ইন্টারনেট অফ থিংস বা আইওটি (IoT) আধুনিক ডিজিটাল সভ্যতার আরেক বিস্ময়। একবার ভাবুনতো, এমন এক দুনিয়া যেখানে আপনার ব্রাশ সতর্ক করছে যে আপনি অনেক শক্ত করে ব্রাশ করছেন মাড়িতে ক্ষত হবে বা আপনি সকালে ঘুমে থেকে উঠার সাথে সাথেই কফি মেকার নিজেথেকে কফি বানাবে অথবা আপনার দেয়াল ঘড়িটি বলে দিবে আপনার ওষুধ খাবার সময় হয়েছে। এই সবই সম্ভব আইওটির মাধ্যমে , আর কিভাবে তা হয় , এটি কিভাবে আমাদে কাজকে আরো সহজ করবে ইত্যাদি নিয়ে সাজানো হয়েছে আমাদের আজকের লেখাটি।
ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT) কি?
এটি একটি ইন্টারনেট ভিত্তিক এক বিশেষ নেটওয়ার্ক যা ডিভাইস টু ডিভাইস এর অভ্যন্তরীন যোগাযোগে ব্যবহৃত হয়।
এটি হলো ভবিষৎ দুনিয়ার প্রযুক্তি যা বর্তমানে ব্যাপকভাবে ব্যবহার শুরু হয়েছে। যেমন একটি স্মার্ট হোমের কথা চিন্তা করুন, যেখানে প্রয়োজন অনুসারে বাতি নিজেই জলে নিভে বা গরমে ফ্যান নিজে থেকে চালু হয়ে রুম ঠান্ডা করে। আপনি বাসার বাইরে গেলে নিজে থেকেই সব ডিভাইস বন্ধ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ডিভাইসগুলোর যে নিজে থেকে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে, একেই আইওটি বলে। ডিভাইসগুলি ইন্টারনেটের মাধ্যমে যুক্ত থাকে বলে , একে ইন্টারনেট ও এভরিথিংস ও বলে হয়।
স্মার্ট ডিভাইস ?
আইওটি নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত ডিভাইসগুলিকেই স্মার্ট ডিভাইস বলে। যেমন, আপনার হাতের সাধারণ ঘড়িতে সময় দিয়ে থাকে কিন্তু এটি যখন আপনার হার্ডের বিটের প্ৰতিমাপ, হাঁটার বা দৌড়ের গতি ইত্যাদি নজরদারি করতে পারে , তখনি একে বলা হয় , স্মার্ট ঘড়ি বা স্মার্ট ডিভাইস।
ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT) এর ব্যবহার
আইওটি একটি খুবই আধুনিক মানের প্রযুক্তি যার ব্যবহার আমাদের জীবনকে আরো আধুনিক ও সহজ করে। আইওটির কিছু বিশেষ ব্যবহার:
স্মার্ট সিটি
পৃথিবীর অনেক উন্নতদেশের শহরগুলি স্মার্ট সিটিতে রূপান্তর হয়েছে। এখানে রাস্তায় সড়কবাতি নিজে থেকেই প্রয়োজন অনুসারে জলে নিভে, স্বয়ংক্রিয় ভাবে ট্রাফিক বাতি নিয়ন্ত্রণ হয়। স্মার্ট সিটিগুলি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অনেক সুবিধা দিয়ে থাকে। কোন গাড়ি ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করলে বা অতিরিক্ত গতিতে চললে স্বয়ংক্রিয় ভাবে মামলা হয়। রাস্তায় থাকা কৃত্রিম বুদ্ধিমান ক্যামেরাগুলি অপরাধীদের উপর নজরদারি করতে পারে। কোথাও আগুন লাগলে বা দুর্গতোনা ঘটলে স্মার্ট মনিটরিং সিস্টেম নিজে থেকে একটিভ হয়ে ফায়ার সার্ভিসে ফোন দেয়।
