Dreamy Media BD

রমনা কালী মন্দির

রমনা কালী মন্দির

প্রিয় পাঠক আজকে আমি আপনাদের সামনে এমন একটি মন্দির নিয়ে আলোচনা করব যে সম্পর্কে আপনার না জানলেই নয়। রমনা কালী মন্দির বিখ্যাত একটি মন্দির। এটি সম্পর্কে আপনি যদি পড়তে শুরু করেন তাহলে আপনার জানার আগ্রহ আরও বেড়ে যাবে। চলুন জেনে নেই কি ছিল এই বিখ্যাত রমনা কালী মন্দিরের পেছনের ইতিহাস। কখন কিভাবে কোন উদ্দেশ্যে এই কালীমন্দির নির্মাণ করা হয়েছে তার বিস্তারিত আজকে এই পোস্টের মাধ্যমে জানবো। শুরু করলাম মূল আলোচনা –

ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত মন্দির গুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল এ রমনা কালী মন্দির। কালিবাড়ি নামেও পরিচিত ছিল এই রমনা কালী মন্দির। পরবর্তীতে ইংরেজ আমলে এটি আবার নতুনভাবে সংস্করণ করা হয়েছে। রমনা কালী মন্দির অবস্থিত বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার রমনা পার্কে বর্তমান নাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বাইরে. সাংস্কৃতিতে বর্তমানে এই মন্দিরের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। বর্তমানে মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ হয়েছে ভারত সরকারের অর্থায়ন। বর্তমানে মন্দিরা চূড়ার উচ্চতা ৯৬ ফুট।ভারত

সরকারের আর্থিক অনুদানে ৫০ বছর আগে ধ্বংস করে দেওয়া রমনা কালী মন্দিরের সে-ই ১২০ ফুট চূড়া ২০২১ সালে এসে আবার দৃশ্যমান হচ্ছে।

রমনা কালী মন্দির

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানী বর্বর সেনাবাহিনীর আক্রমণে মন্দিরের প্রধান পুরোহিতসহ শতাধিক হিন্দু সাধু, সন্ন্যাসী ও ভক্তদের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয় রমনা মন্দিরের মাটি। এমনকি ডিনামাইট দিয়ে ২.২২ একরের উপর বিশাল মন্দির কমপ্লেক্সটি গুড়িয়ে দেওয়া হয়। মন্দির প্রাঙ্গণে ঘন্টাব্যাপী নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে শতাধিক মানুষকে হত্যা করে প্রায় ১৫ জন কমবয়সী হিন্দু কিশোরীকে তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি যাদেরকে আর কখনোই খোঁজে পাওয়া যায় নি।

আরো পড়ুন……

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার উক্ত স্থানকে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে হস্তান্তর করে। তারপর সরকারি বাহিনী দিয়ে মন্দিরের অবশিষ্ট অংশও গুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং তৎকালীন সময় থেকে পরবর্তী বিভিন্ন সরকারের সময় সেখানকার বেঁচে যাওয়া সাধু-সন্ন্যাসীদের মন্দিরে জায়গা বুঝিয়ে না দিয়ে বরং তাদেরকে একরকম বিতাড়িত করা হয়।

