সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি ও বাংলাদেশ রচনা | ২০ টি পয়েন্ট | উক্তি সহকারে ২৫০০+ শব্দ | pdf download

সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি ও বাংলাদেশ রচনা

প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুর আজকে আমরা হাজির হয়েছি খুবই একটি  গুরুপ্তপূর্ণ “সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি ও বাংলাদেশ রচনা ” রচনা  নিয়ে। রচনাটি ২০ টি পয়েন্টে ২৫০০+ শব্দে , প্রয়োজনীয় উক্তি ও কবিতা সহকারে লেখা। যা এসএসসি , এচইএসসি সহ যেকোনো চাকরির এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য তোমাদের অনেক সাহায্য করবে।   

  সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি ও বাংলাদেশ

বা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি 

বা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গুরুপ্ত 

বা, অসম্প্রদায়িক চেতনা 

ভূমিকা 

যেখানে সূর্য উঠে, সেখানে সন্ধ্যে নামে, যেখানে নদী বয়ে যায়, সেখানেই সভ্যতা ডানা মেলে আর যেখানে মানুষ বাস করে, সেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি থাকা উচিত। মানুষ প্রকৃতিতে একমাত্র প্রজাতি যাদের মধ্যে সামাজিকতা ও সহযোগিতার প্রবণতা রয়েছে। আমরা একসাথে বসবাস করি, একসাথে কাজ করি, এবং একসাথে আনন্দ করি। তাই তো কবি বলেছেন- 

‘ জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে। সে জাতির নাম মানবজাতি।’ 

কিন্তু আমাদের এই সামাজিকতা প্রায়ই ধর্ম, জাতি, বা গোষ্ঠীগত পরিচয়ের ভিত্তিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই বিভক্তি সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, বিভেদ, এবং অস্থিরতার দিকে নিয়ে যায়। যার রক্তাক্ত ইতিহাস আমারদের ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে। আশার কথা বর্তমানের বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির এক রোল মডেলে পরিনিত হয়েছে। 

সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির স্বরূপ 

সাম্প্রদায়িকতা হল বিশেষ ধরনের বিরুপ মনোভাব। কোন ব্যক্তির মনোভাবকে তখনই সাম্প্রদায়িক বলে আখ্যা দেওয়া হয়, যখন সে কোন এক বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ এবং ক্ষতিসাধন করতে প্রস্তুত থাকে। সাম্প্রদায়িকতার মূল ভিত্তি হল ধর্মীয় গোঁড়ামি, অসহিষ্ণুতা এবং বিদ্বেষ। সাম্প্রদায়িকতা একটি বিপজ্জনক ব্যাধি যা সামাজিক সম্প্রীতি এবং ঐক্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

অন্যদিকে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি হল বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া, সহযোগিতা এবং সহাবস্থান। সেখানে সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে কোনো জাত্যভিমান থাকে না। কেউ কাউকে ছোট ভাবে না। কেউ কাউকে বড় ও ভাবে না। কেউ নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করে না। কেউ কাউকে শত্রু হিসেবে গণ্য করে না।  সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি একটি সুস্থ দেশ ও সমাজের জন্য অপরিহার্য।

উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস 

উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস একটি দীর্ঘ এবং জটিল ইতিহাস। এটি ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকে শুরু হয় এবং আজও অব্যাহত রয়েছে।

ব্রিটিশ শাসনের আগে, উপমহাদেশে বিভিন্ন ধর্মের লোকেরা শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করত। তবে, ব্রিটিশরা যখন ভারতে আসেন, তখন তারা ধর্মের ভিত্তিতে শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। এই ব্যবস্থায় মুসলিমদের জন্য আলাদা আইন প্রণয়ন করা হয় এবং তাদের জন্য আলাদা নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ করা হয়। এটি মুসলিমদের মধ্যে একটি আলাদা জাতীয়তাবোধের বিকাশ ঘটায়।১৯২২ থেকে ১৯২৭-এর মধ্যে ১১২টি দাঙ্গার কথা জানা যায় এবং এতে অসংখ্য লোকের প্রাণহানি ঘটে। ১৯৩০ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরই ভারতে দাঙ্গা সংঘটিত হয়। ১৯৪৬ সালের বিহার দাঙ্গা ছিল এই অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার একটি ভয়াবহ উদাহরণ। এই দাঙ্গায় প্রায় ১০০,০০০ মানুষ নিহত হয়েছিল এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। দাঙ্গার কারণগুলি এখনও বিতর্কিত, তবে অনেক বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন যে এটি ব্রিটিশদের ভারত ত্যাগের পূর্বে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র পাকিস্তানের সৃষ্টির সাথে সম্পর্কিত ছিল। ১৯৯২ সালের বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার পর দাঙ্গা ও ২০০০ সালের গুজরাট দাঙ্গা ছিল এই অঞ্চলে বড় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এই দাঙ্গায় প্রায় ১,০০০ মানুষ নিহত হয়েছিল এবং হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছিল।  

