Dreamy Media BD

তেভাগা আন্দোলন ও ইলা মিত্র সেন

তেভাগা আন্দোলন ও ইলা মিত্র সেন
তেভাগা আন্দোলন ও ইলা মিত্র সেন
তেভাগা আন্দোলন ও ইলা মিত্র সেন

আজকে আমি আপনাদের সাথে আলোচনা করতে যাচ্ছি বাংলার ইতিহাসের এক অন্যতম মহীয়সী নারীর কাহিনী। হয়তো তিনি না থাকলে তেভাগা আন্দোলন সার্থক হতে পারত না। চলুন দেখে নিই একজন নারী কিভাবে একটি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন সে আন্দোলনকে সফল করে তুলেছে। কৃষকদের অধিকারকে অত্যাচারীদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আবার কৃষকদের কাছে অর্পণ করেছে। আপনি যদি তেভাগা আন্দোলনের ইতিহাস এবং তেভাগা আন্দোলনের সাথে ইলা মিত্র সেন কিভাবে জড়িয়ে ছিলেন সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান তাহলে অবশ্যই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমাদের সাথেই থাকবেন। শুরু করছি মূল আলোচনা –

তেভাগা আন্দোলনের সূচনা

তেভাগা আন্দোলন ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বর -এ শুরু হয়ে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত চলে। বর্গা বা ভাগ-চাষীরা এতে অংশ নেয়। মোট উৎপন্ন ফসলের তিন ভাগের দুইভাগ পাবে চাষী, এক ভাগ জমির মালিক- এই দাবি থেকেই তেভাগা আন্দোলনের সূত্রপাত।এই আন্দোলনের জনক নামে খ্যাত হাজী মোহাম্মদ দানেশ। আগে বর্গাপ্রথায় জমির সমস্ত ফসল মালিকের গোলায় উঠত এবং ভূমিহীন কৃষক বা ভাগ-চাষীর জন্য উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক বা আরও কম বরাদ্দ থাকত। যদিও ফসল ফলানোর জন্য বীজ ও শ্রম দু’টোই কৃষক দিত। তৎকালীন পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিমবঙ্গে এই আন্দোলন সংগঠিত হয়। তবে দিনাজপুর ও রংপুর জেলায় এই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছিল।

প্রধান দাবিঃ- ক) তেভাগা আন্দোলনকারীদের প্রধান দাবি ছিল উৎপন্ন ফসলের ২/৩ ভাগ তাদের দিতে হবে। খ) জমিতে ভাগ চাষীদের দখলিসত্ব দিতে হবে। গ) ভাগচাষির খামারে ধান তুলতে হবে। ঘ) ভাগ চাষ করা ধান বুঝে নেওয়ার পর জমির মালিককে রশেদ দিবে। 

আরও পড়ুন- আর্মেনিয়ান চার্চ কে ঘিরে আর্মেনীয়দের স্মৃতিকথা

তেভাগা আন্দোলনের পটভূমি

তেভাগা আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে ঐ সময়কার ভূমি ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে হবে। ব্রিটিশ শাসনের পূর্ব পর্যন্ত এই বাংলার গ্রামীণ সমাজে ভূমির মালিক ছিল চাষিরা। মোগল আমল পর্যন্ত তারা এক তৃতীয়াংশ বা কখনো কখনো তার চেয়েও কম ফসল খাজনা হিসাবে জমিদার বা স্থানীয় শাসনকর্তার মাধ্যমে রাষ্ট্রকে প্রদান করতেন। ব্রিটিশ শাসনামলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা প্রচলনের ফলে চাষিদের জমির মালিকানা চলে যায় জমিদারদের হাতে। জমিদাররা জমির পরিমাণ ও উর্বরতা অনুযায়ী ব্রিটিশদের খাজনা দিত। জমিদারদের সাথে ফসল উৎপাদনের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এ সময় জমিদার ও কৃষকদের মাঝখানে জোতদার নামে মধ্যস্বত্বভোগী এক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। এরা পত্তনি প্রথার মাধ্যমে জমিদারদের কাছ থেকে জমি পত্তন বা ইজারা নিত। এই জোতদার শ্রেণি কৃষকের জমি চাষ তদারকি ও খাজনা আদায়ের কাজ করতো। ফসল উত্‍পাদনের সম্পূর্ণ খরচ কৃষকেরা বহন করলেও যেহেতু তারা জমির মালিক নন সে অপরাধে উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক তুলে দিতে হতো জোতদারদের হাতে। এ ব্যবস্থাকে বলা হতো ‘আধিয়ারী’। জোতদারি ও জমিদারি প্রথা ক্ষুদ্র কৃষকদের শোষণের সুযোগ করে দেয়। খাজনা আদায়ের জন্য 

