Dreamy Media BD

চিরঞ্জীব বঙ্গবন্ধু

চিরঞ্জীব বঙ্গবন্ধু

শ্রেষ্ঠ নেতা সে-ই, যার অধীনে কোনওকিছু অর্জিত হলে তার সাথে জড়িত প্রতিটি মানুষই ভাবে যে তারা সবাই মিলে কাজটি করেছে” – লাও ঝু (প্রাচীন চীনা দার্শনিক)

এই উক্তিটির মাধ্যমে একজন শ্রেষ্ঠ নেতার আদর্শ কেমন হওয়া উচিত তা জানা যায়। ইতিহাস ঘাটলে এমন অনেক মহান নেতাদের খুঁজে পাওয়া যায় যারা কেবলমাত্র নেতৃত্বই দেয়নি, বরং একটি জাতির পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছে। যাদের আবির্ভাব একটি জাতিকে আলোকিত করেছে ঐক্যের পথ চিনিয়েছে। বাঙালি হিসেবে গর্বের সাথে আমরাও বলতে পারি আমাদেরও এমন একজন মহান নেতা ছিলেন।

আমাদের বাংলার বন্ধু আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একজন দূরদর্শী নেতা। যার নেতৃত্বে আজ আমরা বাঙালিরা স্বাধীন। সকল পরাধীনতার বাঁধ ভেঙে আমরা আজ একটি উন্নত জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারি। যে বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটি পালন করেছিলেন, বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্য এবং ক্ষমতায়নের বোধ জাগিয়ে তুলেছিলেন আজ সেই বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকী। বাংলার ইতিহাসে, প্রত্যেকটি বাঙালির জীবনে সবচেয়ে শোকাহত একটি দিন।

বঙ্গবন্ধুর মত এমন সাহসী সংগ্রামী নেতা আর কখনোই বাঙালির পাওয়া হবে না। বঙ্গবন্ধুকে হারানোর এই দুঃখ বাঙালির কখনোই পূরণ হয়ে উঠবে না। আমাদের এই মহান নেতা আমাদেরকে স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেবার জন্যে নিজের সর্বস্ব দিয়ে লড়াই করেছিলেন। শত নিপীড়ন অত্যাচারের পরেও তাকে দমানো যায়নি। বাঙালির অধিকার আদায়ের জন্য, বাঙালিকে শান্তির পথে পরিচালিত করার জন্য, বাঙালির বিজয় নিশ্চিত করার জন্য তিনি বিভোর ছিলেন। তাইতো তার নামের পাশে স্নেহময়ী “বাংলার বন্ধু” কথাটি রচিত হয়।

আজ জানবো আমাদের এই মহান নেতার পূর্ণ জীবনী সম্পর্কে। সাধারণ একজন মানুষ হয়েও কিভাবে তিনি সকলের কাছে অসাধারণ হয়ে উঠেছেন। তার জীবনী পড়তে পড়তে বাঙালি হিসেবে আরো একবার নিজেকে গর্বিত করে তুলবো। চলুন তবে শুরু করা যাক-

বঙ্গবন্ধুর কিশোরকাল:

সাল তখন ১৯২০। মার্চের সতের তারিখ বাবা মায়ের কোল আলো করে ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটাগাতি ইউনিয়নের টুংগীপাড়া গ্রামে‌ জন্ম নেন একটি ছোট্ট শিশু। বাবা শেখ লুৎফর রহমান এবং মা শেখ সায়েরা খাতুনের আদুরে সন্তানের নাম রাখা হয় শেখ মুজিবুর রহমান। নামটি রেখেছিলেন তার নানা শেখ আব্দুল মজিদ।

নামটি রাখার সময় মেয়েকে বলেছিলেন ” সায়েরা তোর ছেলেরে নাম একদিন জগৎ জোড়া মানুষের মুখে মুখে রোটবে”। সত্যিই আজ মহান নেতার নাম বিশ্ব দরবারের প্রতিটি মানুষ জানে। কে জানত ছোট্ট এই ছেলেটি একদিন বাঙালি জাতির আদর্শ হয়ে উঠবে।

বাবা-মা আদর করে তাকে ডাকতেন “খোকা”। ছয় ভাই বোনের মধ্যে শেখ মুজিবুর ছিলেন তৃতীয়তম সন্তান। দুই বোনের পরেই জন্ম হয়েছিল তার। প্রথম পুত্র সন্তান হিসেবে সকলের চোখের মনি ছিলেন শেখ মুজিব। পরিবারের সকলের স্নেহ মমতায় ধীরে ধীরে বড় হতে থাকেন শেখ মুজিব। বিশাল শেখ পরিবারের তিনি ছিলেন এক মধ্যমণি।

শৈশব কেটেছে তার অসম্ভব মায়া মমতায়। গ্রামের পথ ঘাট বৃষ্টি সকলেই যেন শেখ মুজিব কে চেনে। ফসলের মাঠে ঘুরে বেড়ানো, নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটা, বন্ধুদের সাথে বৃষ্টিতে ভেজা, গাছ বেয়ে উঠে আম চুরি করা এগুলো ছিল তার নিত্যদিনের সঙ্গী। বাংলার প্রকৃতিকে তিনি ছোট থেকেই আঁকড়ে ধরেছিলেন। শুধু তাই নয় পশু পাখির প্রতিও ছিল তার অসম্ভব স্নেহ। রাস্তা থেকে একটি আশ্রয়হিন কুকুরকে ধরে এনে শুরু করলেন লালন পালন। আরেকদিন ধরে আনলেন একটি শালিক পাখির ছানা একটি ময়না পাখির ছানা। পরম যত্নে পুষতে শুরু করলেন পাখি দুটোকে। পশু পাখিদের কেউ কষ্ট দিলে তিনি কখনোই সহ্য করতে পারতেন না।