এই দাঙ্গা গুলো উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার দীর্ঘ ইতিহাসের একটি ধারাবাহিকতা। এই দাঙ্গা গুলোর কারণে উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ও শত্রুতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই দাঙ্গা গুলোকে প্রতিরোধ করার জন্য এবং উপমহাদেশে শান্তি ও সম্প্রীতির সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও বাংলাদেশ

বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, এবং মুসলিমসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বসবাস করে। এই বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সম্প্রীতি বিদ্যমান।কিন্তু এই সংস্কৃতিতে হিন্দু, বৌদ্ধ, এবং মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটেছে। ধর্ম ও বিশ্বাসে ভিন্নতা সত্ত্বেও বাঙালি হিন্দু-মুসলিমের সংস্কৃতি অনেকাংশে সাদৃশ্যপূর্ণ।

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির দীর্ঘ ইতিহাস আছে। হিন্দু-মুসলিম বার ভূইয়াগণ সম্মিলিতভাবেই মোগল সৈন্যদের প্রতিরোধ করে বাংলার স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রেখেছেন। মুসলিম শাসনামলে সরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নিয়োগ দেয়ার অসংখ্য নজির আছে। ব্রিটিশ শাসকরা ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতিতে এ দেশের হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করে। অনেক দিন পরে হলেও বৃটিশদের এ অপনীতি বুঝতে পেরে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যবদ্ধভাবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করেছে।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সুদৃঢ় হয়েছে। কিন্তু অনেক সময় স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি-গোষ্ঠী বা দল ভিন্ন ধর্মের বিশ্বাস ও লোকদের ওপর আক্রমণ করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা করেছে। বিভিন্ন সময় অতর্কিতভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘর ও ধর্মীয় উপসানলয়ে আক্রমণের ঘটনাও ঘটেছে। নিকট অতীতে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উপর আক্রমণ এবং পাবনার সাঁথিয়ায় ও ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘর-বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। 

 আমাদের সামাজিক বন্ধনও হৃদ্যতাপূর্ণ। হিন্দু-মুসলমানের মিলিত সংস্কৃতি বাঙালি সংস্কৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।  উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে আজানের ধ্বনি শুনতে পাওয়ার পাশাপাশি শঙ্খধ্বনি বেজে ওঠে। বোরকা পরিহিত মুসলিম নারীদের সাথে সিঁদুর পরা হিন্দু নারীরা একসাথে গল্প করে। ধূতি-তিলক পরা হিন্দু পুরোহিতের সাথে পাজামা-পাঞ্জাবি-টুপি-দাড়িওয়ালা মৌলভীরা একসাথে আড্ডা দেয়। হিন্দু-মুসলিম একসাথে বাউল-কীর্তন, মুশির্দী-মারফতি গান শোনে।

তাই তো কবির কবিতায় উঠে আসে, 

মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মোসলমান।

মুসলিম তার নয়ণ-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ॥ 

বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। এই সম্প্রীতি রক্ষার জন্য সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সহনশীলতা ও শ্রদ্ধাবোধ বৃদ্ধি করা জরুরি।

সাম্প্রদায়িকতার কারণ

সাম্প্রদায়িকতা একটি জটিল বিষয় এবং এর কারণগুলিও বহুমুখী। সাম্প্রদায়িকতার কারণগুলি:

