Dreamy Media BD

বাংলাদেশের শিয়া সম্প্রদায়

বাংলাদেশের শিয়া সম্প্রদায়

 

প্রিয় পাঠ ক আজকে আমরা এমন একটি সম্প্রদায়ের সম্পর্কে জানব যেটা সম্পর্কে জানা জ্ঞান অর্জনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আজকে আমরা জানবো বাংলাদেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ শিয়া মুসলিম সম্প্রদায় সম্পর্কে। আপনি যদি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমাদের এই পোস্টটি পড়েন তাহলে বাংলাদেশের শিয়া সম্প্রদায়ের ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন।

বাংলাদেশের একটি সবচাইতে বড় সম্প্রদায় হচ্ছে শিয়া মুসলিমরা। মোট জনসংখ্যার ২% হচ্ছে শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়। বাংলাদেশী শিয়া মুসলিম সম্প্রদায় অধিকাংশ বিহারী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশের যদিও অল্প সংখ্য ক শিয়া সম্প্রদায় রয়েছে তারপরও আলী ইবনে আবু তালিবের পুত্র ইমাম হাসান ও ইমাম হোসেন এর মৃত্যুর স্মরণে আসুরা উৎসব পালন করা হয় এখনো দেশের সুন্নি সম্প্রদায়ের মাঝে ব্যাপকভাবে পালিত হচ্ছে। যেটা বাংলায় শিয়া সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক প্রভাবকে উপস্থাপন করে।

বাংলাদেশের শিয়া সম্প্রদায় বিস্তার

দাউদী বোহরা সম্প্রদায়ের শিয়াদের মূলত চট্টগ্রামে এবং নিজারি ইসমাইলি সম্প্রদায়দের শিয়াদের মূলত ঢাকায় পাওয়া যায়। ঢাকার বকশীবাজারের হোসেনী দালান হলো বাংলাদেশের বৃহত্তম শিয়া মসজিদ এবং প্রধান ইমামবাড়া। ঢাকা জুড়ে আদাবর, পল্টন, মোহাম্মদপুর, ফরাশগঞ্জ ও আজিমপুরের মতো জায়গায় অসংখ্য ইমামবাড়া ও শিয়া মসজিদ রয়েছে। উত্তর-পূর্ব সিলেট বিভাগে ইসনা আশারিয়া সম্প্রদায়ের বসবাস রয়েছে কুলাউড়া ও রাজটিলার মতো স্থানে এবং সিলেটের বিখ্যাত পৃথিমপাশা পরিবারের সাথে তাদের সম্পর্ক রয়েছে, যারা নিজেরাও শিয়া মুসলিম ছিল। পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ায় ভেলাই চোকদারের জোড়া মসজিদ রয়েছে, যেটি দক্ষিণ বাংলার শিয়া বসবাস ও ঐতিহ্যের একটি নিদর্শন। এছাড়াও বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ঠাকুরগাঁওয়ের শালবাড়ি শিয়া মসজিদটি ১৮৮৮ সালের শেষের দিকে নির্মিত। মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, অষ্টগ্রাম ও সৈয়দপুরেও শিয়া ইমামবাড়া রয়েছে।

আরো পড়ুন – কপিলমুনির আশ্রম

শিয়া ইসলামের ইতিহাস

শিয়া ইসলাম, তাশাইয়ু বা শিয়া মতবাদ নামে পরিচিত। সুন্নি ইসলামের পরে ইসলামের সবচাইতে বড় শাখা হচ্ছে শিয়া ইসলাম।মুহাম্মদ (সা.) মৃত্যুবরণ করার পর ইসলামের নেতৃত্বের বিষয়ে প্রশ্ন উঠলে শিয়াদের উদ্ভব হয়। শিয়ারা কুরআন ও মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়য়া সাল্লাম কে এবং তার পরিবারের সদস্যদেরকে ও তার উত্তরসূরিদেরকে অনুসরণ করেন। মোহাম্মদ সাঃ এর উত্তরসূরিদেরকে আহলে বাইত বলা হতো। মুহাম্মদ (সা.) এর কন্যা ফাতেমা জাহরা ও চাচা আলীর পরিবারের সদস্যরাই আহলে বাইত হিসেবে পরিগনিত। সুতরাং, শিয়ারা মুহাম্মদের বংশধরকেই মূলত অনুসরণীয় হিসেবে বিবেচনা করেন।

বাংলাদেশের শিয়া সম্প্রদায়

সময়ের পরিক্রমায় শিয়া ইসলাম বিভিন্ন মতবাদ ও শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে যা হয়েছিল বিশেষ করে ইমামদের উত্তসূরী বিষয়ে মতভেদের কারণে। শিয়াদের বিভিন্ন শাখার মধ্যে শুধুমাত্র তিনটিরই বর্তমানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অনুগামী রয়েছে এবং তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব পরিচালন পথ রয়েছে।

শিয়া মতবাদ ইসলামের দ্বিতীয় বৃহত্তম শাখা এবং একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের শেষভাগে গোটা মুসলিম বিশ্ব এর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ছিল শিয়া মুসলমান। ইসনা আশারিয়া হল শিয়া ইসলামের বৃহত্তম উপদল এবং ২০১২ সালের একটি জরিপ মতে শিয়া মুসলমানদের ৮৫ শতাংশ ইসনা আশারিয়া। শিয়াদের উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যা ইরান ও ইরাক এ দুই দেশের বড় অংশ শিয়া মতাবলম্বী। ইয়েমেন, বাহরাইন, সিরিয়া ও লেবানন ইত্যাদি দেশেও শিয়া সম্প্রদায় রয়েছে।

রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে শিয়াদের ইতিহাস বেশ কয়েকটি পর্যায় অতিক্রম করেছে। প্রথম পর্যায়টি ছিল শিয়াদের উত্থান, যা ৬৩২ সালে মুহাম্মদের মৃত্যুর পরে শুরু হয়েছিল এবং ৮৮০ সালে কারবালার যুদ্ধ অবধি অব্যাহত ছিল। এই অংশটি আলী, হাসান ও হোসেনের সাথে মিলিত হয়। দ্বিতীয় পর্যায়টি হল মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে শিয়াদের একটি পৃথক গোষ্ঠী হিসাবে স্বাতন্ত্র্য, পার্থক্য এবং সুন্নি খলিফাদের বিরোধিতা। এই অংশটি কারবালার যুদ্ধের পরে শুরু হয় এবং শিয়া সম্প্রদায় গঠনের প্রায় ৯০০ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এই পর্যায়ে শিয়া মতাবলম্বীরা বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। তৃতীয় পর্যায়টি ছিল শিয়া সাম্রাজ্যের সময়ে।প্রথম শিয়া রাষ্ট্রের নাম ছিল মাগরেবের ইদ্রিসীয় রাজবংশ (৭৮০-৯৭৪)। এরপর ছিল ইরানের উত্তরে মাজান্দারানে (তাবারিস্তান) প্রতিষ্ঠিত আলবীয় রাজবংশ (৮৬৪-৯২৮)। এই রাজবংশগুলো মূূূলত স্থানীয় ছিল। তবে তাদের পরে দুটি দুর্দান্ত এবং শক্তিশালী রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ফাতেমীয় রাজবংশ ইফরিকিয়ায় ৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং ১১৭১ সাল অবধি মাগরেব, মিশর ও লেভান্তের বিভিন্ন অঞ্চলে শাসন করেছিল। বুঈ রাজবংশ ইরানের উত্তর দিকে দাইলামানে আবির্ভূত হয়েছিল এবং প্রায় ৯৩০ সালে ইরান ও ইরাকের মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চলে রাজত্ব করেছিল।  ফলস্বরূপ, দশম শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে একাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়কাল প্রায়শই ইসলামের “শিয়া শতাব্দী” নামে পরিচিত।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] ইয়েমেনের বিভিন্ন রাজবংশের ইমামরা সাধারণত জায়েদি সম্প্রদায়ের ইমামরা একটি আধ্যাত্মিক-রাজনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা ৮৯৭ থেকে ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দ অবধি টিকে ছিল। সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল ইরানে সফবীয় রাজবংশের অধীনে মুসলমানদের জোরপূর্বক শিয়া ইসলামে ধর্মান্তরকরণ করা হয়েছিল ১৬ ও ১৮ শতকের মধ্যে। এর ফলে আধুনিক যুগে শিয়া ইসলামের জাইদিয়া ও ইসমাইলি সম্প্রদায়গুলোর উপর ইসনা আশারিয়া বা বারো ইমামে বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের আধিপত্যও নিশ্চিত হয়েছিল।

সাকিফা থেকে কারবালা (মুহাম্মাদ (সা.)এর উত্তরাধিকারি নির্বাচন)

মুহাম্মাদ (সা.)মদিনায় হিজরতের পূর্বে মক্কায় ইসলাম প্রচার করতেন এবং সেখানে আরবের গোত্রগুলোকে একত্রিত করে আরব মুসলিমদের একটি সুসংগঠিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। ৬৩২ সালে মুহাম্মদের (সা.) মৃত্যুর পর মুসলিম সম্প্রদায়ের পরবর্তী খলিফা বা নেতা কে হবেন এ নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। মুহাম্মদের চাচাতো ভাই ও জামাতা আলী ইবনে আবু তালিব এবং নিকটবর্তী পরিবারবর্গ যখন তাঁকে দাফনের জন্য আগে গোসল দিচ্ছিলেন তখন মক্কা ও মদিনার গোত্রীয় নেতারা সাকিফায় এক গোপন সভায় মিলিত হয়েছিলেন মুহাম্মদের পর কে রাষ্ট্রের উত্তরাধিকার হবেন তা নির্ধারণের জন্য। অনেক মোহাজের তথা হিজরতকারিদের ধারণা ছিল মুহাম্মদ (সা.) আলীকে উত্তরসূরি নির্বাচন করে গেছেন। এ বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করেই সাকিফার গোপন সভাটি অনুুুষ্ঠিত হয়েছিল।

মুহাম্মদ (সা.) এর সাহাবী ওমর ইবনে আল-খাত্তব প্রথম ব্যক্তি ছিলেন যিনি আবু বকরকে খলিফা হিসেবে প্রস্তাব করেছিলেন। অন্যান্যরা এ প্রস্তাবে একমত না হলেও অবশেষ আবু বকরকে প্রথম খলিফা হিসেবে মেনে নেয়া হয়।

