Dreamy Media BD

ফকির লালন শাহ এর জীবনী

ফকির লালন শাহ এর জীবনী

প্রিয় পাঠকগণ আজকে আমি এমন একজনের সম্পর্কে আপনাদের সাথে আলোচনা করব যার সম্পর্কে আপনার শুধু জানতে ইচ্ছা করবে। তিনি আর কেউ নন আমাদের সকল ধর্মের প্রিয় মানুষ লালন ফকির। তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন সব ধর্মের মানুষের সাথে ছিল তার গভীর সম্পর্ক যার কারণে কেউ তার জাত ধর্ম সম্পর্কে কোনদিন জানতে পারেনি। চলুন মূল আলোচনা শুরু করি – 

লালন ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন বাঙালি; যিনি ফকির লালন, লালন সাঁই, লালন শাহ, মহাত্মা লালন ইত্যাদি নামেও পরিচিত। লালন জন্মগ্রহণ করেন ১৭৭৪ সালের ১৭ই অক্টোবর এবং তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১৮৯০ সালের ১৭ই অক্টোবর। বিখ্যাত এই ব্যক্তি একই দিনে জন্মগ্রহণ করেন আবার একই দিনে মৃত্যুবরণ করেন।

তিনি একাধারে একজন আধ্যাত্মিক ফকির সাধক, মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক এবং দার্শনিক। তিনি অসংখ্য গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক ছিলেন। লালনকে ফকিরি গানের অগ্রদূতদের অন্যতম একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং ‘। তার গানের মাধ্যমেই উনিশ শতকে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

লালন ছিলেন একজন মানবতাবাদী সাধক। যিনি ধর্ম, বর্ণ, গোত্রসহ সকল প্রকার জাতিগত বিভেদ থেকে সরে এসে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন। অসাম্প্রদায়িক এই মনোভাব থেকেই তিনি তার গান রচনা করেছেন। তার গান ও দর্শন যুগে যুগে প্রভাবিত করেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,কাজী নজরুল ও অ্যালেন গিন্সবার্গের মতো বহু খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবীসহ অসংখ্য মানুষকে। তার গানগুলো যুগে যুগে বহু সঙ্গীতশিল্পীর কণ্ঠে লালনের এই গানসমূহ উচ্চারিত হয়েছে। গান্ধীরও ২৫ বছর আগে, ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম, তাকে ‘মহাত্মা’ উপাধি দেয়া হয়েছিল।

লালন ফকিরের জীবনী

লালনের জীবন সম্পর্কে বিশদ কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। তার সবচেয়ে অবিকৃত তথ্যসূত্র তার নিজের রচিত ২৮৮টি গান। কিন্তু লালনের কোনো গানে তার জীবন সম্পর্কে কোনো তথ্য তিনি রেখে যাননি, তবে কয়েকটি গানে তিনি নিজেকে “লালন ফকির” হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। তার মৃত্যুর পনেরো দিন পর কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত হিতকরী পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, “ইহার জীবনী লিখিবার কোন উপকরণ পাওয়া কঠিন। নিজে কিছু বলিতেন না। শিষ্যরা তাঁহার নিষেধক্রমে বা অজ্ঞতাবশত কিছুই বলিতে পারে না।”

লালনের জন্ম কোথায় তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। লালন নিজে কখনো তা প্রকাশ করেননি। কিছু সূত্রে পাওয়া যায় লালন ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশের) ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুন্ডু উপজেলার হারিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কোনো কোনো লালন গবেষক মনে করেন, লালন কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানার চাপড়া ইউনিয়নের অন্তর্গত ভাড়ারা গ্রামে জন্মেছিলেন। এই মতের সাথেও অনেকে দ্বিমত পোষণ করেন।

বাংলা ১৩৪৮ সালের আষাঢ় মাসে প্রকাশিত মাসিক মোহম্মদী পত্রিকায় এক প্রবন্ধে লালনের জন্ম যশোর জেলার ফুলবাড়ি গ্রামে বলে উল্লেখ করা হয়। একসূত্র থেকে জানা যায়, তার পিতার নাম কাজী দরীবুল্লাহ্ দেওয়ান। পিতামহের নাম কাজী গোলাম কাদির ও মাতার নাম আমিনা খাতুন। কাজী তাদের বংশগত উপাধি। গবেষকদের ধারণা, লালন শাহের আরো দুই ভাই ছিলেন। আলম শাহ্ ও কলম শাহ্।

আলম শাহ্ কলকাতা শ্রমিকের কাজ করেন। আরেক তথ্য থেকে জানা যায়, তারা চার ভাই: আলম শাহ্, কলম শাহ্, চলম শাহ্ ও লালন শাহ্। চলম শাহ নামে ভাই ছিল না বলে মনে করা হলেও মলম শাহ্ নামে আরেক ভাই ছিলেন। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে আলম ও মলম মৃত্যুমুখে পতিত হন। লালন ফকির জীবকা জন্য হরিশপুরের দক্ষিণ পাড়ার ইনু কাজীর বাড়ি আশ্রয় নেন।