ইতিহাস

জনশ্রুতি, প্রায় ৫০০ বছর আগে বদরীনাথের যোশীমঠ থেকে গোপালগিরি নামে এক উচ্চমার্গের সন্ন্যাসী প্রথমে ঢাকায় এসে সাধন-ভজনের জন্য উপযুক্ত একটি আখড়া গড়ে তোলেন। সেখানেই আরও ২০০ বছর পরে মূল রমনা কালীমন্দিরটি নির্মাণ করেন আর এক বড় সাধু হরিচরণ গিরি। তবে পরবর্তী সময়ে এই মন্দিরের প্রধান সংস্কারকার্য ভাওয়ালের ভক্তিমতী ও দানশীলা রানি বিলাসমণি দেবীর আমলেই হয়। ১৯৭১ সালের ২৬ ও ২৭ মার্চ। এই দুটো দিন রমনা কালীমন্দিরের পবিত্র ভূমি ঘিরে পাকিস্তানি সেনারা যে বিভীষিকার রাজত্ব তৈরি করেছিল তার করুণ কাহিনি ইতিহাসের পাতায় চিরদিন লেখা থাকবে। এক তীর্থভূমি রাতারাতি পরিণত হয়েছিল বধ্যভূমিতে। রমনা কালীমন্দিরের অধ্যক্ষ স্বামী পরমানন্দ গিরি সহ সেখানে উপস্থিত প্রায় ১০০ জন নারী ও পুরুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল পাক সেনারা। শিশুরাও রেহাই পায়নি। এই হত্যাকাণ্ডের সময় রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম দাউ দাউ করে জ্বলেছিল। রমনা কালীমন্দিরের চূড়া ছিল ১২০ ফুট, যা বহুদূর থেকে দেখা যেত। সেটিও ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় ওই বর্বর সেনারা। একাত্তরের এপ্রিল মাসের শেষ দিকে অথবা মে মাসের প্রথম দিকে ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপনায় পুনরায় পাকিস্তানি বর্বররা হামলা চালায়।

 

প্রাচীন আখড়ার পাশে হরিচরণ গিরি কর্তৃক নির্মিত মন্দিরটি বাঙালি হিন্দু স্থাপত্য রীতি বহন করলেও তাতে মুসলিম রীতির প্রভাব লক্ষণীয়। মূল মন্দিরটি ছিল দ্বিতল। এর দ্বিতল ছাদের উপর ছিল ১২০ ফুট উঁচু পিরামিড আকৃতির চূড়া। মূল মন্দিরটি চতুষ্কোণাকার,  ছাদ উঁচু এবং বাংলার চৌচালা রীতিকে অনুসরণ করে নির্মিত। নথিপত্র প্রমাণে দেখা যায় যে, ষোল শতকের শেষভাগে বিক্রমপুর ও শ্রীপুরের জমিদার কেদার রায় তাঁর গুরুর জন্য এ মন্দিরটি নির্মাণ করান। মন্দিরের কৌণিক আকৃতির  চূড়ার নিম্নভাগ ছিল ছত্রি ডিজাইন শোভিত। একে একরত্ন মন্দিরের সঙ্গেও তুলনা করা যেতে পারে। মন্দির চত্বরে পুরনো ও নতুন বেশ কয়েকটি সমাধি মন্দিরের কাঠামো ছিল। এই চত্বরে ছিল হরিচরণ ও গোপাল গিরির সমাধি।

 

কালীবাড়ির মন্দিরের ফটকের সবচেয়ে পুরনো যে আলোকচিত্রটি রয়েছে তা উনিশ শতকের শেষার্ধে তোলা। তখন মন্দিরটি পুরনো ইটের দেয়ালে ঘেরা ছিল। ভেতরে প্রবেশের জন্য দক্ষিণ দিকে একটি নতুন ফটক নির্মাণ করা হয়। অভ্যন্তরভাগে বামদিকে ছিল একটি চতুষ্কোণ ভিত্তির ধ্বংসাবশেষ। এর কেন্দ্রে ছিল একটি বেদী। এখানেই প্রাচীন মন্দিরটি অবস্থিত ছিল।

রমনা কালী মন্দির
রমনা কালী মন্দির

প্রাচীর ঘেরা মন্দিরে একটি সুদৃশ্য কাঠের সিংহাসনে স্থাপিত ছিল ভদ্রকালীর মূর্তি। এই মূর্তির ডানদিকে ছিল ভাওয়ালের কালী মূর্তি। মন্দিরের উত্তর-পূর্ব ও পশ্চিমে ছিল পূজারী, সেবায়েত ও ভক্তদের থাকার ঘর। পাশে একটি শিব মন্দিরও ছিল। আরও ছিল একটি নাট মন্দির ও সিংহ দরওয়াজা।

