Dreamy Media BD

আহসান মঞ্জিল

আহসান মঞ্জিল

ঢাকা; নিজস্ব সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এক প্রচীন শহর। বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত এই অত্যান্ত জনবহুল শহরটি ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, জীবনধারা আর শৈল্পিক স্থাপত্যের মেলবন্ধনে হয়ে আছে অনন্য। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা নিয়ে কথা বললে ‘আহসান মঞ্জিল’-এর নাম আসবে না, তা কেমন করে হয়?
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন বন্ধুরা; আজ আমরা আপনাদের সামনে তুলে ধরব আহসান মঞ্জিলের জানা অজানা অনেক কথা।

আহসান মঞ্জিল; চমৎকার এক স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন। ঢাকা জেলার ইসলামপুরের কুমারটুলী এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। প্রথম দেখাতেই যেকোন দর্শক এর দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলীর প্রেমে পড়তে বাধ্য।

কথিত আছে, অষ্টাদশ শতাব্দীতে মুগল আমলে এখানে জামালপুর পরগনার জমিদার শেখ এনায়েতউল্লাহর রঙমহল ছিল। পরবর্তীতে তাঁর পুত্র মতিউল্লাহর নিকট থেকে রঙমহলটি ফরাসিরা ক্রয় করে এখানে একটি বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। ১৮৩০ সালে খাজা আলীমুল্লাহ ফরাসিদের নিকট থেকে কুঠিবাড়িটি কিনে নেন এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করে এটি নিজের বাসভবনে পরিণত করেন। এ বাসভবনকে কেন্দ্র করে খাজা আব্দুল গনি মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি নামক একটি ইউরোপীয় নির্মাণ ও প্রকৌশলী প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করান যার প্রধান ইমারত ছিল আহসান মঞ্জিল। ১৮৫৯ সালে আহসান মঞ্জিলের নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ১৩ বছর পরে এর নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। আবদুল গনি তাঁর পুত্র খাজা আহসানুল্লাহ র নামানুসারে ভবন এর নামকরণ করেন আহসান মঞ্জিল। ১৮৮৮ সালে ৭ এপ্রিলে প্রবল ঘুর্ণিঝড়ে আহসান মঞ্জিলের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়, বিশেষ করে অন্দরমহলটি একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। নওয়াব আহসানুল্লাহ অন্দরমহলটি পুনর্নির্মাণ এবং রঙমহলটি মেরামত করান। এ মেরামত কাজের জন্য রানীগঞ্জ থেকে উন্নত মানের ইট আনানো হয়েছিলো। রঙমহলটির উপর বর্তমানে যে সুদৃশ্য গম্বুজ রয়েছে তা এ সময় সংযোজন করা হয়। তৎকালীন সময়ে এই গম্বুজের চূড়াটিই ছিলো ঢাকা শহরের সর্বচ্চো।

 

মূল ভবনের বাইরের ত্রি-তোরণবিশিষ্ট প্রবেশদ্বারের  মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যের এক নিশ্চুপ অভ্যর্থনা দর্শনার্থীর হৃদয়ে আলাদা এক জায়গা করে নিবে এতে কোন সন্দেহ নেই। মূল প্রাসাদের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে রয়েছে অর্ধ বৃত্তাকার খিলান সহযোগে প্রশস্ত বারান্দা। বারান্দাগুলো প্রায় এক তলার সমপরিমাণ উচু। দক্ষিণ দিকের বারান্দার উপর থেকে একটি সুবৃহৎ খোলা সিড়িঁ বাগান দিয়ে নেমে গেছে নদীর ধার অব্দি।  সিঁড়িগুলোর সৌন্দর্যের নান্দনিকতা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পূর্ব এবং পশ্চিম প্রান্তের প্রবেশদ্বার গুলোও সৌন্দর্যবোধের শৈল্পিকতাকে এক নতুন সংজ্ঞা দান করে। বারান্দা ও কক্ষগুলোর মেঝে মার্বেল পাথরে শোভিত। চমৎকার দেখতে অসাধারণ এই স্থাপনার তাজতুল্য গম্বুজটি তৈরি করা হয়েছে একটি অষ্টকোণ কক্ষের উপর। অষ্টবাহুর সূচ্যগ্র মাথাগুলোকে কেন্দ্রের দিকে ক্রমে হেলিয়ে চূড়াতে নিয়ে কুমদ্র কলির আদলে গম্বুজটিকে আকার দেয়া হয়েছে।

 

