বিখ্যাত প্রেমের কবিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

প্রেমের কবিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রথম এশীয় ও ভারতীয় হিসাবে যিনি নোবল পুরস্কার লাভ করেছিলেন।  তার সাহিত্য ও কর্মে তিনি আমাদের মাঝে এখনো বেঁচে আছেন। এখনো এই ইন্টারনেটের যুগের প্রেমিক প্রেমিকাদের কাছেও তিনি অনেক জনপ্রিয়, প্রিয় মানুষটিকে মনের কথা প্রকার করতে এখনো আমাদের প্রধান সম্বল “প্রেমের কবিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “।  আজকের এই লেখায় আমরা কবিগুরুর বিখ্যাত কিছু প্রেমের কবিতা নিয়ে হাজির হয়েছি।  

প্রেমের কবিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

প্রেমের কবিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

এক. অত চুপি চুপি কেন কথা কও

__রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অত চুপি চুপি কেন কথা কও
ওগো মরণ, হে মোর মরণ।
অতি ধীরে এসে কেন চেয়ে রও,
ওগো একি প্রণয়েরি ধরন।
যবে সন্ধ্যাবেলায় ফুলদল
পড়ে ক্লান্ত বৃন্তে নমিয়া,
যবে ফিরে আসে গোঠে গাভীদল
সারা দিনমান মাঠে ভ্রমিয়া,
তুমি পাশে আসি বস অচপল
ওগো অতি মৃদুগতি-চরণ।
আমি বুঝি না যে কী যে কথা কও
ওগো মরণ, হে মোর মরণ।

হায় এমনি করে কি, ওগো চোর,
ওগো মরণ, হে মোর মরণ,
চোখে বিছাইয়া দিবে ঘুমঘোর
করি হৃদিতলে অবতরণ।
তুমি এমনি কি ধীরে দিবে দোল
মোর অবশ বক্ষশোণিতে।
কানে বাজাবে ঘুমের কলরোল
তব কিঙ্কিণি-রণরণিতে?
শেষে পসারিয়া তব হিম-কোল
মোরে স্বপনে করিবে হরণ?
আমি বুঝি না যে কেন আস-যাও
ওগো মরণ, হে মোর মরণ (সংক্ষিপ্ত)

উৎসঃ উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ

দুই. পথের বাঁধন

__রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি,
আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী।
রঙিন নিমেষ ধুলার দুলাল
পরানে ছড়ায় আবীর গুলাল,
ওড়না ওড়ায় বর্ষার মেঘে
দিগঙ্গনার নৃত্য,
হঠাৎ-আলোর ঝলকানি লেগে
ঝলমল করে চিত্ত।

নাই আমাদের কনকচাঁপার কুঞ্জ,
বনবীথিকায় কীর্ণ বকুলপুঞ্জ।
হঠাৎ কখন্‌ সন্ধ্যাবেলায়
নামহারা ফুল গন্ধ এলায়,
প্রভাতবেলায় হেলাভরে করে
অরুণ মেঘেরে তুচ্ছ
উদ্ধত যত শাখার শিখরে
রডোডেন্‌ড্রন্‌ গুচ্ছ।

নাই আমাদের সঞ্চিত ধনরত্ন,
নাই রে ঘরের লালনললিত যত্ন।
পথপাশে পাখি পুচ্ছ নাচায়,
বন্ধন তারে করি না খাঁচায়,
ডানা-মেলে-দেওয়া মুক্তিপ্রিয়ের
কূজনে দুজনে তৃপ্ত।
আমরা চকিত অভাবনীয়ের
ক্কচিৎ কিরণে দীপ্ত।

উৎসঃ সঞ্চয়িতা 

তিন. হায় গগন নহিলে তোমারে ধরিবে কে বা

প্রেমের কবিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

__রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

“হায় গগন নহিলে তোমারে ধরিবে কে বা
ওগো তপন তোমার স্বপন দেখি যে,করিতে পারি নে সেবা।’’
শিশির কহিল কাঁদিয়া,
“তোমারে রাখি যে বাঁধিয়া
হে রবি,এমন নাহিকো আমার বল।
তোমা বিনা তাই ক্ষুদ্র জীবন কেবলি অশ্রুজল।’