হিতকরী পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ নিবন্ধে বলা হয়েছে, লালন তরুণ বয়সে একবার তীর্থভ্রমণে বের হয়ে পথিমধ্যে গুটিবসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। তখন তার সাথীরা তাকে মৃত ভেবে পরিত্যাগ করে যার যার গন্তব্যে চলে যায়। কালিগঙ্গা নদীতে ভেসে আসা মুমূর্ষু লালনকে উদ্ধার করেন মলম শাহ। মলম শাহ ও তার স্ত্রী মতিজান তাকে বাড়িতে নিয়ে সেবা-শুশ্রূষা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। এরপর লালন তার কাছে দীক্ষিত হন এবং কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়াতে স্ত্রী ও শিষ্যসহ বসবাস শুরু করেন। গুটিবসন্ত রোগে একটি চোখ হারান লালন। ছেউড়িয়াতে তিনি দার্শনিক গায়ক সিরাজ সাঁইয়ের সাক্ষাতে আসেন এবং তার দ্বারা প্রভাবিত হন।

এছাড়াও জানা গেছে লালন ফকির ছিলেন একজন সংসারী মানুষ। তার অল্প কিছু জমি জামা ও বাড়িঘর রয়েছে। জানা গেছে তিনি অচরণে প্রচুর দক্ষ ছিলেন। তিনি তার শেষ বয়সে অশ্বারোহণের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতেন।

Lalon Shah
Lalon Shah

লালন শাহ এর ধর্মবিশ্বাস

লালন শাহের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে, যা তার জীবিত কালেও বিদ্যমান ছিল। তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত প্রবাসী পত্রিকার মহাত্মা লালন নিবন্ধে প্রথম লালন জীবনী রচয়িতা বসন্ত কুমার পাল বলেছেন, “সাঁইজি হিন্দু কি মুসলমান, একথা আমিও সঠিকভাবে বলতে পারব না।” বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় লালনের জীবদ্দশায় তাকে কোনো ধরনের ধর্মীয় রীতি-নীতি পালন করতেও দেখা যায়নি।

লালনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। নিজ ইচ্ছা শক্তির বলে তিনি হিন্দুধর্ম এবং ইসলামধর্ম উভয় ধর্মের শাস্ত্র সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান লাভ করেন। তার রচিত গানে এসব শাস্ত্রের জ্ঞান লাভের পরিচয় পাওয়া যায়। 

প্রবাসী পত্রিকার নিবন্ধন থেকে জানা যায়, লালনের সব ধর্মের মানুষের সাথেই সুসম্পর্ক ছিল। মুসলমানদের সাথে তার ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে অনেকে তাকে মুসলমান বলে মনে করতেন। আবার বৈষ্ণবধর্মের আলোচনা করতে দেখে হিন্দুরা তাকে বৈষ্ণব মনে করতেন। প্রকৃতপক্ষে লালন ছিলেন মানবতাবাদী এবং তিনি ধর্ম,  কূল, জাত, বর্ণ, লিঙ্গ ইত্যাদি অনুসারে মানুষের ভেদাভেদ বিশ্বাস করতেন না।

বার্ষিক মোহাম্মদের পত্রিকা এক প্রবন্ধ থেকে জানা যায় লালনশা জন্মগ্রহণ করেছেন মুসলিম পরিবারে। আবার অন্য এক তথ্যসূত্র থেকে জানা যায় তার জন্ম হিন্দু পরিবারে বলে উল্লেখ করা হয়।

লালনের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন,

“লালন ধার্মিক ছিলেন, কিন্তু কোনো বিশেষ ধর্মের রীতিনীতি পালনে আগ্রহী ছিলেন না। সব ধর্মের বন্ধন ছিন্ন করে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন জীবনে”

লালনের পরিচয় দিতে গিয়ে সুধীর চক্রবর্তী লিখেছেন,

মীর মশাররফ চিনতেন, ঠাকুরদের হাউসবোটে যাতায়াত ছিল, লেখক জলধর সেন বা অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় তাঁকে সামনাসামনি দেখেছেন কতবার, গান শুনেছেন, তবুও কেউ কখনো জানতে পারেনি লালনের জাত পরিচয় কি সে কোন ধর্মের মানুষ।

