আজ থেকে সাড়ে তিনশ বছর আগে ছিল আধুনিক গোসল খানা যেখানে অনেক মানুষ একসাথে গোসল করতে পারত এবং সেই গোসল খানায় ছিলো পানির পাইপ লাইন এবং দুটি চৌবাচ্ছা ছিল পানি ভর্তি করে রাখার জন্য। এছাড়া শীতকালে গোসল করার জন্য ছিল পানি গরম করার সুব্যবস্থা।
এটি কোনো কল্পকাহিনী নয়, একসময় রাজা-বাদশা ও নবাবরা প্রজাদের স্বাচ্ছন্দে গোসল করার জন্য নির্মাণ করেছিলেন তাঁদের রাজ্য জুড়ে এমনই সব স্থাপনা।‘হাম্মামখানা’ শব্দটি ফারসি শব্দ ‘হাম্মাম’ থেকে এসেছে যার অর্থ ‘গ্রীষ্মের তাপ’। এসব স্নান করার জায়গা গুলো ‘হাম্মামখানা’ নামে পরিচিত। তেমনি একটি স্থাপনা হচ্ছে যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলা হতে ৭ কিলোমিটার পশ্চিমে মির্জানগর গ্রামে অবস্থিত ‘মির্জানগর হাম্মানখানা’ যা কালের সাক্ষী হয়ে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে । এই স্থাপনাটি কপোতাক্ষ নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত।
বাংলাদেশের নানা ঐতিহাসিক স্থাপনা ও নবাব ও সুলতানদের প্রাসাদে হাম্মামখানার নিদর্শন পাওয়া যায়। মোগল আমলে বাংলার অনেক জায়গা জুড়ে তৎকালীন নবাব ও সম্রাটরা অসংখ্য হাম্মামখানা গড়ে তোলা উঠেছিল। বাংলাদেশে এরকম ৬ টি হাম্মামখানা চিহ্নিত করা হয়েছে এগুলো হলো ঢাকার লালবাগ ও জিঞ্জিরা হাম্মামখানা, যশোরের মির্জানগর হাম্মামখানা, ইশ্বরীপুর ও জাহাজঘাটা হাম্মামখানা এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের ছোট সোনা মসজিদ সংলগ্ন হাম্মামখানা।
তবে বাংলাদেশে এইসব স্থাপনার উপস্থিত থাকলে ও এর উৎপত্তিস্থল বাংলায় নয়।
তৎকালীন ইসলামী শাসনভুক্ত অঞ্ছল গুলোতে এই রকম গণ গোসলখানার ধারণা জন্মে। মূলত তুরস্ক ও পারস্য অঞ্ছলে হাম্মামখানার ধারণা প্রথম জন্ম নেয়। তুরস্কে সুলতানি আমলে সুলতানগণ প্রজাদের গোসল করার ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য হাম্মাম্পখানা নির্মাণ করনছিলেন। তুরস্ক এই হাম্মামখানার আইডিইয়া পেয়েছিল ইউরোপের রোমান ও গ্রীক সভ্যতা থেকে। গ্রীক সভ্যতায় খ্রীষ্টপূর্ব ৭০০-৬৬০ সালে হাম্মামখানার ব্যবহার ছিল। পরবর্তীতে ইসলামি সভ্যতায় যখন পর্দা প্রথার বিধান আসে; নারী-পুরুষের মেলামেশায় নিয়মকানুন আসে তখন নারী ও পুরুষের আলাদা গোসল করার ব্যবস্থার জন্য হাম্মামখানার ব্যবহার শুরু হয়।
ঐতিহাসিকদের মতে সম্রাট আকবরের শাসনামলে ১৬৫৯ সালের দিকে মীর্জা সফসিকান যশোর মহকুমার গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি বর্তমান যশোর উপজেলার কেশবপুর উপজেলার থেকে ৭ কিলোমিটার পশ্চিমে বুড়িভদ্রা ও কপোতাক্ষ নদীর মোহনায় বসবাস শুরু করেন। তাঁর নামানুসারে উক্ত স্থানের নাম হয় মির্জানগর।