“আমি বিপুল কিরণে ভুবন করি যে আলো,
তবু শিশিরটুকুরে ধরা দিতে পারি
বাসিতে পারি যে ভালো।’
শিশিরের বুকে আসিয়া
কহিল তপন হাসিয়া,
“ছোটো হয়ে আমি রহিব তোমারে ভরি,
তোমার ক্ষুদ্র জীবন গড়িব
হাসির মতন করি।’

উৎসঃ উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ

চার.  নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে 

__রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে
রয়েছ নয়নে নয়নে,
হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে
হৃদয়ে রয়েছ গোপনে।

বাসনা বসে মন অবিরত,
ধায় দশ দিশে পাগলের মতো।
স্থির আঁখি তুমি ক্ষরণে শতত
জাগিছ শয়নে স্বপনে।

সবাই ছেড়েছে নাই যার কেহ
তুমি আছ তার আছে তব কেহ
নিরাশ্রয় জন পথ যার যেও
সেও আছে তব ভবনে।

তুমি ছাড়া কেহ সাথি নাই আর
সমুখে অনন্ত জীবন বিস্তার,
কাল পারাপার করিতেছ পার
কেহ নাহি জানে কেমনে।

জানি শুধু তুমি আছ তাই আছি
তুমি প্রাণময় তাই আমি বাঁচি,
যতো পাই তোমায় আরো ততো যাচি
যতো জানি ততো জানি নে।

জানি আমি তোমায় পাবো নিরন্তন
লোক লোকান্তরে যুগ যুগান্তর
তুমি আর আমি, মাঝে কেহ নাই
কোনো বাঁধা নাই ভুবনে।

নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে
রয়েছ নয়নে নয়নে।

উৎসঃ সঞ্চয়িতা

পাঁচ. দুর্বোধ

__রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তুমি মোরে পার না বুঝিতে?
প্রশান্তবিষাদভরে দুটি আঁখি প্রশ্ন করে
অর্থ মোর চাহিছে খুঁজিতে,
চন্দ্রমা যেমন-ভাবে স্থিরনতমুখে
চেয়ে দেখে সমুদ্রের বুকে।।

কিছু আমি করি নি গোপন।

যাহা আছে সব আছে তোমার আঁখির কাছে
প্রসারিত অবারিত মন।
দিয়েছি সমস্ত মোর করিতে ধারণা,
তাই মোরে বুঝিতে পার না?

এ যদি হইত শুধু মণি,

শত খন্ড করি তারে সযত্নে বিবিধাকারে
একটি একটি করি গণি
একখানি সূত্রে গাঁথি একখানি হার
পরাতেম গলায় তোমার।।

এ যদি হইত শুধু ফুল,

সুগোল সুন্র ছোট, উষালোকে ফোটো-ফোটো,
বসন্তের পবনে দোদুল-
বৃন্দ হতে সযত্নে আনিতাম তুলে,
পরায়ে দিতাম কালো চুলে।।

এ যে সখী ,সমস্ত হৃদয়।

কোথা জল কোথা কূল, দিক হয়ে যায় ভুল,
অন্তহীন রহস্যনিলয়।
এ রাজ্যের আদি অন্ত নাহি জান রানী,
এ তবু তোমার রাজধানী।।

কী তোমারে চাহি বুঝাইতে?

গভীর হৃদয়-মাঝে নাহি জানি কী যে বাজে
নিশিদিন নীরব সংগীতে,
শব্দহীন স্তব্ধতায় ব্যাপিয়া গগন
রজনীর ধ্বনির মতন।।
এ যে সুখ হইত শুধু সুখ,
কেবল একটি হাসি অধরের প্রান্তে আসি
আনন্দ করিত জাগরূক।
মুহূর্তে বুঝিয়া নিতে হৃদয়বারতা,
বলিতে হতো না কোনো কথা।।

এ যদি হইত শুধু দুখ

দুটি বিন্দু অশ্রুজল দুই চক্ষে ছলছল,
বিষন্ন অধর , স্নায়ুমুখ-
প্রত্যেক্ষ দেখিতে পেতে অন্তরের ব্যথা,
নীরবে প্রকাশ হত কথা।।

