বিলিরুবিনের মাত্রা কত হলে জন্ডিস হয়
ভূমিকা
বিলিরুবিনের মাত্রা রক্তে যদি বেড়ে যায় তাহলে জন্ডিস দেখা দেয়। একটা সময়ে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের রক্তের লোহিত কণিকাগুলি ভেঙে গিয়ে বিলিরুবিন তৈরি করে। যা যা লিভারে পরবর্তীতে প্রক্রিয়াজাত হয়ে পিত্তরসের সঙ্গে পিত্তনালীর মাধ্যমে প্রবেশ করে পরিপাকতন্ত্রে। আর বিলিরুবিন অন্ত্র থেকে পায়খানার মাধ্যমে শরীর হতে বের হয়ে যায়। বিলিরুবিনের এই দীর্ঘ পথে যেকোনো প্রকারের অসঙ্গতি দেখা দিলে রক্তে বিলিরুবিনের পরিমাণ বেড়ে যায় ফলাফল দেখা যায় শরীরে জন্ডিস বাসা বাঁধে। আজকের এই আর্টিকেলে আমরা আলোচনা করব বিলিরুবিনের মাত্রা কত হলে জন্ডিস হয় এবং এর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়গুলি।
জন্ডিস রোগের পরিচিতি
জন্ডিস ইংরেজি শব্দ Jaundice যা ইক্টেরাস ( Icterus ) নামে পরিচিত। বিলিরুবিনের উচ্চমাত্রার কারণে ত্বক এবং সেক্লোরার হলুদ বা সবুজ রঙ হয়ে যায়। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে জন্ডিস হলে সাধারণত অস্বাভাবিক লিভারের কর্মহীনতা, হিম বিপাক বা পিত্তথলির-নালি বাধার অন্তর্নিহিত রোগ এর জানান দেয়। তবে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বিরল। শিশুদের মধ্যে এই রোগ সাধারণত আনুমানিক ৮০% আক্রান্ত হয় তাদের জীবনের প্রথম সপ্তাহে। জন্ডিসের সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণগুলো হলো গারো প্রস্রাব, চুলকানি এবং ফ্যাকাসে মল। বিলিরুবিনের স্বাভাবিক মাত্রা রক্তে 1.0 mg/ dl, যখন মাত্রা 2-3 mg/dl এর বেশি থাকলে তখন সাধারণত জন্ডিস হয়। উচ্চ রক্তের বিলিরুবিন সাধারণত দুই ভাগে বিভক্ত সংযোজিত এবং অসংলগ্ন বিলিরুবিন। জন্ডিসের কারণ তুলনামূলকভাবে অল্প থেকে মারাত্মক পর্যন্ত পরিবর্তিত হয়। অতিরিক্ত লোহিত কণিকা ভাঙ্গন, জিনগত অবস্থা, বড় ক্ষত যেমন দীর্ঘ সময় ধরে না খেয়ে থাকলে, গিলবার্টস সিনড্রোম, নবজাতকের জন্ডি অথবা থাইরয়েডের সমস্যার কারণে উচ্চ অসংলগ্ন বিলুরুবিন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর উচ্চ কনজুগেটেড বিলিরুবিন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে লিভারের রোগ যেমন হেপাটাইটিস বা সিরোসিস সংক্রমণ বাধা, পিত্তথলির পাথর, প্যানক্রিয়াটাইটিস বা ক্যান্সার ইত্যাদি কারণে। এছাড়াও অন্যান্য অবস্থার কারণে ত্বক হলুদাভ হয়, প্রচুর পরিমাণে ক্যারোটিনযুক্ত খাবার খেলে বা রিফাম্পিন এর মত ওষুধ খেলে জন্ডিস হতে পারে।
জন্ডিসের ব্যুৎপত্তি
জন্ডিস ফরাসি শব্দ জাউন থেকে এসেছে যার অর্থ ‘হলুদ’ জাওনিস যার অর্থ ‘হলুদ রোগ’।
এই শব্দটি গ্রিক শব্দ ikteros থেকে icterus। একটি রাজ শব্দের উৎপত্তি কিছুটা উদ্ভট, এটি প্রাচীন বিশ্বাস থেকে উৎপত্তি হয়েছে এই বিশ্বাসটি ছিল যে হলুদ পাখির ইক্টেরিয়া দেখার মাধ্যমে জন্ডিস নিরাময় করা সম্ভব। ইটেরাজ শব্দটি অনেক সময় ভুল ভাবে ব্যবহৃত হয় বিশেষত সেক্লোরার জন্ডিস বোঝানোর জন্য।