এরপর সম্রাট আত্তরঙ্গজেবের আমলে এখানকার গভর্নর হিসেবে নুরল্লা খাঁ নিয়োগ প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তাঁর আমলে তিনি এই মির্জানগরে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে বসবাসের জন্য কিল্লাবাড়ী বা প্রাসাদ নির্মাণ। নুরল্লা খাঁ এই কেল্লার নাম করণ করা হয় মতিঝিল নামে।
প্রাসাদের সর্বত্র মোগল স্থাপত্ব শিল্পের ছোঁয়ায় নির্মাণ করা হয়। বহিঃশত্রুর হাত থেকে প্রতিরক্ষার জন্য প্রাসাদের চারপাশে সুগভীর পরিখা খনন করা হয় ও কেল্লার চারপাশে ১০ ফিট উচু প্রাচীর নির্মাণ করা হয়।
এই ঐতিহ্যবাহি স্থাপনাটি যশোর জেলার অধীনস্থ কেশবপুর উপজেলা থেকে ৭ কিঃমিঃ পশ্চিমে মির্জানগরে অবস্থিত। দর্শনার্থীরা সেখানে গেলেই চোখে পড়বে মারবেল পাথরে খচিত এই হাম্মামখানার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। মির্জানগরে একসময় ছিল নবাব বাড়ি । নবাব বাড়িতে ছিল এক সময় প্রাসাদ, বিশ্রামখানা , বাগান এবং প্রজা ও প্রাসাদের কর্মী ও রক্ষী বাহিনীর গোসল করার জন্য হাম্মামখানা।
দুর্গের ভিতরে এক পাশে ছিল বৈঠক খানা এবং হাম্মামখানা ও পূর্ব দিকে ছিল সদরতর ।
বর্তমানে হাম্মামখানা ছাড়া কেল্লার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। সময়ের ব্যবধানে অন্য সব স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেছে। অবশ্য প্রাসাদের ধ্বংস প্রাপ্ত কয়েকটা পিলার এখনও দেখতে পাওয়া যায়।
হাম্মামখানাটি ৪ কক্ষবিশিষ্ট একটি দালান । দালানটি মোঘল স্থাপত্ব শিল্পের আদলে তৈরি করা হয়েছিল এবং প্রতিটা কক্ষে ও দেয়ালে রয়েছে নান্দনিক মোগল নির্মাণশৈলীর ছাঁপ। এর মাঝে রয়েছে একটি কূপ ছিল যেখান থেকে গোসল করার জন্য পানি তোলা হতো। ইট ও চুন-সুরকি দিয়ে বাঁধাই করা কূপটি ছিল বেশ গভীর । এই কূপের ব্যস ছিল ৯
ফুট । এই কূপটি প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ ফিট গভীর এবং এই কূপটি থেকে গোসল করার যাবতীয় পানি সংগ্রহ করা হতো।
স্থাপনাটির ছাদে রয়েছে মুসলিম স্থাপত্ব শিল্পের নিদর্শন স্বরূপ চারটি গম্বুজ। পুরো ভবন টি পূর্ব-পশ্চিমে বিভক্ত এবং পূর্ব দিকে দুটি ও পশ্চিম দিকে দুটি কক্ষ রয়েছে। পশ্চিম দিকের কক্ষ দুটি পূর্ব দিকের কক্ষ দুটি থেকে বড়। পশ্চিম দিকের কক্ষ গুলো প্রায় ৩২৪ বর্গফিটের আর অন্য কক্ষ দুটি ১২০ বর্গ ফিট বিশিষ্ট। পূর্বের কক্ষ দুটি কুয়া থেকে পানি তুলে ভর্তি করে রাখার কাজে অর্থ্যাৎ চৌবাচ্চা হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