এভাবে মুহাম্মদ (সা.) এর উত্তরাধিকার নির্বাচন একটি অত্যন্ত বিতর্কিত বিষয়ে পরিণত হয়। মুসলিমরা এই ইস্যুতে তাদের রাজনৈতিক মনোভাবের ভিত্তিতে শেষ পর্যন্ত দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়, যেখানে শিয়া সম্প্রদায় কর্তৃক আলীকে মুহাম্মদের উত্তরসূরি হিসেবে অনুসরণ করার মধ্য দিয়ে মুসলিমদের দুটি প্রধান বিভাগ সুন্নি ও শিয়াদের মাঝে প্রথম রাজনৈতিক বিভাজন তৈরি হয়েছিল। দুটি দলই আবু বকর ও তাঁর পরবর্তী দুজন খলিফা: উমর (বা `উমর ইবনুল খাত্তাব) ও উসমান বা (‘ উসমান ইবনে ‘আফ্ফান) সম্পর্কে আলীর মনোভাব বিষয়ে একমত নন। সুন্নিরা জোর দিয়ে বলেন যে, আলী তাঁদের শাসনের প্রতি স্বীকৃতি ও সমর্থন জানিয়েছিলেন অন্যদিকে শিয়ারা দাবি করেন যে, আলী তাঁদের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন এবং তাঁকে মুহাম্মদ কর্তৃক অর্পিত ধর্মীয় দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখা হয়েছিল।  সুন্নি মুসলিমরা বলছেন যে, আলী যদি আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত যথাযথ উত্তরাধিকারী হতেন, তবে মুসলিম জাতির নেতা হিসেবে আলী কোন ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত এঁদের (আবু বকর, উমর এবং উসমান) সঙ্গে যুদ্ধ করতেন।  তবে শিয়াগণ দাবি করেছেন যে, আলী আবু বকর, উমর বা উসমানের সাথে লড়াই করেন নি, কারণ প্রথমদিকে তাঁর সামরিক শক্তি ছিল না এবং যদি তিনি এ সিদ্ধান্ত নিতেন, তবে তা মুসলিমদের মধ্যে একটি গৃহযুদ্ধের কারণ হয়ে উঠত যারা তখনও পর্যন্ত আরব বিশ্বের একটি নব্য সম্প্রদায়মাত্রই ছিল।

শিয়াদের ভিন্নতা ও স্বতন্ত্র 

বাংলাদেশের শিয়া সম্প্রদায়

মুহাম্মদ (সা.) এর মৃত্যুর পরপর খলিফা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত রাজনীতির ফলে শিয়া ইসলাম ও সুন্নি মতবাদ পরস্পর বিভক্ত হয়ে পড়ে। আলীই প্রথম খলিফা হওয়া উচিত ছিল এই বিশ্বাসের কারণে তাঁর পূর্বের তিন খলিফা আবু বকর, উমর এবং উসমানকে শিয়া মতবাদীগণ অবৈধ দখলকারী হিসেবে বিবেচনা করত। এ কারণে এই তিনজন খলিফা (বা তাদের সমর্থকদের) দ্বারা বর্ণিত কোন হাদীস শিয়া হাদীস সংগ্রাহকরা গ্রহণ করেননি। ফলে শিয়াদের গৃহীত হাদীসের সংখ্যা সুন্নী গৃহীত হাদীসের তুলনায় অনেক কম যার মধ্যে অনেকগুলো অগ্রহণযোগ্য হাদিস রয়েছে; যেমন- প্রার্থনা ও বিবাহ সম্পর্কিত হাদিসগুলো ইসলামের অবিচ্ছেদ্য বিষয়াদির আলোকে আলোচনার প্রয়োজন ছিল।

বিশুদ্ধ হাদিসের বিরোধীতা শিয়াদের ধর্মীয় অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে রেখেছে। এছাড়া কোন অবস্থার সুস্পষ্ট হাদীসের অনুপস্থিতিতে শিয়া অনুসারীগণ ইমামদের (নবী পরিবারের সদস্য) বক্তব্য ও আমলকে অন্যান্য পন্থার চেয়ে নবীর হাদীসের মতোই একই মর্যাদা দেন যা ইমামদের আধ্যাত্মিক উত্থানের বিষয়টিকে আরো অকাট্য করে তোলে।

শিয়া মতবাদ যা ছিল মূলত একটি রাজনৈতিক বিষয় পরবর্তীকালে একটি ধর্মমতে রূপ নেয়। আববাসী যুগে এর স্বাতন্ত্র্য স্বীকৃত হয়। এ সময় প্রকাশ্যে এ মতের চর্চা করারও অনুমতি দেওয়া হয়। ৯৬২ খ্রিস্টাব্দে সার্বজনীনভাবে হোসেনের শাহাদাতবরণ উপলক্ষে শোক প্রকাশ করা হয়। ষোড়শ শতকে যখন সফভি বংশ পারস্যের ক্ষমতায় আসে তখন শিয়া মতবাদ প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনায় প্রচারিত হতে থাকে। সফভি শাসকগণ শিয়া মতবাদকে পারস্যের তথা ইরানের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন।