এ যে সখী,হৃদয়ের প্রেম-

সুখদুখবেদনার আদি অন্ত নাহি যার,
চিরদৈন্য,চিরপূর্ণ হেম।
নব নব ব্যাকুলতা জাগে নূতন – নূতনালোকে
পাঠ করো রাত্রিদিন ধরে।
বুঝা যায় আধো প্রেম,আধখানা মন-
সমস্ত কে বুঝেছে কখন।।

প্রেমের কবিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

ছয়. আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার

__রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার,
পরানসখা বন্ধু হে আমার।
আকাশ কাঁদে হতাশ-সম,
নাই যে ঘুম নয়নে মম,
দুয়ার খুলি হে প্রিয়তম,
চাই যে বারে বার।
পরানসখা বন্ধু হে আমার।

বাহিরে কিছু দেখিতে নাহি পাই,
তোমার পথ কোথায় ভাবি তাই।
সুদূর কোন্‌ নদীর পারে,
গহন কোন্‌ অন্ধকারে
হতেছ তুমি পার।
পরানসখা বন্ধু হে আমার।

উৎসঃ গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ

সাত. দায়মোচন

__রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

চিরকাল রবে মোর প্রেমের কাঙাল,
এ কথা বলিতে চাও বোলো।
এই ক্ষণটুকু হোক সেই চিরকাল –
তার পরে যদি তুমি ভোল
মনে করাব না আমি শপথ তোমার,
আসা যাওয়া দু দিকেই খোলা রবে দ্বার –
যাবার সময় হলে যেয়ো সহজেই,
আবার আসিতে হয় এসো।
সংশয় যদি রয় তাহে ক্ষতি নেই,
তবু ভালোবাস যদি বেসো।।

বন্ধু, তোমার পথ সম্মুখে জানি,
পশ্চাতে আমি আছি বাঁধা।
অশ্রুনয়নে বৃথা শিরে কর হানি
যাত্রায় নাহি দিব বাধা।
আমি তব জীবনের লক্ষ্য তো নহি,
ভুলিতে ভুলিতে যাবে হে চিরবিরহী,
তোমার যা দান তাহা রহিবে নবীন
আমার স্মৃতির আঁখিজলে –
আমার যা দান সেও জেনো চিরদিন
রবে তব বিস্মৃতিতলে।।

দূরে চলে যেতে যেতে দ্বিধা করি মনে
যদি কভু চেয়ে দেখ ফিরে,
হয়তো দেখিবে আমি শূন্য শয়নে –
নয়ন সিক্ত আঁখিনীরে।
মার্জনা কর যদি পাব তবে বল,
করুণা করিলে নাহি ঘোচে আঁখিজল –
সত্য যা দিয়েছিলে থাক্ মোর তাই,
দিবে লাজ তার বেশি দিলে।
দুঃখ বাঁচাতে যদি কোনোমতে চাই
দুঃখের মূল্য না মিলে।।

দুর্বল ম্লান করে নিজ অধিকার
বরমাল্যের অপমানে।
যে পারে সহজে নিতে যোগ্য সে তার,
চেয়ে নিতে সে কভু না জানে।
প্রেমেরে বাড়াতে গিয়ে মিশাব না ফাঁকি,
সীমারে মানিয়া তার মর্যাদা রাখি –
যা পেয়েছি সেই মোর অক্ষয় ধন,
যা পাই নি বড়ো সেই নয়।
চিত্ত ভরিয়া রবে ক্ষণিক মিলন
চিরবিচ্ছেদ করি জয়।।

উৎসঃ সঞ্চয়িতা কাব্যগ্রন্থ

আট. আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে

__রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।

তব অবগুন্ঠিত কুন্ঠিত জীবনে
কোরো না বিড়ম্বিত তারে।
আজি খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো,
আজি ভুলিয়ো আপনপর ভুলিয়ো,
এই সংগীতমুখরিত গগনে
তব গন্ধ করঙ্গিয়া তুলিয়ো।
এই বাহিরভূবনে দিশা হারায়ে
দিয়ো ছড়ায়ে মাধুরী ভারে ভারে।