  • ধর্মীয় গোঁড়ামি: ধর্মীয় গোঁড়ামি সাম্প্রদায়িকতার একটি প্রধান কারণ। ধর্মীয় গোঁড়ামি মানুষকে তাদের নিজস্ব ধর্মের বাইরের লোকেদের প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণা পোষণ করতে প্ররোচিত করে।
  • রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিততা:  এটিও সাম্প্রদায়িকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। রাজনৈতিক নেতারা প্রায়ই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাকে উস্কে দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করার চেষ্টা করে।
  • সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য: সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য মানুষকে তাদের নিজস্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও ঐক্যবদ্ধতা বোধ করতে পারে। এটি তাদের অন্য সম্প্রদায়ের লোকেদের প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণা পোষণ করতেও প্ররোচিত করে।
  • শিক্ষা ও সংস্কৃতির অভাব: শিক্ষা ও সংস্কৃতির মাধ্যমে মানুষকে ধর্মীয় সহনশীলতা ও বোঝাপড়া করতে পারে। শিক্ষা ও সংস্কৃতির অভাব মানুষকে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
  • সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা: সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা সাম্প্রদায়িকতার আরেকটি অন্যতম কারণ। সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা মানুষকে তাদের নিজস্ব সম্প্রদায়ের বাইরের লোকেদের সম্পর্কে জানতে বা বুঝতে বাধা দেয়। যা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাকে উস্কে দেয়।

সাম্প্রদায়িকতা একটি মারাত্মক সমস্যা। সাম্প্রদায়িকতার কারণে দেশে অশান্তি ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। সাম্প্রদায়িকতা সমাজে বিভাজন ও শত্রুতার জন্ম দেয়। সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

সাম্প্রদায়িকতার কালো ছোবল

সাম্প্রদায়িকতা একটি মারাত্মক সমস্যা। এটি সমাজে বিভাজন, শত্রুতা এবং সহিংসতার জন্ম দেয়। সাম্প্রদায়িকতার প্রধান সমস্যাগুলো:

ক) অর্থনৈতিক ক্ষতি: সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায় এবং উৎপাদন ব্যাহত হয়। এটি দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলে।

খ) সামাজিক ক্ষতি: সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মানুষ নিহত হয়, আহত হয় এবং বাস্তুচ্যুত হয়। এটি সমাজে বিভাজন এবং শত্রুতার জন্ম দেয়।

গ) নৈতিক অবক্ষয়: সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মানুষকে নৈতিকভাবে অবক্ষয়িত করে। এটি মানুষকে সহিংসতা, বিদ্বেষ এবং ঘৃণার দিকে ঠেলে দেয়।

ঘ) রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা: সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে। এটি দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়।

সাম্প্রদায়িকতার ফলে দেশ ও সমাজের আরও অন্যান্য ক্ষতি হয়। যেমন:

  • শিক্ষা ব্যবস্থার অবনতি
  • স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার অবনতি
  • বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস
  • দেশ ও সমাজের ভাবমূর্তির ক্ষতি

সাম্প্রদায়িকতা একটি মারাত্মক সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানের জন্য সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। 

সাম্প্রদায়িকতা প্রতিকারের উপায়

কোন সাম্প্রদায়িক বিভেদই মানবজাতির জন্য সুখকর নয়। সাম্প্রদায়িকতার কারণে দেশে অশান্তি ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। তাইতো কবিতায় কবির আহ্বান, 

হে চিরকালের মানুষ, হে সকল মানুষের মানুষ পরিত্রাণ করো ভেদচিহ্নের তিলক পরা সংকীর্ণতার ঔদ্ধত্য থেকে।

সাম্প্রদায়িকতা প্রতিকারের উপায়গুলি নিম্নরূপ:

ধর্মীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নতি: ধর্মীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতির মাধ্যমে মানুষকে ধর্মীয় সহনশীলতা ও বোঝাপড়া শেখানো যেতে পারে।  

রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে দায়িত্বশীল আচরণ: রাজনৈতিক নেতাদের অবশ্যই দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাকে উস্কে দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।  ।

সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা: সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য মানুষকে বঞ্চিত বোধ করতে বাধ্য করে, হিংসার আগুনে লালিত করে।  সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে সহায়ক হবে।

সাংস্কৃতিক বিনিময় ও সহযোগিতা বৃদ্ধি: সাংস্কৃতিক বিনিময় ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করে মানুষকে তাদের নিজস্ব সম্প্রদায়ের বাইরের লোকেদের সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে সাহায্য করা যেতে পারে।  

মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঠিক ব্যবহার:  মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টিকারী তথ্য প্রচার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি: সাম্প্রদায়িকতার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। 

এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করে সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ করা সম্ভব।  

বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত 

বাংলাদেশ একটি বহু-ধর্মীয় ও বহুজাতিক দেশ। এখানে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইত্যাদি বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বসবাস করে। এ দেশের অধিবাসীরা বাঙালি, মণিপুরি, চাকমা, মারমা প্রভৃতি নৃগোষ্ঠীতে বিভক্ত হলেও একক পরিচয়ে বাংলাদেশী।বাংলাদেশের প্রধান সংস্কৃতি বাঙালি হলেও এ দেশের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ ও প্রীতিময় করেছে সাঁওতাল-চাকমা, হাজং-ত্রিপুরাসহ অন্যান্য সংস্কৃতি। সাংস্কৃতিক এ সম্প্রীতির কারণে এদেশে খ্রিষ্টানদের বড় দিন, বৌদ্ধদের পূর্ণিমা উদযাপন, হিন্দুদের পূজা পালন এবং মুসলমানদের ঈদ উদযাপনকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সমান গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এজন্য এসব ধর্মীয় দিনগুলোতে সরকারি ছুটি থাকে। এ দেশে রোজা-পূজাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান এক সাথে উদযাপনের অনেক উদাহরণ আছে। হিন্দুদের পূজার অনুষ্ঠানে খ্রিষ্টান, মুসলমান ও বৌদ্ধদের এবং মুসলমানদের ঈদ-জলসাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হিন্দু, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদেরও দাওয়াত দেয়ার রীতি আছে। সেই থেকে বলা হয়, 

ধর্ম যার যার, উৎসব সবার 

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। এই যুদ্ধে ধর্মীয় সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিল। বাংলাদেশের জনগণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সহনশীলতার জন্য অত্যন্ত সচেতন। তারা সাম্প্রদায়িক হানাহানি ও সহিংসতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করে।

ধর্মীয় দৃষ্টিতে সাম্প্রদায়িকতা 

ধর্মীয় দৃষ্টিতে সাম্প্রদায়িকতা একটি ঘৃণ্য ও নিন্দনীয় বিষয়। কোন ধর্মই সাম্প্রদায়িকতা বা চরমপন্থাকে সমর্থন করে না। বরং, সকল ধর্মই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সম্প্রীতির শিক্ষা দেয়।

ইসলামের দৃষ্টিতে সাম্প্রদায়িকতা

ইসলামের দৃষ্টিতে সকল মানুষ সমান, কারও উপর কারও বড়ত্ব নেই। তাই সকল মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতি থাকা উচিত। ইসলামে সাম্প্রদায়িকতা বা চরমপন্থার কোন স্থান নেই। ইসলামে আছে, 

ধর্মের ব্যাপারে কোনাে জবরদস্তি নেই।

হিন্দু ধর্মের দৃষ্টিতে সাম্প্রদায়িকতা

হিন্দু ধর্মের দর্শনে, সাম্প্রদায়িকতা বা চরমপন্থার কোন স্থান নেই। হিন্দুধর্মের ধর্মগ্রন্থ বেদ পুরাণে বলা হয়েছে,

 “সকল মানুষই পরমাত্মার অংশ। তাই সকল মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতি থাকা উচিত।”

বৌদ্ধ ধর্মের দৃষ্টিতে সাম্প্রদায়িকতা

বৌদ্ধধর্মের মূলমন্ত্র হল অহিংসা ও সহানুভূতি। বৌদ্ধধর্মে সকল মানুষকে সমান মনে করা হয়। 

বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম বুদ্ধ বলেছেন, 

“অহিংসা ধর্মের মূল। তাই সকল প্রাণীর প্রতি অহিংসা প্রদর্শন করা উচিত।”

খ্রিস্টান ধর্মের দৃষ্টিতে সাম্প্রদায়িকতা

খ্রিস্টান ধর্মের মূলমন্ত্র হল প্রেম ও ক্ষমা। খ্রিস্টান ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা যীশু খ্রিস্ট বলেছেন,

 “তোমরা সকলকে ভালোবাসবে, তোমাদের শত্রুকেও ভালোবাসবে।”

সকল ধর্মই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সম্প্রীতির শিক্ষা দেয়। কোন ধর্মই সাম্প্রদায়িকতা বা চরমপন্থাকে সমর্থন করে না।  তাই সকল ধর্মের মানুষকে সাম্প্রদায়িকতা ও চরমপন্থার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করতে হবে।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি রক্ষায় গণমাধমের ভূমিকা

১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় গণহত্যায় গণমাধ্যমের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত নেতিবাচক। রুয়ান্ডা রেডিও স্টেশন “হোমানে রুয়ান্ডা” সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টিকারী তথ্য প্রচার করে গণহত্যায় ভূমিকা পালন করেছিল। এই রেডিও স্টেশনটি তুতসি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়িয়ে দিয়েছিল। ফলে রুয়ান্ডায় তুতসি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে গণহত্যা সংঘটিত হয়। কিন্তু

গণমাধ্যম হল একটি শক্তিশালী হাতিয়ার যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। 

