কালোজিরা খাওয়ার নিয়ম ও এর উপকারিতা
কালোজিরা (Black Cumin) এশিয়া এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের একটি ফুলের উদ্ভিদ। এর বীজ হাজার হাজার বছর ধরে ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে । কালোজিরার তেল হল একটি ভেষজ উপাদান যা Nigella sativa উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত, যা পূর্ব ইউরোপ এবং পশ্চিম এশিয়ার একটি উদ্ভিদ। এর শক্তিশালী ঔষধি গুণ রয়েছে । এর মধ্যে শক্তিশালী এন্টিওক্সিডেন্ট থাকার কারণে কালোজিরা খাওয়ার উপকারিতা অনেক বেশি । আমরা সাধারণত কালোজিরা মসলা হিসেবে ব্যবহার করে থাকি তবে আয়ুর্বেদিক ইউনানী কবিরাজি চিকিৎসার ক্ষেত্রে এর বেশ ব্যবহার রয়েছে। সেই প্রাচীনকাল থেকেই কালোজিরা কে বিভিন্ন রোগের প্রতিশোধক এবং প্রতিরোধক হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কালোজিরার এতই উপকারিতা রয়েছে যে বলে শেষ করা যাবে না। যার জন্য কালোজিরা কে সকল রোগের মহা ঔষধ বলা হয়। আজ আমরা এই আর্টিকেলে কালোজিরার খাওয়ার নিয়ম ও উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব। তাই চলুন দেরি না করে আর্টিকেল শুরু করা যাক:
কালোজিরার উপকারিতা
১। স্মরণ শক্তি বৃদ্ধি
যেকোনো ধরনের দুশ্চিন্তা থেকে পরিত্রাণ পেতে এক চা-চামচ পুদিনাপাতার রস বা কমলার রস বা এক কাপ রঙ চায়ের সাথে এক চা-চামচ কালোজিরার তেল মিশিয়ে দিনে তিনবার করে নিয়মিত সেবন করন। এছাড়া মেধা বিকাশের জন্য কালোজিরা ব্যাপক ভূমিকা রাখে। কালোজিরা নিজেই একটি অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যান্টিসেপটিক। মস্তিস্কের রক্ত সঞ্চলন বৃদ্ধির মাধ্যমে স্মরণ শক্তি বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে। কালোজিরা খেলে আমাদের দেহে রক্ত সঞ্চালন ঠিকমতো হয়। এতে করে মস্তিস্কের রক্ত সঞ্চলন বৃদ্ধির হয়। যা আমাদের স্মৃতি শক্তি বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে।
২। মাথা ব্যাথা নিরাময়ে
মাথাব্যথা থেকে মুক্তি পেতে হলে ১/২ চা-চামচ কালোজিরার তেল মাথায় ভালোভাবে লাগাতে হবে এবং এক চা চামচ কালোজিরার তেল সমপরিমাণ মধুসহ দিনে তিনবার করে ২/৩সপ্তাহ সেবন করবেন।
৩। সর্দি সারাতে
১ চা-চামচ কালোজিরা,২ চা-চামচ তুলসী পাতার রস সঙ্গে ৩ চা-চামচ মধু মিশিয়ে খেলে জ্বর, সর্দি-কাশি ও উচ্চ ব্যাথা দূর হয়। সর্দি বুকে বসে গেলে কালিজিরা বেটে কপালে প্রলেপ দিন। সেই সঙ্গে সঙ্গে পাতলা পরিষ্কার কাপড়ে কালিজিরা বেঁধে শুকতে থাকুন। আরো ভাল ফলাফল পেতে বুকে ও পিঠে কালিজিরার তেল মালিশ করুন।
৪। বাতের ব্যাথা দূরীকরণে
বাতের ব্যথা দূর করতে আক্রান্ত স্থানে ধুয়ে পরিষ্কার করে তাতে মালিশ করে এক চা-চামচ কাঁচা হলুদের রসের সাথে সমপরিমাণ কালোজিরার তেল সমপরিমান মধু বা এক কাপ রং চায়ের সাথে দিনে ৩ বার করে ২/৩ সপ্তাহ সেবন করুন।
৫। বিভিন্ন প্রকার চর্মরোগ সারাতে
শরীরে চর্মরোগ থেকে মুক্তি পেতে আক্রান্ত স্থানে ধুয়ে পরিষ্কার করে তাতে মালিশকরে এক চা-চামচ কাঁচা হলুদের রসের সাথে সমপরিমাণ কালোজিরার তেল সমপরিমান মধু বা এককাপ রং চায়ের সাথে দৈনিক ৩বার করে২/৩ সপ্তাহ সেবন করুন।