কথিত আছে, কালীবাড়ির সামনের দিঘিটি খনন করান ভাওয়ালের রাণী বিলাসমণি। তবে ইংরেজ আমলের নথিপত্রে দিঘিটি ইংরেজ মেজিস্ট্রেট ড’স খনন করান বলে উল্লেখ আছে। সম্ভবত ভাওয়ালের রাণী দিঘিটির সংস্কার করান। বর্তমানে এই দিঘিটিই রমনা কালী মন্দিরের স্মৃতি ধারণ করে আছে। রমনা কালী মন্দিরের উত্তর পাশে ছিল আনন্দময়ী আশ্রম। আনন্দময়ী ছিলেন একজন সন্ন্যাসিনী যিনি ঢাকার নবাবের শাহবাগ বাগানের তত্ত্বাবধায়ক রমনীমোহন চক্রবর্তীর স্ত্রী। মা আনন্দময়ী আধ্যাত্মিক শক্তির ধারক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন এবং সাধিকা হিসেবে পূজিত হন। তাঁর ভক্তরা রমনা ও সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়িতে দুটি আশ্রম তৈরি করে দেন। আনন্দময়ী আশ্রমের প্রবেশদ্বার ছিল পূর্বদিকে। পশ্চিম দিকে ছিল একটি নাট মন্দির। এর উত্তর দিকের একটি কক্ষে সংরক্ষিত ছিল মা আনন্দময়ীর পাদপদ্ম। মন্দিরের বেদীর উপর স্থাপিত ছিল বিষ্ণু ও অন্নপূর্ণা বিগ্রহ। কালীমন্দির প্রাঙ্গণে সন্ন্যাসী ভক্ত ছাড়াও সাধারণ কর্মজীবি অনেকেই তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে বাস করতেন এবং মন্দির ও আশ্রমের অনুষ্ঠানাদিতে অংশ নিতেন।

তদানীন্তন রেস কোর্স ময়দান ঢাকা ক্লাবের নিয়ন্ত্রণে ছিল। স্বাধীনতার পর গণপূর্ত বিভাগের হাতে হস্তান্তর করা হয়। মন্দির এবং আশ্রমের ধ্বংসাবশেষ গণপূর্ত বিভাগ বুলডোজার চালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। মন্দির এবং আশ্রমবাসী যারা গণহত্যা থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন তারা ফিরে আসেন আবার এবং উক্ত স্থানে অস্থায়ী ভিটা করে বসতি স্থাপন করেন। সেখানে পূজা অর্চনার জন্য অস্থায়ী মন্দির স্থাপন করেন।

১৯৭৬ সালে তৎকালীন সরকারের সময় পুলিশ দিয়ে অস্ত্রের মুখে তাদের উৎখাত করা হয়। তাদের ভারতে চলে যেতে ‘উপদেশ’ দেওয়া হয়। আবার বাস্তুচ্যুত হন রমনা কালী মন্দিরের বাসিন্দারা। সুচেতা গিরি ভারতে পাড়ি জমান। রমনায় প্রতি বছর দুর্গাপূজা করার উদ্ধোগ নেন স্থানীয়রা। কিন্তু প্রতিবারই তাদের বাঁধা দেওয়া হয়। শুধু ১৯৮২ সালে একবার কালী পূজার অনুমতি দেওয়া হয়। ১৯৮৪ সালে মন্দির এবং আশ্রমের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে রতন সরকার বাদি হয়ে ঢাকার দেওয়ানী আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন।

স্বাধীনতার পর শাহবাজ জামে মসজিদের খাদেম এবং রমনা কালী মন্দিরের অধ্যক্ষ স্বামী পরমানন্দ গিরির বন্ধু আব্দুল আলী ফকির রমনাকালীমন্দির ও শ্রীমা আনন্দময়ী আশ্রমের ভক্ত বৃন্দও অন্যান্য বাসিন্দাদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করেন। তাঁর সাথে ছিলেন প্রয়াত পরমানন্দ গিরির স্ত্রী সুচেতা গিরি। গণহত্যায় নিহতদের পরিবারের উত্তরাধিকারদের প্রত্যেককে একটি করে প্রশংসাপত্র এবং প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ২০০০ টাকার একটি চেক প্রদান করা হয়। ১৯৭৩ সালের ১৩মে সেখানকার বাসিন্দাদের পোস্তাগলায় পাঠানো হয়। সেখানে শ্মশান সংলগ্ন বালুর মাঠে তারা বসতি স্থাপন করেন। তাদের জন্য রেশনের ব্যবস্থাও ছিল।