একটু বড় হওয়া মাত্রই বাড়ি থেকে মাইল খানেক দূরের গিমাডাঙ্গা প্রাইমারি স্কুলে তাকে ভর্তি করে দেওয়া হয়। রেখে দেওয়া হয় তিনটি গৃহ শিক্ষকও। যাদের কাছে তিনি বাংলা ইংরেজি এবং গণিতের দীক্ষা নিতেন। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত তিনি ওই স্কুলে পড়াশোনা করেন। বর্ষাকালে যখন চারিদিক পানিতে থৈ থৈ করত তখন তাকে নৌকায় চড়ে স্কুলে যেতে হতো। একদিন হঠাৎ করেই স্কুল থেকে তিনি বাড়ি ফেরার সময় নৌকাটি উল্টে খালে ডুবে যায়। ভাগ্য ক্রমে ওই যাত্রায় বেঁচে যায় মুজিব। তার মা শুনে হক চকিয়ে যায়। ছেলে কি আর ওই স্কুলে পাঠাবেনই না তিনি।

তার বাবা তখন চাকরি করতেন গোপালগঞ্জ শহরে। সেখানে থেকেই তাকে চাকরি করতে হতো। এই ঘটনার পর শেখ মুজিবকে তার বাবার কাছে শহরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। চতুর্থ শ্রেণীতে শহরের স্কুল গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে তাকে ভর্তি করে দেওয়া হয়। সেখানে বাবার সাথে বেশ ভালই দিন কাটছিল শেখ মুজিবের। পড়াশোনাও চলছিল পুরো দমে। নতুন অনেক বন্ধু হলো। খেলাধুলার প্রতি তার ছিল অনেক টান। তাই ছোট থেকেই তিনি ছিলেন কিছুটা রোগা প্রকৃতির।

১৯৩৪ সালের দিকে তিনি যখন সপ্তম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত সেই সময় হঠাৎ করেই বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হলেন। তার হার্ট অনেক বেশি দুর্বল হয়ে পড়ল। চিকিৎসার জন্য তার বাবা থাকে কলকাতায় নিয়ে গেলেন। বড় বড় ডাক্তারের কাছ থেকে চিকিৎসা করানো হলো। টানা দুই বছর ধরে চলল তার চিকিৎসা। ধীরে ধীরে তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন। ১৯৩৬ সালের দিকে তার বাবা মাদারীপুর বদলি হয়ে গেলেন। সাথে করে ছেলেকেও নিয়ে গেলেন। ছেলে অসুস্থ তাই  তাই যত্ন করার জন্য সাথে করে মাকেও আনলেন।

সেই বছরই হঠাৎ করেই চোখের গ্লুকোমা অসুখ হলেন শেখ মুজিবের। আবারো ডাক্তাররা বললেন কলকাতায় নিয়ে যেতে। চিকিৎসার জন্য তাকে আবারও কলকাতায় নিয়ে ছুটতে হলো। কলকাতার তখনকার নামকরা ডাক্তার আহমেদের কাছে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলো। ডাক্তার বললেন তার চোখের অপারেশন করাতে হবে। না হলে তিনি অন্ধ হয়ে যাবেন। কলকাতা মেডিকেল কলেজে তাকে ভর্তি রাখা হলো। অপারেশনের কথা শুনে শেখ মুজিব আঁতকে উঠলেন। মনে মনে তিনি পরিকল্পনা সাজালেন অপারেশন করবেন না হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাবেন। তবে তার পরিকল্পনা সফল হয়ে উঠল না।

পরদিন সকাল ৯ টায় তার অপারেশন শুরু হল। দশ দিন ধরেই তার দুই চোখের অপারেশন ও নানা চিকিৎসা করা হলো। তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন। তবে ডাক্তার বললেন বেশ কিছুদিন তার পড়ালেখা বন্ধ রাখতে হবে। চোখের উপর খুব একটা প্রেসার দেওয়া যাবে না। এবং তাকে চশমা ও পড়তে হবে। সেই ১৯৩৬ সাল থেকে তার চশমা পড়া শুরু হলো। এবং পরবর্তী আজীবন তাকে চশমা বয়ে বেড়াতে হয়েছে। তবে চশমা যেন তার ব্যক্তিত্ব আরও বেশি ফুটে উঠতো। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর ১৯৩৭ সালের দিকে আবার লেখাপড়া শুরু করলেন তিনি। তবে এবার আর তিনি আগের স্কুলে ফিরে গেলেন না।

তার বাবা তাকে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। সেই সময় তার বাবাও চাকরি বদলি হয়ে গোপালগঞ্জ ফিরে আসেন। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা ও মুজিব বেশ পারদর্শী ছিলেন। ফুটবল খেলা ছিল তার সবচেয়ে প্রিয়। ফুটবলের পাশাপাশি টেনে ভলিবল এবং হকিও খেলতেন। স্কুলের স্পোর্টস টিমে তার ভালো একটি অবস্থান ছিল। তাকে বিভিন্ন জায়গায় খেলতেও নিয়ে যাওয়া হতো।

তার বাবাও ফুটবল খেলা অনেক পছন্দ করতে। তাই ছেলের খেলা দেখতে তিনিও সাথে যেতেন। তার বাবা-ছিলেন অত্যন্ত সৎ নিষ্ঠাবান একজন মানুষ। বাবাকে যেমন মুজিব ভালোবাসতেন তেমনি ভয়ও পেতেন। তার বাবা ছিলেন অত্যন্ত উদার মনের একজন মানুষ। ছেলেকেও তিনি উদার এবং দয়াশীল হতে শিখিয়েছিলেন। অসুস্থতার কারণে তিনি চার বছর পড়ালেখায় পিছিয়ে গিয়েছিলেন। তাই তার সহপাঠীদের তুলনায় তার বয়স একটু বেশি ছিল। তবুও সহপাঠীদের সাথে বেশ ভালই খাতির ছিল তার।