তেভাগা আন্দোলন ও ইলা মিত্র সেন

জোতদাররা এদেরকে দাসের মতো ব্যবহার করে। উৎপন্ন ফসলের পরিবর্তে একসময় কৃষককে বাধ্য করা হয় অর্থ দিয়ে খাজনা পরিশোধ করতে। ফলে কৃষকেরা গ্রামীণ মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হন। সর্বস্বান্ত হয়ে এক সময়ের সমৃদ্ধ বাংলার কৃষক পরিণত হন আধিয়ার আর ক্ষেত মজুরে। জমিদার-জোতদারদের এই শোষণ কৃষকের মনে বিক্ষোভের জন্ম দেয়। এই বিক্ষোভকে সংগঠিত করে ১৯৩৬ সালে গঠিত হয় ‘সর্ব ভারতীয় কৃষক সমিতি’। ১৯৪০ সালে ফজলুল হক মন্ত্রিসভার উদ্যোগে বাংলার ভূমি ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব দেয় ‘ফ্লাউড কমিশন’। এই কমিশনের সুপারিশ ছিল জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ করে চাষিদের সরাসরি সরকারের প্রজা করা এবং তাদের উৎপাদিত ফসলের তিনভাগের দুইভাগের মালিকানা প্রদান করা। এই সুপারিশ বাস্তবায়নের আন্দোলনের জন্য কৃষক সমাজ ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। এছাড়া জনসাধারণের কাছ থেকে হাটের ‘তোলা’ ও ‘লেখাই’ সহ নানা কর আদায় করা হতো। এসব বন্ধের জন্য আন্দোলন জোরদার হয়।

নাচোল উপজেলার ইলা মিত্র তেভাগা আন্দোলনের একজন অগ্রদূতী মহিলা ছিলেন।

ইলা মিত্র এর পরিচয়

ইলা মিত্র সেন জন্মগ্রহণ করেন হাজার ১৯১৮ সালের ১৮ই অক্টোবর এবং এই মহীয়সী নারী মৃত্যুবরণ করেন ২০০২ সালের ১৩ই অক্টোবর। ইনি হলেন একজন বাঙালি মহীয়সী নারী এবং সংগ্রামী কৃষকদের নেতা। ইলা মিত্র সেন সর্বাধিক পরিচিত তেভাগা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য। তিনি বাংলার শোষিত নিপীড়িত গরিব-দুঃখী কৃষকদের অধিকার আদায়ের জন্য অত্যাচার শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। তিনি সহ্য করেছেন অমানবিক নির্যাতন।