২০০০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেস কাল্বে অনুষ্ঠিত গনতদন্ত কমিশনের সাংবাদিক সম্মেলনে রমনা কালী মন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞ গণতদন্ত কমিশনের প্রাথমিক রিপোট প্রকাশ করা হয়।২০০৬ সালে ভারত সরকারের উদ্যোগে রমনা কালী মন্দিরের পুনঃনির্মাণ কাজ শুরু হয়। পুজোর্চ্চনাও শুরু হয়। ৭কোটি টাকা ব্যয়ে ২০২১ সালে স্থাপনার কাজ হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০বছর পূর্তিতে ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ তা উদ্বোধন করেন আর রমনা কালী মন্দির ফিরে পায় তার ৫ শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্য। বর্তমানে এখানে নতুন করে নির্মিত হয়েছে শ্রী শ্রী কালী মন্দির ও শ্রী মা আনন্দময়ী আশ্রম। মন্দিরের প্রধান ফটক দিঘির উত্তর-পূর্ব পাশে অবস্থিত এবং প্রধান ফটকের বাইরে রয়েছে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞে শহীদদের তালিকা সম্বলিত একটি স্মৃতিফলক। প্রধান ফটকের পরেই রয়েছে আরও কয়েকটি মন্দির, যেমন শ্রী শ্রী দুর্গা মন্দির, শ্রী শ্রী রাধাগোবিন্দ মন্দির, শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী মন্দির (নির্মাণাধীন), শ্রী শ্রী আনন্দময়ী মন্দির আশ্রম (নির্মাণাধীন), শ্রী শ্রী হরিচাঁদ মন্দির (নির্মাণাধীন) এবং দুটি শিবের মূর্তি।

রমনা কালী মন্দিরের স্থাপনা সমূহ

রমনা কালী মন্দির এ বর্তমানে কালী মূর্তি ছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি মন্দির রয়েছে। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো, দুর্গা মন্দির, লোকনাথ মন্দির, রাধা গোবিন্দ মন্দির, মা আনন্দময়ীর মন্দির।মন্দিরটির স্থাপত্য শৈলী বহুবার পরিবর্তিত হয়েছে। মন্দিরের সামনে একটি বড় দিঘি ছিল যা উপাসক এবং দর্শনার্থীদের সাঁতার কাটার জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান ছিল। মন্দিরটিতে একটি লম্বা শিখর (টাওয়ার) রয়েছে। মন্দিরের পাশেই ছিল মা আনন্দময়ী আশ্রম, সেখানে থাকা ও গোসল করার সুবিধা ছিল।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক গণহত্যাও ধ্বংসযজ্ঞ

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদী/ স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমন করার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী ” অপারেশন সার্চলাইট ” শুরু করে। অপারেশনটি একটি গণহত্যা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূত্রপাত করে। অপারেশন সার্চলাইটের বেশিরভাগ লক্ষ্য ছিল তরুণ হিন্দু পুরুষ, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র এবং শিক্ষাবিদরা। অপারেশন সার্চলাইট জগন্নাথ হল ( ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে হিন্দু ছাত্রদের জন্য একটি হোস্টেল) এবং রমনা কালী মন্দির সহ বিশিষ্ট হিন্দু ধর্মাবলম্বীদেরকে লক্ষ্য করে।

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী রমনা কালী মন্দির কমপ্লেক্সে প্রবেশ করে এবং এক ঘন্টার মধ্যে ১০০০ জনেরও বেশি লোককে হত্যা করে। মন্দির চত্বরে আশ্রয় নেওয়া বেশ কিছু মুসলমানকেও হত্যা করা হয়।