স্মার্ট হোম
বর্তমানে স্মার্ট হোমের ব্যবহার ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কেননা , স্মার্ট হোম স্বয়ংক্রিয় ভাবে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন হয়। বেশি গরম হলে ফ্যান বা এয়ারকুলার চালু হয় আর ঠান্ডায় রুম হিটার।
বাড়ির বাগানে, স্মার্ট ইরিগেশন সিস্টেম নিজে থেকে পানি প্রয়োগ করে। বাসার বাইরে গোলে সমস্ত দিবস , ফ্যান লাইট ইত্যাদি বন্ধ হয়ে যায়। ফ্রিজ টিভি ইত্যাদি প্রয়োজনীয় ডিভাইস অফিস থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। স্মার্ট হোমে, চাবি হারানোর ভয় নেই কেননা বাসার বাইরে থেকে দরজার লক নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
স্মার্ট অফিস
জ্বালানি সাশ্রয়ী ও পরিবেশ বান্ধব হয়ে থাকে। কর্পোরেট অফিসগুলিতে অপ্রয়োজনে অনেক লাইট , ফ্যান ও এয়ার কন্ডিশনার চালু করা থাকে। স্মার্ট অফিসে একটি কেন্দ্রীয় আইওটি বেইজ এয়ার কুলার সিস্টেম থাকায় এটি প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন জায়গার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। বৈদুত্যিক বাতিগুলিতে সেন্সর থাকায় আলোর প্রয়োজন অনুসারে বন্ধ বা চালু হয়।
অফিসের নিরাপত্তায় স্মার্ট সিসিটিভি থাকে যা বিশেষ এরিয়ার বা রুমে অনুমোদিত ব্যাক্তির অনুপ্রবেশ কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেয়। আবার অফিসে আগুন লাগলে স্বয়ংক্রিয় ভাবে ফায়ার সার্ভিস অফিসে ফোন যাবে , এবং ফায়ার এলার্ম বেজে উঠবে।
পরিধানযোগ্য ডিভাইস
পরিধানযোগ্য স্মার্ট ডিভাইসগুলোতে একাধিক সেন্সর থাকে যা শরীরের ও পরিবেশের ডেটা সবসময় পর্যবেক্ষণ করে থাকে। স্বাস্থ্যের ডেটা , সংয়ক্রিয় রং পরিবর্তন , ইনভিজিবিলিটি ইত্যাদি আধুনিক সুবিধার কারণে বর্তমানে ব্যাপকভাবে এটির ব্যবহার হচ্চে। কিছু বহুল ব্যবহৃত পরিধানযোগ্য স্মার্ট ডিভাইস:
- স্মার্ট কাপড়ঃ স্বয়ংক্রিয় ভাবে পরিবেশের ভিত্তিতে রং পরিবর্তন করতে পারে এবং থানা বা গরম তাপমাত্রার সাথে সমতারাখতে পারে।
- স্মার্ট জুয়েলারি: আঙুলের রিং , ব্রেসলেট ও কোমরের বেল্ট ইত্যাদি স্মার্ট আইওটি ডিভাইস।
- ফিটনেস ট্রেকার: সাধারণ ট্রেকিং স্যুট এর মতো দেখতে হলেও এগুলি ব্যবহারকারীর শরীরের তাপমাত্রা, হার্ডের গতি , হাঁটার বা দৌড়ের পদক্ষেপ ও দূরত্ব , কত ক্যালোরি বার্ন হয়েছে তার হিসাব করতে পারে। প্রয়জনজনে এই ডেটাগুলি আপনার ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে দিবে , আপনার শরীরের বর্তমান অবস্থা যাচাই করতে । বতমানে কিছু ফিটনেস ট্রেকার এর সাথে মিউজিক প্লেব্যাক ও জিপিএস ট্রেকার থাকে।