একটি গানে লালনের প্রশ্ন

এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে।

যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান

জাতি গোত্র নাহি রবে।

কিছু লালন অনুসারী যেমন মন্টু শাহের মতে, তিনি হিন্দু বা মুসলমান কোনোটিই ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন ওহেদানিয়াত নামক একটি নতুন ধর্মীয় মতবাদের অনুসারী। ওহেদানিয়াতের মাঝে বৌদ্ধধর্ম এবং বৈষ্ণব ধর্মের সহজিয়া মতবাদ, সুফিবাদসহ আরও অনেক ধর্মীয় মতবাদ বিদ্যমান। লালনের অনেক অনুসারী লালনের গানসমূহকে এই আধ্যাত্মিক মতবাদের কালাম বলে অভিহিত করে থাকে।

লালন মূলত অসাম্প্রদায়িক ও মানবধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন।

লালন ফকিরের আখড়া

লালন কুষ্টিয়ার কুমারখালি উপজেলার ছেউড়িয়াতে একটি আখড়া তৈরি করেন, যেখানে তিনি তার শিষ্যদের নীতি ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিতেন। লালনের আখড়া, যেখানে বর্তমানে তার মাজার অবস্থিত।

তার শিষ্যরা তাকে “সাঁই” বলে সম্বোধন করতেন। তিনি প্রতি শীতকালে আখড়ায় একটি ভান্ডারা (মহোৎসব) আয়োজন করতেন। যেখানে সহস্রাধিক শিষ্য ও সম্প্রদায়ের লোক একত্রিত হতেন এবং সেখানে সংগীত ও আলোচনা হত।

চট্টগ্রাম, রংপুর, যশোর এবং পশ্চিমে অনেক দূর পর্যন্ত বাংলার ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বহুসংখ্যক লোক লালন ফকিরের শিষ্য ছিলেন; শোনা যায় তার শিষ্যের সংখ্যা প্রায় দশ হাজারের বেশি ছিল।

লালনের আখড়া
লালনের আখড়া

লালনের শিষ্যদের কথা

লালনের শিষ্যের মধ্যে অন্যতম ছিলেন পাঞ্জু শাহ, ভোলাই শাহ, মলম শাহ, শীতল শাহ, মনিরুদ্দিন, যাদের কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সংস্কৃতি ও লোকায়ত ধর্মের সম্পর্কে জানেন। লালন সাঁইজির সঙ্গে তার উত্তরাধিকার সম্পর্ক–লতিকার পর্যায়ক্রমটা এই রকম: ফকির লালন শাহ, ভোলাই শাহ, কোকিল শাহ, লবান শাহ ওরফে আব্দুর রব শাহ, তারপরই ফকির নহির শাহ। আব্দুর রব শাহর প্রধান খলিফা ফকির নহির একাধারে আধ্যাত্মিক গুরু, ভাবসংগীতের শিক্ষক এবং সংগীত সংগ্রাহক।

ঠাকুর পরিবারের সাথে সম্পর্ক

কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের অনেকের সঙ্গে লালনের পরিচয় ছিল বলে বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া যায়। বিরাহিমপুর পরগনায় ঠাকুর পরিবারের জমিদারিতে ছিল তার বসবাস এবং ঠাকুর-জমিদারদের প্রজা ছিলেন তিনি। উনিশ শতকের শিক্ষিত সমাজে তার প্রচার ও গ্রহণযোগ্যতার পেছনে ঠাকুর পরিবার বড় ভূমিকা রাখেন।

কিন্তু এই ঠাকুরদের সঙ্গে লালনের একবার সংঘর্ষ ঘটে। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের কুষ্টিয়ার কুমারখালির কাঙাল হরিনাথ মজুমদার গ্রামবার্তা প্রকাশিকা নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। এরই একটি সংখ্যায় ঠাকুর-জমিদারদের প্রজাপীড়নের সংবাদ ও তথ্য প্রকাশের সূত্র ধরে উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মকর্তারা বিষয়টির তদন্তে প্রত্যক্ষ অনুসন্ধানে আসেন।

এতে করে কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের উপর বেজায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন ঠাকুর-জমিদারেরা। তাঁকে শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে লাঠিয়াল পাঠালে শিষ্যদের নিয়ে লালন সশস্ত্রভাবে জমিদারের লাঠিয়ালদের মোকাবিলা করেন এবং লাঠিয়াল বাহিনী পালিয়ে যায়। এর পর থেকে কাঙাল হরিনাথকে বিভিন্নভাবে রক্ষা করেছেন লালন।

লালনের জীবদ্দশায় তার একমাত্র স্কেচটি তৈরী করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। লালনের মৃত্যুর বছরখানেক আগে ৫ মে ১৮৮৯ সালে পদ্মায় তার বোটে বসিয়ে তিনি এই পেন্সিল স্কেচটি করেন- যা ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। যদিও অনেকের দাবী এই স্কেচটিতে লালনের আসল চেহারা ফুটে ওঠেনি।

