিফোর’। তাছাড়া কয়েকটি কবরের স্মৃতিফলকের ওপরের দিকে শ্বেতপাথরের ডানাওয়ালা দেবশিশু বা দেবকন্যা দেখা যায়। যেমন: জনৈক ক্যাটচিক আভেটিক থমাসের সমাধির ওপর তাঁর স্ত্রী সুন্দর এক মূর্তি বসিয়েছিলেন, যা এখনো টিকে আছে। স্মৃতিফলকে তিনি তার স্বামীকে ‘বেস্ট অব হাজব্যান্ডস’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।
এছাড়াও প্রবেশপথ মাড়িয়ে সম্মুখে গেলেই নজরে পড়বে একটি কবরের উপর স্থাপিত মার্বেল পাথরে তৈরী দৃষ্টিনন্দন ভাষ্কর্য (মাতা মেরির ওবেলিস্ক)। বর্তমানে সুন্দর সেই ভাষ্কর্যটির একটি হাত ভাঙা।
আরো রয়েছে চার্চের পাশেই পুরনো একটি একতলা দালান, যেখানে মার্টিন থাকতেন। বর্তমানে সেখানে এখন শঙ্কর ঘোষ সপরিবারে বসবাস করছেন।
চলুন এবার একটু পরিচিত হই আর্মেনিয়া দেশটির সাথে।
বিশ্ব মানচিত্রে তুরস্কের ঠিক পূর্বের দেশটাই আর্মেনিয়া। এটি পশ্চিম এশিয়ার একটি রাষ্ট্র। আর্মেনিয়ার উত্তরে জর্জিয়া, পূর্বে আজারবাইজান এবং দক্ষিণে ইরান অবস্থিত। দেশটির বৃহত্তম শহর ও রাজধানীর নাম ইয়েরাভান।
আর্মেনিয়ার রাজধানীর নামটা চমৎকার। এইরূপ নামকরণের পেছনেও রয়েছে অসাধারণ এক গল্প। আর্মেনীয় পুরাণ অনুসারে মহাপ্লাবনের শেষে হযরত নূহ (আঃ) বজরা আরারাত পাহাড়ের চূড়ায় এসে ঠেকে, চারপাশে প্রবল জলরাশির ভেতর নূহ নবী সতর্ক চোখে তাকাতে তাকাতে সহসাই দেখেন দূরে শুকনো মাটি। তখন তিনি গর্জন করেন, ‘ইয়েরেভান!’ ঐ দেখা যায়! সেই হতে ইয়েরেভান নগরী আর্মেনিয়ার রাজধানী।
ইয়েরেভান শহরটা সে দেশের পশ্চিমে এবং তার পাশ দিয়ে হরাজদান নদী বয়ে যায়। আর্মেনিয়ার মানচিত্রের মাঝখানে সেভান নামক একটা হ্রদ দেখতে পাবেন। ১৯২২ সালে দেশটি সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম প্রদেশ আর্মেনিয়া একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এরপর ১৯৯১ সালে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। আর ১৯৯৫ সালে দেশটির প্রথম সোভিয়েত-পরবর্তী সংবিধান পাশ হয়।
আর্মেনিয়া কখনো কখনো তুর্কি সেনাবাহিনী, কখনো ইরানী সৈন্য আবার কখনো রুশ সেনাবাহিনী কর্তৃক পরাভূত হয়েছে। ইরান ও তুরস্কের সীমান্তের দেশ হওয়ায় এইরূপ হয়েছে। ভাগ্যের কাছে অসহায় আর্মেনীয় জনগণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইহুদি জনগোষ্ঠী মতো উদ্বাস্তু জীবন পার করেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী।