পড়াশোনার জন্য তাকে একটি গৃহ শিক্ষকও রেখে দেওয়া হয়েছিল। গৃহ শিক্ষকের নাম ছিলেন কাজী আব্দুল হামিদ। তার গৃহ শিক্ষকের কাছেই তিনি প্রথম সংগঠন কি এবং কিভাবে করতে হয় সেই শিক্ষা পেয়েছিলেন। তার মাস্টার সাহেব একটি সংগঠন করেছিলেন যার নাম দিয়েছিলেন “মুসলিম সেবা সমিতি”। এই সমিতির লক্ষ্য ছিল গরীব ছেলেমেয়েদের সাহায্য করা। সংগঠনে জড়িত থাকা প্রত্যেকেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে এক দু মুঠ করে চাল তুলতেন। এবং সেই চাল জমিয়ে তা বিক্রি করা হতো। যা টাকা পাওয়া যেত তা দিয়ে গরিব ছেলে মেয়েদের বই কিনে দেওয়া হতো। অনেক সময় পরীক্ষার ফি ও দিয়ে দিতেন অন্যান্য খরচও দেওয়া হতো। এছাড়াও যে সকল শিক্ষার্থীদের থাকা খাওয়ার কোন নির্দিষ্ট ব্যবস্থা ছিলেন না তাদেরকে থাকার একটি জায়গা করে দিতেন মাস্টার সাহেব।

মাস্টার সাহেবের সাথে সংগঠনের জড়িত ছিলেন মুজিব নিজেও। রোববার যখন তার স্কুল বন্ধ থাকতো মুজিব তার বন্ধুদের নিয়ে মাস্টার সাহেবের সাথে বাড়ি বাড়ি চাল তুলতে যেতেন। জনগণের সেবা করার কাজ করতেন। কিছুদিন পরেই মাস্টার সাহেব যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। পুরো সমিতির দায়ভার তখন গিয়ে বলল মুজিবের উপর। তার স্কুলের আরো একজন মাস্টার এই সমিতির সভাপতি দায়িত্বে ছিলেন যার কাছে যাবতীয় টাকা পয়সা জমা থাকতো। তারা দুজনে মিলেই সব কাজ সামলানো শুরু করলেন। মুজিবের বাড়ির সকলেই তাকে এই কাজে উৎসাহিত করত। ১৯৪২ সালে তিনি এসএসসি পাস করেন। এভাবেই কেটে গেল তার কিশোরকাল।

Sheikh Mujibur Rahman Early Age
Sheikh Mujibur Rahman Early Age

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন

ছোট থেকেই বঙ্গবন্ধু অনেক বেশি সাহসী এবং নীতিবান একজন মানুষ ছিলেন। আর সাহসিকতার জন্য তিনি সর্বদাই সকলের কাছে বাহবা পেতেন। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ঘটে তার ছাত্র জীবনেই। এবং সেটা স্কুল থেকেই। স্কুলে থাকাকালীন একবার অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য তাকে জেলে যেতে হয়। এবং সেই সময় তিনি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। তাছাড়াও নেতৃত্ব দলের ক্ষমতাও তার স্কুল থেকেই ছিল।

১৯৩৯ সালে তার স্কুলে পরিদর্শন করতে গিয়েছিলেন তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং বাংলার প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকর্তা হোসেন মোহাম্মদ শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তারা যখন পরিদর্শন এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু সাহস করে একটি দল তৈরি করেছিলেন এবং দলবল নিয়ে তাদের কাছে একটি প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। প্রস্তাবটি ছিল তাদের স্কুলের ভাঙ্গা ছাদ সংস্কার করে দেওয়ার। গণ্যমান্য এই নেতাদের সামনে তার সাহসিকতার সাথে প্রস্তাব তুলে ধরার এই উদ্যম দেখে সকলেই অবাক হয়েছিলেন।

১৯৪০ সালের দিকে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যুক্ত হন। এভাবেই কাটছিল তার দিন। ১৮ বছর বয়সে তার সহধর্মিনী শেখ ফজিলাতুন্নেছার সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তারপর স্কুল শেষে তিনি কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে আইন বিভাগে ভর্তি হয়। কলেজে থাকাকালীন তিনি সরাসরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।

১৯৪৩ সালের দিকে তিনি বেঙ্গল মুসলিম লীগে যুক্ত হন এবং বাঙালি মুসলিম নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্য পান। সেই সময় তার ছাত্র আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করা। ১৯৪৩ সালে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর হিসেবেও নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর ১৯৪৪ সালের দিকে কলকাতায় ফরিদপুরবাসীদের নিয়ে গঠিত “ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট অ্যাসোসিয়েশন” এর  সেক্রেটারি হিসেবে তাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়।

এর ঠিক দুই বছর পরেই তার কলেজে তিনি ইউনিয়নের মহাসচিব হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে কলকাতা ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বিএ ডিগ্রী লাভ করেন। অতঃপর পাকিস্তান এবং ভারত বিভক্ত হয়ে যাওয়ার পরে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের ফিরে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন।

১৯৪৮ সালের জানুয়ারি ৪ তারিখ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ নামে একটি ছাত্র সংগঠন তৈরি করেন তিনি। এবং পূর্ব বাংলার ছাত্রনেতায় পরিণত হন। তার এই ছাত্রলীগ স্বাধীনতা অর্জনে বিশাল ভূমিকা রেখেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে পড়াকালীন সময় থেকেই তিনি পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ গড়ে তুলেছিলেন। পূর্ব বাংলার মানুষের উপর থেকে পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য।

দেশ বিভক্ত হওয়ার পর ১৯৪৮ সালের দিকে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্য ঘোষণা দেওয়া হয়। এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার জন্য শেখ মুজিবুর ছাত্র আন্দোলন গড়ে তুলে। ১৯৪৯ সালের জুনের ২৩ তারিখে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করা হলে শেখ মুজিব কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন।

তখন তার বয়স ছিল ২৯ বছর। রাজনীতিতে তার গভীর মনোনিবেশ এর কারণে ১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই তাকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচিত করা হয়। সেই বছরেরই ১৪ ই নভেম্বর অন্যান্য দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হয় সাধারণ নির্বাচনের জন্য। অতঃপর ১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা হয়। এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২৩৭টি আসনের মধ্যে ২২৩ টি আসনে বিশাল এক ব্যবধানে বিজয় লাভ করে। এবং এর মধ্যে 143 টি আসন লাভ করেছিলেন আওয়ামীলীগ।