শিয়াদের বারো নিয়মের তালিকা

আলী ইবনে আবি তালিব

তিনি জন্মগ্রহণ করেন ৬০০ খ্রিস্টাব্দে। আলী ইবনে আবি তালিব ইমামতি গ্রহণ করেছেন ৩৩ বছর বয়সে। তিনি দীর্ঘ .২৮ বছর ইমামতি করার পর ৬১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন মুহম্মদের চাচাতো ভাই ও জামাতা। শিয়া বিশ্বাসমতে তিনি ইসলামের পবিত্রতম স্থান কাবার অভ্যন্তরে জন্মগ্রহণকারী একমাত্র ব্যক্তি এবং প্রথম ইসলামগ্রহণকারী পুরুষ। শিয়া মুসলমানেরা তাঁকে মুহম্মদের একমাত্র ন্যায্য স্থলাভিষিক্ত এবং প্রথম ইমাম হিসেবে বিবেচনা করে। সুন্নি মুসলমানেরা তাঁকে চতুর্থ রাশিদুন খলিফা হিসেবে গণ্য করে। সুফিবাদের প্রায় সকল তরিকায় তাঁকে উচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়; তরিকাসমূহের সদস্যগণ মুহম্মদ পর্যন্ত তাদের সিলসিলা আলীর মাধ্যমে জারি রাখেন।

রমজান মাসে মসজিদ আল-কুফায় নামাজে সেজদারত অবস্থায় আব্দুর রহমান ইবনে মুলজিম নামক এক খারিজি গুপ্তঘাতকের বিষাক্ত তরবারির আঘাতে আহত হয়ে বিষক্রিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন।

শিয়া বিশ্বাসমতে তাঁকে ইরাকের নাজাফ শহরের ইমাম আলী মসজিদে দাফন করা হয়।।আলীর উপাধি গুলো ছিল –

আমীরুল মুʾমিনীন (বিশ্বাসীদের নেতা)

আল-মুর্তজ়া (প্রিয়জন)

আল-ওয়াস়ী (স্থলাভিষিক্ত)

আল-ওয়ালী (ওয়ালি)

আবু তুরাব (মাটির পিতা)

আসাদুল্লাহ (আল্লাহর সিংহ)

ওয়ালীউল্লাহ (আল্লাহর ওয়ালি)

মওলা (সর্দার, কর্তা, বন্ধু)

হয়দর (সিংহ)

উলিল আমর (কর্তৃত্বের অধিকারী)

মুশকিল কুশা (কষ্ট দূরকারী)

নফসে নবী (নবীর নফস)

বাব আল-মদীনাতুল ʿইলম (জ্ঞানের শহরের দরজা)

আন-নাসি মাইয়াশরিয়ুন নফসাহুব তিগাআ মরদাতিল্লাহ (যে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নিজেকে বিকিয়ে দেয়)

হাসান ইবনে আলী

হাসান ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন এবং মৃত্যুবরণ করেন ৬৭০ খ্রিস্টাব্দে। হাসান ইবনে আলী ইমাম মতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন ৩৯ বছর বয়সে। তিনি আট বছর ইমামতি করার পর  বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করে।তিনি ছিলেন মুহম্মদের কন্যা ফাতিমার গর্ভজাত দৌহিত্রদের মধ্যে সবার বড়। হাসান কুফায় তাঁর পিতা আলীর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নিযুক্ত হন। সাত মাস খলিফা হিসেবে দায়িত্বপালনের পর মুয়াবিয়া ইবনে আবী সুফিয়ানের সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তির ভিত্তিতে তিনি পদত্যাগ করেন।

মুয়াবিয়ার প্ররোচনায় স্বীয় স্ত্রীর মাধ্যমে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়।তাঁকে মদীনার জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হয়। তার উপাধিগুলো ছিল –

আল-মুজতবা (মনোনীত)

আস-সৈয়দ (সর্দার)

সৈয়দু শবাবি আহলিল জান্নাহ (জান্নাতি যুবকদের সর্দার)

সিবত় আন-নবী (নবীর বংশ)

ইকিঞ্জি আলী (দ্বিতীয় আলী)

হোসাইন ইবনে আলী

হোসাইন ইবনে আলী ৬২৬ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং মৃত্যুবরণ করেন ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে। তিনি ইমামতি গ্রহন করেন ৪৬ বছর বয়সে। ১১ বছর ইমামতি করার পর ৫৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।তিনি ছিলেন মুহম্মদের  দৌহিত্র, আলীর পুত্র এবং হাসানের ভাই। হোসাইন উমাইয়া শাসক ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার দুঃশাসনের বিরোধিতা করেন। ফলস্রুতিতে তিনি, তাঁর পরিবার ও সহচারীরা কারবালার যুদ্ধে ইয়াজিদের সৈন্যবাহিনী কর্তৃক নির্মমভাবে শহীদ হন। এই ঘটনার পর থেকে হোসাইনের শাহাদতের স্মৃতিচারণ শিয়া আত্মপরিচয়ের একটি কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে ওঠেকারবালার যুদ্ধে শিরশ্ছেদ করে হত্যা করা হয়।

তাঁকে ইরাকের কারবালার ইমাম হোসেনের মাজারে দাফন করা হয়। তার উপাধিগুলো ছিল-

আশ-শহীদ(শহীদ)

 

সৈয়দ আশ-শুহাদাʾ(শহীদদের সর্দার)

 

সৈয়দু শবাবি আহলিল জান্নাহ](জান্নাতি যুবকদের সর্দার)

 

আর-রশীদ(ন্যায়নিষ্ঠ)

 

আত-তাবিঈ লি মর্দাতিল্লাহ(দৈব ইচ্ছার অনুসারী)

 

আল-মুবারক(মহিমান্বিত)

 

আত়-ত়ৈয়িব(বিশুদ্ধ)

 

আল-মজ়লুম(নিপীড়িত)

 

আল-ওয়াফী(বিশ্বস্ত)