আর্মেনীয়দের সম্পর্কে একটি কথা মনে রাখবেন, রোম নয়, বিশ্বের ইতিহাসে আর্মেনিয়াই প্রথম খ্রিস্টধর্মকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দিয়েছিল।
এবার চলুন আর্মেনীয়রা কিভাবে বাংলায় এসেছিল তার খোঁজখবর নিই।
আর্মেনীয়দের এদেশে আগমন কাল সম্পর্কিত কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। বাংলাপিডিয়ায় আর্মেনীয়দের সম্পর্কে বলা হয়েছে, ” ষোলো শতকে পারস্যের সাফাভি শাসকগণ মধ্য এশিয়ায় আর্মেনীয়দের আবাসভূমি (আর্মেনিয়া) জয় করে নিলে আর্মেনীয়রা বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এরপর রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে শাহ আববাস আন্তএশীয় বাণিজ্যে ইস্পাহান ও নিউজালফায় দক্ষ প্রায় চল্লিশ হাজার বণিককে পুনর্বাসিত করেন। বলা যায় আর্মেনীয়রা প্রথম বাংলায় আসেন এ দুটি বাণিজ্য-নগরী থেকেই পারস্যদেশীয় ভাগ্যান্বেষীদের অনুসরণের মাধ্যমে। শুরুরদিকে তারা তাদের পারস্যদেশীয় মনিবদের পক্ষে বাংলায় ব্যবসা করতেন। এরপর কালক্রমে তারা বাংলায় তাদের নিজস্ব সম্প্রদায় গড়ে তোলেন। যদিও তাদের সংখ্যা খুব বেশি কিংবা বড় পরিসরের ছিলোনা তবুও ব্যবসায়ীক জ্ঞান ছিলো অধিক। যার ফল সরূপ ব্যাবসার ক্রমাগত পরিধিবিস্তার আর্মেনীয়দের করে তুলেছিলো বেশ প্রভাবশালী। লবন ব্যবসা থেকে শুরু করে কাপড়ের ব্যবসায়, কিংবা ঠিকদারি কিংবা পান ও পাট; তাদের হাতে সর্বস্তরের সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ ছিলো।
আর্মেনীয়গণ হুগলি, চুঁচুড়া, সায়দাবাদ, মুর্শিদাবাদ ও কাসিমবাজার এবং বাংলার আরও বেশ কিছু বাণিজ্যকেন্দ্রে তাদের বসতি নির্মাণ করেছিল। কিন্তু তাদের মূল বসতি ছিল ঢাকায়। ফল সরূপ তারা তাদের ঢাকার বসতির নামকরণ করেছিল আর্মানিটোলা।
ভারত উপমহাদেশে যখন ব্রিটিশ শাসন শেষ হয়ে গেল তখন আর্মেনীয়রাও ব্রিটিশদের পথ ধরে ঢাকা ত্যাগ করতে শুরু করে। বাংলাপিডিয়ায় আরও বলা হয়েছে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে এ অঞ্চলে আর্মেনীয়দের অবস্থানে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। বাংলায় তাঁদের সঞ্চিত অর্থ-সম্পদসহ মধ্য এশিয়ার ইরানে তাঁরা ফিরে যেতে থাকেন। অনেকেই পাড়ি জমান ইউরোপে। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত পুরান ঢাকার আর্মেনিয়ান চার্চে প্রার্থনা সভা হতো। এরপরে আর কোনো আর্মেনীয় ফাদার ঢাকায় না থাকার কারণে পুরোপুরি নিয়মিত প্রার্থনা বন্ধ হয়ে যায়।
আর্মেনীয়রা কত বছর ধরে ঢাকায় বসবাস করছেন?