২০০০ সাল পর্যন্ত, মন্দির ধ্বংসের প্রমাণগুলি বেঁচে থাকা এবং সাক্ষীদের মৌখিক সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করেছিল। ২০০০ সালে, বাংলাদেশ সরকার আওয়ামী লীগ, তদন্তের জন্য একটি পাবলিক অনুসন্ধান খোলে। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে চেয়ারম্যান বিচারপতি কে এম সোবহান একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন পেশ করেন।

গণহত্যার শিকার হয়েছে এমন প্রায় ৫০জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং অন্য নিহতদের স্বজনরা হয় মৃত বা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেছে। রমনা কালী মন্দির হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া মানুষের জীবিত আত্মীয়দের জন্য একটি বিশ্বব্যাপী আবেদন করা হয়েছে যাতে তারা তাদের মৃত পরিবারের সদস্যদের নাম ভবিষ্যতের স্মৃতিসৌধে তালিকাভুক্ত করতে অবদান রাখে।

স্বাধীনতা পরবর্তী অবিচার

স্বাধীনতার পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের গণপূর্ত অধিদফতর সম্পূর্ণ জায়গাটি নিজেদের দখলে নিয়ে মন্দিরের অবশিষ্ট ধ্বংসাবশেষও নিশ্চিহ্ন করে দেয়।

মন্দিরের বেঁচে যাওয়া বাসিন্দারা, যারা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আক্রমণে ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল এবং বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছিল, তারা ফিরে এসেছিল। যথারীতি, তারা উপাসনা শুরু করার জন্য একটি অস্থায়ী মন্দির তৈরি করেছিলো এবং সেখানে থাকার জন্য নিজেদের (সরকারি সহযোগিতা পায় নি) অর্থায়নে কিছু বসতঘরও নির্মাণ করেছিলো।

রমনা কালী মন্দিরের পুরোহিত পরমানন্দ গিরির ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবদুল আলী ফকির মন্দিরের ভক্তদের সাথে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন এবং তাঁকে একটি স্মারকলিপি দিয়ে ঐতিহাসিক এই মন্দিরটি পুনর্নির্মাণের জন্য তাঁকে অনুরোধও করেন। পরমানন্দ গিরির স্ত্রী সুচেতা গিরি ও মা আনন্দময়ী আশ্রমের তপস্যাবিদ জটালি মাও তাঁদের সাথে গিয়েছিলেন।

রমনা কালী মন্দির

কিন্তু গণমানুষের নেতা খ্যাত বঙ্গবন্ধু ভুক্তভোগীদের রিক্ত হস্তে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন এমনকি তাদেরকে ঢাকার নিকটস্থ পোস্তগোলার শ্মশান সংলগ্ন একটি চারণভূমিতে থাকতে দিয়েছিলেন সামান্য তাবু গেড়ে। তাঁদেরকে কোনরকম সরকারি তদারকি করা হয় নি এমনকি ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে কোন সরকারি সহায়তাও দেওয়া হয়নি।

ক্ষমতায় পরিবর্তন হয় কিন্তু ভুক্তভোগীদের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় না। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে বন্দুকের নলের মুখে পোস্তগোলার চারণভূমি থেকেও তাঁদেরকে উচ্ছেদ করে। দীর্ঘ লড়াই করে স্বাধীন বাংলাদেশের সকল সরকার কর্তৃক অবিচারের শিকার হয়ে হতাশাগ্রস্ত সুচেতা গিরি ১৯৯২ সালে ভারতে চলে যান। কয়েকবছরের মধ্যে জটালি মাও মারা যান। ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার ও অধিকার বঞ্চিত অবস্থায়ই বিদায় নেন।

১৯৭১ সালে মন্দিরটি ধ্বংস করার সময় ২.২২ একর এলাকা জুড়ে স্থাপিত রমনা মন্দিরের চূড়াটি প্রায় ১২০ ফুট লম্বা ছিলো যা বহুদূর হতেও দৃশ্যমান ছিলো। পরবর্তীতে বাংলাদেশের কোন সরকারই মন্দিরটির পুনঃনির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ না করে উলটো রমনা মন্দিরের জায়গা দখলের নানারকম প্রয়াস চালায়৷