৬। হার্টের বিভিন্ন সমস্যার ক্ষেত্রে
হার্ট এর বিভিন্ন সমস্যা দূর করতে ১ চা-চামচ কালোজিরার তেলর সাথে এক কাপ দুধ খেয়ে দৈনিক ২বার করে ৪/৫ সপ্তাহ সেবন করতে হবে। এবং কালোজিরার তেল নিয়মিত বুকে মালিশ করতে হবে।
৭। অর্শ রোগ নিরাময়ে
অর্শ রোগ দূর করতে১ চা-চামচ কালোজিরার তেল ,১ চা-চামচ মাখন ও সমপরিমাণ তিলের তেল ভালভাবে মিশিয়ে প্রতিদিন খালি পেটে ৩/৪ সপ্তাহ সেবন করন।
৮। শ্বাস কষ্ট বা হাঁপানি রোগ সারাতে
যারা হাঁপানী বা শ্বাসকষ্ট জনিত সমসসায় ভুগে থাকেন তাদের জন্য কালোজিরা অনেক বেশি উপকারী। প্রতিদিন কালোজিরার ভর্তা রাখুন খাদ্য তালিকায়। কালোজিরা হাঁপানি বা শ্বাস কষ্টজনিত সমস্যা উপশম হবে।এছাড়া এক কাপ চা-চামচ কালোজিরার তেল, এক কাপ দুধ বা রং চায়ের সাথে দৈনিক ৩-৪ বার করে নিয়মিত সেবন করুন।
৯। ডায়বেটিক নিয়ন্ত্রণে
ডায়াবেটিকদের রোগ উপশমে বেশ কাজে লাগে কালিজিরা। এক চিমটি পরিমাণ কালিজিরা এক গ্লাস পানির সঙ্গে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে খেয়ে দেখুন, রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এছাড়া এক কাপ চা-চামচকালোজিরার তেল, এক কাপ রং চা বা গরম ভাতের সাথে মিশিয়ে দৈনিক ২বার করে নিয়মিত সেব্য। যা ডায়বেটিকস নিয়ন্ত্রণে একশত ভাগ ফলপ্রসূ।
১০। জৈব শক্তি বৃদ্ধির জন্য
কালোজিরা নারী- পুরুষ উভয়ের যৌনক্ষমতা বাড়ায়। প্রতিদিন কালোজিরা খাবারে সাথে খেলে পুরুষের স্পার্ম সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং পুরুষত্বহীনতা থেকে মুক্তির সম্ভাবনা তৈরি করে। মধ্যপ্রাচ্যে প্রচলিত আছে যে, কালিজিরা যৌন ক্ষমতা বাড়ায় এবং পুরুষত্বহীনতা থেকে মুক্তি দিতে সহায়তা করে। একচা-চামচ মাখন, এক চা-চামচ জাইতুন তেল সমপরিমাণ কালোজিরার তেল ও মধুসহ দৈনিক ৩বার৪/৫ সপ্তাহ সেব্য। তবে পুরানো কালোজিরা তেল স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক।
১১। অনিয়মিত মাসিক রোগের ক্ষেত্রে
অনিয়মিত মাসিক থেকে মুক্তি পেতে এক কাপ কাঁচা হলুদের রস বা সমপরিমাণ আতপ চাল ধোয়া পানির সাথে এক কাপ চা-চামচ কালোজিরার তেল মিশিয়ে দিনে ৩বার করে নিয়মিত সেবন করুন।এটা শতভাগ কার্যকরী ।
১২। গ্যাষ্ট্রীক বা আমাশয় নিরাময়ে
গ্যাস্ট্রিক ও আমাশয় থেকে মুক্তি পেতে এক চা-চামচ কালোজিরার তেল সাথে সমপরিমাণ মধু সহ দিনে ৩বার করে ২/৩ সপ্তাহ সেবন করুন।
১৩। জন্ডিস বা লিভারের বিভিন্ন সমস্যার দূরীকরণে
জন্ডিস ও লিভারের বিভিন্ন সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে কালোজিরা বেশ কার্যকরী।একগ্লাস ত্রিপলার শরবতের সাথে এক চা-চামচ কালোজিরার তেল দিনে ৩বার করে ৪/৫ সপ্তাহ সেবন করুন।
১৪। রিউমেটিক এবং পিঠেব্যাথা দূর করার জন্য
কালোজিরার থেকে যে তেল বের করা হয় তা আমাদের দেহে বাসা বাঁধা দীর্ঘমেয়াদী রিউমেটিক এবং পিঠে ব্যথা কমাতে বেশ সাহায্য করে। এছাড়াও সাধারণভাবে কালোজিরা খেলেও অনেক উপকার পাওয়া যায়।
১৫। শিশুর দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধি করতে কালোজিরা
