ডায়েবেটিস রোগির খাদ্য তালিকা
ডায়াবেটিস রোগ চেনে না বর্তমানে এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। কেননা ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে হোক সেটি গ্রাম বা শহরে। এই রোগ নিয়ন্ত্রণে না করতে পারলে এটি দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আক্রান্ত করে। এজন্য বলা হয় ডায়াবেটিস হলে তিনটি বিষয় মেনে চলতে হবে পরিমিত খাবার বা ডায়েট, ডিসিপ্লিন বা নিয়মানুবর্তিতা এবং ড্রাগ বা ঔষধ। বিশ্ব সংস্থার মত অনুযায়ী এটি একটি অসংক্রমক রোগ এবং দিন দিন এটি মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়ছে। আজ এই আর্টিকেল থেকে আমরা জানব ডায়েবেটিস রোগির খাদ্যতালিকা কেমন হওয়া উচিত।
ডায়াবেটিস কি?
ডায়াবেটিস এক প্রকারের মেটাবলিক ডিসঅর্ডার যা শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা তৈরি করে। এক্ষেত্রে শরীরে পর্যাপ্ত ইনসুলিন উৎপাদিত হয় না এবং তা ব্যবহার করতে উপযুক্ত হতে পারেনা। আমাদের শরীরে খাওয়ার পর সেই খাদ্য শর্করাকে ভেঙে গ্লুকোজ এ পরিণত করে। অগ্নাশয় ইনসুলিন নামের একটি হরমোন উৎপন্ন করে যা শরীরের কোষগুলোকে চিনি গ্রহণ করার জন্য নির্দেশ দেয়। এবং এই চিনি শরীরের শক্তি হিসেবে কাজ করে। কিন্তু শরীরে ইনসুলিন উৎপন্ন না হলে এটি ঠিকঠাক কাজ করে না ফলে ডায়াবেটিস রোগটি হয়।
চার ধরনের ডায়াবেটিসে মানুষ আক্রান্ত হয়
টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস
টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে রোগীদের সব ইনসুলিন নষ্ট হয়ে যায়। আলাদাভাবে তাদের ইনসুলিন দেওয়ার না হলে তাদের মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্রায় পাঁচ থেকে দশ শতাংশ মানুষ আক্রান্ত হয়।
টাইপ টু ডায়াবেটিস
যারা এই রোগে আক্রান্ত হয় তাদের শরীরে ইনসুলিন আছে তবে সেটি কাজ করতে সক্ষম হয় না। এই রোগীরা যে খাবারইখান না কেন তাদের শরীরে গ্লুকোজ জমে যায়। বেশিরভাগ মানুষ টাইপ টু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়, প্রায় ৮০ থেকে ৯০পার্সেন্ট।
গেস্টশনাল ডায়াবেটিস
গর্ভবতী নারীদের মধ্যে সাধারণত এই ডায়াবেটিস টি দেখা যায়। প্রসব পরবর্তী সময়ে বেশিরভাগ মহিলাদের গ্লুকোজ স্বাভাবিক সহনশীলতায় ফিরে আসে।
অন্যান্য টাইপ ডায়াবেটিস
রক্তে শর্করা বৃদ্ধি না পেলে, প্রচন্ড চেষ্টার অনুভূতি হয় এবং কম আ্যন্টি-ডাইউরেটিক হরমোন নিঃসরণ হয় ফলে অতিরিক্ত প্রস্রাব উৎপাদন হয়। এটি শুধু এক থেকে দুই শতাংশ মানুষের হতে পারে।
ডায়েবেটিস রোগীর ডায়েট (খাদ্যতালিকা)
বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতি অনুমোদন করে একজন ডায়াবেটিস রোগীর ১৬০০ কিলো ক্যালরি চাহিদা হলে খাদ্য তালিকা যেমন হবে-
সকাল