Lalon Shah scatch

মৃত্যু

লালন ১৮৯০ সালের ১৭ই অক্টোবর লালন ১১৬ বছর বয়সে কুষ্টিয়ার কুমারখালির ছেউড়িয়াতে নিজ আখড়ায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর প্রায় একমাস পূর্ব থেকে তিনি পেটের সমস্যা ও হাত পায়ের গ্রন্থির সমস্যায় ভুগছিলেন। অসুস্থ অবস্থায় দুধ ছাড়া অন্য কিছু খেতেন না। এসময় তিনি মাছ খেতে চাইতেন।

মৃত্যুর দিন ভোর ৫টা পর্যন্ত তিনি গান-বাজনা করেন এবং এক সময় তার শিষ্যদের বলেন, “আমি চলিলাম”, এবং এর কিছু সময় পরই তার মৃত্যু হয়। তার নির্দেশ বা ইচ্ছা না থাকায় তার মৃত্যুর পর হিন্দু বা মুসলমান কোনো ধরনের ধর্মীয় রীতি নীতিই পালন করা হয় নি। তিনি তার শিষ্যদের উপদেশ দিয়েছিলেন যেন তার সমাধিটা তার নিজের তৈরি আখড়ার মধ্যে যেন করা হয়।

আজও সারা বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাউলেরা অক্টোবর মাসে ছেউড়িয়ায় মিলিত হয়ে লালনের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে। তার মৃত্যুর ১২ দিন পর তৎকালীন পাক্ষিক পত্রিকা মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত হিতকরী-তে প্রকাশিত একটি রচনায় সর্বপ্রথম তাঁকে ‘মহাত্মা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। রচনার লেখকের নাম রাইচরণ।

দর্শন

লালনের গানে মানুষ ও তার সমাজই ছিল মুখ্য। লালন বিশ্বাস করতেন সকল মানুষের মাঝে বাস করে এক মনের মানুষ। আর সেই মনের মানুষের সন্ধান পাওয়া যায় আত্মসাধনার মাধ্যমে। দেহের ভেতরেই মনের মানুষ বা যাকে তিনি অচিন পাখি বলেছেন, তার বাস। সেই অচিন পাখির সন্ধান মেলে পার্থিব দেহ সাধনার ভেতর দিয়ে দেহোত্তর জগতে পৌঁছানোর মাধ্যমে। আর এটাই বাউলতত্ত্বে ‘নির্বাণ’ বা ‘মোক্ষ’ বা ‘মহামুক্তি’ লাভ।

তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে মানবতাবাদকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছেন। তার বহু গানে এই মনের মানুষের প্রসঙ্গ উল্লিখিত হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করতেন মনের মানুষ এর কোন ধর্ম, জাত, বর্ণ, লিঙ্গ, কূল নেই। মানুষের দৃশ্যমান শরীর এবং অদৃশ্য মনের মানুষ পরস্পর বিচ্ছিন্ন, কিন্তু শরীরেই মনের বাস। সকল মানুষের মনে ঈশ্বর বাস করেন। লালনের এই দর্শনকে কোন ধর্মীয় আদর্শের অন্তর্গত করা যায় না।

লালন, মানব আত্মাকে বিবেচনা করেছেন রহস্যময়, অজানা এবং অস্পৃশ্য এক সত্তা রূপে। খাঁচার ভিতর অচিন পাখি গানে তিনি মনের অভ্যন্তরের সত্তাকে তুলনা করেছেন এমন এক পাখির সাথে, যা সহজেই খাঁচারূপী দেহের মাঝে আসা যাওয়া করে কিন্তু তবুও একে বন্দি করে রাখা যায় না।

লালনের সময়কালে যাবতীয় নিপীড়ন, মানুষের প্রতিবাদহীনতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি-কুসংস্কার, লোভ, আত্মকেন্দ্রিকতা সেদিনের সমাজ ও সমাজ বিকাশের সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সমাজের নানান কুসংস্কারকে তিনি তার গানের মাধ্যমে করেছেন প্রশ্নবিদ্ধ। আর সে কারণেই লালনের সেই সংগ্রামে বহু শিষ্ট ভূস্বামী, ঐতিহাসিক, সম্পাদক, বুদ্ধিজীবী, লেখক এমনকি গ্রামের নিরক্ষর সাধারণ মানুষও আকৃষ্ট হয়েছিলেন ।

আধ্যাত্মিক ভাবধারায় তিনি প্রায় দুই হাজার গান রচনা করেছিলেন। তার সহজ-সরল শব্দময় এই গানে মানবজীবনের রহস্য, মানবতা ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। লালনের বেশ কিছু রচনা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে তিনি ধর্ম-গোত্র-বর্ণ-সম্প্রদায় সম্পর্কে অতীব সংবেদনশীল ছিলেন। ব্রিটিশ আমলে যখন হিন্দু ও মুসলিম মধ্যে জাতিগত বিভেদ-সংঘাত বাড়ছিল তখন লালন ছিলেন এর বিরূদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর।