ইলা মিত্র সেনের প্রাথমিক জীবন

তেভাগা আন্দোলন ও ইলা মিত্র সেন

ইলা মিত্র সেন ১৮ অক্টোবর ১৯২৫ সালের কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের সময় তিনি ইলা সেন নামে পরিচিত ছিলেন। তার বাবা ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের অধীনস্থ বাংলার অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল। তার বাবার নাম ছিল নগেন্দ্রনাথ সেন। তাদের আদিনিবাস ছিল তৎকালীন যশোরের অন্তর্গত ঝিনাইদহের বাগুটিয়া নামক গ্রামে। চাকরি করার কারণে তারা সবাই কলকাতাতে এই অবস্থান করতেন। ইলা সেন কলকাতাতে বেড়ে ওঠেন সেখানে লেখাপড়া করেন বেথুন স্কুল ও বেথুন কলেজে।.১৯৪৪ সালে কলকাতা বেথুন কলেজ থেকে তিনি স্নাতক শ্রেণীতে বি এ ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির বিষয়ে ১৯৫৮ সালে এমএ ডিগ্রী অর্জন করেন। কিশোর বয়সে তিনি খেলাধুলায় খুব পারদর্শী ছিলেন। তিনিই প্রথম বাঙালি মেয়ে যিনি জাপানে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকের জন্য নির্বাচিত হয় ১৯৪০ সালে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে .১৯৪০ সালের অলিম্পিক টি বাতিল হয়ে যাওয়ার কারণে তার অংশগ্রহণ করা হয়নি। খেলাধুলা ছাড়াও তিনি গান ও সংস্কৃতির অন্যান্য কর্মকাণ্ডে পারদর্শী ছিলেন।

ইলা মিত্র সেনের রাজনৈতিক জীবন

ইলাসেন যখন বেথুন কলেজে বাংলা সাহিত্যে বিএ পড়াশোনা করেন তখন থেকেই তার রাজনীতির সাথে পরিচয় ঘটে। তার রাজনীতিতে প্রবেশ হয় নারী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ১৯৪৩ সালে ইলা সেন কলকাতা মহিলা সমিতির সদস্য হন। ওই বছরই হিন্দু কোড বিলের বিরুদ্ধে মহিলা সমিতির সদস্যরা আন্দোলন শুরু করে। ময়লা সমিতির একজন স্বয়ংক্রিয় সদস্য হিসেবে তিনি উক্ত আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ঐ সময় তিনি সনাতনপন্থীদের যুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান করে নানা প্রচার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি নামক সংগঠনের মাধ্যমে নারী আন্দোলনে এ সকল কাজ করতে করতে তিনি একসময় মাত্র 18 বছর বয়সে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন।

ইলা মিত্র সেন এর বিবাহ ও কর্মজীবন

১৯৪৫ সালে ইলা সেনের বিয়ে হয় দেশকর্মী কমিউনিস্ট রমেন্দ্র মিত্রের সাথে। রমেন্দ্র মিত্র মালদহের নবাবগঞ্জ থানার রামচন্দ্রপুর হাটের জমিদার মহিমচন্দ্র ও বিশ্বমায়া মিত্রের ছোট ছেলে। বিয়ের পর বেথুনের তুখোড় ছাত্রী ইলা সেন হলেন জমিদার পুত্রবধূ ইলা মিত্র। কলকাতা ছেড়ে চলে এলেন শ্বশুরবাড়ি রামচন্দ্রপুর হাটে। হিন্দু রক্ষণশীল জমিদার পরিবারের নিয়মানুসারে অন্দরমহলেই থাকতেন ইলা মিত্র। তখনও তিনি মা হননি, তাই হাতে অফুরন্ত অবসর। এই বন্দি জীবনে মুক্তির স্বাদ নিয়ে এলো গ্রামবাসীর একটি প্রস্তাব। রমেন্দ্র মিত্রের বন্ধু আলতাফ মিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় বাড়ির কাছেই কৃষ্ণগোবিন্দপুর হাটে মেয়েদের জন্য একটি স্কুল খোলা হলো। গ্রামের সবাই দাবি জানালেন তাদের নিরক্ষর 

