কালের সাক্ষী হয়ে দারিয়ে আছে এই বলিয়াদী জমিদার বাড়ি।
বলিয়াদী জমিদার বাড়ী অবস্থান মূলতো কালিয়াকৈর উপজেলায় অবস্থিত প্রাচীনতম জমিদার বাড়ী এবং এটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনার মধ্যে একটি । কালিয়াকৈর বাজার থেকে মাত্র ২ কি. মি. দক্ষিণে পরগনা ভালেবাবাদ এলাকায় এই বলিয়াদী জমিদার বাড়ী অবস্থিত।এখানে যাওয়ার জন্য ঢাকা বা যেকোন স্থান থেকে থেকে ঢাকা -টাঙ্গাইল – সাভার রোড / বাইপাস / চন্দ্রা অথবা কালিয়াকৈর বাইপাস। ঢাকা থকে ভাড়া ৫০ – ৭০ টাকা। সাভার থেকে বাইপাস ভাড়া ৩০ / ৪০… এরপর রিক্সা সি এন জি, অটো বা টেম্পুতে চরে সরাসারি বলিয়াদি জমিদার বাড়ি।
প্রায় – ১৫২ টি মৌজায় ৩২৭৮ জন মানুষ নিয়ে পত্তন হয় এই বলিয়াদী জমিদার। এই বলিয়াদী এস্টেটের প্রশাসক ছিলেন খলিফা আবু বকর সিদ্দিকীর বংশধর। ৪ র্থ পুরুষ কাশেম সিদ্দিকী থেকে পঞ্চদশ পুরুষ শাহাব উদ্দিন সিদ্দিকী পর্যন্ত এই পরিবার তুরস্কে বসবাস করতেন। ষোড়শ ও সপ্তদশ পুরুষ যথাক্রমে নিজাম উদ্দিন সিদ্দিকী ও জহির উদ্দিন সিদ্দিকী উত্তর ভারতে বসতি স্থাপন করেন। অষ্টাদশ পুরুষ শাহ কুতুব উদ্দিন সিদ্দিকী যিনি ইতিহাসে নবাব কুতুব উদ্দিন খান কোকালতাস বা কুকু ওরফে শেখ কোবান নামে পরিচিত। যিনি মুঘল সম্রাট মহামতি আকবরের পালিত পুত্র এবং দিল্লী রাজদরবারে উচ্চপদস্থ কর্মচারী। ইতিহাসে খ্যাত সুবাদার ইসলাম খানের অব্যবহিত পূর্বে সম্রাট জাহাঙ্গীরকর্তৃক তিনি বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন।
আরো পড়ুন……পানাম নগর
১৬০৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বর্ধমানে শেখ আফগান কর্তৃক নিহত হন। তার পুত্র উনবিংশ তিন পুরুষ সাদ উদ্দিন সিদ্দিকী জাহাঙ্গীর নগর (ঢাকার) সুবাদার ইসলাম খানের নির্দেশে সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক সুজাত খানের সাথে বিদ্রোহী আফগান ওসমান খানের দমনের উদ্দেশ্যে প্রেরিত হন। সাদ উদ্দিন সিদ্দিকী উক্ত অভিযানে অসামান্য কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। পুরস্কার স্বরূপ সম্রাট জাহাঙ্গীর তাকে চন্দ্র প্রতাপ, আমিনাবাদ এবং তালেবাবাদ এই তিন পরগনার জায়গীর দারী প্রদান করেন (১৬১২ খ্রিষ্টাব্দে)। তিনি তালেবাবাদ পরগনার অন্তর্গত পুলখার গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। ৩০ তম পুরুষ চৌধুরী আব্দুল ওয়াজেদ সিদ্দিকীর জীবনকাল পর্যন্ত উক্ত পরিবার পুলখার গ্রামে বসবাস করেন।
৩১ তম পুরুষ চৌধুরী নাজেম উদ্দিন হোসেন সিদ্দিকী তালেবাবাদ পরগনার বলিয়াদী গ্রামে নতুন নিবাস স্থাপন করেন। তখন থেকে উক্ত পরিবার বলিয়াদীতে বসতি স্থাপন করেন। বাংলাদেশের প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী বলিয়াদী জমিদার পরিবার সর্বত্র বলিয়াদী সিদ্দিকী পরিবার হিসাবে পরিচিত। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় থেকে আজ পর্যন্ত এই পরিবার তাদের ঐতিহ্য বজায় রেখে তালেবাবাদ পরগনায় ও দেশের অন্যান্য স্থানে এবং বিদেশে বসবাস করছেন।
বলিয়াদী এস্টেট মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর ফরমান বলে প্রতিষ্ঠিত হয় (ইংরেজি ১৬১২ খ্রিষ্টাব্দে)। ১৬১২ খ্রিষ্টাব্দে বলিয়াদী এস্টেটে অন্তর্ভুক্ত ছিল সমগ্র কালিয়াকৈর থানা। কালিয়াকৈর থানার লোক সংখ্যা তখন ছিল ৩২৭৮ জন। বাংলাদেশের প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী এই এস্টেট আজও তার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বলিয়াদী নবাব কুতুব উদ্দিন সিদ্দিকীর পুত্র সাদ উদ্দিন সিদ্দিকী বলিয়াদী এস্টেটের প্রথম কর্ণধর ছিলেন।