রমনা কালীমন্দিরে সেদিন রাতে কি ঘটেছিল

২৭শে মার্চ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি জল্লাদরা রাত দুইটায় এদেশের রাজাকার আল বদর আল সামস সহ রমনা কালী বাড়িতে প্রবেশ করে। আসার সাথে সাথেই তারা গোলাগুলি শুরু করে দিল। আতঙ্কিতা হয়ে অনেকে পাকিস্তানি জিন্দাবাদ স্লোগান দিতে শুরু করলো। এবং অনেক মহিলা হাতের শাখা ভেঙে ফেলেছিল এবং সিঁদুর মুছে দিয়েছিল নিজেদের সন্তানদের বাঁচানোর জন্য। কেউ কেউ আত্মগোপন করেছিল মন্দির এবং আশ্রমের বিভিন্ন কোণে। পাকিস্তানের সৈন্যরা সেখান থেকে তাদের খুঁজে বের করে মন্দিরের সামনে লাইন করে দাঁড় করিয়ে দেয়। বাচ্চারা সহ মহিলাদের এক লাইনে দাঁড় করা হয়েছিল এবং পুরুষদের অন্য লাইনে দাঁড় করিয়েছিল। এরপর নির্বিচারে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর সকল লাস জড়ো করে পাকিস্তানি জল্লাদরা। এরপর লাস গুলোর উপর পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেই। যার ফলে আহত মানুষগুলো আগুনে পুড়ে মারা যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা উল্লেখ করেন রমনা কালী মন্দিরে, বহু নারী ও শিশুকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল। এমনকি পঞ্চাশটিরও বেশি গরু পুড়িয়ে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি জল্লাদরা।

সকল লোকের সামনেই মন্দিরের পুরোহিত পরমানন্দ গিরিকে কালেমা আবৃত করতে বাধ্য করে পাকিস্তানি জল্লাদরা।। এবং সাথে সাথে তার পেটে বেওনেট ভরে গুলি করে হত্যা করে।

কমলা রায় সরকারি আইন কমিশনে দেওয়া সাক্ষীতে বলেন পাকিস্তানিরা মৃত অর্ধেক লোকের সাথে সমস্ত মৃত লোককে এক স্থানে রেখে আগুন লাগিয়ে দেই। সে দেখে শিশুরা চিৎকার করে পালাতে থাকে এবং সেই শিশুগুলোকেধরে ধরে আগুনের নিক্ষেপ করতে থাকে। সুচেতাগিরি পুরোহিত পরমানন্দ গিরির স্ত্রী এবং মা আনন্দময়ী আশ্রমের তাপশি জটালি মা এই রমনা মন্দির ত্যাগ করেছিলেন। এর সাথে সাথে এই গণহত্যায় যারা বেঁচে ছিল তারা সবাই এই মন্দির ত্যাগ করে চলে যায়।

মন্দির নব নির্মাণ

পরবর্তীতে ২০১৬ সালে তৎকালীন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা সরাজের ঐকান্তিক ইচ্ছে ও তত্ত্বাবধানে এবং ভারত সরকারের ৭ কোটি টাকা অনুদানের উপর ভিত্তি করে মন্দিরটি পুনঃনির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় যা ২০২১ সালে এসে পূর্ণতা পায় এবং রমনা কালী মন্দিরের সে-ই চূড়াটি আবারও দৃশ্যমান হয়।।

রমনা কালী মন্দির ৭১ এর ভয়ংকর সময়সহ স্বাধীনতা পরবর্তী সময় বিভিন্ন অবিচারের স্বাক্ষী হয়ে থাকবে আরও দীর্ঘ সময়। এই কলংকিত ইতিহাস মুছে ফেলা যাবে না।

স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর পর ২০২১ সালের ১৭ ডিসেম্বর ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ নবনির্মিত মন্দির কমপ্লেক্সটি উদ্বোধন করেছেন এবং একটি কালিমালিপ্ত অধ্যায়ের সমাপ্তি করেছেন।