তিনি মানুষে-মানুষে কোনও ভেদাভেদে বিশ্বাস করতেন না। মানবতাবাদী লালন দর্শনের মূল কথা হচ্ছে মানুষ। আর এই দর্শন প্রচারের জন্য তিনি শিল্পকে বেছে নিয়েছিলেন। লালনকে অনেকে পরিচয় করিয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন সাম্প্রদায়িক পরিচয় দিয়ে। কেউ তাকে হিন্দু, কেউ মুসলমান হিসেবে পরিচয় করাবার চেষ্টা করেছেন। লালনের প্রতিটি গানে তিনি নিজেকে ফকির (আরবি “সাধু”) হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।

লালন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন:

“লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন – আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।”

যদিও তিনি একবার লালন ‘ফকির’ বলেছেন, এরপরই তাকে আবার ‘বাউল’ বলেছেন, যেখানে বাউল এবং ফকিরের অর্থ পারস্পরিক সংঘর্ষপ্রবণ।

বাউল দর্শন

বাউল একটি বিশেষ লোকাচার ও ধর্মমত। লালনকে বাউল মত এবং গানের একজন অগ্রদূত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। লালনের গানের জন্য উনিশ শতকে বাউল গান জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বাউল গান মানুষের জীবন দর্শন সম্পৃক্ত বিশেষ সুর সমৃদ্ধ। বাউলরা সাদামাটা জীবনযাপন করেন এবং একতারা বাজিয়ে গান গেয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানোই তাদের অভ্যাস। বাংলা লোকসাহিত্যের একটি বিশেষ অংশ।

২০০৫ সালে ইউনেস্কো বাউল গানকে বিশ্বের মৌখিক এবং দৃশ্যমান ঐতিহ্যসমূহের মাঝে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে।

বাউলেরা উদার ও অসাম্প্রদায়িক ধর্মসাধক। তারা মানবতার বাণী প্রচার করেন। বাউল মতবাদের মাঝে বৈষ্ণবধর্ম এবং সূফীবাদের প্রভাব লক্ষ করা যায়। বাউলরা সবচেয়ে গুরুত্ব দেন আত্মাকে তাদের মতে আত্মাকে জানলেই পরমাত্মা বা সৃষ্টিকর্তাকে জানা যায়। আত্মা দেহে বাস করে তাই তারা দেহকে পবিত্র জ্ঞান করেন। সাধারণত অশিক্ষিত হলেও বাউলরা জীবনদর্শন সম্পর্কে অনেক গভীর কথা বলেছেন। বাউলরা তাদের দর্শন ও মতামত বাউল গানের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করে থাকেন।

লালনের বিশ্ব সাহিত্য প্রভাব

লালনের গান ও দর্শনের দ্বারা অনেক বিশ্বখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক প্রভাবিত হয়েছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ লালনের মৃত্যুর ২ বছর পর তার আখড়া বাড়িতে যান এবং লালনের দর্শনে প্রভাবিত হয়ে ১৫০টি গান রচনা করেন। তার বিভিন্ন বক্তৃতা ও রচনায় তিনি লালনের প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন। লালনের মানবতাবাদী দর্শনে প্রভাবিত হয়েছেন সাম্যবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। মার্কিন কবি এলেন গিন্সবার্গ লালনের দর্শনে প্রভাবিত হন এবং তার রচনাবলিতেও লালনের রচনাশৈলীর অনুকরণ দেখা যায়। তিনি আফটার লালন নামে একটি কবিতাও রচনা করেন।

লালনের সংগীত ও ধর্ম-দর্শন নিয়ে দেশ-বিদেশে নানা গবেষণা হয়েছে ও হচ্ছে। ১৯৬৩ ছেউড়িয়ায় আখড়া বাড়ি ঘিরে লালন লোকসাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর লালন লোকসাহিত্য কেন্দ্রের বিলুপ্তি ঘটিয়ে ১৯৭৮ সালে শিল্পকলা একাডেমীর অধীনে প্রতিষ্ঠিত হয় লালন একাডেমী।

তার মৃত্যুদিবসে ছেউড়িয়ার আখড়ায় স্মরণ উৎসব হয়। দেশ-বিদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অসংখ্য মানুষ লালন স্মরণোৎসব ও দোল পূর্ণিমায় এই আধ্যাত্মিক সাধকের দর্শন অনুস্মরণ করতে প্রতি বছর এখানে এসে থাকেন। ২০১০ সাল থেকে এখানে পাঁচ দিনব্যাপী উৎসব হচ্ছে। এই অনুষ্ঠানটি “লালন উৎসব” হিসেবে পরিচিত। ২০১২ সালে এখানে ১২২তম লালন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।