মেয়েদের লেখাপড়া শেখাবার দায়িত্ব নিতে হবে বধূমাতা ইলা মিত্রকে। বাড়ি থেকে অনুমতিও মিললো, কিন্তু বাড়ির চার’শ গজ দূরের স্কুলে যেতে হয় গরুর গাড়ি চড়ে। মাত্র তিনজন ছাত্রী নিয়ে স্কুলটি শুরু হলেও ইলা মিত্রের আন্তরিক পরিচালনায় তিনমাসের মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০-এ। আর এর মধ্যে তিনি হেঁটে স্কুলে যাওয়ার অনুমতি লাভ করতেও সক্ষম হন। সংগ্রামী নেত্রী এভাবেই আনন্দমহল হতে বের হয়ে এসে আবার নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন বৃহত্তর সমাজ সেবা কাজের জন্য। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি মানব সেবার কাজ করে হয়ে উঠেন ওই এলাকার রানী মা। এ সময়ে তিনি তার স্বামীর কাছে জমিদার ও জোতদারের দ্বারা বাংলার চাষীদের নিদারুণ বঞ্চনা শোষণের কাহিনী শোনেন। আরো শোনেন এই শোষণের বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলনের প্রচেষ্টার কথা। কমিউনিস্ট রমেন্দ্র মিত্র এর আগেই জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য নিজের পারিবারিক ঐতিহ্য ও মোহ ত্যাগ করে কৃষকের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। রমেন্দ্র মিত্র, ইলা মিত্রকে তাদের কাজে যোগ দিতে উৎসাহিত করেন। ছাত্রী জীবনেই ইলা মিত্র কমিউনিস্ট আদর্শের সংস্পর্শে এসেছিলেন, তাই স্বামীর আদর্শ ও পথ চলার সাথে সহজেই নিজেকে যুক্ত করতে পেরেছিলেন। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত রাজশাহীর নবাবগঞ্জ অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেন ইলা মিত্র।

তেভাগা আন্দোলন ও ইলা মিত্র সেন

ইলা মিত্র (১৮ অক্টোবর, ১৯২৫-১৩ অক্টোবর, ২০০২) একজন বাঙালি নারী, সংগ্রমী কৃষক নেতা। বাংলার শোষিত ও বঞ্চিত কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি সংগ্রাম করেছেন। ভোগ করেছেন অমানুষিক নির্যাতন।

ইলা মিত্র ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের সময় ইলা মিত্র ছিলেন ইলা সেন। তার বাবা নগেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের অধীন বাংলার অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল। তাদের আদি নিবাস ছিল তৎকালীন যশোরের ঝিনাইদহের বাগুটিয়া গ্রমে। বাবার চাকরির সুবাদে তারা সবাই কলকাতায় থাকতেন। এ শহরেই তিনি বেড়ে ওঠেন, লেখাপড়া করেন কলকাতার বেথুন স্কুল ও বেথুন কলেজে। এই কলেজ থেকে তিনি ১৯৪৪ সালে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে ১৯৫৮ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। কৈশোরে তিনি খেলাধুলায় তুখোড় ছিলেন।

১৯৩৫ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত ছিলেন রাজ্য জুনিয়র অ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়ন। সাঁতার, বাস্কেটবল ও ব্যাডমিন্টন খেলায় ছিলেন পারদর্শী। তিনিই প্রথম বাঙালি নারী যিনি ১৯৪০ সালে জাপানে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকের জন্য নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে অলিম্পিক বাতিল হয়ে যাওয়ায় তার অংশগ্রহণ করা হয়নি। খেলাধুলা ছাড়াও গান, অভিনয়সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকা-েও ছিলেন সমান পারদর্শী।

ইলা সেন যখন বেথুন কলেজে বাংলা সাহিত্যে বিএ সম্মানের ছাত্রী তখন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে পরিচয় ঘটে। নারী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তার রাজনীতিতে প্রবেশ। সময়টা ছিল ১৯৪৩ সাল, ইলা সেন কলকাতা মহিলা সমিতির সদস্য হলেন। হিন্দু কোড বিলের বিরুদ্ধে ঐ বছরই মহিলা সমিতি আন্দোলন শুরু করে। সমিতির একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে তিনি এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ সময় তিনি সনাতনপন্থীদের যুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে অনেক প্রচার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি নামক সংগঠনের মাধ্যমে নারী আন্দোলনের এই কাজ করতে তিনি মাত্র ১৮ বছর বয়সে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন।