রমনা কালী মন্দিরের মূর্তি

তন্ত্রশাস্ত্রে মা কালীর নানাপ্রকারের মূর্তিভেদ বর্ণনা করা হয়েছে। তার মধ্যে রমনাকালী অন্যতম।পাথরের বেদির ওপর শ্রীশ্রীভদ্রকালীর সুউচ্চ প্রতিমা। চতুর্ভুজা মাতৃমূর্তি। মহাদেবের শয়ান মূর্তির ওপর দণ্ডায়মান। দু’পাশে ডাকিনী-যোগিনী। ভদ্রকালিকা দেবীর কণ্ঠে মুণ্ডমালা। লালজবার মালা। দেবী মা লাল বস্ত্র পরিহিতা। ভদ্রকালিকার একপাশে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও মা সারদামণির ছবি।

রমনা কালী মন্দিরের অনুষ্ঠানমা

রমনা কালী মন্দির এর মূল পূজা হলো কালী পূজা।।কালীপুজোয় সুন্দর করে সাজানো হয় গোটা মন্দিরকে। নানা অলংকারে সেজে ওঠেন শ্রীশ্রীভদ্রকালী মাতা।এখানে দুর্গাপুজোও খুব বড় করে হয়। তাছাড়া এখানে সরস্বতী পূজা, বাৎসরিক অনুষ্ঠান সহ নানা ধরনের ধর্মীয় উৎসব এখানে হয়ে থাকে ।বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু ভক্ত আসেন মন্দিরে। ভারত থেকেও ভক্তরা আসেন। সে এক দেখার মতো ব্যাপার। উৎসবমুখর হয়ে ওঠে এই মন্দির।

 

রমনা কালী মন্দির যাওয়ার উপায়

রমনা কালী মন্দিরর মূল প্রবেশ পথ হলো বাংলা একাডেমির বিপরীতে। এ ছাড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পূর্ব দিকের গেইট দিয়েও এখানে যাতায়াত করা যায়। ঢাকার যেকোনো জায়গা থেকে আপনি রমনা কালী মন্দিরে যেতে পারেন।

Related Post

মৃত্যু নিয়ে উক্তি

150+মৃত্যু নিয়ে উক্তি, বাণী, ক্যাপশন 2024

মৃত্যু নিয়ে উক্তি জন্মিলে মরিতে হবে আর এটাই সত্যি। মৃত্যু হচ্ছে সবচেয়ে চিরন্তন সত্যি। পৃথিবীতে প্রতিটি প্রাণীর মৃত্যুর স্বাদ অনুভব করতে হবে। সবসময় মৃত্যুর জন্য

Read More »
খুশির স্ট্যাটাস

200+ স্টাইলিশ খুশির স্ট্যাটাস | হাসি নিয়ে ক্যাপশন

খুশির স্ট্যাটাস | হাসি নিয়ে ক্যাপশন জীবনের সুন্দর খুশির মুহূর্ত আমরা সবাই বাঁধাই করে রাখতে চাই। আর এই খুশির মুহূর্তকে ধরে রাখার সবচেয়ে সহজ উপায়

Read More »

স্টাইলিশ ভালোবাসার ছন্দ | রোমান্টিক ছন্দ | Love Status Bangla

❤❤ভালোবাসার ছন্দ | ভালোবাসার ছন্দ রোমান্টিক | ভালোবাসার ছন্দ স্ট্যাটাস❤❤ ভালোবাসা হলো এক অন্যরকম অনুভূতির নাম, যা শুধুমাত্র কাউকে ভালবাসলেই অনুভব করা যায়। আমরা বিভিন্নভাবে

Read More »
মন খারাপের স্ট্যাটাস

মন খারাপের স্ট্যাটাস, উক্তি, ছন্দ, ক্যাপশন, কিছু কথা ও লেখা

মন খারাপের স্ট্যাটাস মন খারাপ – এই কষ্টের অনুভূতি কার না হয়? সবারই কখনো না কখনো সবারই মন খারাপ হয়। জীবনের ছোটোখাটো অঘটন থেকে শুরু

Read More »

Leave a Comment

Table of Contents