ভারতের উপমহাদেশের ইতিহাসে গণমাধ্যম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও সহিংসতার সময় গণমাধ্যম শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা প্রচার করেছে।  গণমাধ্যম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। গণমাধ্যমের মাধ্যমে জনগণকে ধর্মীয় সহনশীলতা ও সম্প্রীতির শিক্ষা দেওয়া যায়। 

সম্পদিয়িকতা রক্ষায় শিল্প সাহিত্য  

 ব্রিটিশ শাসনের পাততাড়ি গোটানোর কালে ভারতবর্ষ হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক জ্বরে উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল। প্রায় হাজার বছর ধরে পাশাপাশি বসবাসকারী এই দুই বৃহত্তর সম্প্রদায়ের নেতারা তখন ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের দুঃস্বপ্নে বিভোর ছিলেন।

 বাঙালি কবি, সাহিত্যিক ও শুভবুদ্ধি-সম্পন্ন মানুষরা এই হিংসা ও হানাহানি পছন্দ করেননি কখনো। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মতো দুই প্রধান শক্তিমান কবি ধর্মের ভিত্তিতে দেশ বিভাগ রোধ এবং হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক সংকট নিরসনে সারাজীবন কাজ করে গেছেন। 

তাই তো নজরুল লিখেছিলেন, 

‘মানবতার এই মহান যুগে একবার

গণ্ডী কাটিয়া বাহির হইয়া আসিয়া বল যে,

তুমি ব্রাহ্মণ নও, শূদ্র নও, হিন্দু নও, মুসলমানও নও,

তুমি মানুষ- তুমি ধ্রুব সত্য।’

রবীন্দ্রনাথ জীবন-সায়াহ্নে এসে উনিশ’শ একচল্লিশ সালের জুন মাসের শেষের দিকে শুভবোধের তাড়নায় লিখলেন ‘মুসলমানীর গল্প’। এই গল্পের প্রতিপাদ্য ছিল- ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কের ধরন নির্ণয়। এই গল্পে তিনি ভারতবর্ষের অসাম্প্রদায়িক চেতনা নির্মাণে মুসলমানদের অবদান অকুণ্ঠ চিত্তে স্বীকার করেছেন। 

মধ্যযুগের সাহিত্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রিতিঃ  প্রদাস পিপলাইয়ের ‘মনসাবিজয়’ কাব্যে বেহুলা-লখিন্দরের লোহার বাসর ঘরে পুত্রের কল্যাণার্থে মুসলমানের ধর্মগ্রন্থ কোরআন রেখে দিয়েছিলেন চাঁদ সদাগর। মঙ্গলকাব্যের সময়কালে মুসলিম কবিদের রচিত রোমান্টিক-প্রণয়োপাখ্যানগুলোতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের মিথস্ক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়।এই ঐতিহ্যের সম্প্রসারিত রূপ আমরা দেখতে পাই মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ উপন্যাসে, যেখানে তিনি আজর নামে এক মূর্তিপূজককে নবী-দৌহিত্রের সম্মান রক্ষায় পুরো পরিবারসহ আত্মত্যাগ দেখিয়েছেন। 

মধ্যযুগে গৌরাঙ্গ শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত বৈষ্ণব আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়ে চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাসের মতো অসংখ্য কবি বহু অমর পদ রচনা করেছেন। এটি হিন্দু ধর্মীয় ভাব আন্দোলন বলে মুসলমান কবিরা দূরে থাকেননি, তারাও রচনা করেছেন রাধা-কৃষ্ণকে নিয়ে অসংখ্য ভক্তি সংগীত। এদের মধ্যে আলাওল, আফজল, সৈয়দ সুলতান, সৈয়দ মুর্তজা, আলী রেজা প্রধান। তাদের রচনার ভাব ও বিষয় হিন্দু রচিত পদ থেকে কোনো অংশে কম নয়। তাদের রাধা-কৃষ্ণের জীবাত্মা-পরমাত্মার ভাবরসের সঙ্গে ইসলামি সুফিতত্ত্বের দর্শন একাকার হয়ে গিয়েছিল।