অতি নিবিড় বেদনা বনমাঝে রে
আজি পল্লবে পল্লবে বাজে রে –
দূরে গগনে কাহার পথ চাহিয়া
আজি ব্যকুল বসুন্ধরা সাজে রে।
মোর পরানে দখিন বায়ু লাগিছে,
কারে দ্বারে দ্বারে কর হানি মাগিছে,
এই সৌরভবিহবল রজনী
কার চরণে ধরণীতলে জাগিছে।
ওগো সুন্দর, বল্লভ, কান্ত,
তব গম্ভীর আহবান কারে।

উৎসঃ গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ

নয়. অসময় 

__রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বৃথা চেষ্টা রাখি দাও। স্তব্ধ নীরবতা
আপনি গড়িবে তুলি আপনার কথা।
আজি সে রয়েছে ধ্যানে—এ হৃদয় মম
তপোভঙ্গভয়ভীত তপোবনসম।
এমন সময়ে হেথা বৃথা তুমি প্রিয়া
বসন্তকুসুমমালা এসেছ পরিয়া,
এনেছ অঞ্চল ভরি যৌবনের স্মৃতি—
নিভৃত নিকুঞ্জে আজি নাই কোনো গীতি।
শুধু এ মর্মরহীন বনপথ-’পরি
তোমারি মঞ্জীর দুটি উঠিছে গুঞ্জরি।
প্রিয়তমে, এ কাননে এলে অসময়ে,
কালিকার গান আজি আছে মৌন হয়ে।
তোমারে হেরিয়া তারা হতেছে ব্যাকুল,
অকালে ফুটিতে চাহে সকল মুকুল।

উৎসঃ চৈতালি কাব্যগ্রন্থ

দশ. দৃষ্টি

__রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

প্রেমের কবিতা রবীন্দ্রনাথ

বুঝি গো সন্ধার কাছে শিখেছে সন্ধার মায়া
ওই আঁখিদুটি,
চাহিলে হৃদয়-পানে মরমেতে পড়ে ছায়া,
তারা উঠে ফুটি।
আগে কে জানিত বল কত কি লুকানো ছিল
হৃদয়নিভৃতে–
তোমার নয়ন দিয়া আমার নিজের হিয়া
পাইনু দেখিতে।
কখনো গাও নি তুমি, কেবল নীরবে রহি
শিখায়েছ গান–
স্বপ্নময় শান্তিময় পূরবী রাগিণীতানে
বাঁধিয়াছ প্রাণ।
আকাশের পানে চাই সেই সুরে গান গাই
একেলা বসিয়া।
একে একে সুরগুলি অনন্তে হারায়ে যায়
আধারে পশিয়া।।

উৎসঃ সঞ্চয়িতা কাব্যগ্রন্থ

এগার. ১৪০০ সাল

__রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আজি হতে শতবর্ষ পরে

কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি

কৌতুহলভরে,

আজি হতে শতবর্ষ পরে!

আজি নব বসন্তের প্রভাতের আনন্দের

লেশমাত্র ভাগ,

আজিকার কোনো ফুল, বিহঙ্গের কোনো গান,

আজিকার কোনো রক্তরাগ-

অনুরাগে সিক্ত করি পারিব কি পাঠাইতে

তোমাদের করে,

আজি হতে শতবর্ষ পরে?

তবু তুমি একবার খুলিয়া দক্ষিণদ্বার

বসি বাতায়নে

সুদূর দিগন্তে চাহি কল্পনায় অবগাহি

ভেবে দেখো মনে-

একদিন শতবর্ষ আগে

চঞ্চল পুলকরাশি কোন্ স্বর্গ হতে ভাসি

নিখিলের মর্মে আসি লাগে,

নবীন ফাল্গুনদিন সকল-বন্ধন-হীন

উন্মত্ত অধীর,

উড়ায়ে চঞ্চল পাখা পুষ্পরেণুগন্ধমাখা

দক্ষিণসমীর

সহসা আসিয়া ত্বরা রাঙায়ে দেয়েছে ধরা

যৌবনের রাগে,

তোমাদের শতবর্ষ আগে।

সেদিন উতলা প্রাণে, হৃদয় মগন গানে,

কবি একা জাগে-

কত কথা পুষ্প প্রায় বিকশি তুলিতে চায়

কত অনুরাগে,

একদিন শতবর্ষ আগে।

আজি হতে শতবর্ষ পরে

এখন করিছে গান সে কোন্ নুতন কবি

তোমাদের ঘরে!