 

সিবত় আন-নবী(নবীর বংশ)

 

উচুঞ্জু আলী(তৃতীয় আলী)

আলী ইবনে হোসাইন

আলী ইবনে হুসাইন ৬৫৮/৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৭১২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ২৩ বছর বয়সে ইমামতি গ্রহণ করেন। ৩৪ বছর ইমামতি করার পর ৫৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।সহিফা আস-সাজ্জাদিয়ার রচয়িতা, যা আহল আল-বাইতের স্তোত্র হিসেবে পরিচিত। দুর্বলতাজনিত অসুস্থতার কারণে কারবালার যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান।উমাইয়া খলিফা প্রথম আল-ওয়াহিদের নির্দেশে তাঁকে বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করা হয়।

মদীনার জান্নাতুল বাকিতে তাঁকে দাফন করা হয়। তার উপাধিগুলো ছিল-

 

আস-সাজ্জাদ(অবিচল সেজদাকারী

 

জ়য়নুল ʿআবেদীন(উপাসকদের অলঙ্কার)

 

দর্দুঞ্জু আলী(চতুর্থ আলী)

মোহাম্মদ ইবনে আলী

৬৭৭ খ্রিস্টাব্দে মোহাম্মদ ইবনে আলী জন্মগ্রহণ করেন এবং ৭৩২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ৩৮ বছর বয়সে ইমামতি গ্রহণ করেন। 19 বছর ইমামতি করার পর 57 বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।সুন্নি ও শিয়া উভয় সূত্রমতে তিনি অন্যতম প্রাচীন ও বিশিষ্ট ফিকহশাস্ত্রবিদ ছিলেন যিনি তাঁর জীবদ্দশায় অসংখ্য শিক্ষার্থীদের পাঠদান করেন।উমাইয়া খলিফা হিশাম ইবনে আবদুল মালিকের নির্দেশে ইব্রাহীম ইবনে ওয়ালিদ ইবনে আব্দুল্লাহ কর্তৃক বিষপ্রয়োগে তাঁকে হত্যা করা হয়।

মদীনার জান্নাতুল বাকিতে তাঁকে দাফন করা হয়। তার উপাধি গুলো হল-

 

আল-বাক়ির(উন্মোচনকারী)

 

বেশিঞ্জি আলী(পঞ্চম আলী)

জাফর ইবনে মুহাম্মদ

জাফর ইবনে মোহাম্মদ ৭০২ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং 765 খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ৩১ বছর বয়সে ইমামতি গ্রহন। ৩৪ বছর ইমামতি করার পর ৬৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।শিয়া বিশ্বাসমতে তিনি জাফরি মাজহাব এবং দ্বাদশী ধর্মতত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে অসংখ্য পণ্ডিতদের শিক্ষাদান করেছিলেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে ফিকহশাস্ত্রে আবু হানিফা ও মালিক ইবনে আনাস, কালামশাস্ত্রে ওয়াসিল ইবনে আতা ও হিশাম ইবনে হাকাম, এবং বিজ্ঞান ও আলকেমিতে জাবির ইবনে হাইয়ান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুরের নির্দেশে মদীনায় বিষপ্রয়োগ করে তাঁকে হত্যা করা হয়।

তাঁকে মদীনার জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হয়। তার উপাধি গুলো হলো-

 

আস়-স়াদিক়(সজ্জন)

 

আলতিঞ্জি আলী(ষষ্ঠ আলী।

মুসা ইবনে জাফর

মুসা ইবনে জাফর ৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ২০ বছর বয়সে ইমামতি গ্রহন করেন। ৩৫ বছরে ইমামতি করার পর ৫৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি জাফর আস-সাদিকের মৃত্যুর পর ইসমাইলি ও ওয়াকিফি বিচ্ছেদকালীন শিয়া সম্প্রদায়ের নেতা ছিলেন।তিনি মধ্যপ্রাচ্য ও বৃহত্তর খোরাসানের শিয়া মতাবলম্বীদের কাছ থেকে খুমুস সংগ্রহের উদ্দেশ্যে প্রতিনিধিদের একটি অন্তর্জাল গড়ে তোলেন। তিনি মাহদবী তরিকায় উচ্চ সম্মানে ভূষিত যারা তাঁর মাধ্যমে মুহম্মদ  অবধি সিলসিলা চিহ্নিত করে থাকে।আব্বাসীয় খলিফা হারুনুর রশিদের নির্দেশে বাগদাদে তাঁকে কারাবন্দী করা হয় এবং বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করা হয়।

ইরাকের বাগদাদ শহরের কাজিমিয়া শহরতলীর আল-কাজিমিয়া মসজিদের তাঁকে দাফন করা হয়। তার উপাধি গুলো হল-

 

আল-কাজ়িম(কারারুদ্ধ)

 

ইয়েদিঞ্জি আলী(সপ্তম আলী।

আলী ইবনে মুসা

তিনি ৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৮১৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। আলী ইবনে মুসা ৩৫ বছর বয়সে ইমামতি গ্রহণ করেন। ২০ বছর ইমামতি করার পর ৫৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করে,।আব্বাসীয় খলিফা আল-মামুন তাঁকে যুবরাজ ঘোষণা করেন। তিনি মুসলিম ও অমুসলিম ধর্মীয় পণ্ডিতদের সাথে তাঁর আলোচনার জন্য বিখ্যাত।শিয়া সূত্রমতে আল-মামুনের নির্দেশে পারস্যের মাশহাদে তাঁকে বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করা হয়৷