নাটক

লালন সাঁইজির জীবনীর নির্ভরযোগ্য তথ্য ও লালন-দর্শনের মূল কথা নিয়ে সাইমন জাকারিয়া রচনা করেছেন “উত্তরলালনচরিত” শীর্ষক নাটক। নাটকটি ঢাকার সদর প্রকাশনী হতে প্রকাশিত হয়েছে। উত্তরলালনচরিত নাটকটি নাট্যকার ও বাউলসাধকদের সমন্বয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটমণ্ডলে উপস্থাপিত হয়েছে।

উপন্যাস

রণজিৎ কুমার লালন সম্পর্কে সেনবাউল রাজারাম, নামে একটি উপন্যাস রচনা করেন। পরেশ ভট্টাচার্য রচনা করেন বাউল রাজার প্রেম নামে একটি উপন্যাস। ভারতের বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লালনের জীবনী নিয়ে রচনা করেন মনের মানুষ উপন্যাস। 

এই উপন্যাসে কোন নির্ভরযোগ্য সূত্র ব্যতিরেকেই লালনকে হিন্দু কায়স্থ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছ, নাম দেয়া হয়েছে লালন চন্দ্র কর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত উপন্যাস ‘গোরা’ শুরু হয়েছে লালনের গান ‘‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’’ দিয়ে।

ছোট গল্প

১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে সুনির্মল বসু লালন ফকিরের ভিটে নামে একটি ছোট গল্প রচনা করেন। শওকত ওসমান ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে রচনা করেন দুই মুসাফির নামের একটি ছোটগল্প।

চলচ্চিত্র

লালনকে নিয়ে কয়েকটি চলচ্চিত্র ও তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ হাসান ইমাম পরিচালনা করেন লালন ফকির চলচ্চিত্রটি। শক্তি চট্টোপাধ্যায় ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে একই নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ম. হামিদ ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে পরিচালনা করেন তথ্যচিত্র দ্যাখে কয়জনা যা বাংলাদেশে টেলিভিশনে প্রদর্শিত হয়। 

তানভীর মোকাম্মেল ১৯৯৬ সালে পরিচালনা করেন তথ্যচিত্র অচিন পাখি। ২০০৪ সালে তানভির মোকাম্মেলের পরিচালনায় লালন নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয় । এ চলচ্চিত্রটিতে লালনের ভূমিকায় অভিনয় করেন রাইসুল ইসলাম আসাদ এবং এটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে।

এছাড়া ২০১০ এ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে গৌতম ঘোষ মনের মানুষ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে যা ২০১০ খ্রিস্টাব্দে ৪১তম ভারতীয় চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার লাভ করে। উল্লেখ্য যে এই চলচ্চিত্রে লালনকে কোন উল্লেখযোগ্য সূত্র ছাড়াই হিন্দু হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই চলচ্চিত্রটি অনেক সমালোচনার মুখোমুখি হয়।

২০১১ সালে মুক্তি পায় হাসিবুর রেজা কল্লোল পরিচালিত ‘অন্ধ নিরাঙ্গম’ নামের চলচ্চিত্র। এ চলচ্চিত্রটিতে লালনের দর্শন ও বাউলদের জীবনযাপন তুলে ধরা হয়েছে। এটিতে অভিনয় করেছেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, রোকেয়া প্রাচী, আনুশেহ্ অনাদিল প্রমুখ।

কবিতা

মার্কিন কবি এলেন গিন্সবার্গ লালনের দর্শনে প্রভাবিত হন এবং তার রচনাবলিতেও লালনের রচনাশৈলীর অনুকরণ দেখা যায়। তিনি After Lalon নামে একটি কবিতাও রচনা করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন তিনি লালনের আছে যার মনের মানুষ সে মনে এই গানে উল্লিখিত মনের মানুষ কে তা আবিষ্কার করতে পেরেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি একটি কবিতাও রচনা করেন। যার কথা ছিল আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে, তাই হেরি তায় সকলখানে …

লালন শাহের গান

লালনের গান লালনগীতি বা লালন সংগীত হিসেবে পরিচিত। লালন তার সমকালীন সমাজের নানান কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা, সামাজিক বিভেদ ইত্যাদির বিরুদ্ধে তার রচিত গানে তিনি একই সাথে প্রশ্ন ও উত্তর করার একটি বিশেষ শৈলী অনুসরণ করেছেন। এছাড়া তার অনেক গানে তিনি রূপকের আড়ালেও তার নানান দর্শন উপস্থাপন করেছেন।