এছাড়া শীতকালে গরম পানি পাওয়ার জন্য হাম্মামখানাটিতে রয়েছিল বিশেষ ব্যবস্থা। চৌবাচ্চার নিচে ছিল একটি বিশেষ চুল্লি যা দিয়ে পানি গরম করে চৌবাচ্চায় সংরক্ষণ করা হতো । এরপর চৌবাচ্চা থেকে পাইপের মাধ্যমে নির্ধারিত গোসল করার কক্ষে দেয়ালের ভেতরের পাইপের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হতো। পাইপ গুলো ছিল পোড়ামাটির তৈরি। কক্ষের ভেতরে আলো ঢোকার জন্য স্নান ঘরের দেয়ালে ছিল অনেকগুলো জানালা । তবে জানালা গুলো ছিল মাটি থেকে একটু উঁচুতে যাতে করে ভেতরে স্নানরত ব্যক্তির শরীরের নিম্নাংশ দেখা না যায়। এছাড়া স্থাপনাটির মাঝখানে ছিল বড় সভা কক্ষের মতো জায়গা যেখানে সভা বা বিশ্রাম কক্ষ হিসেবেও ব্যবহার করা হতো বলে ঐতিহাসিক গণ ধারণা করে থাকেন। এই হাম্মামখানে কেল্লার নিরাপত্তার কাজে যুক্ত সিপাহি ও অন্যান্য পুরুষ কর্মচারীরা শুধু স্নান করত। নারী বা মহিলারা এখানে স্নান করত না বলে ধারণা করা হয়। নারীদের জন্য প্রাসাদের ভেতরে ছিল আলাদা সংরক্ষিত স্নান করার ব্যবস্থা।
এই স্থাপনাটি পর্যাপ্ত জায়গা নিয়ে তৈরি করা হলেও এর মূল দরজাটি ছিল অপেক্ষাকৃত ছোট এবং সবসময় মূল দরজা সহ পুরো স্থাপনাটি কড়া নিরাপত্তায় বেষ্টিত থাকত। কারণ স্থাপনাটির দক্ষিণ পাশে একটি সুড়ঙ্গ ছিল এবং ধারণা করা হয় এই সুড়ঙ্গ দিয়ে গোপন তোশাখানায় যাওয়ার রাস্তা ছিল। অর্থাৎ এই কেল্লার খাঁজনা আদায়ের যত স্বর্ণ মুদ্রা ও মূল্যবান জিনিস রয়েছে সব এই গোপন কক্ষে সংরক্ষণ করা হত। বহিঃশত্রু ও ডাকাতদল যাতে কেল্লা আক্রমণ করে ধন-সম্পদ লুট করে নিয়ে যেতে না পারে তাই এই গোপন তোশাখানা নির্মাণ করা হয়েছিল।
১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ স্থাপনাটিকে ঐতিহাসিক স্থাপনা বলে ঘোষণা করে ও পুনঃনির্মাণ করে। দর্শনার্থীদের জন্য স্থাপনাটি উন্মুক্ত থাকলেও মূল ভবনের ভেতরে এখন কাওকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। কারণ অনেক দর্শনার্থী এর ভেতরে অসচেতনতা বসত নোংরা করে ফেলে। তাই বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ভবনটির দরজায় তালা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
এই সব ঐতিহাসিক স্থান সমূহ আমাদের দেশের ইতিহাসের সাক্ষী এবং এগুলোকে সংরক্ষণ করা আমাদের প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব। বর্তমানে আকাশ সংস্কৃতি ও পশ্চিমা সংস্কৃতির জাতাকলে পিষ্ট হয়ে নতুন প্রজন্ম আমাদের নিজস্ব ইতিহাস ঐতিহ্য প্রায় ভুলতে বসেছে ও বিপদগামী হচ্ছে । আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি যে অত্যন্ত গৌরবময় ইতিহাস আছে তা বর্তমান প্রজন্মকে জ্ঞাত করতে হবে। তাই এসব ঐতিহাসিক স্থাপনা ও নিদর্শনের ইতিহাস সংরক্ষণ , নিজে জানা ও প্রচার জরুরি হয়ে পড়েছে।
আপনি চাইলে ঘুরে আসতে পারেন মির্জাপুর হাম্মামখানা থেকে।
যেভাবে যাবেনঃ
যশোরের কেশবপুর উপজেলা থেকে সাতবাড়িয়া বাজার যেতে হবে। সেখান থেকে ১ কিঃমিঃ গেলে নবাববাড়ি মোড় । এই নবাববাড়ি মোড় থেকে ২০০-২২০ গজ পশ্চিমে গেলে মির্জানগর হাম্মামখানা দেখা যাবে।