অভ্যন্তরভাগে গম্বুজের দুপার্শ্বে ভবনটিকে দুটি সুসম অংশে বিভক্ত করা যায়। দোতলায় পূর্ব দিকে রয়েছে বৃহদাকার ড্রইং রুম; উত্তরে লাইব্রেরি ও কার্ডরুম এবং পূর্বপ্রান্তে ৪টি বর্গাকার কক্ষ। পশ্চিম অংশে আছে বৃহদাকার জলসাঘর, এর উত্তরে হিন্দুস্থানি কক্ষ এবং পশ্চিম প্রান্তে ৪টি বর্গাকার কক্ষ। ড্রইং রুম ও জলসাঘরের ছাদে কাঠের তৈরী ভল্টেড সিলিং খুবই দৃষ্টিনন্দন। এ কক্ষ দুটির মেঝের উপরি আবরণ কাঠের পাটাতনের তৈরী। নিচ তলায় পূর্বাংশে রয়েছে বৃহদাকার ডাইনিং হল ও ছয়টি বর্গাকার কক্ষ; পশ্চিমাংশে রয়েছে বৃহৎ দরবার হল এবং এর উত্তরে পার্শ্বে রয়েছে বিলিয়ার্ড কক্ষ। ডাইনিং ও দরবার হলের মেঝে সাদা, সবুজ, হলুদ প্রভৃতি রঙের চীনা টালি দ্বারা খুবই সুন্দরভাবে অলংকৃত। নিচতলায় পশ্চিম প্রান্তে নির্মিত ৫টি কক্ষের মধ্যবর্তীটি বিখ্যাত স্ট্রং রুম যেখানে নওয়াবদের মূলবান সামগ্রী সংরক্ষিত থাকত। গম্বুজ কক্ষের উত্তর পাশের কক্ষটিতে রয়েছে আকর্ষণীয় কাঠের সিঁড়ি। সিঁড়িটির রেলিং-এ লতা সম্বৃদ্ধ লোহার তৈরী ব্যালাস্টার এবং জ্যামিতিক নকশা সমৃদ্ধ কাঠের সিলিংটি খুবই চিত্তাকর্ষক। নওয়াবদের গৌরবময় দিনগুলিতে এ সিঁড়ি কক্ষে সোনা দিয়ে বাঁধাইকৃত একটি ভিজিটর বুক রাখা থাকত যেখানে প্রাসাদে আগত গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ তাতে তাঁদের মন্তব্য লিখতেন।

 

প্রাসাদ কক্ষের দেয়ালগুলোর পুরুত্ব প্রায় ০.৭৮ মিটার। অর্ধবৃত্তাকার খিলানের মাধ্যমে দরজাগু্লোকে স্থাপন করা হয়েছে। দরজাগুলিতে ভেতর পাল্লায় নানা রঙের কাঁচ এবং বহির্পাল্লায় কাঠের খড়খড়ি লাগানো। কক্ষগুলির ছাদ কাঠের কড়ি-বরগার উপর নির্মিত। অসাধারণ স্থাপত্যশৈলীর ভিন্নরকম বহিঃপ্রকাশ অট্টালিকাটিকে অন্যসব স্থাপত্য থেকে আলাদা করেছে তো বটেই সাথে মানানসই রূপ দিয়েছে।

 

আহসান মঞ্জিল এমন একটি স্থাপত্য যার সঙ্গে বাংলার ইতিহাসের বেশ কিছু অত্যান্ত গুরুত্বপুর্ন অধ্যায় জড়িত। পঞ্চায়েত প্রধান হিসেবে ঢাকার নওয়াবগণ প্রায় প্রতিদিন এখানে সালিশি দরবার বসাতেন। মুসলিম স্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী নওয়াব আহসানুল্লাহর উদ্যোগে এখানে কংগ্রেস বিরোধী বহু সভা হয়েছে। ব্রিটিশ ভারতের যেসব ভাইসরয়, গভর্নর ও লে. গভর্নর ঢাকায় এসেছেন, তাঁদের সবাই এই রাজমহলেই আতিথীয়তা গ্রহণ করেছেন।  খাজা সলিমুল্লাহ তাঁর যাবতীয় রাজনৈতিক কর্মকান্ড এ প্রাসাদ থেকেই পরিচালনা করেছেন। উনিশ শতকের শেষ ভাগ থেকে পাকিস্তানের প্রথম পর্ব পর্যন্ত প্রায় একশ বছর ধরে এ ভবন থেকেই পূর্ব বাংলার মুসলমানদের নেতৃত্ব দেওয়া হয়েছে। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে এই প্রাসাদেই অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। বাঙালী জাতির জাতীয় জীবনের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশগুলোর সাক্ষী হয়ে আছে এই স্থাপনাটি।

 

আহসান মঞ্জিল নবাবদের আবাস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসলেও ১৯৭৪ সালে ঢাকা নওয়াব পরিবারের উত্তরসূরিরা আহসান মঞ্জিল প্রাসাদ নিলামে বিক্রির পরিকল্পনা করেন। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব আহসান মঞ্জিলের স্থাপত্য সৌন্দর্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব উপলব্ধি করে এটি নিলামে বিক্রির প্রস্তাব নাকচ করে দেন।

‘আহসান মঞ্জিলের সংস্কার, সৌন্দর্যবর্ধন ও জাদুঘরে রুপান্তর’ শীর্ষক প্রকল্পের বাস্তবায়ন আরম্ভ হয় ১৯৮৬ সালের মার্চ মাসে।

অবশেষে ১৯৯২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর আহসান মঞ্জিল জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ও জনসাধারণের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