আজিকার বসন্তের আনন্দ-অভিবাদন

পাঠায়ে দিলাম তাঁর করে।

আমার বসন্তগান তোমার বসন্তদিনে

ধ্বনিত হউক ক্ষণতরে-

হৃদয়স্পন্দনে তব, ভ্রমরগুঞ্জনে নব,

পল্লবমর্মরে,

আজি হতে শতবর্ষ পরে।

বার. অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে

__রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে

চলবে না।

এবার হৃদয় মাঝে লুকিয়ে বোসো,

কেউ জানবে না, কেউ বলবে না।

বিশ্বে তোমার লুকোচুরি,

দেশ বিদেশে কতই ঘুরি –

এবার বলো আমার মনের কোণে

দেবে ধরা, ছলবে না।

আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে

চলবে না।

জানি আমার কঠিন হৃদয়

চরণ রাখার যোগ্য সে নয় –

সখা, তোমার হাওয়া লাগলে হিয়ায়

তবু কি প্রাণ গলবে না।

না হয় আমার নাই সাধনা,

ঝরলে তোমার কৃপার কণা

তখন নিমেষে কি ফুটবে না ফুল

চকিতে ফল ফলবে না।

আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে

চলবে না।

তের. প্রেমের হাতে ঘরা দেব

__রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

প্রেমের হাতে ধরা দেব

তাই রয়েছি বসে;

অনেক দেরি হয়ে গেল,

দোষী অনেক দোষে।

বিধিবিধান-বাঁধনডোরে

ধরতে আসে, যাই সে সরে,

তার লাগি যা শাস্তি নেবার

নেব মনের তোষে।

প্রেমের হাতে ধরা দেব

তাই রয়েছি বসে।

লোকে আমায় নিন্দা করে,

নিন্দা সে নয় মিছে,

সকল নিন্দা মাথায় ধরে

রব সবার নীচে।

শেষ হয়ে যে গেল বেলা,

ভাঙল বেচা-কেনার মেলা,

ডাকতে যারা এসেছিল

ফিরল তারা রোষে।

প্রেমের হাতে ধরা দেব

তাই রয়েছি বসে।

পনেরো.  অনন্ত প্রেম  

__রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শতবার
জনমে জনমে গে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয় গাঁথিয়াছে গীতহার –
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়, নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।

যত শুনি সেই অতীত কাহিনী, প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,
অতি পুরাতন বিরহ মিলন কথা,
অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে দেখা দেয় অবশেষে
কালের তিমির রজনী ভেদিয়া তোমারি মুরতি এসে
চিরস্মৃতিময়ী ধ্রুবতারকার বেশে।

আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি যুগল প্রেমের স্রোতে
অনাদি কালের হৃদয়-উৎস হতে।
আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা কোটি প্রেমিকের মাঝে
বিরহ বিধুর নয়ন সলিলে, মিলন মধুর লাজে –
পুরাতন প্রেম নিত্যনূতন সাজে।

আজি সেই চির-দিবসের প্রেম অবসান লভিয়াছে,
রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে।
নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ, নিখিল প্রাণের প্রীতি,
একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে সকল প্রেমের স্মৃতি –
সকল কালের সকল কবির গীতি।