জন্ডিসের প্রকারভেদ
জন্ডিসের কয়েকটি প্রকারভেদ রয়েছে। এটি মূলত তিন প্রকার। যথা –
হেমলাইটিক জন্ডিস
শরীরে যদি আরবিসি বার রেড ব্লাড সেল বেড়ে যায় তখনই হিমোলাইটিক জন্ডিস হয়।
হেপাটোসেলুলার জন্ডিস
এই জন্ডিস টি তৈরি হয় লিভারের প্রদাহ থেকে। যেকোনো কারণে লিভারের কোষগুলি আক্রান্ত হলে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়লে হেপাটোসেলুলার জন্ডিস হতে পারে।
অবস্ট্রাক্টিভ জন্ডিস
যেকোনো সমস্যার কারণে যদি পিত্তরস বের হতে না পারে বা তীর্থস্থলিতে পাথর হয় সে ক্ষেত্রে অবস্ট্র্যাক্টিভ জন্ডিস হতে পারে।
জন্ডিসের লক্ষণ গুলি
আমাদের দেশে জন্ডিস রোগটি অনেক বেশি দেখা দেয়। এই রোগটি যে কোন বয়সের মানুষের যেকোনো সময় হতে পারে। তাই জন্ডিসের লক্ষণ গুলি সম্পর্কে আমাদের অবশ্যই জানতে হবে। কেননা এ লক্ষণ গুলি ভালোভাবে জেনে থাকলে আমরা সঠিক সময়ে সচেতন হতে পারবো।
- প্রস্রাব হলুদ হওয়া
- চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া
- হাতের নখ হলুদ হওয়া
- ত্বক হলুদ হওয়া এবং সমগ্র শরীর হলুদ হয়ে যায়
এগুলি ছাড়াও আরো বিভিন্ন ছোটখাটো উপসর্গ রয়েছে। যেগুলির মাধ্যমে ও জন্ডিস হয়েছে কিনা আমরা বুঝতে পারবো –
- পায়খানার রং পরিবর্তন হয়
- জ্বর হতে পারে
- শরীর দুর্বল লাগবে
- বমি বমি ভাব হতে পারে
- লিভার শক্ত হতে পারে
- তলপেট এবং নাভির চারপাশ ব্যথা হওয়া
- ক্ষুধামন্দা বা খাদ্যে অরুচি দেখা দেওয়া
- ওজন কমে যাওয়া
- পায়ে ব্যথা হওয়া
- শরীরে এলার্জির মত চুলকানি হওয়া
জন্ডিসের চিকিৎসা
জন্ডিসের চিকিৎসা অন্তর্নিহিত কারণ দ্বারা সাধারণত নির্ধারিত হয়ে থাকে। যদি পিছনালিতে বাধা থাকে তাহলে অস্ত্র পাচারের প্রয়োজন হয় তাছাড়া ব্যবস্থাপনা চিকিৎসা যথেষ্ট। চিকিৎসার ব্যবস্থাপনায় সংক্রামক নানা কারণে যেসব চিকিৎসা এবং জন্ডিসের অবদান রাখে এমন ওষুধ এই রোগের কারণ হতে পারে। নবজাতকদের মধ্যে এই জন্ডিস ফোটোথেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়ে থাকে বা করা যেতে পারে। এছাড়া সময় এবং বয়সের আগে বিলিরুবিন 4-21 mg/ dl (68-360 L) এর বেশি হলে ট্রান্সফিউশন পরিবর্তন করা যায়। গলব্লাডার, naltrexone/ ursodeoxycholic acid এগুলোর মত ওপিওড বিরোধী পদার্থ নিষ্কাশন করার মাধ্যমে চুলকানিতে সাহায্য করা সম্ভব।
জটিলতা
হাইপার বিলিরুবিনেমিয়া আরো ভালোভাবে হাইপার বিলিরুবি লিমিয়া অসংযুক্ত ভগ্নাংশ এর কারণে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে ধূসর পদার্থের বিলিরুবিন জমা হতে পারে, সম্ভাব্য স্নায়বিক ক্ষতি ঘটতে পারে এবং একটি অবস্থানের দিকে পরিচালিত করে থাকে। যা এক্সপোজারের স্তরের উপর নির্ভর করে থাকে, প্রভাব গুলো অলক্ষ্য হতে শুরু করে গুরু তোর মস্তিষ্কে ক্ষতি এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। হাইপার