- স্মার্ট গ্লাস: চশমার ডিজিটাল ভার্সন যেখানে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার আর্গুমেন্ট রিয়েলিটি ও ভার্চুয়াল রিয়েলিটির অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়। যেসব ব্যাক্তি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইন পেশার সাথে যুক্ত তাদের যন্ত্রের প্রোটোটাইপ জিজাইন করতে ব্যবহার হতে পারে। আবার ঘুরতে গিয়ে এই গ্লাসে রাস্তার ম্যাপ দেখা যায় , কোন অচেনা জায়গার বিস্তারিত তথ্য চোখের সামনে ভেসে আসে।
- স্মার্ট ওয়াচ: ওয়ারেবল ডিভাইসগুলোর মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত। বিশেষত স্বাস্থ সচেতন মানুষের জন্য এটি স্মার্ট ট্রেকার এর মতো অনেক হেলথ ডাটা মনিটর করতে পারে। এটি ফোনের সাথে সংযুক্ত হয়ে ফোনের নোটিফিকেশন , ফোনকল রিসিভ , ইনস্ট্যান্ট মেসেজ রিপ্লে , মেইল পড়া ইত্যাদি কাজ করতে পারে। স্মার্ট বাচা এ জিপিস , মিউজিক সিস্টেম ও পেইমেন্ট করার সুবিধা থাকে।
ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT) এর সুবিধা
এর অনেকগুলি সুবিধার সাথে আমরা ইতিমধ্যে পরিচিত, তার মধ্যে অন্যতম সুবিধা গুলো:
- কর্মদক্ষতা ও উৎপাদন বৃদ্ধি করে
- অফিস বা বাসার পরিচালনা খরচ হ্রাস করে
- বুদ্ধিমত্তা পূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে জীবন সহজ করে
- নতুন পণ্য ও প্রযুক্তি তৈরিতে গবেষকদের সাহায্য করে
- প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক পরিষেবার মান উন্নত করে
- অফিস বা বাসার নিরাপত্তা ও সুরক্ষার উন্নতি করে
- এটি সাসটেইনেবল প্রযুক্তি
- বিশেষ মানুষদের ক্ষেত্রে অ্যাক্সেসযোগ্য বৃদ্ধি করে
- ব্যবসায়ের জন্য নতুন সুযোগ
- জীবনযাত্রার মান আধুনিক করে
ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT) এর অসুবিধা
এর সুবিধার পাশাপাশি অনেকগুলো অসুবিধা আছে , তাদের মধ্যে অন্যতম:
- অতিমাত্রায় ডিভাইস ও সেন্সরের ব্যবহার স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে
- বেশিরভাগ ডিভাইস এর মূল্য অনেক বেশি হয়ে থাকে।
- পরিবেশের উপর প্রভাব ফেলে।
- হ্যাক হলে নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার জন্য হুমকি হবে
- কাজের জটিলতা বৃদ্ধি করতে পারে
- নতুন প্রযুক্তি তাই, মানদণ্ডের অভাব আছে
- বহুলমাত্রায় ইন্টারনেট সংযোগের উপর নির্ভরশীল
- ডেটা ওভারলোড হতে পারে
- অনেক মানুষের চাকরি দখল করবে
- প্রযুক্তির অপরিপক্কতার কারণে অপব্যবহার হয়
কিভাবে ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT) কিভাবে কাজ করে?