তাঁকে ইরানের মাশহাদের ইমাম রেজার মাজারে দাফন করা হয়। তার উপাধি গুলো হলো-

 

আর-রিদ়া(মনোরম)

 

সেকিজ়িঞ্জি আলী(অষ্টম আলী)

মোহাম্মদ ইবনে আলী

মোহাম্মদ ইবনে আলী ৮১০ খ্রিস্টাব্দের জন্মগ্রহণ করেন এবং ৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি মাত্র ৮ বছর বয়সে ইমামতি গ্রহণ করেন । ১৭ বছর ইমামতি করার পর 25 বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।আব্বাসীয় খলিফাদের নিপীড়নের মুখেও তাঁর উদারতা ও ধার্মিকতার জন্য বিশেষভাবে খ্যাত।খলিফা আল-মুতাসিমের নির্দেশে আল-মামুনের কন্যা ও স্বীয় স্ত্রীর মাধ্যমে বিষপ্রয়োগ করে তাঁকে হত্যা করা হয়।

তাঁকে ইরাকের বাগদাদ শহরের কাজিমিয়া শহরতলীর আল কাজিমিয়া মসজিদে দাফন করা হয়। তার উপাধি গুলো হলো-

 

আল-জওয়াদ(উদার)

 

আত-তক়ী(খোদাভীরু)

 

দোকুজ়ুঞ্জু আলী(নবম আলী)।

আলী ইবনে মুহাম্মদ

আলী ইবনে মোহাম্মদ ৮২৭ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি আট বছর বয়সে ইমামতি গ্রহণ করেন। ৩৪ বছরে ইমামতি করার পর ৪২ বছর বয়সের মৃত্যুবরণ করেন।তিনি শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রতিনিধিদের অন্তর্জালকে জোরদার করেন। তিনি তাঁদের নির্দেশনা প্রদান করেন এবং বিনিময়ে বিশ্বাসীদের কাছ থেকে খুমুস জাতীয় আর্থিক অনুদান ও ধর্মীয় প্রতিশ্রুতি লাভ করেন।খলিফা আল-মুতাজের নির্দেশে ইরাকের সামাররায় তাঁকে বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করা হয়।

তাঁকে ইরাকের সামাররা শহরের আল-আসকারী মসজিদে দাফন করা হয়। তার উপাধি গুলো হলো-

আল-হাদী(পথপ্রদর্শক)

 

আন-নক়ী(পবিত্র)

 

ওনুঞ্জু আলী(দশম আলী ।

হাসান ইবনে আলী

হাসান ইবনে আলী ৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ২২ বছর বয়সে ইমামতি গ্রহন করেন। ৬ বছর ইমামতি করার পর ২৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।তাঁর পিতার মৃত্যুর পর তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময়ই খলিফা আল-মুতামিদের নজরদারিতে গৃহবন্দী অবস্থায় কাটে। এই সময় শিয়া মুসলমানেরা সংখ্যায় ও শক্তিতে বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের ওপর নিপীড়ন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়।ইরাকের সামাররায় খলিফা আল-মুতামিদের নির্দেশে বিষপ্রয়োগ করে তাঁকে হত্যা করা হয়।

তাঁকে ইরাকের সামাররা শহরের আল-আসকারী মসজিদে দাফন করা হয়। তার উপাধি গুলো হল-আল-

 

ʿআসকারী(সামরিক ঘাঁটির নাগরিক)

 

ওনবিরিঞ্জি আলী(একাদশ আলী)।

মোহাম্মদ ইবনে হাসান

মোহাম্মদ ইবনে হাসান জন্মগ্রহণ করেন ৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে। তিনি ইমামতির দায়িত্ব পান মাত্র ৫ বছর বয়সে। দ্বাদশী শিয়া বিশ্বাসমতে তিনি হলেন বর্তমান ইমাম এবং প্রতীক্ষিত মাহদী, একজন মসীহীয় ব্যক্তিত্ব যিনি নবী ঈসা ইবনে মরিয়মের সঙ্গে শেষ জমানায় আবির্ভূত হবেন। তিনি ইসলামের ন্যায়ভিত্তিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন এবং সমগ্র পৃথিবীতে ন্যায়বিচার ও বিশ্বশান্তি কায়েম করবেন।

 

দ্বাদশী শিয়া তত্ত্বমতে তিনি ৮৭৪ সাল থেকে গয়বত বা সমাবরণে চলে গিয়েছেন এবং আল্লাহর নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত এ অবস্থাতেই থাকবেন। মোহাম্মদ ইবনে হাসানের উপাধি গুলো হল –

আল-মাহদী (দিকনির্দেশিত)

 

আল-ক়াʾইম (উত্থানকারী)

 

আল-গ়াʾইব (অদৃশ্য)

 

আল-হ়ুজ্জত ʾআল মুহ়ম্মদ (মুহম্মদের  বংশের প্রমাণ)

 

ওনিকিঞ্জি আলী (দ্বাদশ আলী)