তেভাগা আন্দোলন ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয়ে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত চলে। বর্গা বা ভাগচাষিরা এতে অংশ নেয়। মোট উৎপন্ন ফসলের তিন ভাগের দুইভাগ পাবে চাষি, এক ভাগ জমির মালিকÑ এই দাবি থেকেই তেভাগা আন্দোলনের সূত্রপাত। এর আগে বর্গাপ্রথায় জমির সমস্ত ফসল মালিকের গোলায় উঠত এবং ভূমিহীন কৃষক বা ভাগচাষির জন্য উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক বা আরও কম বরাদ্দ থাকত। যদিও ফসল ফলানোর জন্য বীজ ও শ্রম দুটোই কৃষক দিত। তৎকালীন পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিমবঙ্গে এই আন্দোলন সংঘটিত হয়। তবে দিনাজপুর ও রংপুর জেলায় এই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছিল।

১৯৪৬ সালের দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে পরিহার করে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে এই কৃষক আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। নিখিল ভারত কৃষক সভার নীতি ছিল কৃষক ঐক্য যার ভিত্তিতে তেভাগা আন্দোলন জেলায় জেলায় সমস্ত ভ্রাতৃঘাতী বিবাদকে ত্যাগ করে ছড়িয়ে পড়ে। সমিতি গঠন, মহিলা কর্মী গড়ে তোলা, সংগ্রামী তহবিল এবং রাজনৈতিক শিক্ষাদানের ক্লাস ইত্যাদির মাধ্যমে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলাতে কৃষক সংগ্রামীরা একজোট হন। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উত্তরবঙ্গ বিভিন্ন জায়গায় কৃষক তেভাগার দাবি তুলেছিলেন। এই আন্দোলনের প্রধান নেতাদের মধ্যে অজিত বসু, বিষ্ণু চট্টোপাধ্যায়, ইলা মিত্র, কংসারী হালদার, সুশীল সেন, নুর জালাল, কৃষ্ণবিনোদ রায়, ভূপাল পা-ার নাম উল্লেখ করা যায়। মহিলাদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল তেভাগার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তেভাগা আন্দোলনের প্রথম শহীদ ছিলেন দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর উপজেলার তালপুকুর গ্রামের সমির উদ্দিন ও শিবরাম মাঝি। শিবরাম মাঝি হলেন আদিবাসী হাঁসদা সম্প্রদায়ের এবং সমির উদ্দিন ছিলেন একজন মুসলমান।

তেভাগা আন্দোলনের ইতিহাস জানতে হলে সে সময়ের ভূমি ব্যবস্থা বিষয়ে জানা প্রয়োজন। বাংলার গ্রামীণ সমাজে ব্রিটিশ শাসনের আগ পর্যন্ত ভূমির মালিক ছিলেন চাষিরা। মোঘল আমল পর্যন্ত তারা এক-তৃতীয়াংশ বা কখনো কখনো তার চেয়েও কম ফসল খাজনা হিসাবে জমিদার বা স্থানীয় শাসনকর্তার মাধ্যমে রাষ্ট্রকে প্রদান করতেন। ব্রিটিশ শাসনামলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা প্রচলনের ফলে চাষিদের জমির মালিকানা চলে যায় জমিদারদের হাতে। জমিদাররা জমির পরিমাণ ও উর্বরতা অনুযায়ী ব্রিটিশদের খাজনা দিত। জমিদারদের সঙ্গে ফসল উৎপাদনের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এ সময় জমিদার ও কৃষকদের মাঝখানে জোতদার নামে মধ্যস্বত্বভোগী এক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। এরা পত্তনি প্রথার মাধ্যমে জমিদারদের কাছ থেকে জমি পত্তন বা ইজারা নিত। এই জোতদার শ্রেণি কৃষকের জমি চাষ তদারকি ও খাজনা আদায়ের কাজ করত। ফসল উৎপাদনের সম্পূর্ণ খরচ কৃষক বহন করলেও তারা জমির মালিক না হওয়ার কারণে উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক তুলে দিতে হতো জোতদারদের হাতে। এ ধরনের ব্যবস্থাকে বলা হতো ‘আধিয়ার’।