দ্রুত শিশুর দৈহিক মানসিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কালোজিরার তেল বেশ কার্যকর ।কালোজিরা শিশুর মস্তিষ্কের সুস্থতা এবং স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতেও অনেক কাজ করে । তবে হ্যাঁ দুই বছরের কম বয়সের বাচ্চাদের কালোজিরার তেল সেবন করা উচিত নয়। কিন্তু বাহ্যিক ভাবে ব্যবহার করতে পারবে।
১৬। মাথা ব্যথা দূর করতে
মাথাব্যথা দ্রুত দূর করতে মাথা ও কপালে উভয় চিবুকে ও কানের পার্শ্ববর্তি স্থানে দৈনিক ৩/৪ বার কালোজিরা তেল মালিশ করলে উপকার পাওয়া যায়।
১৭। স্বাস্থ্য ভাল রাখতে
কালোজিরা কে বলা হয় সকল রোগের মহা ঔষধ। মধুসহ প্রতিদিন সকালে কালোজিরা সেবনে স্বাস্থ্য ভালো থাকে ও সকল রোগ মহামারী হতে রক্ষা পাওয়া যায়।
১৮। হজমের সমস্যায দূরীকরণে
হজমের সকল ধরনের সমস্যায় দূর করতে এক-দুই চা-চামচ কালিজিরা বেটে পানির সঙ্গে মিশিয়ে নিয়মিত খেতে থাকুন। এভাবে দিনে দু-তিনবার খেলে এক মাসের মধ্যে হজমশক্তি বেড়ে যাবে। পাশাপাশি পেট ফাঁপাভাবও দূর হবে।
১৯। লিভারের সুরক্ষায়
লিভারের সুরক্ষায় কালোজিরা বেশ উপকারী।কালিজিরা লিভার ক্যান্সারের জন্য দায়ী আফলাটক্সিন নামক বিষ ধ্বংস করে ।
২০। চুল পড়া বন্ধ করতে
চুল পর্যাপ্ত পুষ্টি ও চুল পড়া বন্ধ করতে নিয়মিত কালোজিরা খান। আরো ভালো ফলাফল পেতে চুলের গোড়ায় এর তেল মালিশ করতে থাকুন।
২১। দাঁত ব্যথা দূরীকরণে
দাঁতে প্রচন্ড ব্যথা হলে দাঁতের ব্যথা দূর করতে কুসুম গরম পানিতে কালোজিরা দিয়ে কুলি করুন।এতে জিহ্বা, তালু, দাঁতের মাড়ির জীবাণু মরে যাবে।
২২। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে কালোজিরা
কালোজিরা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে। নিয়মিত কালোজিরা খেলে শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সতেজ থাকে। এতে করে যে কোন জীবানুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে দেহকে প্রস্তুত করে তোলে এবং সার্বিকভাবে স্বস্থ্যের উন্নতি করে। ১ চামচ কালোজিরা অথবা কয়েক ফোটা কালোজিরার তেল ও ১চামচ মধুসহ প্রতিদিন সেবন করলে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে।
কালোজিরা খাওয়ার নিয়ম
কালোজিরার উপকারিতা পেতে হলে এটি নিয়মিত খেতে হবে। কালোজিরা খাওয়ারও কিছু নিয়ম আছে চলুন এগুলো জেনে নিই:
১)প্রতিদিন সকাল বেলা খালি পেটে পানির সাথে অথবা মধুর সাথে মিশিয়ে ১-২.৫০ গ্রাম কালোজিরা খাবেন শরীরের শর্করা নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
২)চা বা গরম ভাতের সাথে মিশিয়েও খাওয়া যায়।
৩) যেকোন তরকারি রান্নায় কালোজিরা ব্যবহার করা যায়। এছাড়াও কালোজিরার ভর্তাও অনেক সুস্বাদু।
৪) পিঠা বা বিভিন্ন মুখরোচক খাবারে কালোজিরা ব্যবহার করলে এর পুষ্টিগুন অনেক বেড়ে যায়।
সবশেষে
কালোজিরার এতসব উপকারিতা জেনে আমরা নিঃসন্দেহে কালোজিরাকে সকল রোগের মহা ওষুধ বলতেই পারি। ঠিক এই কারণেই কালোজিরা কে মৃত্যু ছাড়া সকল রোগের ঔষধ বলা হয়ে থাকে। তাই সুস্থ সবল জীবন যাপন করতে ও সকল প্রকার রোগ থেকে মুক্তি পেতে নিয়মিত কালোজিরা সেবন করুন। আশা করি আজকের এই আর্টিকেলটি থেকে আপনি কিছুটা হলেও উপকৃত হয়েছেন। আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
Also Read : চিয়া সিড এর উপকারিতা ও অপকারিতা