শেখ মুজিব বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয় লাভ করেন গোপালগঞ্জ আসনে। তারপর তাকে কৃষি ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নির্বাচিত করা হয়।১৯৫৫ সালের ৫ জুন তাকে আইন পরিষদের সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়। সতেরই জুন পল্টনে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে শেখ মুজিব ২১ দফা দাবি পেশ করেন। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগের এক বিশেষ অধিবেশনে সর্বসম্মেলনে সকলের সম্মতিতে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি কেটে দেওয়া হয়। আইন পরিষদের সদস্য হিসেবে শেখ মুজিব পরবর্তীতে একযোগে শিল্প, দুর্নীতি দমন, শ্রম মন্ত্রণালয়, ভিলেজ এইড দপ্তরের অধীনেও দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি তার দলে তার সর্বোচ্চ সময় ব্যয় করার জন্য হাজার ১৯৫৭ সালের ৩০ শে মে মন্ত্রীপরিষদ থেকে‌ পদত্যাগ গ্রহণ করেন। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা দেশের সামরিক আইন জারি করেন। এবং সকল ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। তার ঠিক ২০ দিন পরেই ২৭ অক্টোবর মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা কে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন আইয়ুব খান। এবং সেই বছরের ১১ অক্টোবর শেখ মুজিবুর রহমানকে আটক করা হয়েছিল।

সকল রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পর শেখ মুজিবুর রহমান গোপনে একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। যার নাম দিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ। এই পরিষদের উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনতা আধার লক্ষ্যে কাজ করা। আইয়ুব খানের বিরোধী নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগামী ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ষাটের দশকের মধ্যভাগে আওয়ামী লীগ আবার পুনর্জীবিত হয়। কারন সেই সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক নেতায় পরিণত হয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারিতে লাহোর বিরোধী দলেরা এটি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত করে। এবং এই সম্মেলনেই শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবি তুলে ধরেছিলেন। এই দাবির বিষয়টি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের উপর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের সাহিত্য শাসন উঠিয়ে নেওয়া। কিন্তু এই দাবি পশ্চিম পাকিস্তানরা প্রত্যাখ্যান করে এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে বিচ্ছিন্নবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তাই তিনি সম্মেলন বর্জন করে পূর্ব পাকিস্তানের চলে আসেন। এবং ছয় দফা দাবি কার্যকর করার জন্য পূর্ব বাংলায় গণ আন্দোলন গড়ে তোলেন। সেনাবাহিনীরা তাকে দুই বছর জেলে আটক করে রাখেন। অতঃপর ১৯৬৮ সালের দিকে তিনি ছাড়া পান।

পাকিস্তানি সরকার সেই সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার ৩৪ জন সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। যেটা ইতিহাসে সকলের পরিচিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। মামলায় বলা হয়েছিল শেখ মুজিবুর এবং তার কর্মকর্তারা আগরতলা শহরে ভারত সরকারের সাথে একটি বৈঠকে পাকিস্তানকে বিভক্ত করার জন্য ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা করেছেন। এবং এই মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রথম আসামী হিসেবে গণ্য করা হয়। সকল আসামিদেরকে আবার সেনানিবাসে আটক করে রাখা হয়।

কিন্তু এই মামলাকে মিথ্যা ঘোষণা করে আন্দোলনে নেমে আসেন সর্বসাধারণ। শেখ মুজিবুর কে মুক্তি দেওয়ার দাবি জানায়।আগরতলা মামলার বিচারকার্য চলাকালীন ১৯৬৯ সালের জানুয়ারির ৫ তারিখে ১১ দফা পেশ করা হয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে। এবং এই ১১ দফার মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফার সবগুলো দাবি উল্লেখ করা ছিল। পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবি নিয়ে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। এবং এই ছাত্র সংগ্রাম একসময় তীব্র আন্দোলনের রূপ ধারণ করে।

এই আন্দোলনে ইতিহাসে ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান নামে পরিচিত। টানা মাসব্যাপী প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের পর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান আগরতলা মামলা তুলে নেন। এবং শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সাথে যাদেরকে আটক করা হয়েছিল তাদের সবাইকে মুক্তি দেওয়া হয়। একই বছরের ২৩ শে ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মানে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে একটি সভার আয়োজন করা হয়েছিল। রাজনীতিতে ভূমিকার জন্য একেক  সময় একেক নেতাকে একেক নামে ভূষিত করা হয়েছিল। যেমন ফজলুল হকের শেরে বাংলা খেতাব দেওয়া হয়। তেমনি শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু মানে বাংলার বন্ধু যিনি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের বিপদে-আপদে সবার আগে এগিয়ে আসেন। তাদেরকে দিকনির্দেশনা দেন।

অতঃপর ১৯৬৯ সালে ডিসেম্বরের ৫ তারিখে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত ১ জনসভায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ নামকরণ করা হবে। বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণা ছাড়া দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নবাদী নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কিন্তু অপরদিকে বঙ্গবন্ধুও পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক জনবল গড়ে তুলেছিলেন। এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রভাবশালী নেতা হিসেবে তার আবির্ভাব হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিলেন। তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির প্রবল বিরোধিতা করেন।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে একজন সভায় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেন বাঙালিকে অত্যাচার মুক্ত করার জন্য। এবং জনগণকে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হতে বলেন। তারপর পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং শেখ মুজিবুর রহমান সহ সকল নেতাদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাংলার মানুষের জীবনকে ধ্বংস করতে ২৫ শে মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে। এবং ওই রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানি নিয়ে যাওয়া হয়।

গ্রেফতারের পূর্বে বন্ধু বলেছিলেন “এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষ কে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আমাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।”  বঙ্গবন্ধুর এই সাড়া দিয়েছিলেন পুরো বাংলার মানুষ। এরপরই শুরু হয় যুদ্ধের সূচনা।