১৭১৪ সালে লেজার অফ এরিভানের পুত্র খোজাহ এভিয়েটেস লেজারের মৃত দেহ তেজগাঁওয়ের সমাধিক্ষেত্রে সমাধিস্থ করা হয়। তার এই সমাধি থেকে স্পষ্ট হয়, ঢাকায় আর্মেনীয়দের বসবাস ৩০০ বছরের বেশি সময় ধরে।
মাইকেল জোসেফ মার্টিনির সম্পর্কে কিছু কথা:
পূর্বেই বলেছি মাইকেল জোসেফ মার্টিন সম্ভবত বাংলাদেশের ঢাকায় বসবাসকারী শেষ আর্মেনীয়। তার জন্ম ঢাকায়। তিনি পড়াশুনা করেছেন ক্যালকাটা আর বোম্বাইয়ে। সেভেন্টি ওয়ানের আগে জুটের বিজনেস করতেন খুলনায়।
যখন ১৯৮৬ সালে ঢাকায় বসবাসরত কোনো ফাদার না থাকায় আর্মেনিয়ান চার্চের প্রার্থনা সভা থেমে যায়। সে সময় একটি আর্মেনিয়ান পরিবার চার্চটি দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন। তারা ছিলেন মাইকেল জোসেফ মার্টিন ও তার স্ত্রী ভেরোনিকা মার্টিন। তাদের দুই মেয়ে শেরিল ও ক্রিস্টিন স্থায়ীভাবে বাংলাদেশ থেকে চলে যাওয়ার পর। তারা স্বামী–স্ত্রী দুজনে মিলেই চার্চের দেখাশোনা করতেন। ২০০৫ সালে স্ত্রী ভেরোনিকা মার্টিনের মৃত্যুর পর মাইকেল মার্টিন একা হয়ে যান। এটিই ছিল ঢাকায় শেষ আর্মেনীয়র কবর।
মাইকেল জোসেফ মার্টিনির তার ভাঙা বাংলায় জানান, ‘আমি একা নয়। মাই ওয়াইফ স্লিপস হেয়ার। মাই প্যারেন্টস স্লিপ হেয়ার। তাই, আমি এখানেই থাকবে। টিল আই ডাই!’
কিন্তু তিনিও দীর্ঘ নয় বছর একাকী চার্চটির দেখাশোনা করার পর ২০১৪ সালে কানাডায় মেয়েদের কাছে চলে যান। আর এর মধ্য দিয়েই ঢাকায় আর্মেনীয়দের ৩০০ বছরের বেশি সময়ের বসবাসের ইতি ঘটে। ২০২০ সালের ১১ এপ্রিলে মাইকেল জোসেফ মার্টিন (সর্বশেষ বাংলাদেশি আর্মেনীয়) বার্ধক্যজনিত কারণে ৮৯ বছর বয়সে মারা যান। মার্টিনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আর্মেনীয়দের যবনিকা ঘটে।
চার্চটি এখন জীর্ণ-মলিন অবস্থায় রয়েছে এবং চার্চ গেটের পাশেই দেয়ালটির কিছু অংশ ডুবে আছে স্যুয়ারেজ লাইনের ময়লা তরলে। এই নোংরা তরলে ভেতরের আবার কয়েকটি কবরও আংশিক ডুবে আছে। বর্তমানে কিছু স্মৃতিচিহ্ন ছাড়া সেখানে আর্মেনীয়দের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। উপরন্তু, ঢাকায় আর্মেনীয়দের সবচেয়ে বড় নিদর্শন ঐতিহাসিক চার্চটিও এখন বিলুপ্তির পথে।
আরমেন আর্সালিয়ান বর্তমানে চার্চটির তত্ত্বাবধায়ক। তিনি দেশের বাইরে থেকে পুরান ঢাকার এই আর্মেনিয়ান চার্চের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন। আর চার্চের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন আল মামুন এম রাসেল। উপরন্তু চার্চে ব্যবস্থাপক হাসনাত ও একজন স্থানীয় তদারককারী কর্মী রয়েছেন।
এককালের এহেন সরগরম আর্মেনীয় গীর্জায় এখন চব্বিশ ঘণ্টাই তালা দেওয়া। মাঝে মাঝে কিছু বিদেশী পর্যটকরা ঢোকার অনুমতি পায়। এই গীর্জার কবরগুলো বহু অতীতের সাক্ষী। তবে উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অধিকাংশ কবরের এপিটাফেই ফাটল ধরেছে।
পুরনো ঢাকার আর্মানীটোলার, ‘আর্মেনিয়ান চার্চে’ -এর মতো শান্ত, নিরিবিলি জায়গা হয়ত ঢাকা শহরে খুব কমই আছে। দুইশতেরও বেশি সময়ের পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী গীর্জাটির রক্ষণাবেক্ষণ এখনো অবশিষ্ট আর্মেনী পরিবাররাই করে থাকে। আজও আর্মেনিয়ান চার্চ প্রাঙ্গণে গেলে দেখা মেলে পরতে পরতে ইতিহাসের ছোঁয়া।