ষোল.  প্রথম চুম্বন 

__রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

স্তব্ধ হল দশ দিক নত করি আঁখি-

বন্ধ করি দিল গান যত ছিল পাখি।

শান্ত হয়ে গেল বায়ু, জলকলস্বর

মুহূর্তে থামিয়া গেল, বনের মর্মর

বনের মর্মের মাঝে মিলাইল ধীরে।

নিস্তরঙ্গ তটিনীর জনশূন্য তীরে

নিঃশব্দে নামিল আসি সায়াহ্নচ্ছায়ায়

নিস্তব্ধ গগনপ্রান্ত নির্বাক্ ধরায়।

সেইক্ষণে বাতায়নে নীরব নির্জন

আমাদের দুজনের প্রথম চুম্বন।

দিক্-দিগন্তরে বাজি উঠিল তখনি

দেবালয়ে আরতির শঙ্খঘণ্টাধ্বনি।

অনন্ত নক্ষত্রলোক উঠিল শিহরি,

আমাদের চক্ষে এল অশ্রুজল ভরি।

সতেরো. আমার এ প্রেম নয় তো ভীরু

__রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমার এ প্রেম নয় তো ভীরু,
নয় তো হীনবল-
শুধু কি এ ব্যাকুল হয়ে
ফেলবে অশ্রুজল।
মন্দমধুর সুখে শোভায়
প্রেম কে কেন ঘুমে ডোবায়।
তোমার সাথে জাগতে সে চায়
আনন্দে পাগল।

নাচ যখন ভীষণ সাজে
তীব্র তালের আঘাত বাজে,
পালায় ত্রাসে পালায় লাজে
সন্দেহ বিহবল।
সেই প্রচন্ড মনোহরে
প্রেম যেন মোর বরণ করে,
ক্ষুদ্র আশার স্বর্গ তাহার
দিক সে রসাতল।

আঠারো.  আছে আমার হৃদয় আছে ভরে

__রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আছে আমার হৃদয় আছে ভরে,
এখন তুমি যা খুশি তাই করো।
এমনি যদি বিরাজ’ অন্তরে
বাহির হতে সকলই মোর হরো।
সব পিপাসার যেথায় অবসান
সেথায় যদি পূর্ণ করো প্রাণ,
তাহার পরে মরুপথের মাঝে
উঠে রৌদ্র উঠুক খরতর।

এই যে খেলা খেলছ কত ছলে
এই খেলা তো আমি ভালবাসি।
এক দিকেতে ভাসাও আঁখিজলে,
আরেক দিকে জাগিয়ে তোল’ হাসি।
যখন ভাবি সব খোয়ালাম বুঝি
গভীর করে পাই তাহারে খুঁজি,
কোলের থেকে যখন ফেল’ দূরে
বুকের মাঝে আবার তুলে ধর’।

উনিশ.   অসময়

__রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বৃথা চেষ্টা রাখি দাও। স্তব্ধ নীরবতা

আপনি গড়িবে তুলি আপনার কথা।

আজি সে রয়েছে ধ্যানে—এ হৃদয় মম

তপোভঙ্গভয়ভীত তপোবনসম।

এমন সময়ে হেথা বৃথা তুমি প্রিয়া

বসন্তকুসুমমালা এসেছ পরিয়া,

এনেছ অঞ্চল ভরি যৌবনের স্মৃতি—

নিভৃত নিকুঞ্জে আজি নাই কোনো গীতি।

শুধু এ মর্মরহীন বনপথ-’পরি

তোমারি মঞ্জীর দুটি উঠিছে গুঞ্জরি।

প্রিয়তমে, এ কাননে এলে অসময়ে,

কালিকার গান আজি আছে মৌন হয়ে।

তোমারে হেরিয়া তারা হতেছে ব্যাকুল,

অকালে ফুটিতে চাহে সকল মুকুল।

বিশ.  সাধারণ মেয়ে

__রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমি অন্তঃপুরের মেয়ে,
চিনবে না আমাকে।
তোমার শেষ গল্পের বইটি পড়েছি, শরৎবাবু,
“বাসি ফুলের মালা’।
তোমার নায়িকা এলোকেশীর মরণ-দশা ধরেছিল
পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে।
পঁচিশ বছর বয়সের সঙ্গে ছিল তার রেষারেষি,
দেখলেম তুমি মহদাশয় বটে–
জিতিয়ে দিলে তাকে।