Sheikh Mujibur Rahman
Sheikh Mujibur Rahman

বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে বাঙালির স্বাধীনতা অর্জন

পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা পূর্ববাংলায় হামলার সিদ্ধান্ত নেন। এবং তাদের এই পরিকল্পনা তীব্র ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। শুরু হয় রক্তপাত। রাজাকাররা একে একে পূর্ব পাকিস্তানের জড়ো হওয়া শুরু করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে দখল করা। স্বাধীনতা কামি মানুষদেরকে হত্যা করে অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া। শুরু হলো যুদ্ধ।

যুদ্ধকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে আটকে রাখা হয়। কিন্তু পূর্ব বাংলার মানুষ দমে থাকে নি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে নিয়ে তারা লড়াই করে দিয়েছে। রাজাকাররা প্রথমেই একে একে বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, ও ছাত্র নেতাদের হত্যা করে। এরপর হামলা চালায় সাধারণ মানুষের উপর। হিংস্র রাজাকাররা একে একে নারীদের উপর অত্যাচার চালাতে থাকে। বন্দী করে ধর্ষনের পর হত্যাযজ্ঞ চালায়। এমনকি হিংস রাজাকাররা ছোট ছোট শিশুদেরও রেহাই দেয়নি।

সকল বয়সের মানুষ এই হিংস্রতার শিকার হয়েছে। শহীদ হয়েছে লাখো মানুষ। বীরাঙ্গনা হয়েছে শত শত বাঙালি নারী। কত মানুষ যে পিতৃহারা, মাতৃহারা,‌স্বামী হারা, হয়েছে তার কোন হিসেব নেই। তবুও বাঙ্গালীকে হার মানানো যায়নি। বাংলার মানুষের মনে এই সাহস দিয়ে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বীরত্বের সাথে লড়াই করে অধিকার রক্ষা করেন বাঙালি জাতি। বাংলার দুরন্ত ছেলেরা বীরত্বের সাথে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীদের পরাজিত করেছেন।

দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। দেশ স্বাধীনতা পাওয়ার পর ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানি শাসকবৃন্দরা মুক্তি দেয়। এরপর তিনি লন্ডন এবং দিল্লি থেকে ঘুরে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে অবস্থান করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বাংলায় আবার নতুন করে মন্ত্রী পরিষদ গঠন করা হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।

শোকাহত ১৫ ই আগস্ট

১৫ ই আগস্ট বাঙালির জীবনের সবচেয়ে বেদনাদায়ক দিন। ঘটনার সূত্রপাত হয় ১৪ই আগস্ট থেকে। প্রতিদিনের মতোই সকালটা সুন্দরভাবেই শুরু হয়েছিল। পুরো রাজধানীজুড়ে চলছিল ব্যাপক উত্তেজনা। কারণ পরের দিনই তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করতে যাওয়ার কথা। কিন্তু অপরদিকে চলছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা। সন্ধ্যা আসার সাথে সাথেই সেনাবাহিনীর টু ফিল্ড রেজিমেন্টের কামানবাড়ি গাড়িগুলো চলতে শুরু করলো।

রাত তখন দশটা। বেঙ্গল ল্যান্সারের টি-৫৪ ট্যাংক গুলো এসে থামলো বিমানবন্দরের বিস্তীর্ণ মাঠে। একে একে জড়ো হল ১৮ টি কামান ও ২৮ টি ট্যাংক গাড়ি। রাত ১১.৩০ টার দিকে এসে হাজির হলেন মেজর নুর, মেজর ডালিম, মেজর শাহরিয়ার, মেজর রাশেদ, মেজর পাশা, মেজর হুদা সহ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী আরও ঘাতকের। ঠিক ১৫ ই আগস্ট রাত বারোটার দিকে একটি ব্রিফিং করে মেজর ফারুক। সেই সময় সকলে জানতে পারলেও আজ রাতে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হবে।

ভোর তখন সোয়া পাঁচটা। ধানমন্ডিতে চলল হত্যাযজ্ঞ। চারদিকে বুলেটের ছড়াছড়ি। ভোর পাঁচটা দশ মিনিটে রিসালদার মোসলেম উদ্দিন এসে হাজির হন ধানমন্ডির শেখ মণির ভাষার গেটে। সাথে নিয়ে আসেন দুই ট্রাক ভর্তি সৈন্য। প্রতিদিন সকালে উঠে পত্রিকা পড়ার অভ্যাস বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ মণির। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর চোখের মণি। প্রতিদিনের মতোই সেদিন ও ড্রয়িং রুমে বসে তিনি পত্রিকা পড়ছিলেন। দরজা খোলা পেয়ে শতাংশ ঢুকে পড়েন মোসলেম। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মোসলেম তার হাতের স্টেনগান দিয়ে শেখ মণিকে ছিন্নভিন্ন করে দিলেন। মাটিতে লুকিয়ে পড়ল শেখ মণি। গুলির আওয়াজ পেয়ে ছুটে এলেন অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী। তাকেও ব্রাশফায়ার করা হলো। কেবল প্রাণে বেঁচে ছিলেন তাদের দুই সন্তান শামস পরশ ও শেখ ফজলে নূর তাপস।

প্রথম হত্যাযজ্ঞ এই বাড়িতে চালানোর পরে দ্বিতীয় হত্যাযজ্ঞ টি চালানো হয় ধানমন্ডির আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায়। তিনি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের ভগ্নিপতি। ভোর তখন ৫ টা ১৫। পাহারত পুলিশদের প্রথম অবস্থায় গুলি করা হয়। গুলির শব্দে জেগে ওঠেন সেরনিয়াবাত। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ফোন করার জন্য তিনি ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। কিন্তু তাকে আর সেই সুযোগ দেওয়া হয় না। দরজা ভেঙে ঘাতকেরা ঘরে ঢুকে পড়েন। এবং ব্রাসফায়ারে হত্যা করা হয় সেরনিয়াবাতকে। ছোট ছোট শিশুদেরও রক্ষা দেওয়া হয়নি। হত্যা করা হয় তার চোদ্দ বয়সের বয়সী মেয়ে বেবীকে, ১২ বছর বয়সী ছেলে আরিফকে, ‌ চার বছর বয়সের নাতি বাবুকে। আরো হত্যা করা হয় তার ভাগ্নে ভাতিজা সহ তিন অতিথি এবং চার কাজের লোককে। শুধুমাত্র প্রাণ নিয়ে বেঁচে যান তার বড় ছেলে হাসানাত।