বাংলাদেশের শিয়া সম্প্রদায়ের ইতিহাস

অনেক ইসনা আশারিয়া বা দ্বাদশী শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ নানা সালতানাত এবং পরবর্তীতে মুঘল সাম্রাজ্যের সময় দক্ষিণ এশিয়ায় স্থানান্তরিত হয়ে উন্নতি লাভ করে এবং সাম্রাজ্যে উচ্চ পদ লাভ করে। এদের অনেকেই ছিলেন বিদ্রোহী ও অভিজাত, যারা পারস্যে নিজেদের রাজকীয় সম্মান হারিয়ে ভারতবর্ষে চলে আসেন। মুঘলরাও বিদেশি মুসলিম কর্মকর্তাদের নিয়োগ করতে পছন্দ করতো, কারণ তাদের কোনো স্থানীয় স্বার্থ ছিল না এবং তাঁরা সম্রাটের প্রতি অনুগত ছিল। বাংলার সব নবাবই শিয়া মুসলিম ছিলেন।

বাংলাদেশের শিয়া সম্প্রদায়

সুলতানি যুগে ইস্পাহানের একজন শিয়া সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি সখী সালামত ১৪৯৯ সালে কুলাউড়ার পৃথিমপাশা গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। তাঁর পুত্র ইসমাইল খান লোদিকে অসংখ্য জমিদারি প্রদান করা হয়েছিল এবং পৃথিমপাশা রাজবংশ বৃহত্তর সিলেটের অন্যতম প্রধান পরিবারে পরিণত হয় যারা পূর্ব বাংলার ওই সময়ের সামন্ততান্ত্রিক আভিজাত্যের অন্তর্গত ছিল।

মুঘল যুগে

বাংলাদেশের প্রাচীনতম শিয়া ইমামবাড়া ছিল ঢাকার ফরাশগঞ্জে বিবি কা রওজা, যেটি ১৬০৮ সালে আমির খান নির্মাণ করেছিলেন। যদিও ভবনটি এখন আর বিদ্যমান নয়। সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে ইব্রাহিম খান ফতেহ জঙ্গ নামে একজন শিয়া কর্মচারীকে ১৬১৭ সালে বাংলার সুবাহদারিত্ব দেওয়া হয় এবং তিনি তাঁর সঙ্গে অনেক শিয়া সহকর্মীদের ঢাকার নিয়ে এসেছিলেন।

মুঘল বাংলার সুন্নি সুবাহদার শাহ সুজার মা, দুই স্ত্রী ও শিক্ষক সকলেই ছিলেন শিয়া। শাহ সুজার দরবারীদের মধ্যে অনেকেই শিয়া ছিলেন। এজন্য ঢাকায় একটি কথা প্রচলিত হয়ে যায় যে, শাহ সুজা তাঁর সঙ্গে ৩০০ জন শিয়াকে নিয়ে এসেছিলেন যাদের তিনি বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বসতি স্থাপন করিয়েছিলেন। যদিও একজন কট্টর সুন্নি মুসলিম ও শাহ সুজার বিরোধীরা দিল্লিতে গুজব ছড়াতে শুরু করে যে শাহ সুজা শিয়া ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছে। ১৬৪২ সালে শাহ সুজার মেয়াদকালে ঢাকার মুঘল নৌপ্রধান সাইয়িদ মুরাদ হোসেনি দালান নির্মাণ করেন।

ভোলামলে এ বাংলার পরবর্তী দুইজন সুবাদার মেয়ের জুমলা ও শায়েস্তা খা ও শিয়া সম্প্রদায় মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন।

নাজাফের মির সাইয়িদ শাকরুল্লাহ আল-হুসাইনি ছিলেন শাহ সুজা কর্তৃক আনীত শিয়া সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের একজন এবং তিনি নবাব সাইয়িদ ছোটন সাহেবের পূর্বপুরুষ ছিলেন, যার ঢাকার আবুল হাসনাত রোডে একটি বিশাল ভূসম্পত্তি ছিল। সেখানে মোহাম্মদী বেগম ইমামবাড়া রয়েছে, যেটি ১৭০৭ সালে নির্মিত হয়েছিল।

১৭১৭ সাল থেকে ১৮৮০ সাল পর্যন্ত, তিনটি ধারাবাহিক নবাবি বংশ – নাসিরি, আফশার ও নাজাফি – বাংলায় শাসন ​​করেছিল এবং সকলেই শিয়া মতবাদে বিশ্বাসী ছিল।

বাংলার প্রথম নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ মূলত দাক্ষিণাত্যের একটি দরিদ্র হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, ক্রিতদাস হিসাবে বিক্রি হওয়ার পর ইস্পাহানের একজন পারসিক ব্যবসায়ী হাজি শফি তাকে শিয়া ইসলামে ধর্মান্তরিত করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি তাঁর পথ ধরে কাজ করে যান এবং অবশেষে বাংলার নবাবদের মধ্যে প্রথম হন এবং নাসিরি রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বাংলার রাজধানী জাহাঙ্গীরনগর (ঢাকা) থেকে বর্তমান ভারতের মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করেন।

দ্বিতীয় নবাবি বংশ, আশফার বংশ ১৭৪০ থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত বাংলা ও একই সঙ্গে বিহার ও ওড়িশা শাসন করেছিল এবং শিয়া বংশোদ্ভূত আলীবর্দী খান দ্বারা এই বংশটি প্রতিষ্ঠিত হয়। আশফার রাজবংশের শেষ ও বাংলার নবাবদের মধ্যে সর্বাধিক আলোচিত নবাব সিরাজউদ্দৌলা ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে নিহত হন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন শিয়া বংশোদ্ভূত সেনাপতি মীর জাফর, যিনি বাংলার তৃতীয় এবং চূড়ান্ত নবাবি বংশ নাজাফি রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন।