আধুনিক যুগের সাহিত্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রিতিঃ  বিশ শতকের সূচনালগ্নে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাবের আগে মীর মশাররফ হোসেন ছাড়া উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের পক্ষে শক্তিশালী সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না।বিশ শতকের প্রথমার্ধে কাজী নজরুল তার সাহিত্যে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতার পাশাপাশি ব্যাপকভাবে হিন্দু-মুসলিম মিলনে কাজ করেছিলেন। এমনকি ধর্মের ভিত্তিতে ভারতভাগ তিনি সমর্থন করেননি। তার পরবর্তীকালের কবি-সাহিত্যিকগণের মধ্যেও এ ধারা অব্যাহত থাকে। কলকাতার গ্রেটকিলিংয়ের সময়ে জীবনানন্দ দাশ ‘১৯৪৬-৪৭’ নামে কবিতায় লিখেছিলেন-

‘মানুষ মেরেছি আমি- তার রক্তে আমার শরীর

ভ’রে গেছে; পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল অসাম্প্রদায়িকতা। পাকিস্তান সরকারের উগ্র সাম্প্রদায়িক নীতির বিরুদ্ধে বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এই অসাম্প্রদায়িকতার টানেই। 

নজরুল চেতনায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি

উপনিবেশকে আঁকড়ে রাখার মানসে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সুচতুর কৌশলে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করেছিল ভারতবর্ষে ভারতের দুই বৃহৎ ধর্ম-সম্প্রদায় পরস্পর বিভেদে জড়িয়ে পড়েছে বার বার। এর পশ্চাতে ছিল একাধিক রাজনৈতিক দলের ইন্ধন। এই সাম্প্রদায়িক বিভেদ নজরুলকে ব্যথিত করেছে। তাই তিনি সচেতনভাবে হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ সম্প্রীতি প্রত্যাশা করেছেন।সত্য-সুন্দর-কল্যাণের পূজারি নজরুল চেয়েছেন সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে মানুষের মুক্তি। বস্তুত, সাম্যবাদী চিন্তা তাঁর মানসলোকে সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ মানবসত্তার জন্ম দিয়েছে- হিন্দু ও মুসলমান বৈপরীত্যের দ্যোতক না হয়ে তাঁর চেতনায় হতে পেরেছে জাতিসত্তার পরিপূরক দুই শক্তি।  তিনি লিখেছিলেন, 

হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?

কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার

-কাজী নজরুল ইসলাম।

সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে বিভেদ ও অনৈক্য সম্পর্কে নজরুল ইতিবাচক চিন্তা করেছেন। তার নিজের জীবনে তিনি হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ধর্মপ্রাণ মুসলমানের ঘরে জন্মগ্রহণ করেও জাতধর্ম অক্ষুণ্ন রেখে হিন্দু মেয়ের পাণিগ্রহণ করেছিলেন। নিজের পুত্রদের নাম হিন্দু-মুসলমানের মিলিত ধারার সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছিলেন। মুসলমানের ধর্মকে নিয়ে তিনি যত গান-কবিতা লিখেছেন, হিন্দুর দেবতাকে নিয়ে তার চেয়ে কম লেখেননি। সাম্প্রদায়িক কলহের দুর্বলতা দিয়ে ভারতের মুক্তি সম্ভব নয়। নজরুল এ কারণেই ভারতীয়দের শক্তির দুর্বলতর সূত্রগুলো ‘যুগবাণী’ ও অন্যান্য পর্বের সম্পাদকীয় রচনায় বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি জানতেন হিন্দু মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ শক্তির দুর্বার আঘাতেই ব্রিটিশ শাসনশৃঙ্খল ভাঙা সম্ভব। নজরুল আহ্বানও জানিয়েছেন ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের।

সাম্প্রদায়িকতা বনাম একতা

সাম্প্রদায়িকতা হল একটি নেতিবাচক ধারণা। সাম্প্রদায়িকতা হল বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ ও বিদ্বেষ। সাম্প্রদায়িকতা সমাজে অশান্তি ও সহিংসতার জন্ম দেয়। অন্যদিকে একতা হল একটি ইতিবাচক ধারণা। একতা হল বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রীতি ও সহনশীলতা। একতা সমাজে শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্ম দেয়।

সাম্প্রদায়িকতা বনাম একতার মধ্যে পার্থক্য

বৈশিষ্ট্যসাম্প্রদায়িকতাএকতা
সংজ্ঞাবিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ ও বিদ্বেষবিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রীতি ও সহনশীলতা
প্রভাবসমাজে অশান্তি ও সহিংসতাসমাজে শান্তি ও সমৃদ্ধি
ফলাফলব্যক্তি, পরিবার, দেশ ও জাতির ধ্বংস এবং বিশ্ব অশান্তিব্যক্তি, পরিবার, দেশ ও জাতির উন্নতি এবং বিশ্ব শান্তি