৩৫ তম বংশধর থেকে বলিয়াদী রাজত্বের ইতিহাস নিম্নরূপ। ৩৫ তম বংশধর খান বাহাদুর চৌধুরী কাজেম উদ্দিন আহম্মদ ১৯২৩ সালের ২ ই জুন ইংল্যান্ডের রাজার জন্মদিন উপলক্ষে খান বাহাদুর উপাদী লাভ করেন। তিনি ১৯০৫ সালে আসাম বেঙ্গল মুসলীম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। চৌধুরী কাজেম উদ্দিন আহম্মদ সিদ্দিকীর একমাত্র সন্তান চৌধুরী লাবিব উদ্দিন আহম্মদ সিদ্দিকী। ৩৬ তম বংশধর খান বাহাদুর চৌধুরী লাবিব উদ্দিন আহম্মদ সিদ্দিকী ১৯৪৫ সালে ইংল্যান্ডের রাজার দেয়া প্রদত্ত খান বাহাদুর উপাধি লাভ করেন। তার তিন পুত্র চৌধুরী তানভীর আহম্মদ সিদ্দিকী, চৌধুরী রকিব উদ্দিন আহম্মদ সিদ্দিকী চৌধুরী দবির উদ্দিন আহম্মদ সিদ্দিকী । এবং তার আরও তিন কন্যা রয়েছেন।
বর্তমানে এই ঐতিহ্যবাহী বলিয়াদী জমিদার বাড়ি এস্টেটের জমিদার চৌধুরী তানভীর আহম্মদ সিদ্দিকী। ৩৭ তম এই বংশধর চৌধুরী তানভীর আহম্মদ সিদ্দিকী ১৯৩৯ সালের ১৪ ই ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। পিতার পর তিনি ১৮ বছর বয়সে ১৯৫৭ সালের ৫ ই মে ঐতিহ্যবাহী বিশাল বলিয়াদী এস্টেটের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৮০ সালে ২৬ সে এপ্রিল থেকে ১৯৮১ সালের ৭ ই নভেম্বর পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভার বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
চৌধুরী তানভীর আহম্মদ সিদ্দিকীর ভাই চৌধুরী দবির উদ্দিন আহম্মদ সিদ্দিকী ১৯৬৬ সালে ঢাকা জেলা বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হন। চৌধুরী দবির উদ্দিন আহম্মদ সিদ্দিকী ১৯৬৮ সালে ঢাকা কেন্দীয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত চৌধুরী দবির উদ্দিন আহম্মদ সিদ্দিকী ফেডারেল অব বাংলাদেশ চেম্বার কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ- এর সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি মুসলিম বিশ্বের একমাত্র বণিক সমিতি ইসলামিক চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। উক্ত বণিক সমিতি তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ১৯৭৯ সালে ৪২ টি মুসলিম দেশের প্রতিনিধি সমবায় গঠন করে।
গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈরে বলিয়াদি জমিদার বাড়ি কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ৪০০ বছরের ইতিহাস নিয়ে। পরিবার পরিজন নিয়ে বেড়ানোর এক মনোরম পরিবেশ এই জমিদার বাড়ি। যে কারোর মন কাড়তে পাড়ে এখানকার বৈচিত্র্যপূর্ণ পরিবেশ।
পিচঢালা পথ হতেই চোখে পড়বে অন্যরকম সুন্দর এই জমিদার বাড়িটি। জমিদার বাড়ির সীমানায় ঢোকার মুখে হাতের ডান পাশে একটি পুকুর পড়বে আর বাম পাশে এক টুকরো খোলা মাঠ। এই মাঠ ধরে একটু সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথে হাতের বাম পাশের রয়েছে ‘বলিয়াদি ওয়াকফ এস্টেট জামে মসজিদ’। মসজিদটি প্রথম নির্মাণ করা হয় ১৬১২ খ্রিষ্টাব্দে। কিন্তু সেই মসজিদটি এখন আর নেই। মসজিদটি পুনঃনির্মিত হয়েছে ১৯৯২ সালে। চার কোনায় চারটি এবং প্রতি বাহু’র মাঝে একটি করে মোট আটটি ছোট্ট মিনার রয়েছে এই একতলা বর্গাকৃতির মসজিদটিতে।