আটার তিনটি ছোট পাতলা রুটি বা তিন টুকরো বড়ো সাইজের পাউরুটি বা ছয়টি নান রুটি ছোট সাইজের, একটি ডিম বা এক টুকরো মাংস যা ৩০ গ্রাম পরিমাণ হবে, দুই কাপ ডাল এবং ১৫ থেকে ১৬টি চীনা বাদাম।
সবজি ইচ্ছেমতো
লাল শাক, পুঁই শাক, পালং শাক, ডাঁটা শাক, কলমি শাক,ফুলকপি, ঝিংগা, চিচিঙ্গা,চাল কুমড়া,চিচিঙ্গা, বাঁধাকপি, ফুলকপি, ওলকপি, লাউ, সজনা, ধুন্দল, বেগুন, কাঁচা মরিচ,পাকা টমেটো ইত্যাদি।
ফল
আমড়া,জাম্বুরা কামরাঙ্গা, বাঙ্গি, আমলকি, জামরুল,কচি ডাবের পানি ইত্যাদি খেতে পারেন।
বেলা ১১টা
বিস্কুট বা মুড়ি বা খই বা চিড়া ৩০ গ্রামের মতো খেতে পারেন। চা বা কফি খেতে পারেন তবে চিনি ছাড়া।
ফল যেকোনো একটি
একটি পাকা পেয়ারা বা ছোট আমের অর্ধেক বা ছয়টি বড় লিচু বা তিন কোয়া কাঁঠাল বা একটি মাঝারি সাইজের কমলা বা একটি মাঝারি সাইজের আপেল বা একটি মাঝারি সাইজের মালটা পাকা পেঁপে ৬০ গ্রামের মতো বা পাকা কলা অর্ধেক বা মাঝারি সাইজের মিষ্টি বড় ছয়টি বা ছয়টি আঙ্গুর বা একটি মাঝারি সাইজের নাশপাতি বা অর্ধেক বেদেনা বা আধা কাপ পাকাবেল বা ৬০ গ্রাম আনারস বা ৩০ গ্রাম তাল।
দুপুর
৩০০ গ্রাম বা সাড়ে তিন কাপ এর মতো ভাত বা আড়াইটি ব্রেডরোল বা আড়াইটি ছোট নান রুটি। দুই টুকরো মাংস বা মাছ ৬০ গ্রামের মত, বা একটি ডিম কিন্তু কুসুম ছাড়া বা একটি ডিম কুসুম ছাড়া, মাঝারি দুই কাপ ডাল ৩০ গ্রামের মতো বা ২৫ গ্রাম ছোলা ভাজা।
সবজি ইচ্ছেমতো
কলমি শাক,ফুলকপি, ঝিংগা, চিচিঙ্গা,চাল কুমড়া,চিচিঙ্গা, বাঁধাকপি, পুঁই শাক, পালং শাক, ডাঁটা শাক, ওলকপি, লাউ, সজনা, ধুন্দল, বেগুন, কাঁচা মরিচ,পাকা টমেটো ইত্যাদি।
সবজি যেকোনো একটি
একটি মাঝারি গাজর বা বা সিমের বীচি ২০টি বা ঢেঁড়স ৮টি বা ছোট আলু একটি বা দুই টুকরো কচু বা অর্ধেক কাঁচা কলা বা ৭৫ গ্রাম মোচা বা একটি ছোট কাকরোল বা শালোম একটি বা মিষ্টি কুমড়া ৯০ গ্রাম।
বিকেল
দুধ এক কাপ বা ১২৫ মিলি আর গুড়া দুধ হলে ৩০ গ্রাম বা ডাল বা চিনা বাদাম বা পিয়াজু তিনটি। চা বা কফি খেতে চাইলে চিনি ছাড়া।
রাত
৪ টুকরো বড় সাইজের পাউরুটি বা চারটি ছোট পাতলা আটার রুটি। এক টুকরো মাংস বা মাছ ৩০ গ্রামের মতো, এক কাপ ডাল বা ছোলা ভাজা ১২ গ্রাম।
সবজি ইচ্ছেমতো
লাল শাক, পুঁই শাক, পালং শাক, ডাঁটা শাক, কলমি শাক,ফুলকপি, ঝিংগা, চিচিঙ্গা,চাল কুমড়া,চিচিঙ্গা, বাঁধাকপি, ফুলকপি, ওলকপি, লাউ, সজনা, ধুন্দল, বেগুন, কাঁচা মরিচ,পাকা টমেটো ইত্যাদি ২৫ মিলি তেল দিয়ে রান্না করতে হবে।
অনেক রাতে ক্ষুধা লাগলে সকাল ১১ টার মতো নাস্তা করবেন।
তথ্য: বাংলাদেশ ডায়েবেটিক সমিতির বই
ডায়েবেটিস রোগীর জন্য সুষম খাদ্য