জোতদারি ও জমিদারি প্রথা ক্ষুদ্র কৃষকদের শোষণের সুযোগ করে দেয়। খাজনা আদায়ের জন্য জোতদাররা এদেরকে দাসের মতো ব্যবহার করে। উৎপন্ন ফসলের পরিবর্তে একসময় কৃষককে বাধ্য করা হয় অর্থ দিয়ে খাজনা পরিশোধ করতে। ফলে কৃষকরা গ্রামীণ মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হন। সর্বস্বান্ত হয়ে এক সময়ের সমৃদ্ধ বাংলার কৃষক পরিণত হন আধিয়ার আর খেতমজুরে। জমিদার-জোতদারদের এই শোষণ কৃষকের মনে বিক্ষোভের জন্ম দেয়। এই বিক্ষোভকে সংগঠিত করে ১৯৩৬ সালে গঠিত হয় ‘সর্ব ভারতীয় কৃষক সমিতি’। ১৯৪০ সালে ফজলুল হক মন্ত্রিসভার উদ্যোগে বাংলার ভূমি ব্যবস্থা সংস্কারে প্রস্তাব দেয় ‘ফাউন্ড কমিশন’। এই কমিশনের সুপারিশ ছিল জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ করে চাষিদের সরাসরি সরকারের প্রজা করা এবং তাদের উৎপাদিত ফসলের তিনভাগের দুইভাগের মালিকানা প্রদান করা। এই সুপারিশ বাস্তবায়নের আন্দোলনের জন্য কৃষক সমাজ ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। এছাড়া জনসাধারণের কাছ থেকে হাটের ‘তোলা’ ও ‘লেখাই’সহ নানা কর আদায় করা হতো। এসব বন্ধের জন্য আন্দোলন জোরদার হয়। চল্লিশের দশকে এসব আন্দোলনেও ইলা মিত্র নেতৃত্ব দেন।

১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ বাংলা ১৩৫০ সনে সমগ্র বাংলায় দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ, যা পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে পরিচিত। এ দুর্ভিক্ষের সময় কৃষকের ওপর শোষণের মাত্রা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। এ সময়কার অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে মরিয়া হয়ে ওঠে শোষিত কৃষকরা। তিনভাগের দুইভাগ ফসল কৃষকের এই দাবি নিয়ে বেগবান হয় তেভাগা আন্দোলন। ১৯৪৬-১৯৪৭ সালে দিনাজপুরে কমরেড হাজী দানেশের প্রচেষ্টায় সূচিত হয় এক যুগান্তকারী তেভাগা আন্দোলন। কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতি প্রান্তিক চাষিদের সংগঠিত করে আন্দোলনকে জোরদার করতে থাকে। পার্টি থেকে রমেন্দ্র মিত্রকে গ্রামের কৃষক সমাজের মধ্যে কাজ করার দায়িত্ব দিয়ে তাকে কলকাতা থেকে তার নিজ গ্রাম রামচন্দ্রপুর হাটে পাঠানো হলো স্বামীসহ ইলা মিত্র সরাসরি ভাবেমাঠ পর্যায়ে কৃষক সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়।

১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হলে কমিউনিস্ট পার্টি দাঙ্গাবিধ্বস্ত এলাকায় সেবা ও পুনর্বাসনের কাজ করতে এগিয়ে আসে। এ সময় ইলা মিত্র নোয়াখালীর দাঙ্গাবিধ্বস্ত হাসনাবাদে পুনর্বাসনের কাজে চলে যান। তখন নোয়াখালীতে মহাত্মা গান্ধী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করছিলেন। ইলা মিত্রের এই সাহসী পদক্ষেপ সে সময় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়ে যাবার পর মিত্র পরিবারের জমিদারি অঞ্চল রামচন্দ্রপুর হাট তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান রাজশাহী জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তানের বেশিরভাগ হিন্দু পরিবারের সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় হিন্দুরা ভারতে চলে যায়। কিন্তু শাশুড়ি ভারতের না গিয়ে এখানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যার কারণে ইলা মিত্র ও রমেন্দ্র মিত্র এখানেই থেকে যান। পাকিস্তান রাষ্ট্র হওয়ার পরও তেভাগা আন্দোলন অব্যাহত থেকে যায়। পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে কমিউনিস্ট পার্টের নেতৃত্বে সশস্ত্র আন্দোলন হয়। পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর কঠোর হাতে এ আন্দোলন দমন করে। তারপর কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। স্থানীয় হিন্দু নেতাদের অনেককেই দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। সরকারের এই কঠোর দমননীতির ফলে কমিউনিস্ট ও কৃষক আন্দোলনের নেতারা আত্মগোপন করে তারা তাদের কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। ইলা মিত্র ও রমেন্দ্র মিত্র নাচলের একটি গ্রামে আত্মগোপন করে থাকেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে সাধারণ মানুষের মাঝে ইলা মিত্র নারী নেতৃত্বে নতুন জাগরণ সৃষ্টি করে।