সর্বশেষ হত্যাযজ্ঞ টি চালানো হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নাম্বার বাড়িতে। ভোর তখন সাড়ে পাঁচটা। ইতিমধ্যেই বঙ্গবন্ধু তার ভগ্নিপতির হত্যার খবর জেনে গিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু উপরের ঘরে ছিলেন এবং মেচ তলায় ছিলেন দুই গৃহকর্মী সেলিম ও আব্দুর রহমান শেখ রমা এবং বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারি এ এফ এম মহিতুল ইসলাম। তৎক্ষণাৎ বঙ্গবন্ধু মহিতুলকে ফোন করেন এবং বলেন ” সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতিকারী আক্রমণ করেছে। জলদি পুলিশ কন্ট্রোলরুমে ফোন লাগা।”

মড়িতুল পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন লাগানোর চেষ্টা করছিল কিন্তু কোন সারা শব্দ পেলেন না। ততক্ষণ এই দুষ্কৃতিকারীরা গেটের সামনে পৌঁছে গিয়েছে। গোলাগুলির শব্দ পেয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ান শেখ মুজিব। গোলাগুলি সব দিয়ে ঘুম থেকে জেগে ওঠে তার গৃহকর্মী আব্দুল এবং রমা। গৃহকর্মী দেখেন কিছু সেনাবাহিনী গুলি করতে করতে বাড়ির দরজার দিকে এগিয়ে আসছে। এই খবরটি দেওয়ার জন্য রমা উপরে ওঠার সময় দেখে বঙ্গবন্ধু লুঙ্গি এবং গেঞ্জি পরে নিচে নেমে আসছে। রমা দ্রুত দোতলায় উঠে গেলেন। গোলাগুলির  শব্দের আতঙ্কে ছোটাছুটি বেগম মুজিব। রমা দ্রুত তিনতলায় চলে গেলেন। ঘুম থেকে ডেকে তুললেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে শেখ কামাল ও তার স্ত্রী সুলতানা কামালকে।

শেখ কামাল পুরো ঘটনা শুনে দ্রুত প্যান্ট শার্ট পড়ে নিচে নামতে লাগলেন। তার পিছু পিছু তার স্ত্রী ও দোতলায় নেমে এলো। রমা এবার ডাকতে গেলেন শেখ জামাল ও তার স্ত্রীকে। শেখ জামাল জামা কাপড় পড়ে তার স্ত্রীকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে অবস্থান করেন। বাইরে তখন প্রচন্ড গোলাগুলি। মহিতুল বারবার পুলিশ কন্ট্রোলরুমে কল লাগানোর চেষ্টা করছে। মহিতুল এর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে শেখ মুজিব বলেন” আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব।” এইটুকু কথায় তিনি বলতে পেরেছিলেন। জানালার কাজ ভেদ করে একের পর এক গুলি এসে লাগছিল অফিসের দেয়ালে। বঙ্গবন্ধু দ্রুত টেবিলের নিচে নুয়ে পড়েন। জানালার ভাঙা একটি কাজ এসে মহিতুলের হাত জখম করল।

কিছুক্ষণ পর যখন গোলাগুলির শব্দ থেমে গেল শেখ মুজিব উঠে দাঁড়ালেন। পক্ষ থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসে পাহারায় থাকা পুলিশ সদস্যদের বললেন ” এত বলি হচ্ছে, তোমরা কি করছ? এই কথা বলেই দ্রুত উপরে চলে যান বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু উপরে উঠা মাত্রই নিচে নামেন শেখ কামাল। আর্মিদের নির্দেশ দেন তার সঙ্গে যেতে।

শেখ কামালের পিছনে গিয়ে দাঁড়ান মহিতুল ও সুপারিনটেনডেন্ট নুরুল ইসলাম খান। সাথে সাথেই বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ঢুকে যায় মেজর নুর, মেজর মহিউদ্দিন, এবং ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা। দরজার ভিতর ঢুকেই তারা হ্যান্ডসআপ বলতে শুরু করেন। মহিতুলকে টেনে হিচড়ে ঘরের ভিতরে নিয়ে যায় নুরুল ইসলাম। বজলুল হুদা গুলি করতে থাকে শেখ কামালের পায়ে। শেখ কামাল মহিতুলকে বলতে থাকে ” আপনি ওদের বলুন আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে।” মহিতুল ঘাতক বাহিনী দের বলেন” কি করছেন আপনারা। উনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে শেখ কামাল”।

এই কথা বলা মাত্রই বজলুল হুদা তার হাতের অস্ত্র দিয়ে ঝাজরা করে দেয় শেখ কামালের দেহ। স্থানেই প্রাণ হারান তিনি। একটি গুলি এসে মহিতুলের হাটুতে লাগে। নিচতলার বারান্দা রক্তে ভেসে গিয়েছে। ঘরের দরজা বন্ধ করে একের পর এক ফোন করতে ব্যস্ত বঙ্গবন্ধু। ফোনে তিনি সামরিক সচিব কর্নেল জামিল উদ্দিন কে বলেন ” তুমি তাড়াতাড়ি এসো”। সেনারা আমার বাসা অ্যাটাক করেছে। শফিউল্লাহ কে ফোর্স পাঠাতে বল। সেই সময়কার সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহকে নিজেও ফোন করেন বঙ্গবন্ধু। শফিউল্লাহ কে বলেন ” তোমার ফোর্স আমার বাড়িতে অ্যাটাক করছে। কামালকে বোধ হয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।” ফোনের অপরপাশ থেকে শফিউল্লাহ বলেন ” আই এম ডুয়িং সামথিং, ক্যান ইউ গেট আউট?” ।