শরীরকে পুষ্ট রাখতে এবং শক্তি জোগাতে সুষম খাদ্যের কোন বিকল্প নেই। সবাইকে সুষম খাদ্য খেতে হবে বিশেষ করে তরুণদের। কেননা এটি অপুষ্টি এবং স্থূলতা প্রতিরোধ করে ও স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখে। এছাড়াও সুষম খাদ্য রোগকে প্রতিহত করে এবং শরীরকে ফিট রাখে। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যভাসের জন্য টাইপ ২ ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক উচ্চ রক্তচাপ এমনকি ক্যান্সারও হতে পারে। তাই ছোট থেকে বড় সবাইকে সুষম খাদ্য খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। একজন ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকা হবে সুষম খাবারে পরিপূর্ণ। ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকায় থাকবে মোট ক্যালরির ৫০% শর্করা, ২০% আমিষ ও ৩০% পার্সেন্ট ফ্যাট থেকে পাবে। সুষম খাদ্যের তালিকা বর্ণনা করা হলো-
শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট
কার্বোহাইড্রেট এর প্রধান কাজ হল শরীরে শক্তির যোগান দেয় সত্যি উৎপাদন করে। রুটি, মিষ্টি, ভাত, পাউরুটি ইত্যাদি কার্বোহাইড্রেট এর প্রধান উৎস। তবে একজন ডায়াবেটিস রোগীর এই খাবারগুলি যথা সম্ভব কম খেতে হবে।
প্রোটিন বা আমিষ
খাদ্যের ছয়টি উপাদানের মধ্যে প্রোটিন একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান খাদ্যের ৬টি উপাদানের মধ্যে। সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রোটিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি শরীরের কোষ গঠনে ও নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রোটিন যুক্ত খাবারে ডায়াবেটিস রোগীদের কোন সমস্যা নেই যদি না কিডনিতে কোন সমস্যা থাকে।
ফ্যাট বা চর্বি
চর্বি হচ্ছে এমন প্রাকৃতিক তৈলাক্ত পদার্থ যা ত্বকের নিচে অর্গান এর চারপাশে জমা থাকে। মাছের তেল, বাদাম,অলিভ অয়েল ইত্যাদি চর্বি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী। তবে অতিরিক্ত চর্বি বা ফ্যাট খাওয়া যাবে না এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ক্ষতিকর।
পানীয়
পানি মানব দেহের জন্য অপরিহার্য এবং পানি ছাড়া বাঁচা অসম্ভব। এজন্যই পানির অপর নাম জীবন। ঘনঘন প্রস্রাবের ভয়ে অনেকেই কোম্পানি খান যেটি একদমই ঠিক নয়। একজন ডায়াবেটিস রোগীকে স্বাভাবিক মাত্রায় প্রতিদিন পানি পান করতে হবে। এছাড়াও ডাবের পানি খেতে পারেন এটি খুব উপকারী পানীয়।
প্রয়োজনীয় ক্যালোরি
- ১৪০০-১৮০০ কিলোক্যালরির বেশি নয় একজন বয়স্ক ডায়াবেটিস রোগীর জন্য
- ১০০০-১৬০০ কিলোক্যালরি প্রয়োজন একজন মধ্যবয়স্ক ডায়াবেটিস রোগীর
- ১৮০০-৩০০০ কিলোগ্রাম প্রয়োজন কম বয়স্ক ডায়াবেটিস রোগীর
- প্রতিদিন ৫০ গ্রাম থেকে ১১০ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে
- এবং প্রতিদিন কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করতে হবে মোট ক্যালরির ১৮০ গ্রাম।
খাবারেই নিয়ন্ত্রণ হবে ডায়াবেটিস
এখন আমরা জানবো একজন পুষ্টিবিদ এর মতামত যেভাবে খাবার খেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আসবে –