গানের জনপ্রিয়তা

সমগ্র বিশ্বে,বিশেষ করে বাংলাদেশসহ সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে লালনের গান বেশ জনপ্রিয়। শ্রোতার পছন্দ অনুসারে বিবিসি বাংলার করা সর্বকালের সেরা ২০টি বাংলা গানের তালিকায় লালনের “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়” গানটির অবস্থান ১৪তম। আত্মতত্ত্ব,দেহতত্ত্ব,গুরু বা মুর্শিদতত্ত্ব, প্রেম-ভক্তিতত্ত্ব,সাধনতত্ব,মানুষ-পরমতত্ত্ব, আল্লাহ্-নবীতত্ত্ব, কৃষ্ণ-গৌরতত্ত্ব এবং আরও বিভিন্ন বিষয়ে লালনের গান রয়েছে। লালনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গানঃ

  • আমি অপার হয়ে বসে আছি
  • সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে
  • কে বোঝে সাঁইয়ের লীলাখেলা
  • জাত গেলো জাত গেলো বলে
  • খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়
  • আপন ঘরের খবর লে না
  • আমারে কি রাখবেন গুরু চরণদাসী
  • মন তুই করলি একি ইতরপনা
  • এই মানুষে সেই মানুষ আছে
  • যেখানে সাঁইর বারামখানা
  • বাড়ির কাছে আরশিনগর
  • আমার আপন খবর আপনার হয় না
  • দেখ না মন,ঝকমারি এই দুনিয়াদারী
  • ধর চোর হাওয়ার ঘরে ফান্দ পেতে
  • সব সৃষ্টি করলো যে জন
  • সময় গেলে সাধন হবে না
  • আছে আদি মক্কা এই মানব দেহে
  • তিন পাগলে হলো মেলা নদে এসে
  • এসব দেখি কানার হাট বাজার
  • মিলন হবে কত দিনে
  • কে বানাইলো এমন রঙমহল খানা

ফরিদা পারভিন উপমহাদেশের সেরা লালন সঙ্গীত শিল্পীদের একজন। আনুশেহ আনাদিল, অরূপ রাহী, ক্লোজআপ ওয়ান তারকা মশিউর রহমান রিংকু জনপ্রিয় লালন সঙ্গীত শিল্পী। লালনের মাজারে অসংখ্য বাউল শিল্পী একতারা বাজিয়ে লালন গানের চর্চা করে থাকেন। একতারার সাথে বাউল গান আলাদা মাত্রা যোগ করে।

গানের সংগ্রহ

লালনের গান “লালনগীতি” বা কখনও “লালন সংগীত” হিসেবে প্রসিদ্ধ। লালন মুখে মুখে গান রচনা করতেন এবং সুর করে পরিবেশন করতেন। এ ভাবেই তার বিশাল গান রচনার ভাণ্ডার গড়ে ওঠে। তিনি সহস্রাধিক গান রচনা করেছেন বলে ধারণা করা হয়। তবে তিনি নিজে তা লিপিবদ্ধ করেন নি। তার শিষ্যরা গান মনে রাখতো আর পরবর্তীকালে লিপিকার তা লিপিবদ্ধ করতেন। আর এতে করে তার অনেক গানই লিপিবদ্ধ করা হয় নি বলে ধারণা করা হয়।

বাউলদের জন্য তিনি যেসব গান রচনা করেন, তা কালে-কালে এত জনপ্রিয়তা লাভ করে যে মানুষ এর মুখে মুখে তা পুরো বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনের গানে প্রভাবিত হয়ে, প্রবাসী পত্রিকার ‘হারামণি’ বিভাগে লালনের কুড়িটি গান প্রকাশ করেন। মুহম্মদ মনসুরউদ্দিন একাই তিন শতাধিক লালন গীতি সংগ্রহ করেছেন যা তার হারামণি গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে।

এ ছাড়াও তার অন্য দুটি গ্রন্থের শিরোনাম যথাক্রমে ‘লালন ফকিরের গান’ এবং ‘লালন গীতিকা’ যাতে বহু লালন গীতি সংকলিত হয়েছে। জ্যোতিরিন্দ্রিনাথ ঠাকুর সম্পাদিত ‘বীণা’, ‘বাদিনী’ পত্রিকায় ৭ম সংখ্যা ২ ভাগ (মাঘ) ১৩০৫-এ ‘পারমার্থিক গান’ শিরোনামে লালনের ‘ক্ষম অপরাধ ও দীননাথ’ গানটি স্বরলিপিসহ প্রকাশিত হয়।

এ পত্রিকায় ৮ম সংখ্যা ২ ভাগ (ফাগুন) ১৩০৫-এ প্রকাশিত আরেকটি লালনগীতি ‘কথা কয় কাছে দেখা যায় না’ দুটি গানেরই স্বরলিপি করেন ইন্দিরা দেবী। প্রেমদাস বৈরাগী গীত এ লালন গীতি সংগ্রহ করেছিলেন মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন এবং তা মাসিক প্রবাসী পত্রিকার হারামণি অংশে প্রকাশিত হয়েছিল।