নিজের কথা বলি।

বয়স আমার অল্প।
একজনের মন ছুঁয়েছিল
আমার এই কাঁচা বয়সের মায়া।
তাই জেনে পুলক লাগত আমার দেহে–
ভুলে গিয়েছিলেম, অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে আমি।
আমার মতো এমন আছে হাজার হাজার মেয়ে,
অল্পবয়সের মন্ত্র তাদের যৌবনে।

তোমাকে দোহাই দিই,

একটি সাধারণ মেয়ের গল্প লেখো তুমি।
বড়ো দুঃখ তার।
তারও স্বভাবের গভীরে
অসাধারণ যদি কিছু তলিয়ে থাকে কোথাও
কেমন করে প্রমাণ করবে সে,
এমন কজন মেলে যারা তা ধরতে পারে।
কাঁচা বয়সের জাদু লাগে ওদের চোখে,
মন যায় না সত্যের খোঁজে,
আমরা বিকিয়ে যাই মরীচিকার দামে।

কথাটা কেন উঠল তা বলি। মনে করো তার নাম নরেশ।

সে বলেছিল কেউ তার চোখে পড়ে নি আমার মতো।
এতবড়ো কথাটা বিশ্বাস করব যে সাহস হয় না,
না করব যে এমন জোর কই।

একদিন সে গেল বিলেতে।

       চিঠিপত্র পাই কখনো বা।

মনে মনে ভাবি, রাম রাম! এত মেয়েও আছে সে দেশে,

       এত তাদের ঠেলাঠেলি ভিড়!

    আর তারা কি সবাই অসামান্য–

           এত বুদ্ধি, এত উজ্জ্বলতা।

আর তারা সবাই কি আবিষ্কার করেছে এক নরেশ সেনকে

       স্বদেশে যার পরিচয় চাপা ছিল দশের মধ্যে।

গেল মেলের চিঠিতে লিখেছে

       লিজির সঙ্গে গিয়েছিল সমুদ্রে নাইতে–

    বাঙালি কবির কবিতা ক’ লাইন দিয়েছে তুলে

       সেই যেখানে উর্বশী উঠছে সমুদ্র থেকে–

           তার পরে বালির ‘পরে বসল পাশাপাশি–

সামনে দুলছে নীল সমুদ্রের ঢেউ,

           আকাশে ছড়ানো নির্মল সূর্যালোক।

    লিজি তাকে খুব আস্তে আস্তে বললে,

“এই সেদিন তুমি এসেছ, দুদিন পরে যাবে চলে;

       ঝিনুকের দুটি খোলা,

           মাঝখানটুকু ভরা থাক্‌

    একটি নিরেট অশ্রুবিন্দু দিয়ে–

       দুর্লভ, মূল্যহীন।’

    কথা বলবার কী অসামান্য ভঙ্গি।

সেইসঙ্গে নরেশ লিখেছে,
“কথাগুলি যদি বানানো হয় দোষ কী,
কিন্তু চমৎকার–
হীরে-বসানো সোনার ফুল কি সত্য, তবুও কি সত্য নয়।’
বুঝতেই পারছ
একটা তুলনার সংকেত ওর চিঠিতে অদৃশ্য কাঁটার মতো
আমার বুকের কাছে বিঁধিয়ে দিয়ে জানায়–
আমি অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে।
মূল্যবানকে পুরো মূল্য চুকিয়ে দিই
এমন ধন নেই আমার হাতে।
ওগো, নাহয় তাই হল,
নাহয় ঋণীই রইলেম চিরজীবন।

পায়ে পড়ি তোমার, একটা গল্প লেখো তুমি শরৎবাবু,
নিতান্তই সাধারণ মেয়ের গল্প–
যে দুর্ভাগিনীকে দূরের থেকে পাল্লা দিতে হয়
অন্তত পাঁচ-সাতজন অসামান্যার সঙ্গে–
অর্থাৎ, সপ্তরথিনীর মার।
বুঝে নিয়েছি আমার কপাল ভেঙেছে,
হার হয়েছে আমার।
কিন্তু তুমি যার কথা লিখবে
তাকে জিতিয়ে দিয়ো আমার হয়ে,
পড়তে পড়তে বুক যেন ওঠে ফুলে।
ফুলচন্দন পড়ুক তোমার কলমের মুখে।