ঔপনিবেশিক যুগে শিয়া সম্প্রদায়

মির আশরাফ আলি (মৃত্যু ১৮২৯) শিরাজের একজন ধার্মিক শিয়া ছিলেন যিনি ১৮ শতকে ঢাকায় চলে আসেন, যেখানে তিনি ঢাকার নায়েব নাজিমদের কাছে একজন জমিদার ও দরবারি হিসেবে বিশিষ্টতা অর্জন করেন। ঢাকা, কুমিল্লা, বরিশাল, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সম্পত্তি এবং শত শত অধীনস্থ কর্মরত কৃষক ও ঢাকা শহরে অসংখ্য দাতব্য দানশীলতা মির আশরাফ আলিকে তাঁর সময়ে পূর্ব বাংলার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি করে তোলে। ইরাকের জ্যেষ্ঠ শিয়া আলেমদের সমালোচনার জবাবের বিনিময়ে দ্বাদশী মতাদর্শের উপর শাহ আব্দুল আজিজের বিখ্যাত সমালোচনার জবাবে মির আশরাফ আলি সেখানে প্রচুর অর্থ প্রেরণ করেন। এর প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়েছিল কিনা তা অজানা।

১৭৯৯ সালে ইরানি বংশোদ্ভূত সিলেটের মুঘল শিয়া সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি আগা মুহাম্মাদ রেজা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। নিজেকে সুফি সাধক বলে দাবি করার পর হাজার হাজার কৃষকের সমর্থন পেয়ে মুহাম্মাদ রেজা সফলভাবে নিকটবর্তী কাছাড়ি রাজ্য আক্রমণ করেন। পরে নিজেকে মাহদী (প্রতিশ্রুত মসীহ) এবং দ্বাদশ ইমাম হিসাবে ঘোষণা করে, পরে তাকে আটক করা হয় এবং কলকাতায় বন্দী করা হয়।

ঢাকার ফরাশগঞ্জের বিবি কা রওজা ইমামবাড়া আর. এম. দোশানজি সংস্কার করেন ১৮৬১ সালে। ১৯ শতকে বিহারের পূর্ণিয়ার শীতলপুরের শিয়া জমিদার পরিবারের বংশধররা আধুনিক বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁওয়ের সিন্দুরনা গ্রামে চলে আসেন। এই পরিবারের শায়েখ মুহাম্মদ রাজ ১৮৮৮ সালে গ্রামে শিয়া সম্প্রদায়ের জন্য শালবাড়ি মসজিদ নির্মাণ করেন এবং বর্তমানে স্থানটি একটি জনপ্রিয় পর্যটক আকর্ষণ। ১৮৯১ সালে ঢাকার ১, হোসেনী দালান রোডে মির ইয়াকুব ইমামবাড়া নির্মিত হয়। এটি ২০০৪ সালে শিয়া আঞ্জুমান-ই-হুসাইনি সংস্কার করে।

সমসাময়িক নিপীড়ন

বাংলাদেশ ও সমগ্র বাংলায় শিয়াদের একটি দীর্ঘ এবং সমৃদ্ধ ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে শিয়া সম্প্রদায়গুলো সাম্প্রদায়িক সহিংসতার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৫ সালে শিয়াদের একটি আশুরা সমাবেশে বোমা হামলা চালানো হয়েছিল।

Related Post

মৃত্যু নিয়ে উক্তি

150+মৃত্যু নিয়ে উক্তি, বাণী, ক্যাপশন 2024

মৃত্যু নিয়ে উক্তি জন্মিলে মরিতে হবে আর এটাই সত্যি। মৃত্যু হচ্ছে সবচেয়ে চিরন্তন সত্যি। পৃথিবীতে প্রতিটি প্রাণীর মৃত্যুর স্বাদ অনুভব করতে হবে। সবসময় মৃত্যুর জন্য

Read More »
খুশির স্ট্যাটাস

200+ স্টাইলিশ খুশির স্ট্যাটাস | হাসি নিয়ে ক্যাপশন

খুশির স্ট্যাটাস | হাসি নিয়ে ক্যাপশন জীবনের সুন্দর খুশির মুহূর্ত আমরা সবাই বাঁধাই করে রাখতে চাই। আর এই খুশির মুহূর্তকে ধরে রাখার সবচেয়ে সহজ উপায়

Read More »

স্টাইলিশ ভালোবাসার ছন্দ | রোমান্টিক ছন্দ | Love Status Bangla

❤❤ভালোবাসার ছন্দ | ভালোবাসার ছন্দ রোমান্টিক | ভালোবাসার ছন্দ স্ট্যাটাস❤❤ ভালোবাসা হলো এক অন্যরকম অনুভূতির নাম, যা শুধুমাত্র কাউকে ভালবাসলেই অনুভব করা যায়। আমরা বিভিন্নভাবে

Read More »
মন খারাপের স্ট্যাটাস

মন খারাপের স্ট্যাটাস, উক্তি, ছন্দ, ক্যাপশন, কিছু কথা ও লেখা

মন খারাপের স্ট্যাটাস মন খারাপ – এই কষ্টের অনুভূতি কার না হয়? সবারই কখনো না কখনো সবারই মন খারাপ হয়। জীবনের ছোটোখাটো অঘটন থেকে শুরু

Read More »

Leave a Comment

Table of Contents