বিলিরুবিনেমিয়া নবজাতকদের স্নায়বিক ক্ষতির জন্য খুব ঝুঁকিপূর্ণ। এই কারণে তাদের সিরাম বিলিরুবিনের মাত্রা পরিবর্তন করার জন্য সর্বদা পর্যবেক্ষণে রাখা উচিত এবং বিলিরুবিনের মাত্রা কত হলে জন্ডিস হয় সেটি খেয়াল রাখতে হবে। এছাড়াও যাদের প্যারেনকাইমাল লিভার রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি তাদের হেমস্ট্যাসিস প্রতিবন্ধকতা থাকে ফলে রক্তপাতের সমস্যা হতে পারে।
প্রতিরোধ
জন্ডিস প্রতিরোধ করার জন্য যে বিষয়গুলি জেনে রাখা প্রয়োজন –
- মদ্যপান করা থেকে বিরত থাকতে হবে
- কলকারখানার যেসব রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে সেসব থেকে দূরে থাকতে হবে
- ব্যবহার করা ইঞ্জেকশন বা করার জন্য যে সুই ব্যবহার করা হয় সেটি থেকে বিরত থাকতে হবে
- যারা সেলুনের শেভ করেন তারা খেয়াল রাখবেন একই ব্লেড বা খুর যেন পরবর্তীতে ব্যবহার করা না হয়।
- হেপাটাইটিস এ এবং বি থেকে মুক্ত থাকতে হেপাটাইটিস-এ এবং বি এর ভ্যাকসিন নিতে হবে।
- নিরাপদ যৌন মিলন করতে হবে।
- শরীরের রক্ত নেওয়ার প্রয়োজন হলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় স্ক্রিনিং করে তারপর নিতে হবে।
- হেপাডাইসিস ই এবং এ খাদ্য এবং পানির মাধ্যমে সংক্রমিত হয়ে থাকে। আর বি সি ও ডি দূষিত রক্ত বা আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে শারীরিক মিলনের মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকে। তাই অবশ্যই বিশুদ্ধ পানি এবং বিশুদ্ধ খাবার গ্রহণ করতে হবে। ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ ব্যবহার করাটা জরুরী।
অনেক ক্ষেত্রেই জন্ডিসের এর মাধ্যমে মৃত্যুও হতে পারে। তাই এই রোগ থেকে বাঁচার জন্য আমাদেরকে সচেতন থাকতে হবে।
নবজাতকের জন্ডিস
জন্মের পরপরই অনেক শিশুরই জন্ডিস হয়। কারণ নবজাতকের রক্তে উচ্চ বিলিরুবিন এর মাত্রা থাকে। যেসব নবজাতকগুলি ৬০ শতাংশ পূর্ণ গর্ভকাল অথবা ৮০ শতাংশ প্রি টার্ম সেসব অকালজাত নবজাতকদের প্রথম সপ্তাহের জন্ডিস দেখা দেয়। বাচ্চার বিলিরুবিনের মাত্রা কত হলে জন্ডিস হয় তা খেয়াল রাখতে হবে । কিন্তু এই জন্ডিসের বেশিরভাগ গুলি ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস।
ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিসের বৈশিষ্ট্য হলো :
- এটি সাধারণত ভূমিষ্ঠ হওয়ার ২৪ ঘন্টা পর থেকে শুরু হয়।
- বিলিরুবিনের মাত্রা রক্তে ১৫ মি গ্রাম বা ডিসের নিচে থাকে।
- এটা এক ধরনের সাময়িক জন্ডিস যা চিকিৎসার কোন প্রয়োজন নেই।
প্যাথলজিক্যাল জন্ডিস বা ঝুঁকি সম্পন্ন জন্ডিস-
- বিলিরুবিন এর মাত্রা ১৫ মে গ্রাম বা ডিসের বেশি থাকে।
- জন্মগ্রহণের ২৪ ঘন্টার মধ্যেই দেখা দিতে পারে।
- দুই সপ্তা বয়স হওয়ার পরও যাচ্ছে না
- বিলিরুবিনের মাত্রা যদি ০.৫ মি গ্রাম বা প্রতি ঘন্টায় বেড়ে যায় বাপ ২৫ ডেসির বেশি হয় তবে তা বিপদজনক হিসেবে বিবেচিত হবে।
প্রতিরোধ
গর্ভাবস্থায় প্রত্যেক মায়ের আর এইচ রক্ত, এ বি ও গ্রুপ পরীক্ষা করে নিতে হবে।
নবজাতকদের জন্ডিসের ঝুঁকি বিবেচনা রেখে তিন থেকে পাঁচ দিন বয়সের মধ্যেই বিলিরুবিন পরীক্ষা করতে হবে।
শিশুকে দেখে হলদেটে যদি মনে হয় তবে অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করতে হবে।
শিশুকে অবশ্যই মাতৃদুগ্ধ পান করিয়ে যেতে হবে।
যেসব ভূমিষ্ঠ বাচ্চারা উচ্চমাত্রার জন্ডিসের আক্রান্ত থাকে তাদের শ্রবণশক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ পরে কিভাবে হচ্ছে কিনা সেটি ফলোআপে রাখতে হবে।
উপসংহার
জন্ডিস নামটি সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত থাকলেও এই রোগটির সাথে অনেকেই পরিচিত না। তবে তার জন্য এই রোগ সম্পর্কে আমাদের প্রত্যেকের জেনে থাকা উচিত। কেননা সঠিক সময়ে এই রোগের লক্ষণ বা উপসর্গ সম্পর্কে না জেনে থাকলে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা কত হলে জন্ডিস হয় এটি আমাদের জানতে হবে যাই ইতোমধ্যেই আমরা উপরে আলোচনা করেছি। আর সহজ ভাবে বলতে গেলে রক্তের লোহিত কণিকা ভেঙে যাওয়ার পর বিলিরুবিনের বৃদ্ধি হয়ে থাকে এবং শরীর পুরোপুরি হলুদ হয় তার সঙ্গে প্রস্রাবের রং হলুদ হয়ে যায় তখনই মূলত জন্ডিস হয়।
এই রোগ শরীরে দেখা দিলে চামড়া ফ্যাকাসে বা পান্ডুর দেখা যায় এর জন্য জন্ডিস রোগকে আগে পান্ডুরোগও বলা হতো।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন
১. জন্ডিস কি?
উত্তর: বিলিরুবিনের মাত্রা রক্তে যদি বেড়ে যায় তাহলে জন্ডিস দেখা দেয়। একটা সময়ে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের রক্তের লোহিত কণিকাগুলি ভেঙে গিয়ে বিলিরুবিন তৈরি করে। যা যা লিভারে পরবর্তীতে প্রক্রিয়াজাত হয়ে পিত্তরসের সঙ্গে পিত্তনালীর মাধ্যমে প্রবেশ করে পরিপাকতন্ত্রে। আর বিলিরুবিন অন্ত্র থেকে পায়খানার মাধ্যমে শরীর হতে বের হয়ে যায়। বিলিরুবিনের এই দীর্ঘ পথে যেকোনো প্রকারের অসঙ্গতি দেখা দিলে রক্তে বিলিরুবিনের পরিমাণ বেড়ে যায় ফলাফল দেখা যায় শরীরে জন্ডিস বাসা বাঁধে।
২. বিলিরুবিনের মাত্রা কত হলে জন্ডিস হয়?
উত্তর: বিলিরুবিনের স্বাভাবিক মাত্রা রক্তে 1.0 mg/ dl, যখন মাত্রা 2-3 mg/dl এর বেশি থাকলে তখন সাধারণত জন্ডিস হয়।
৩. জন্ডিসের কারণগুলি কি কি?
উত্তর: কারণগুলি হল-
- প্রস্রাব হলুদ হওয়া
- চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া
- হাতের নখ হলুদ হওয়া
- ত্বক হলুদ হওয়া এবং সমগ্র শরীর হলুদ হয়ে যায়
৪. জন্ডিস কি ভাইরাস জনিত রোগ?
উত্তর জন্ডিস এক ধরনের ভাইরাসজনিত রোগের পাশাপাশি এটি একটি পানি বাহিত রোগ। হেপাটাইটিস ভাইরাস গুলির কারণেই মূলত জন্ডিস হয়ে থাকে। এই ভাইরাসগুলির মধ্যে রয়েছে হেপাটাইটিস এ, হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি এবং হেপাটাইটিস ই।
Also Read: জন্ডিস হলে কি ওষুধ খাব