ইলা মিত্র সেনের প্রকাশনাবলী

ইলা মিত্র সেন কিছু রুশ গ্রন্থের অনুবাদ করেন। তার অনুবাদ গ্রন্থগুলো হলো – লেলিনের জীবনী, হিরোশিমার মেয়ে, রাশিয়ার ছোট গল্প, মনে প্রানে দুই খন্ড, জেলখানার চিঠি।

ইলা মিত্র সেনের স্বীকৃতি ও সম্মাননা

হিরোশিমার মেয়ে বইটির জন্য তিনি ‘সোভিয়েত ল্যান্ড নেহেরু’ পুরস্কার লাভ করেন। এ্যাথলেটিক অবদানের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া ভারত সরকার তাকে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে স্বতন্ত্র সৈনিক সম্মানে “তাম্রপত্র পদক” দ্বারা ভূষিত করে সম্মানিত করা হয়। কবি  তাকে নিয়ে গোলাম কুদ্দুস ‘ইলা মিত্র’ কবিতায় লিখেন “ইলা মিত্র স্তালিন নন্দিনী, ইলা মিত্র ফুচিকের বোন”।

 

 

 

 

Related Post

মৃত্যু নিয়ে উক্তি

150+মৃত্যু নিয়ে উক্তি, বাণী, ক্যাপশন 2024

মৃত্যু নিয়ে উক্তি জন্মিলে মরিতে হবে আর এটাই সত্যি। মৃত্যু হচ্ছে সবচেয়ে চিরন্তন সত্যি। পৃথিবীতে প্রতিটি প্রাণীর মৃত্যুর স্বাদ অনুভব করতে হবে। সবসময় মৃত্যুর জন্য

Read More »
খুশির স্ট্যাটাস

200+ স্টাইলিশ খুশির স্ট্যাটাস | হাসি নিয়ে ক্যাপশন

খুশির স্ট্যাটাস | হাসি নিয়ে ক্যাপশন জীবনের সুন্দর খুশির মুহূর্ত আমরা সবাই বাঁধাই করে রাখতে চাই। আর এই খুশির মুহূর্তকে ধরে রাখার সবচেয়ে সহজ উপায়

Read More »

স্টাইলিশ ভালোবাসার ছন্দ | রোমান্টিক ছন্দ | Love Status Bangla

❤❤ভালোবাসার ছন্দ | ভালোবাসার ছন্দ রোমান্টিক | ভালোবাসার ছন্দ স্ট্যাটাস❤❤ ভালোবাসা হলো এক অন্যরকম অনুভূতির নাম, যা শুধুমাত্র কাউকে ভালবাসলেই অনুভব করা যায়। আমরা বিভিন্নভাবে

Read More »
মন খারাপের স্ট্যাটাস

মন খারাপের স্ট্যাটাস, উক্তি, ছন্দ, ক্যাপশন, কিছু কথা ও লেখা

মন খারাপের স্ট্যাটাস মন খারাপ – এই কষ্টের অনুভূতি কার না হয়? সবারই কখনো না কখনো সবারই মন খারাপ হয়। জীবনের ছোটোখাটো অঘটন থেকে শুরু

Read More »

Leave a Comment

Table of Contents