কফির উপকারিতা এবং অপকারিতা
শীতের এই সময় গরম এক কাপ কফি পেলে দিনটাই উষ্ণ হয়ে যায় যেন। হালকা তিতটে এই পানীয় বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয। কফির সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা সবগুলোই যে ইতিবাচ, তা কিন্তু নয়। বরং কফি সম্পর্কে অনেক নেতিবাচক তথ্যও পাওয়া যায়। তবে যেসব প্রসঙ্গ আসে অতিরিক্ত কফি খেলে অতিরিক্ত কোন কিছুই যে ভালো নয়, একথা তো আমরা সবাই জানি। এদিকে পরিমিত কফি পান করলে তার শরীরে নানা উপকারে আসে। এক কাপ কপি পান করলে তা আপনাকে সারা দিন চাঙ্গা রাখতে সাহায্য করে। দিনভর আপনাকে রাখবে কর্মক্ষম।
কফি বীজ নামে পরিচিত এক প্রকার বীজ গুড়া পানির সাথে গরম করে বা ফুটিয়ে তৈরি করা হয়ে থাক। কফি বীজ কফি চেরি নামক এক ধরনের ফলের বীজ। প্রায় ৭০ টি দেশে এই ফলের গাছ জন্মে। সবুজ কফি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিক্রিত কৃষি পণ্যের মধ্যে একটি। কফির মূল উপাদান হলো ক্যাফেইন। ৮ আউন্স কফিতে প্রায় ১৩৫ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে।
এছাড়াও কফি থেকে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং সামান্য পরিমাণে ভিটামিন বি২ রিবোফ্লাভিন ও ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম পাওয়া যায়। শহুরে জীবনে পানীয় হিসেবে কফি বেশ জনপ্রিয়। কফি যেমন শরীরকে চাঙ্গা করে তেমনি এর বিপরীত ফলাফলও রয়েছে। যুক্তরাজ্যের দি গ্লেন হাসপাতাল ব্রিসটলের কনসালটেন্ট সার্জন এবং ওজন কমানোর বিশেষজ্ঞ স্যালি নরটন, ক্যাফেইন গ্রহণের সুবিধা অসুবিধার চিত্র তুলে ধরেন।
কফির উপকারিতা
নিয়মিত ও পর্যাপ্ত পরিমাণে কফি পানের বেশ কিছু স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছ। ঘুম থেকে উঠেই অনেকে কফি না হলে চলে না। ঘুমের আমেজ কাটাতে কফি খান অনেকে। কফি স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী। নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
ওজন কমায়
নিয়মিত ও পর্যাপ্ত পরিমাণে কফি খাওয়ার শরীরের ওজন কমাতে সাহায্য করে। বিশেষ করে পুরুষদের নিয়মিত কফি পানে শরীরের চর্বি কমতে ভূমিকা রাখে। প্রতিদিন এক থেকে দুই কাপ কফি শরীরকে চাঙ্গা রাখতে সাহায্য করে যা ওজন কমানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে অনেকেই ওজন কমানোর জন্য কফি পান করে থাকেন।
টাইপ 2 ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়
নিয়মিত কফি খাওয়া দীর্ঘ মেয়াদে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। এটি অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষগুলির কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে যা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে ইনসুলিন তৈরি করে থাকে। এছাড়া এটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ এবং ইনসুলিন সংবেদনশীলতা প্রদাহ এবং বিপাককে প্রবাহিত করতে পারে। যার সবই টাইপ ২ ডায়াবেটিসের বিকাশের সাথে জড়িত।
ক্লান্তি কমায়
কফিতে থাকা ক্যাফেইন একটি কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের উদ্দীপক। যা ক্লান্তি কমিয়ে শরীরের শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। কারণ ক্যাফেইন অ্যাডেনোসিন নামক নিউরোট্রান্সমিটারের রিসেপ্টর ব্লক করে এবং মস্তিষ্কে অন্যান্য নিউরোট্রান্সমিটারের মাত্রা বাড়ায় যা শক্তির মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে
কিছু গবেষণা থেকে দেখা যায় যে কফি আলঝাইমার রোগ এবং পারকিনসন রোগ সহ নির্দিষ্ট কিছু নিউরোডিজেনারেটিভ ডিসঅর্ডার থেকে রক্ষা করতে পারে। যারা নিয়মিত ক্যাফেইন গ্রহণ করেন তাদের পার্কিনসন রোগ হবার ঝুঁকি অনেক কম।
হার্টের স্বাস্থ্য ভালো রাখে
রোজ পর্যাপ্ত পরিমানে কফি পান হাটের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। একটি পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে, প্রতিদিন কোন ব্যক্তি যদি তিন থেকে পাঁচ কাপ কফি পান করে তাহলে হৃদরোগের ঝুঁকি ১৫ শতাংশ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি ২১ শতাংশ কমায় । তবে উচ্চমাত্রার ক্যাফেইন রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। তাই যাদের অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ আছে তাদের পরিমিত পরিমাণে কফি পান করা উচিত।
বিষন্নতা কমায়
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে রোজ পর্যাপ্ত কফি পান হতাশার ঝুঁকি কমায়। এমন কি আত্মহত্যার প্রবণতাও কমিয়ে আনতে পার। সাতটি সমীক্ষার পর্যালোচনা অনুসারী প্রতিদিন এক কাপ কফি পান বিষন্নতার ঝুঁকি চার শতাংশ কমায়।
আয়ু বৃদ্ধি করে
কিছু গবেষণায় দেখা যায় যে কফি দীর্ঘায়ুতে সাহায্য করে। কারণ রোজ পর্যাপ্ত কফি পানে নানা রকম রোগ দূর করে, হার্ট সুস্থ রাখে, এমনকি ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। যার ফলে মৃত্যু ঝুঁকি কমে আসে। হৃদয়ের জন্য ভালো নয় কিছু গবেষণায় দেখা গেছে ক্যাফেইন হৃদপিন্ডের রক্ত সরবরাহকারীদের ধমনীতে রক্ত চলাচল ধীরে করে দেয়। বিশেষ করে যখন বেশি দরকার। যেমন: ব্যায়ামের সময়। তাছাড়া বুক ধড়ফড়ানি, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন বা উচ্চ রক্তচাপের জন্য শরীরের অতিরিক্ত ক্যাফেইন দায়ী।
কফির অপকারিতা
যত উপকারী থাকুক না কেন কোন খাবারই একেবারে অনেকখানি খাওয়া ভালো না। কফি ও তার ব্যতিক্রম নয়। অতিরিক্ত কফি খাওয়ার ফলে শরীরে দেখা দিতে পারে নানা ধরনের সমস্যা। নিচে কফির অপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো :
ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়
এ কথা অনেকেই জানেন য, কফি বা চা খেলে ঘুম কম হয। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, যারা দিনে তিন কাপের বেশি কপি পান করে তাদের শান্তির ঘুম খুবই কম হয়। আরেক গবেষণায় দেখা গেছে যারা কফি পান না করে তাদের থেকে কফির পানকারীদের ৭৯ মিনিট কম ঘুম হয়।তাই ঘুমের সমস্যা থাকলে কফিকে না বলুন। এটি ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়।
সন্তান ধারণের অক্ষমতা
দৈনিক পাঁচ কাপের বেশি কফি খেলে গর্ভধারণের ক্ষমতা কমে যেতে পারে। যদি মা হতে চান তবে অবশ্যই কফি খাওয়ার পরিমাণ কমাতে হব। আর গর্ভধারণের পরও কফি খাওয়া বাদ দিতে হবে। কারণ দৈনিক ২০ মিলিগ্রাম ক্যাফিন শরীরে গেলে গর্ভের শিশুর ক্ষতি হওয়ার পাশাপাশি জন্ম ত্রুটি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই সতর্কতা অবলম্বনে কফি না খাওয়াই ভালো গর্ভধারণ অবস্থায়।