হাতের বাম পাশে মসজিদ রেখে সামনে এগিয়ে গেলে রয়েছে মূল জমিদার বাড়ির ভবন। মসজিদ এর ঠিক সম্মুখভাগে রয়েছে পারিবারিক কবরস্থান। এই কবরস্থান আর মূল ভবনের মাঝে রয়েছে ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত বলিয়াদি এস্টেটের ‘হেড অফিস’ তথা ‘সদর দফতর’। যেখান থেকে বলিয়াদি এস্টেটের সকল প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হতো।
মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের ফরমান বলে ইংরেজিতে ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে সমগ্র ধামরাই থানা, কালিয়াকৈর থানা, সাভার থানা এবং বাসাইল থানা নিয়ে বলিয়াদি এস্টেট প্রতিষ্ঠিত হয়।
তৎকালীন সময়ে কালিয়াকৈর থানার নাম ছিল পরগনা তালেবাবাদ। ধামরাই এবং সাভার থানা একসাথে ছিল। যার নাম ছিল পরগনা চন্দ্রপ্রতাপ। অপরদিকে বাসাইল থানার নাম ছিল পরগনা আমেনাবাদ।
বাংলাদেশের প্রাচীনতম ঐতিহাসিক এই এস্টেটের দিল্লী মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর কর্তৃক নিযুক্ত বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার সুবেদার নবাব কুতুবুদ্দিন সিদ্দিকীর পুত্র নবাব সাদ উদ্দিন সিদ্দিকী তিনি বলিয়াদী এস্টেটের প্রথম কর্ণধার ছিলেন।
বর্তমান ডাক সাইটে রাজনীতিবিদ, বিএনপি নেতা চৌধুরী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী’র পূর্বপুরুষ হলেন এই বলিয়াদি জমিদারেরা। এই বলিয়াদি জমিদার বাড়ি তার পরবর্তী প্রজন্মের যত্নে আজো ভালো অবস্থায়ই টিকে আছে অন্যান্য জমিদার বাড়ির তুলনায়।
অপূর্ব নির্মাণশৈলীর এই জমিদার বাড়ির মূল পাঁচিলঘেরা অংশে মাঝখানে ত্রিতল জমিদার বাড়ির মূল কাঠামো। মূল বাড়ির ছাদে রয়েছে সফেদ গম্বুজ, যার চারিদিকে প্রতিটি ভিতের মাথায় রয়েছে ছোট ছোট মিনার আকৃতির নকশা।
বলিয়াদি অফিসের যে প্রশাসনিক কার্যালয় আছে সেখান থেকে অনুমতি নিয়ে ভেতরে ঢুকে ঘুরে দেখতে পারেন এর চারপাশ। এর নান্দনিক স্থাপত্যশৈলী আপনার ভালো লাগবে। সামনে সবুজ ঘাসের লনে বসে আপনি অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারবেন একটি আনন্দঘন বিকেল।
গুলিস্তান ও মতিঝিল থেকে সরাসরি বাসে কালিয়াকৈর যাওয়া যায়।
ঘুরতে আসা এক দর্শনাত্রী রাসেল হোসেন জানান, বলিয়াদী জমিদার বাড়ীতে অনেকে পুরাতন ইতিহাস দেখে অতীতকে স্মরণ করানোর মতো ।
কালিয়াকৈর উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা কাজী হাফিজুল আমিন জানান, যে সব স্থাপত্য নষ্ট হয়েছে সেগুলো সংস্কারের জন্য ইতিমধ্যে আমরা ওই অধিদপ্তরের সাথে যোগাযোগ করেছি। তাদের পজেটিভ রিপোর্ট আসলেই আমরা সংস্কারের কাজ করবো।
বিলাদিয়া জমিদার বাড়ি গিয়ে কোথায় খাবেন তা নিয়ে চিন্তা ! তাহলে নিশ্চিত হয়ে যান কারন – কালিয়াকৈর বাইপাসের কাছে অবস্থিত ঘরোয়া রেস্তোরাঁর খাবার বেশ মানসম্মত। এছাড়া চাইলে ঢাকায় ফিরে এসে আপনার পছন্দমত রেস্টুরেন্টে খেতে পারবেন।
ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বর্ণিল যোগাযোগের গাজীপুর জেলা প্রত্নসম্পদ ও দর্শনীয় স্থানে ভরপুর। রাজধানী ঢাকা জেলার সাথে লাগোয়া গাজীপুর জেলার দর্শনীয় স্থান ও প্রত্নসম্পদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ ভাওয়াল রাজবাড়ী, বলধার জমিদার বাড়ী, প্রাচীন রাজধানী ইন্দ্রাকপুর, শ্রীফলতললী জমিদার বাড়ী, কাশিমপুর জমিদার বাড়ী, সেন্ট নিকোলাস চার্চ, একডালা দূর্গ, ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান, নুহাস পল্লী, বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, মন পুড়া পার্ক, বড় ভূঁইয়া বাড়ী তাছাড়াও আরো অনেক দার্শনিক স্থান রয়েছে গাজীপুরে।