   তাকে নাম দিয়ো মালতী।

       ওই নামটা আমার।

       ধরা পড়বার ভয় নেই।

এমন অনেক মালতী আছে বাংলাদেশে,

       তারা সবাই সামান্য মেয়ে।

           তারা ফরাসি জর্মান জানে না,

               কাঁদতে জানে।

       কী করে জিতিয়ে দেবে।

উচ্চ তোমার মন, তোমার লেখনী মহীয়সী।

    তুমি হয়তো ওকে নিয়ে যাবে ত্যাগের পথে,

       দুঃখের চরমে, শকুন্তলার মতো।

           দয়া কোরো আমাকে।

       নেমে এসো আমার সমতলে।

    বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাত্রির অন্ধকারে

দেবতার কাছে যে অসম্ভব বর মাগি–
সে বর আমি পাব না,
কিন্তু পায় যেন তোমার নায়িকা।
রাখো-না কেন নরেশকে সাত বছর লণ্ডনে,
বারে বারে ফেল করুক তার পরীক্ষায়,
আদরে থাক্‌ আপন উপাসিকামণ্ডলীতে।
ইতিমধ্যে মালতী পাস করুক এম.এ.
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে,
গণিতে হোক প্রথম তোমার কলমের এক আঁচড়ে।
কিন্তু ওইখানেই যদি থাম
তোমার সাহিত্যসম্রাট নামে পড়বে কলঙ্ক।
আমার দশা যাই হোক
খাটো কোরো না তোমার কল্পনা।
তুমি তো কৃপণ নও বিধাতার মতো।
মেয়েটাকে দাও পাঠিয়ে য়ুরোপে।
সেখানে যারা জ্ঞানী, যারা বিদ্বান, যারা বীর,
যারা কবি, যারা শিল্পী, যারা রাজা,
দল বেঁধে আসুক ওর চার দিকে।
জ্যোতির্বিদের মতো আবিষ্কার করুক ওকে–
শুধু বিদুষী ব’লে নয়, নারী ব’লে।
ওর মধ্যে যে বিশ্বজয়ী জাদু আছে
ধরা পড়ুক তার রহস্য, মূঢ়ের দেশে নয়–
যে দেশে আছে সমজদার, আছে দরদি,
আছে ইংরেজ জর্মান ফরাসি।
মালতীর সম্মানের জন্য সভা ডাকা হোক-না,
বড়ো বড়ো নামজাদার সভা।
মনে করা যাক সেখানে বর্ষণ হচ্ছে মুষলধারে চাটুবাক্য,
মাঝখান দিয়ে সে চলেছে অবহেলায়–
ঢেউয়ের উপর দিয়ে যেন পালের নৌকো।
ওর চোখ দেখে ওরা করছে কানাকানি,
সবাই বলছে ভারতবর্ষের সজল মেঘ আর উজ্জ্বল রৌদ্র
মিলেছে ওর মোহিনী দৃষ্টিতে।
(এইখানে জনান্তিকে বলে রাখি
সৃষ্টিকর্তার প্রসাদ সত্যই আছে আমার চোখে।
বলতে হল নিজের মুখেই,
এখনো কোনো য়ুরোপীয় রসজ্ঞের
সাক্ষাৎ ঘটে নি কপালে।)
নরেশ এসে দাঁড়াক সেই কোণে,
আর তার সেই অসামান্য মেয়ের দল।

আর তার পরে?

তার পরে আমার নটেশাকটি মুড়োল,
স্বপ্ন আমার ফুরোল।
হায় রে সামান্য মেয়ে!
হায় রে বিধাতার শক্তির অপব্যয়!

 

শেষ কথা 

শতবছর আগে লেখা কবিগুরুর প্রেমের কবিতাগুলি আজও অমর।  তার বেশিরভাগ কবিতাগুলি গানে রূপান্তরিত হয়ে এখনো আমাদের বৃষ্টিবিলাস, চাঁদনী রাতে জ্যোস্নাস্নান কিংবা নিভৃতে আমাদের সঙ্গ দেয়।  এই জাতীয় আরোও লেখা পেতে আমাদের ব্লগে চোখ রাখুন।  

Scroll to Top