মেজাজ এর জন্য খারাপ
ক্যাফেইন শরীরের অ্যাড্রেনালির নামক এক ধরনের হরমোনের মাত্রা বাড়ায়। যে কারণে শরীরে টানটান উত্তেজনা বা ঘাবরিয়ে যাওয়ার অনুভূতির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
কফি খাওয়ার নিয়ম
খালি পেটে কফি নয় তবে খালি পেটে বা একদম সকালে কফি না খাওয়াই ভালো। যাদের রাতে ঘুমের সমস্যা আছে তারা গরম রাতে কফি খাওয়া এড়িয়ে চলুন। লেবু মধু মিশিয়ে কফি খাওয়ার আদর্শ সময় হল সন্ধ্যা বেলা। কফির সঙ্গে মধু আর লেবুর রস মিশালে হজম ভালো হয়।
কফি খাওয়ার উপযুক্ত সময়
কফিতে উপস্থিত ক্যাফেইন শরীরে বিপির মাত্রাকে ব্যাহত করতে পারে। প্রতিদিন কফি পানের পরিবর্তে অল্প পরিমানে কফি পান করুন। ব্ল্যাক কফি খাওয়ার সঠিক নিয়ম হল সকালে ব্রেকফাস্ট এর 30 মিনিট থেকে এক ঘন্টা পর। কফি শরীরের মেটাবলিজম বড়ায় এবং হজম প্রক্রিয়ারও উন্নতি ঘটায়।
কফি বানানোর নিয়ম
এক বাটিতে চিনি, পানি ও কফি মিশিয়ে নিন ১:১:১ পরিমাণে, অর্থাৎ যতটুকু চিনি ঠিক ততটাই কফি এবং ঠিক ততটুকুই পানি৷ লাগবে। ইলেকট্রিক ব্লেন্ডার বা সাধারণ চামচ দিয়ে ফেটিয়ে নিয়ে ফোম বানিয়ে নিতে হবে। যতক্ষণ না ফোন না হয় ততক্ষণ নাড়তে হবে। কাপে বরফ ও দুধ দিয়ে উপর দিয়ে কপির ফোম দিয়ে গুঁড়ো কফি ছিটিয়ে দিলে তৈরি হয়ে যাবে কফি।
সকালে কফি খাওয়া কি ভালো
সৌভাগ্যক্রমে কফি আপনার সকলের শক্তির মাত্রা বাড়ানোর একটি ব্যতিক্রমী সহজ উপায়। একটি বর্ধিত সকালের শক্তির স্তর আপনাকে কেবল সকালের সময় শক্তি দেয় না। এটি সারাদিন আপনার শক্তির মাত্রা উন্নত করতে সাহায্য করে। ক্যাফে ইন মূলত একটি পাওয়ার ন্যাপ এর মত কাজ করতে পারে। যা আপনাকে সতেজ এবং আরো সতর্কবোধ করতে সহায়তা করে থাকে।
সকালে খালি পেটে কফি খেলে কি হয়
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং ডায়েটিশিয়ানদের মতে খালি পেটে ব্লাক কফি পান করলে এসিডিটির সমস্যা হতে পারে। এই কারণে আপনার কোষ্ঠকাঠিন্য এবং ভিটামিন বি ১২ এর অভাব দেখা দিতে পারে। কফি যেমন খালি পেটে পান করা উচিত নয় তেমনি বেশি কফিও পান করা উচিত নয়। তাই আমরা সকালে খালি পেটে কফি খাওয়া থেকে বিরত থাকব।
উপসংহার
কফি তো আমাদের কাছে খুব জনপ্রিয় পানীয়। কিন্তু আমরা কি জানি কফি আসলে কি জিনিস?আমরা বাজারে যে কফি পাই সেটা আসলে কিন্তু প্রসেসজড। কফি চেরি নামক এক ধরনের ফলের বীজ পুড়িয়ে গুঁড়ো করে কফি তৈরি করা হয়। বিশ্বের ৭০ টি দেশে এ কফি বীজ পাওয়া যায়। কফিতে ক্যাফেইন নামক এক ধরনের উত্তেজক পদার্থ থাকে।
আজকে আমরা আমাদের এই আর্টিকেলটিতে জেনে নিলাম কফি খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে। সব কিছুরই একটি পরিমাপ আছে। কোন কিছুই অতিরিক্ত ভালো না। অতিরিক্ত মাত্রায় কফি খাওয়ার পরে আমাদের ওজন কমা, বুক ধরফর, অনিদ্রা, পেট খারাপ, নার্ভাসনেস, বমি বমি, মাথা ঘোরা অস্থিরতা, হৃদপিণ্ড এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের হার বৃদ্ধি, কানে ব্যথা, অতিরিক্ত মাত্রায় কফি পান করলে কোলেস্টেরল বৃদ্ধি হবে। আশা করি আপনাদের কাছে আমাদের এই আর্টিকেলটি বোঝার মত হয়েছে। যদি ভালো লাগে তাহলে বন্ধুদের সাথে অবশ্যই শেয়ার করবেন। সবাই ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন
Also Read: দুধের উপকারিতা ও অপকারিতা