লালনের গানের কথা, সুর ও দর্শনকে বিভিন্ন গবেষক বিভিন্নভাবে উল্লেখ করেছেন। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, লালন গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী বলেন, অনেক গান যাতে লালন বলে কথাটির উল্লেখ আছে তার সবই প্রকৃতপক্ষে লালনের নয়। মন্টু শাহ নামের একজন বাউল, তিন খণ্ডের একটি বই প্রকাশ করেছেন যাতে তিনি মনিরুদ্দিন শাহ নামক লালনের সরাসরি শিষ্যের সংগৃহীত লালন সংগীতগুলো প্রকাশ করেছেন।

বিতর্ক সমালোচনা

সাম্প্রদায়িক ধর্মবাদীরা লালনের অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তার সর্বাধিক সমালোচনা করে থাকে। লালন তার জীবদ্দশায় নিজের ধর্ম পরিচয় কারও কাছে প্রকাশ করেন নি। তার ধর্মবিশ্বাস আজও একটি বিতর্কিত বিষয়। লালনের অসাম্প্রদায়িকতা, লিঙ্গ বৈষম্যের বিরোধিতা ইত্যাদির কারণে তাকে তার জীবদ্দশায় ধর্মান্ধ এবং মৌলবাদী হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের ঘৃণা, বঞ্চনার এবং আক্রমণের শিকার হতে হয়।

এছাড়া তার ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী দর্শন এবং ঈশ্বর, ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ে তার উত্থাপিত নানান প্রশ্নের কারণে অনেক ধর্মবাদী তাকে নাস্তিক হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন।

এছাড়াও তার জীবদ্দশায় তৎকালীন সমাজের দাবি ছিল তিনি তার আখড়ায় সাধক সঙ্গিনী বা সেবাদাসী রূপে একটি প্রথা চালু করেছিলেন। যার ফলে হিন্দু মুসলমান নারী-পুরুষের বিবাহ বা বিবাহবহির্ভূত যৌনাচার সংঘটিত হতো। এছাড়াও আখড়ায় মাদকসেবনের জন্যও তিনি ও তার শিষ্যগণ সমালোচিত হয়েছিলেন।

পরিশেষ

সর্বোপরি আমরা বলতে পারি লালন ছিলেন একজন রহস্য মানব । উনার জীবন, দর্শন সবকিছুই এখন ও খুব প্রসিদ্ধ। লালন শাহ আমাদের শিখিয়ে গেছেন কিভাবে আমাদের ভিতরের আত্মাকে ভালোবাসতে হয়, জীবনকে উপলব্দি করতে হয় । প্রতি বছর উনার ভক্তরা জড়ো হন লালন এর আখড়া তে। লালন এখনো মানুষের স্মৃতিতে রয়ে গেছে  অমলিন হয়ে।

Related Post

মৃত্যু নিয়ে উক্তি

150+মৃত্যু নিয়ে উক্তি, বাণী, ক্যাপশন 2024

মৃত্যু নিয়ে উক্তি জন্মিলে মরিতে হবে আর এটাই সত্যি। মৃত্যু হচ্ছে সবচেয়ে চিরন্তন সত্যি। পৃথিবীতে প্রতিটি প্রাণীর মৃত্যুর স্বাদ অনুভব করতে হবে। সবসময় মৃত্যুর জন্য

Read More »
খুশির স্ট্যাটাস

200+ স্টাইলিশ খুশির স্ট্যাটাস | হাসি নিয়ে ক্যাপশন

খুশির স্ট্যাটাস | হাসি নিয়ে ক্যাপশন জীবনের সুন্দর খুশির মুহূর্ত আমরা সবাই বাঁধাই করে রাখতে চাই। আর এই খুশির মুহূর্তকে ধরে রাখার সবচেয়ে সহজ উপায়

Read More »

স্টাইলিশ ভালোবাসার ছন্দ | রোমান্টিক ছন্দ | Love Status Bangla

❤❤ভালোবাসার ছন্দ | ভালোবাসার ছন্দ রোমান্টিক | ভালোবাসার ছন্দ স্ট্যাটাস❤❤ ভালোবাসা হলো এক অন্যরকম অনুভূতির নাম, যা শুধুমাত্র কাউকে ভালবাসলেই অনুভব করা যায়। আমরা বিভিন্নভাবে

Read More »
মন খারাপের স্ট্যাটাস

মন খারাপের স্ট্যাটাস, উক্তি, ছন্দ, ক্যাপশন, কিছু কথা ও লেখা

মন খারাপের স্ট্যাটাস মন খারাপ – এই কষ্টের অনুভূতি কার না হয়? সবারই কখনো না কখনো সবারই মন খারাপ হয়। জীবনের ছোটোখাটো অঘটন থেকে শুরু

Read More »

Leave a Comment

Table of Contents