 

তাই বেচে নিতে হবে একতাকে। কেননা, পৃথিবীটা আমার দেশ, সমস্ত মানব জাতি আমার ভাই এবং সবার ভালো করাই আমার ধর্ম।

সাম্প্রদায়িক জাতির পরিণতি 

সাম্প্রদায়িক জাতির পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ ও ধ্বংসাত্মক। ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে যে সাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনা শুধুমাত্র নিরীহ মানুষের দুঃখকষ্টই বাড়ায় না, বরং সমগ্র জাতিকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়।

ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ উদাহরণ হল হিটলারের নাৎসি জার্মানি। সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের বিষাক্ত আদর্শের উপর নির্মিত এই রাষ্ট্র ইহুদিদের ওপর ব্যাপক গণহত্যা চালায়, যা ইতিহাসে হলোকাস্ট নামে পরিচিত। এই ঘটনাটি সাম্প্রদায়িকতার কতটা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে, তার চরম নিদর্শন। এর ফলে ইহুদি ও জার্মান দুই জাতি অনেক ভোগান্তির স্বীকার হয়। ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় হুতু ও তুতসি গোষ্ঠীর মধ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যা অবশেষে একটি ভয়াবহ গণহত্যায় রূপ নেয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত হয় এই ঘটনায়। এতে দেশ দারিদ্র্যর কবেলে পড়ে। তেমনিভাবে,  ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের বিভাজনের সময় হিন্দু ও মুসলিম গোষ্ঠীর মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। এই দাঙ্গায় লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত হয় এবং কোটি কোটি মানুষ উচ্ছেদ হয়ে যায়। এতে করে ভাতর পাকিস্থান ও বাংলাদেশ অনেক বছর পিছিয়ে যায়। তাই, সাম্প্রদায়িকটা কক্ষনোই ভালো ফল বয়ে আনে না, কারও জন্যই কল্যাণকর নয়। 

 

জাতীয় জীবনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রয়োজনীয়তা

জাতীয় জীবনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গুরুত্ব অপরিসীম। মাহাত্মা গান্ধীর ভাষায়, 

যখন আপনার চিন্তা, আপনার কথা আর আপনার কাজের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় থাকবে, তখনই প্রকৃত সুখী হবেন।  

তিনি বিশ্বাস করতেন যে শান্তি অর্জনের জন্য, আমাদের চিন্তা, কথা এবং কাজের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকতে হবে। আর একমাত্র অসাম্প্রদায়িক মানুষেই পারে এই করতে, যা তার নিজের ও সমাজের জন্য সুখ শান্তি বয়ে আনে। জাতীয় জীবনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি একটি অপরিহার্য বিষয়। যেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজ করে সেখানে শান্তি, সমৃদ্ধি ও উন্নতি বিরাজ করে। কিন্তু যে জাতি সাম্প্রদায়িক বিভাজনে জর্জরিত সেখানে অশান্তি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও সহিংসতা বিরাজ করে।

সাম্প্রদায়িকতা ও বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি 

বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য অত্যন্ত কঠিন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষ বিভিন্নভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, যা সাম্প্রদায়িকতার উন্মাদনা ছড়িয়ে দিচ্ছে।

  • ইসরায়েল-ফিলিস্তিন: দীর্ঘদিনের সংঘাত ও দখলদারির কারণে এই অঞ্চলে শান্তি এখনও প্রতিষ্ঠা হয়নি, এবং দিন দিন সংঘাত বেড়েই যাচ্ছে।
  • ইউক্রেন-রাশিয়া: রাশিয়ার সাথে চলমান যুদ্ধ ইউক্রেনীয় ও রুশ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজন তৈরি করেছে। দুই দেশেই এখন ক্ষতির সম্মুখীন। 
  • ভারত-পাকিস্তান: ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক চাপ, ধর্মীয় মতবিরোধ এবং কাশ্মীর ইস্যু হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন তৈরি করেছে। মাঝে মধ্যেই দুই দেশ লারাইয়ে জরিয়ে পড়ছে। 
  • মধ্যপ্রাচ্য: ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব, ইয়েমেন, ইরাক, সিরিয়ার গৃহজুধ  এবং মিশরের রাজনৈতিক সংকট ইত্যাদি মানবিক সংকট তৈরি করেছে।
  • রোহিঙ্গা সংকট: মায়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সংঘটিত নির্যাতন ও গণহত্যা বিশ্বজুড়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য এখন একটি বড় ধাক্কা। মিয়েনমার নিজেও আজ ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। 