বঙ্গবন্ধুর ফোন কল পাওয়া মাত্রই নিজের গাড়ি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে রওনা হয় কর্নেল জামিল। সঙ্গে ছিল তার ড্রাইভার আয়েন উদ্দিন মোল্লা। ঘাতকেরা একের পর এক নিচের সবাইকে গুলি করতে করতে উপরে চলে যায়। উপরে গিয়েই গুলি চালায় শেখ জামালের ঘরে থাকা আবদুলের উপর। ভোর তখন ৫ টা ৫০। বঙ্গবন্ধুর ঘরে বঙ্গবন্ধু তার স্ত্রী, শেখ জামাল, শেখ রাসেল,  সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল দরজা বন্ধ করে আতঙ্কে বসে আছে। গুলির শব্দ তখন নেই। বঙ্গবন্ধু ভাবলেন ঘাতকেরা চলে গিয়েছে। দরজা খোলা মাত্রই বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ধরে ঘাতকেরা। টেনে হিচরে নামিয়ে আনে নিচে।

বঙ্গবন্ধু মেজর হুদাকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে বলেন “তোরা কি চাস? তোরা কি আমাকে মারতে চাস? মেজর হুদাও উত্তর দেয় ” আমরা আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি”। বঙ্গবন্ধু আবার বলেন ” তোরা কি আমাকে মেরে ফেলতে চাস? কামাল কোথায়? তোরা কামাল কে কি করেছিস?” মেজর হুদা প্রতিউত্তরে বলেন “স্যার কামাল তার নিজের জায়গাতেই আছে। আর আপনি তুই করে কথা বলবেন না। আপনি এখন বন্দী। চলুন।”

বঙ্গবন্ধু আবারো চিৎকার করে বললেন ” কি তোদের এত সাহস? পাকিস্তানি আর্মিরা আমাকে মারতে পারেনি। আমি বাঙালি জাতিকে ভালোবাসি। বাঙালি আমাকে ভালোবাসে। কেউ আমাকে মারতে পারেনা।” সিঁড়িবে টগবগিয়ে পড়ছে রক্তের স্রোত।  বজলুল হুদা তার হাতের অস্ত্র দিয়ে ১৮ টি গুলি করে ঝাজড়া করে দেয় বঙ্গবন্ধুর বুক ও পেট। নিচে লুটিয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধু তখন নিজের প্রাণ হারান। তার রক্তে ভেসে যায় সিঁড়ি। তারপরই দোতালায় উঠে আসে আজিজ পাষা ও রিসালদার মোসলেউদ্দিন। সবাইকে নিচে নেমে আসার আদেশ দেয় ঘাতকেরা। একে একে নিচে নেমে আসে সবাই‌। তারপর ঘাতকেরা একে একে হত্যা করে বেগম মুজিব, সুলতানা কামাল, রোজি জামাল।

তখনো বেঁচে ছিল গৃহকর্মী রমা। তিনি বলেন ” আমি তো রাজনীতি করি না আমাকে কেন মারবে?”। সাথে সাথেই গুলিবর্ষণে প্রাণ হারায় রমা। রমার পিছনেই দাঁড়িয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ছোট্ট ছেলে শেখ রাসেল। শিশুটিকেও রেহাই দিলেন না ঘাতকেরা। পিছন থেকে শিশুটিকে গুলি করলো। ছোট্ট শিশুটির মাথা থেপলে যায়। নিথর রক্তমাখা দেহটি নিচে লুটিয়ে পড়ে। একে একে অবশিষ্ট সবাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

শুধু বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। তারা দুই বোন সেদিন বাড়িতে ছিলেন না। শেখ হাসিনা তার স্বামীর সঙ্গে জার্মানিতে ছিলেন এবং শেখ রেহানাও তাদের সঙ্গে গিয়েছিলেন। ভাগ্যক্রমে সেদিন মৃত্যুর এই লীলাখেলা থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন আমাদের আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে বাবার হত্যাকারীদের তিনি কখনোই ভুলেন নি। দীর্ঘকাল পরে হলেও বাবার হত্যাকারীদের তিনি যথাযথ শাস্তি দিয়েছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী তার বাবার মতোই আমাদের গর্ব।

Sheikh Mujibur Rahman kill
Kill of Sheikh Mujibur Rahman

এতক্ষণ বঙ্গবন্ধুর পুরো জীবন সম্পর্কে জেনে গিয়েছেন। চলো এবার জেনে নিই বঙ্গবন্ধুর জীবনের সংক্ষিপ্ত কিছু অংশ।