বর্তমানে আহসান মঞ্জিল জাদুঘর তথা সংগ্রহসালা হিসেবেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এর ৩১টি কক্ষের ২৩টিতে প্রদর্শনী সামগ্রী উপস্থাপন করা হয়েছে। ৯টি কক্ষ লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরীতে প্রাপ্ত ও মি. ফ্রিৎজকাপ কর্তৃক ১৯০৪ সালে তোলা আলোকচিত্রের সাথে মিলিয়ে খুব সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে। আহসান মঞ্জিলের তোষাখানা ও ক্রোকারীজ কক্ষে থাকা তৈজসপত্র ও নওয়াব এস্টেটের পুরোনো অফিস এডওয়ার্ড হাউজ থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন নিদর্শন সংরক্ষণ করে প্রদর্শনীতে দেওয়া হয়েছে যাতে সর্ব সাধারণ নবাবদের জীবন যাত্রার মান এবং ইতিহাস সম্মন্ধে স্বচ্ছ ধারণা পেতে পারে। এছাড়া উক্ত আলোকচিত্রের সাথে মিলিয়ে বিভিন্ন আসবাবপত্র তৈরী ও সমসাময়িককালের সাদৃশ্যপূর্ণ নিদর্শনাদি ক্রয় ও সংগ্রহ করে গ্যালারীতে সংরক্ষণ করা হয়েছে। আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে এ যাবৎ সংগৃহীত নিদর্শন সংখ্যা মোট ৪০৭৭টি।

 

বর্তমানে আহসান মঞ্জিল জাদুঘর জনসাধারণ সকলের জন্যে উন্মুক্ত করা আছে। কেবল মাত্র বৃহস্পতিবার ছাড়া সপ্তাহের ছয়দিনই জাদুঘরটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে সকলের জন্যে উম্নুক্ত থাকে।

 

আহসান মঞ্জিলের সাথে জড়িয়ে রয়েছে ঢাকার শত বছরের পুরনো ইতিহাস। ঢাকার পুরনো স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য হিসেবে বিবেচনা করা হয় আহসান মঞ্জিলকে। “আহসান মঞ্জিল” বাংলার গৌরবময় ইতিহাস ও নবাবি ঐতিহ্যের স্মৃতি ধারণ করে রাখা এক বিষ্ময়কর স্থাপনা। আহসান মঞ্জিলের বাহ্যিক সৌন্দর্য যেমন আমাদের চমৎকৃত করে তেমনি এর ভিতরকার সংগৃহীত বস্তু সমূহ আমাদের নিজেদের সাথে বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয় করিয়ে দেয়। শতবছরেরও অধিক সময় ধরে অট্টালিকাটি এখনো বুড়িগঙ্গার কোল ঘেষে হাজারো ইতিহাস এবং ঐতিহাসিক সব ঘটনার সাক্ষী হয়ে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে, বাঙালি নবাবদের ঐত্যিহ্য এবং তাদের শৈল্পিক রুচির নান্দনিকতার মানদন্ড হিসেবে।

Related Post

মৃত্যু নিয়ে উক্তি

150+মৃত্যু নিয়ে উক্তি, বাণী, ক্যাপশন 2024

মৃত্যু নিয়ে উক্তি জন্মিলে মরিতে হবে আর এটাই সত্যি। মৃত্যু হচ্ছে সবচেয়ে চিরন্তন সত্যি। পৃথিবীতে প্রতিটি প্রাণীর মৃত্যুর স্বাদ অনুভব করতে হবে। সবসময় মৃত্যুর জন্য

Read More »
খুশির স্ট্যাটাস

200+ স্টাইলিশ খুশির স্ট্যাটাস | হাসি নিয়ে ক্যাপশন

খুশির স্ট্যাটাস | হাসি নিয়ে ক্যাপশন জীবনের সুন্দর খুশির মুহূর্ত আমরা সবাই বাঁধাই করে রাখতে চাই। আর এই খুশির মুহূর্তকে ধরে রাখার সবচেয়ে সহজ উপায়

Read More »

স্টাইলিশ ভালোবাসার ছন্দ | রোমান্টিক ছন্দ | Love Status Bangla

❤❤ভালোবাসার ছন্দ | ভালোবাসার ছন্দ রোমান্টিক | ভালোবাসার ছন্দ স্ট্যাটাস❤❤ ভালোবাসা হলো এক অন্যরকম অনুভূতির নাম, যা শুধুমাত্র কাউকে ভালবাসলেই অনুভব করা যায়। আমরা বিভিন্নভাবে

Read More »
মন খারাপের স্ট্যাটাস

মন খারাপের স্ট্যাটাস, উক্তি, ছন্দ, ক্যাপশন, কিছু কথা ও লেখা

মন খারাপের স্ট্যাটাস মন খারাপ – এই কষ্টের অনুভূতি কার না হয়? সবারই কখনো না কখনো সবারই মন খারাপ হয়। জীবনের ছোটোখাটো অঘটন থেকে শুরু

Read More »

Leave a Comment

Table of Contents