ডায়াবেটিস রোগের প্রধান চিকিৎসায় হল রক্তের শর্করার পরিমাণ কমিয়ে আনা এতে অন্যান্য সব জটিলতার সম্ভাবনা কমে যায়। ইনসুলিনের ওপর নির্ভর না হয়ে ডায়াবেটিস রোগীর উত্তম উপায় হলো খাদ্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে চিকিৎসা নির্ভর হওয়া। এজন্য ডায়াবেটিস রোগীদের খাদ্য তালিকা সুষম হতে হবে। যেসব ব্যক্তিরা মাঝারি শ্রমের নিয়োজিত তাদের প্রতি কেজি ওজনে ৩০ ক্যালরি খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। শর্করাযুক্ত খাবার খেতে হবে যা মোট ক্যালরির ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ। শর্করা জাতীয় খাবার যেমন ঢেঁকি ছাটা চাল, ভূসিসহ আটা, বাদাম, শিমের বিচি, ছোলা ইত্যাদি খাবার নির্বাচন করা উচিত। ১৫ থেকে ২০ শতাংশ প্রোটিন খাদ্য গ্রহণ করতে হবে মোট ক্যালরি থেকে।
সারাদিনের খাবার তিন ভাগ করা লাগবে। খাবার পাঁচ ভাগের এক ভাগ খেতে হবে সকালের নাস্তায় দুপুরে দুই ভাগ এবং রাতে দুই ভাগ। এছাড়াও এগারোটা ও বিকেল চারটায় হালকা নাস্তা করা যায়। টাটকা খাবার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদিন কিছু ফল রাখতে হবে বিশেষ করে কামরাঙ্গা, আমড়া, জাম্বুরা ইত্যাদি ফল দৈনিক দেড়শ থেকে দুইশো গ্রাম পর্যন্ত খাওয়া যেতে পারে। কারণ এই ফলগুলোতে তেমন ক্যালরি থাকে না। ডায়াবেটিস রোগীদের মধু, মিষ্টি, গুড়, দুধের সর, আইসক্রিম, পেস্ট্রি, মিষ্টি বিস্কুট, মিষ্টি দই, গলদা চিংড়ি, পাকা কলা, আঙুর, আখের রস ইত্যাদি খাওয়া উচিত নয়। তবে নোনতা বিস্কুট, বাদাম, নুডুলস, চরবিহীন মাংস, ননীতলা দুধ, ছানা ও ডিম ইত্যাদি খাবার খাবেন। এসবগুলি খাবার ডায়াবেটিস রোগীর জন্য স্বাস্থ্যকর ও উপকারী।
ডায়াবেটিস রোগীদের সকালের নাস্তায় তিনটি ছোট ও পাতলা আটার রুটি বা পাউরুটি খাওয়া যেতে পারে সঙ্গে একটি ডিম, এক বাটি ডাল, সবজি ও ফল খেলেন। দুপুরে অল্প ভাতের সঙ্গে মাছ বা মাংস সবুজ সবজি সঙ্গে ইচ্ছামত সালাত ও লেবু খেতে পারেন। বিকেলের নাস্তায় এক কাপ দুধের সঙ্গে ৩০ গ্রাম যেকোনো ধরনের বাদাম খেতে পারেন।রাতের খাবারেও চারটা আটার রুটি বা এক টুকরো মাছ আর সবজি ইচ্ছামতো খাবেন।
প্রধান পুষ্টিকর্মকর্তা
চট্টগ্রাম ডায়াবেটিস জেনারেল হাসপাতাল
উপসংহার
ডায়াবেটিস মানেই খাবার নিষিদ্ধ এমনটি নয় বরং আপনি সব খাবারই খেতে পারবেন নিয়মমতো। একজন ডায়াবেটিস রোগীকে এড়িয়ে চলতে হবে চিনি, লবণ, অত্যাধিক চর্বি, চিনি দ্বারা তৈরি কফি ও চা, ময়দার তৈরি খাবার, দুগ্ধজাত মিষ্টি খাবার ইত্যাদি। তবে ফাইবার যুক্ত খাবার খেতে হবে কেননা এর মাধ্যমে রক্তে গ্লুকোজ স্তর বাড়ে ধীরে ধীরে এবং নিয়ন্ত্রণ রাখে। মোটকথা ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকা হবে সুষম খাদ্যে ভরপুর যা স্বাস্থ্যকর এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস থেকে দূরে থাকতে হবে।
Also Read: ২ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা