মানসিক রোগ থেকে মুক্তির উপায় কি
শরীরে নানা কারণে যেরকম রোগ হতে পারে তেমনি মানসিক সুস্থতা বিপর্যস্ত হলে সৃষ্টি হয় মানসিক রোগ। শারীরিক রোগের পাশাপাশি দিন দিন মানসিক রোগের পরিমাণ বৃদ্ধি বাড়ছে নানা পারিপার্শ্বিক কারণে। যা আমাদেরকে ভাবিয়ে তোলে মানসিক রোগ থেকে মুক্তির উপায় কি তা সম্বন্ধে।
আমরা অনেকেই বিশ্বাস করতে চায় না মানসিক সমস্যা বা মানসিক রোগ বলতে কিছু রয়েছ । আমাদের আশেপাশে কেউ মানসিক সমস্যায় ভুগছে কিন্তু তা আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি না এবং সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি না। যার ফলে এই সমস্যা একসময় কঠিন রূপ ধারণ করে।
মানসিক চাপ, বংশগত কারণে, গ্লোবালাইজেশন ,মাদকের প্রতি আসক্ত, ইন্টারনেটের আসক্তি, আর্থসামাজিক অবস্থা, শারীরিক এবং মানসিক নানা ধরনের অসুস্থতা ইত্যাদির কারণে যদি মানসিক রোগের আশঙ্কা হয়ে থাকে। তাহলে অবশ্যই ঘরে বসে না থেকে এর চিকিৎসা এবং প্রতিকারের সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। চলুন আমরা এই আর্টিকেলটির মাধ্যমে জেনে নেই মানসিক রোগ কি এর কারণ কি
এবং এর থেকে মুক্তির উপায় গুলো কি।
মানসিক রোগ কি ?
মস্তিষ্কের সাধারণ কার্যকলাপ বিঘ্নিত তার সকল হলে একজন মানুষের মন এবং শরীরের উপর যে প্রভাব পড়ে তাকে বলা হয় মানসিক রোগ। মানুষ যখন মানসিক রোগে আক্রান্ত হয় তখন তার আচার-আচরণ জীবন যাপন কাজ বাজ সবকিছুর ভিতর অস্বাভাবিক কোন কিছু পরিলক্ষণ করা যায়।
এবং যে সকল মানুষের মস্তিষ্ক জনিত এসব সমস্যা দেখা দেয় তাকে আমরা বলি মানসিক রোগী। মানসিক রোগ হলে একজন সাধারন মানুষ নানা ধরনের মানসিক চাপে এবং অসুস্থতায় ভোগেন, সাধারণ চিন্তা ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন, অস্বস্তিতে ভোগেন এবং খুব অল্পতেই বিচলিত হয়ে যান।
সাধারণত মানসিক রোগকে দুই ভাগে ভাগ করা হয় যথা :
১.নিউরোটিক
২.সাইকোসিস
নিউরোটিক : এটি মানসিক রোগের ক্ষেত্রে প্রাথমিক একটি পর্যায়। সাধারণত এই পর্যায়ে রোগী অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ, অতিরিক্ত রাগ, সূচিবায়ু, ইন্টারনেটে আসক্ত, যৌন সমস্যা, ঘুমের সমস্যা ইত্যাদি আরও নানান সমস্যায় ভুগতে থাকে। এই রোগটিতে বর্তমানে অধিক সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত এবং দিন দিন এর পরিমাণ বেড়ে চলছে।
সাইকোসিস : মানসিক সমস্যা যখন গুরুতর এবং অতিরিক্ত অস্বাভাবিক পর্যায়ে চলে যায় তখন এই রোগ হয়। তুলনামূলক এতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কম। বাইপোলার মোট ডিসঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া ইত্যাদি এর সকল রোগের অন্তর্ভুক্ত।
মানসিক রোগের কারণ ?
আমরা মানসিক রোগ সম্বন্ধে জানলেও হয়তো অনেকেই মানসিক রোগের কারণ সম্বন্ধে জানি না। মানসিক রোগ সম্বন্ধে না জানলে আমরা কখনই বুঝতে পারবোনা যে কোন মানুষ মানসিক রোগে আক্রান্ত কিনা। তাই মানসিক রোগ থেকে মুক্তির উপায় কি এ সম্বন্ধে জানতে হলে সবার আগে মানসিক রোগের কারণ সম্পর্কে জানতে হবে।
বিভিন্ন কারণে মানসিক রোগের সৃষ্টি হতে পারে । গবেষকদের মতামত অনুযায়ী মানসিক রোগের সঠিক কারণ সম্পর্কে এখনো জানা যায়ন।তবে নির্দিষ্ট কিছু বিষয় মানসিক রোগের সাথে জড়িত । তাহলে চলুন জেনে নেওয়া যাক মানসিক রোগের কারণ গুলো কিঃ
- বংশগত
- মস্তিষ্কের রাসায়নিক পরিবর্তন
- শারীরিক ও মানসিক যৌন নির্যাতন
- মানসিক আঘাত
- মাদকাসক্ত
- পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব
- দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ
- দীর্ঘমেয়াদি ঘুমের অভাব
- শারীরিক নানা জটিলতা
- স্ট্রোক অথবা ব্রেনে টিউমার
এসব ছাড়াও মানসিক রোগের আরো অনেক কারণ রয়েছে। উপরের উল্লেখিত কারণ এর প্রতি সবসময় সতর্ক থাকা উচিত এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত মানসিক স্বাস্থ্য কে ঠিক রাখার জন্য।
মানসিক রোগের লক্ষণ
যে সব উপসর্গ আমরা একজন মানুষের ভেতরের দেখলে বুঝতে পারব যে সে মানসিকভাবে স্বাভাবিক নয় সেগুলোই মূলত মানসিক রোগের লক্ষণ। মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, ডক্টর মেঘলা সরকার বলেন, ‘ যখন কোন ব্যক্তির আচরণ ব্যবহারে বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় বিশেষ করে তার আবেগীয় প্রকাশের পরিবর্তন আসে এবং সেটা তার দৈনন্দিন কর্মকান্ডে এবং সম্পর্কে প্রভাব ফেলে এখনই তার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে ‘
মানসিক রোগের লক্ষণগুলো জানাটা অত্যন্ত জরুরী মানসিক রোগ কে প্রতিহত করার জন্য । মানসিক রোগের লক্ষণগুলো হলঃ
- হঠাৎ করেই আবেগের পরিবর্তন হওয়া। যেমন কখনো অতিরিক্ত হাসা বা কখনো অতিরিক্ত কান্না করা অথবা কখনো অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে যাওয়া ।
- দৈনন্দিন যে সকল কাজ অথবা সেলফ কেয়ার,যেমন: খাওয়া, গোসল, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি কাজ বন্ধ করে দেওয়া।
- একা থাকতে চাওয়া এবং নিজেকে সকলের নিকট থেকে গুটিয়ে নেওয়া।
- মেজাজ খিটখিটে থাকা এবং সকলের সাথে ঝগড়া করা অথবা অকারনে কাউকে সন্দেহ করা।
- নিজেকে আঘাত করা এবং আত্মহত্যার চিন্ত, পরিকল্পনা এবং চেষ্টা করা।
- অতিরিক্ত পরিমাণ শুচিবায়ুতে আক্রান্ত হওয়া।
- খাবারের প্রতি অনীহা এবং অরুচি হওয়া অথবা খাবারের প্রতি অতিরিক্ত আগ্রহ এবং রুচি তৈরি হওয়া।
- ভুলে যাওয়া, কাউকে চিনতে না পারা বা কোন কিছু মনে রাখতে না পারা।
- ঘুমের ক্ষেত্রে সমস্যা হওয়া অর্থাৎ ঘুম অতিরিক্ত হওয়া বা একেবারে না হওয়া।
- কোন ধরনের গাইবি আওয়াজ শুনতে পাওয়া এবং নিজে নিজে কথা বলা।
- টানা দুই সপ্তাহ বিষন্নতায় ভোগা এবং তা স্বাভাবিকভাবে কাটিয়ে উঠতে না পারা।
- যেকোনো কারণে হীনমন্যতায় ভোগা অথবা নিজেকে অপরাধী মনে করা এবং নিজের প্রতি নেতিবাচক ধারণা পোষণ করা ।
- পরিবারের আত্মীয়-স্বজন বা আপনজনকে নিজের শত্রু ভাবা।
- সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা এবং তা নিয়ে সর্বদা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ থাকা ।
এছাড়াও আরো অনেক লক্ষণ রয়েছে মানসিক রোগের যা কম গুরুত্বপূর্ণ নয় । যা একটি সাধারন মানুষের আচরণের তুলনায় সম্পূর্ণই উল্টো।
তবে প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা কখনোই দুই একটি লক্ষণ দেখে কাউকে মানসিক রোগী হিসেবে বিবেচনা করতে পারি না। কারণ কম বেশি আমাদের সকলের ভেতরেই এসব কিছু লক্ষণ থাকে।
তবে কারো ভেতর যদি এ সকল লক্ষণের পরিমাণ এবং সময়সীমা বেশি দেখা যায় তাহলে অবশ্যই তা গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে।
তাই আমরা যদি কখনো এ সকল লক্ষণ গুলো নিজের মাঝে এবং অন্যের মাঝে লক্ষ্য করি তাহলে আমাদের অবশ্যই দ্রুত মানসিক রোগ থেকে মুক্তির উপায় কি তা সম্পর্কে জানতে হবে এবং সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
মানসিক রোগ থেকে মুক্তির উপায়
কেউ যদি স্বাভাবিক জীবন থেকে সরে এসে মানসিক রোগে আক্রান্ত হয় তবে তাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোন উপায় নেই।
ছোট্ট একটি পদক্ষেপ হয়তো আপনার জীবনকে সারা জীবনের জন্য সুন্দর করে তুলবে। অথবা আপনার অবহেলার কারণে কি সুন্দর জীবন নষ্ট বা স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
তাই সচেতনতার সাথে মানসিক রোগ থেকে মুক্তির উপায় কি, এগুলো জানতে হবে এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তাহলে চলুন এ সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক এ পর্যায়ে
- অভিজ্ঞ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ অথবা চিকিৎসা নেওয়া যা সবথেকে কার্যকারী উপায়। যার মাধ্যমে মানুষের রোগ সর্বোপরি সেরে ওঠা সম্ভব।
- নিজের লাইফ স্টাইল এর পরিবর্তন আনা এবং নিয়ম মাফিক জীবন পরিচালনা করা।
- সুষম খাবার গ্রহণ করার মাধ্যমে আমাদের শরীর এবং মন দুটি কি ঠিক রাখা এবং বিভিন্ন রোগ থেকে সরে ওঠা সম্ভব।
- নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমানো
- ব্যায়াম, ইয়োগা, মেডিটেশন এগুলো হলো মানসিক রোগ মুক্তির ক্ষেত্রে বিশেষ উপায়।তোমারে চিকিৎসকরা এগুলোর মাধ্যমে মানসিক রোগ দূর করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
- নিজেকে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত রাখা যাতে করে কোন ধরনের মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তা, বিষন্নতা, একাকীত্ব ইত্যাদি সমস্যা গুলো আমাদের গ্রাস না করতে পারে।
- ধর্মীয় এবং সামাজিক কাজে মনোনিবেশ করা। কারণ ভালো কাজ করার মাধ্যমে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয় এবং ভালো থাকে।
- পজিটিভ বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজনের সাথে মেলামেশা করা এবং যে সকল মানুষ মানসিক চাপ এবং কষ্ট দেয় তাদের থেকে দূরত্ব রক্ষা করা।
- মাদক আর নেসা জাতীয় দ্রব্য থেকে দূরে থাকা। এবং যারা নেশাজাত দ্রব্য গ্রহণ করে তাদের থেকে দূরে থাকা।
- সৃজনশীল এবং কর্মঠ হয়ে ওঠা দৈনন্দিন কাজে। নিজের কাজ নিয়ে আনন্দিত থাকা প্রতিভার বিকাশ করার চেষ্টা করা।
- সর্বদা মানসিক চাপ থেকে নিজেকে দূরে রাখা এবং নিজেকে শান্ত রাখা।
- নিজের মানসিক পরিবর্তন আনা,যেমন: ক্ষমা করতে শেখা, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, কোন জিনিসকে কঠিন ভাবে না দেখা, না বলতে শেখা ইত্যাদি।
কিছু মানসিক হাসপাতালের নাম এবং পরিচয়
- পাবনা মানসিক হাসপাতাল।
- নিরাময় হাসপাতাল ঢাকা।
- লাইফ স্প্রিং, ঢাকা।
- মডার্ন সাইক্রেটিক হাসপাতাল (প্রা). লি.
উপরের আলোচনা থেকে আমরা এতোটুকু বুঝলাম মানসিক রোগ কোন সাধারন বিষয় নয় যে, যাকে আমরা গুরুত্বহীন মনে করতে পারি অথবা অবহেলা করে এড়িয়ে যেতে পারি। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা এবং পদক্ষেপের মাধ্যমে আমরা মানসিক রোগ সম্পূর্ণরূপে সারিয়ে তুলতে পারি।
জীবনকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে মানসিক স্বাস্থ্যের উপর গুরুত্ব দেওয়ার কোন বিকল্প নেই। রোগ বিশেষজ্ঞ, মনোবিজ্ঞানী এবং মনোরোগ থ্রাপিস্ট এর সঠিক চিকিৎসা এবং একটি সঠিক জীবন ব্যবস্থার মাধ্যমে এই মনো রোগ সম্পূর্ণরূপে সারিয়ে তোলা যায়।
তার জন্য আমাদের মানসিক রোগ থেকে মুক্তির উপায় কি সম্বন্ধে সঠিকভাবে জানতে হবে যা আমরা উপরে আলোচনা করেছি। আশা করি এসব আলোচনা থেকে জ্ঞান অর্জন করে আমাদের জীবনে প্রয়োগ করা এবং একটি সুন্দর জীবন যাপন করা সম্ভব। যদি মানসিক রোগ এর কোন লক্ষণ আমাদের জীবনে বা আশেপাশে আমরা পরিলক্ষিত করি।
Also Read: পাইলস থেকে চিরতরে মুক্তির উপায়