বেশিরভাগ IoT সিস্টেম সাধারণত চারটি প্রধান উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত, এদের সমন্বয়ে কোন সেবা প্রদান করতে পারে। উদহারণ হিসাবে আমরা একটা স্মার্ট হাতের ব্যাচেলেটকে নিতে পারি।
সেন্সর এবং ডিভাইস: মূল ডিভাইসের সাথে সেন্সর যুক্ত করা থাকে যা পরিবেশ ও আমাদের শরীর থেকে ডেটা সংগ্রহ করে। এই সেন্সর সেন্সর বিভিন্ন ধরনের প্যারামিটার পরিমাপ করতে পারে, যেমন পরিবেশের তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, চাপ, গতি , শব্দ এবং শরীরের থেকে তাপমাত্রা, রক্তের চাপ , হার্ড বিট ইত্যাদি ডেটা নিতে পারে।
সংযোগ নেটওয়ার্ক: এটি একটি নেটওয়ার্ক অবকাঠামো যা ব্যবহার করে সেন্সর এবং ডিভাইসকে ক্লাউড সার্ভারে যুক্ত হয় ও শরীর ও পরিবেশ থেকে প্রাপ্ত ডেটা সার্ভারে প্রেরণ করে।
ডেটা পাঠানোর ও যোগাযোগের জন্য বিভিন্ন প্রোটোকল ও নেটওয়ার্ক ব্যবহার হয়, যেমন Wi-Fi, Bluetooth, সেলুলার নেটওয়ার্ক এবং LPWANs।
ক্লাউড সার্ভার: সেন্সর এবং ডিভাইস থেকে সংগৃহীত ডেটা ক্লাউড সার্ভারে সংরক্ষণ করা হয়। পরবর্তীতে এই ডেটা প্রক্রিয়াকরণ এবং বিশ্লেষণের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম এ প্রেরণ করা হয়।
অ্যাপ্লিকেশন: অ্যাপ্লিকেশন ডেটা এবং ডিভাইস এর মধ্যে ইন্টারঅ্যাক্ট করতে ব্যবহৃত হয়। এটি ক্লাউড সার্ভার থেকে প্রাপ্ত ডেটাকে বিশ্লেষণ করে, ব্যবহারকারীকে প্রয়োজনীয় রিপোর্ট প্রদান করে। হাঁটার সময় হার্ডবিট বেড়ে জেলে আপনার ব্রেসলেট থেকে মেসেজ করে সতর্ক করে দিবে।
আইওটি অ্যাপ্লিকেশনগুলি বিভিন্ন প্রকারের ডিভাইসে রান করতে পারে, যেমন স্মার্টফোন, ট্যাবলেট এবং কম্পিউটার।
ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT) এর ভবিষ্যত
আমরা ক্রমশই একটি সম্পূর্ণ ডিজিটাল দুনিয়ার দিকে ধাবিত হচ্ছি, যেখানে সব কিছুই হবে স্মার্ট।যার শুরু ইতিমধ্যে হয়ে গেছে, প্রযুক্তির সাথে সাথে বেশি মানুষ আইওটি ডিভাইসগুলোর সাথে যুক্ত হচ্ছে। কেননা, আইওটির মাঝে আমাদের দুনিয়া কে আমূলে বদলে দেবার ও আমাদের জীবন সহজ করার সক্ষমতা আছে। আইওটি সমন্ধে প্রযুক্তিবিদদের কিছু ধারণা:
- আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ব্যাক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আইওটি ডিভাইস ব্যবহার এক বিলিয়ন পৌঁছবে।
- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিং এর জনপ্রিয়তা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধির সাথে সাথে আইওটি ডিভাইসগুলিও অনেক কার্যকরী ও স্মার্ট হয়ে উঠবে।
- খুব দ্রুতই বেশিসংখ্যক মানুষ এতে অভ্যস্থ হয়ে উঠবে এর স্বাস্থ্য নিরাপত্তার ফিচারগুলির জন্য।
- সমাজবিজ্ঞানীদের ধারণা, ইন্টারনেটের কারণ মানুষের ব্যাক্তিজীবন ও নিরাপত্তার যা ক্ষতি হয়েছে তার আরো বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে আইওটি।
তাই একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে , ভবিষৎতের ডিজিটাল দুনিয়া হতে যাচ্ছে ইন্টারনেট অব থিংস (IoT) নির্ভরশীল এক স্মার্ট দুনিয়া।