 এই অবস্থার পরিবর্তন এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য আমাদের আরো মানবিক হতে হবে। জাতিসংঘ ও অন্যান্য ধর্মীয় – সামাজিক সংঘটন কে এগিয়ে আসতে হবে। 

সম্প্রদিয়িকতা রক্ষায় আমাদের ভূমিকা 

সাম্প্রদায়িকতার কালো ছায়া ঘনিয়ে আসছে পৃথিবীর আকাশে। বিভিন্ন ধর্ম ও গোষ্ঠীর মানুষ অবিশ্বাসের দেয়াল তুলে একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই ভয়াবহ অবস্থায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় আমাদের, প্রতিটি মানুষের, ভূমিকা অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ।

ব্যক্তি হিসেবে, আমাদের মন থেকে ঘৃণার বিষ ঝেড়ে ফেলা দরকার। প্রতিবেশী মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি, গির্জায় ঘণ্টা বা শঙ্খের সুরকে উৎপাত হিসাবে না দেখে, সেটিকে সংস্কৃতির সুর হিসেবে অনুভব করতে হবে। বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবে উৎসাহ ও শুভেচ্ছা জানানো আমাদের কর্তব্য। আর সামাজিক মাধ্যমে মিথ্যাচার বা ভুল তথ্যের প্রবাহে হাতিয়ার না হয়ে, সত্য জানার চেষ্টা করতে হবে।

পরিবার হিসেবে, বাচ্চাদের মনে ছোটবেলা থেকেই ধর্মীয় সহনশীলতার শিক্ষা দেওয়া জরুরি। তাদের বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ সম্পর্কে জানতে উৎসাহিত করতে হবে, বন্ধুদের মধ্যেও যেন বিভিন্নতা ঈর্ষার কারণ না হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। কারণ শৈশবে রোপণ করা সাম্প্রদায়িক বীজ ভবিষ্যতে মহাকাঠের মতো প্রকাট আঁকার ধারন করে।

সমাজ হিসেবে, আমাদের দায়িত্ব আরও বড়। গণমাধ্যমকে সত্য সংবাদ প্রচারের দায়িত্ব মনে করিয়ে দিতে হবে, উস্কানিমূলক প্রচারণার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবে যৌথ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা, পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র গড়ে তোলা প্রয়োজন। শিল্প সাহিত্যের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে।

রাষ্ট্র হিসেবে, সরকারকে নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে যেখানে কোনো ধর্মকে বঞ্চনা না করা হয়। শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মীয় সহনশীলতার শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। আর সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কঠোর শাস্তির বিধান থাকা উচিত।

ভবিষ্যতে, আমাদের প্রত্যেকের ছোট্ট ছোট্ট পদক্ষেপগুলি ইটের মত হয়ে  সম্প্রীতির একটা প্রাসাদ গড়ে তুলবে। আসুন, সবাই ধর্মের নামে ভিন্নতা নয়, ঐক্য গড়ার পথে হাত মিলাই!

উপসংহার 

আজ আমরা যদি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্বপ্ন দেখতে চাই, তাহলে আমাদেরকে প্রথমেই আমাদের চিন্তাভাবনাকে বদলাতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে যে, ধর্মই আমাদের একমাত্র পরিচয় নয়। আমরা সবাই মানুষ। একই মাটির সন্তান। আমাদেরকে একে অপরের ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। আমাদেরকে একে অপরের সুখ-দুঃখে পাশে থাকতে হবে। আমাদেরকে একে অপরের মধ্যে সহযোগিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তুলতে হবে। মধ্যযুগের প্রখ্যাত কবি বাংলা ভাষায় বৈষ্ণব পদাবলীর আদি রচিয়তা চণ্ডীদাসের ভাসায়, 

 সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই   

যদি আমরা সবাই একসাথে কাজ করি, তাহলেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্বপ্ন পূরণ হবে। তখনই আমরা একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধ জাতি গড়ে তুলতে পারব, গড়ে উঠবে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির বাংলাদেশ।

 

Pdf ডাউনলোড 

বন্ধুরা তোমাদের সুবিধার্থে রচনাটি পিডিএফ আকারে দেওয়া হল।  এটি ডাউনলোড করে তোমাদের মোবাইল / ল্যাপটপ / কম্পিউটারে রেখে দিতে পারো।  এই জাতীয় শিক্ষামূলক আরো লেখা পেতে নিয়মিত চোখ রাখো আমাদের ব্লগে।  ধন্যবাদ।   

 

Scroll to Top