বঙ্গবন্ধুর সংক্ষিপ্ত জীবনী

  • জন্মগ্রহণ করেন ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রাম।
  • ১৯২৭ সালে নিজ গ্রামের গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয় সাত বছর বয়স থেকে পড়ালেখা শুরু করেন।
  • ১৯৩৪ সালে মাদারীপুর ইসলামিয়া স্কুলে পড়া কালীন তার বেরিবেরি রোগ হয়।
  • অসুস্থতার জন্য দীর্ঘকাল পড়ালেখা বন্ধ থাকার পর ১৯৩৭ সালে পুনরায় পড়ালেখা শুরু করেন।
  • ১৯৩৮ সালের ১৬ই জানুয়ারি গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল পরিদর্শনের সময় শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের সাথে তার দেখা হয়।
  • মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৯৩৮ সালে শেখ ফজিলাতুন্নেসার সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
  • ১৯৩৯ সালে স্কুলে পড়াকালীন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য তিনি প্রথম কারাগার বরণ করেন।
  • ১৯৪২ সালে তিনি কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন।
  • ১৯৪৪ সালে নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগে যুক্ত হন। এবং শুরু হয় তার রাজনীতিতে অভিষেক। একই বছরে তিনি ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন।
  • ১৯৪৬ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্য পান। এবং প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
  • ১৯৪৭ সালের কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে বি এ ডিগ্রী লাভ করেন।
  • দেশ বিভক্তের পর ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন।
  • ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ধর্মঘট করার কারণে তিনি গ্রেফতার হন।
  • ১৯৪৮ সালের ১৫ই মার্চ তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান
  • ১৯৪৯ সালে পূর্ব বাংলায় অভাব অনটন শুরু হলে তিনি খাদ্যের দাবিতে আবার আন্দোলন শুরু করেন।
  • ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি এই আন্দোলনের কারণে তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়।
  • ১৯৫২ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবিতে বঙ্গবন্ধু কারাগারে বসেই অনশন করেন।
  • ১৯৫৩ সালের ১৬ই নভেম্বর আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
  • ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর যুক্ত ফ্রন্ট গঠন করা হয়েছিল।
  • ১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ সাধারণ নির্বাচনের ২৩৭ টি আসনের মধ্যে ২২৩ আসন পেয়ে বিজয়ী হয় যুক্তফ্রন্ট। এবং গোপালগঞ্জের আসনে বিজয় লাভ করেন বঙ্গবন্ধু।
  • ১৯৫৪ সালের ২ এপ্রিল যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়।
  • ১৯৫৫ সালের ৫ জুন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
  • ১৯৫৮ সালের ১২ই অক্টোবর বঙ্গবন্ধু নামে আগরতলা মামলা দেওয়া হয় এবং তাকে আবার জেলে পাঠানো হয়।
  • ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
  • ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দাবি তুলে ধরেন।
  • এই দাবির জন্য তাকে গ্রেফতার করা হয় ১৯৬৮ সালে তিনি ছাড়া পান।
  • ১৯৬৯ সালে ডিসেম্বরের ৫ তারিখে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত ১ জনসভায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ নামকরণ করা হবে। 
  • ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিলেন।
  • ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে একজন সভায় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেন বাঙালিকে অত্যাচার মুক্ত করার জন্য। 
  • স্বাধীনতার ডাক দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭১ সালে আবার গ্রেফতার করা হয়। এবং তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে আটকে রাখা হয়।
  • দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
  • দেশ স্বাধীনতা পাওয়ার পর ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানি শাসকবৃন্দরা মুক্তি দেয়। এরপর তিনি লন্ডন এবং দিল্লি থেকে ঘুরে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে অবস্থান করেন। 
  • স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বাংলায় আবার নতুন করে মন্ত্রী পরিষদ গঠন করা হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিশিষ্ট মানুষদের কিছু উক্তি

বঙ্গবন্ধু কেবলমাত্র বাংলার বন্ধু নয়। সারা বিশ্বের মানুষ আমাদের এই মহান নেতাকে ভালোবাসেন। তার নেতৃত্বকে শ্রদ্ধা করেন। তাইতো বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিশেষ বিশেষ উক্তি রেখে গিয়েছেন। কিছু উক্তি আপনাদের মাঝে তুলে ধরা হলো।

  • “দিকে দিকে আজ অশ্রম্নুগঙ্গা রক্তগঙ্গা বহমান নাই নাই ভয় হবে হবে জয় জয় মুজিবুর রহমান।” -অন্নদাশঙ্কর রায়
  • “জনগণকে ভুল পথেও নিয়ে যাওয়া যায়; হিটলার মুসোলিনির মতো একনায়কেরাও জনগণকে দাবানলে, প্লাবনে, অগ্নিগিরিতে পরিণত করেছিলো, যার পরিণতি হয়েছিলো ভয়াবহ। তারা জনগণকে উন্মাদ আর মগজহীন প্রাণীতে পরিণত করেছিলো। একাত্তরের মার্চে শেখ মুজিব সৃষ্টি করেছিলো শুভ দাবানল, শুভ প্লাবন, শুভ আগ্নেয়গিরি, নতুনভাবে সৃষ্টি করেছিলেন বাঙালি মুসলমানকে, যার ফলে আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম।” -হুমায়ুন আজাদ
  • “শেখ মুজিব দৈহিকভাবেই মহাকায় ছিলেন, সাধারণ বাঙালির থেকে অনেক উচুঁতে ছিলো তার মাথাটি, সহজেই চোখে পড়তো তার উচ্চতা। একাত্তরে বাংলাদেশকে তিনিই আলোড়িত-বিস্ফোরিত করে চলেছিলেন, আর তার পাশে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে যাচ্ছিল তার সমকালীন এবং প্রাক্তন সকল বঙ্গীয় রাজনীতিবিদ।” -কেনেথা কাউণ্ডা
  • “শেখ মুজিব সরকারীভাবে বাংলাদেশের ইতিহাস এবং জনগনের হৃদয়ে উচ্চতম আসনে পূর্নপ্রতিষ্ঠিত হবেন। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার।এটা যখন ঘটবে তখন নিঃসন্দেহে তার বুলেটবিক্ষত বাসগৃহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন স্মারকচিহ্ন এবং কবরস্থান পূন্যতীর্থে পরিনত হবে।”-ব্রায়ান বারণ 
  • “আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব এবং সাহসিকতায় তিনিই হিমালয়।” – ফিদেল কাস্ত্রো
  • “মুজিব হত্যার পর বাঙালীদের আর বিশ্বাস করা যায় না, যারা মুজিবকে হত্যা করেছে তারা যেকোন জঘন্য কাজ করতে পারে।” – উইলিবান্ট
  • “বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডে বাঙলাদেশই শুধু এতিম হয় নি বিশ্ববাসী হারিয়েছে একজন মহান সন্তানকে।” – জেমসলামন্ড
  • “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন সমাজতন্ত্র প্রতীষ্ঠার সংগ্রামের প্রথম শহীদ। তাই তিনি অমর।” – সাদ্দাম হোসেন
  • “আওয়ামিলীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মত তেজী এবং গতিশীল নেতা আগামী বিশ বছরের মধ্যে এশিয়া মহাদেশে আর পাওয়া যাবে না।” – হেনরি কিসিঞ্জার
  • “শেখ মুজিবকে চতুর্দশ লুই য়ের সাথে তুলনা করা যায়। জনগন তার কাছে এত প্রিয় ছিল যে লুই ইয়ের মত তিনি এ দাবী করতে পারেন আমি ই রাষ্ট্র।” -পশ্চিম জার্মানী পত্রিকা
  • “বঙ্গবন্ধু সর্বকালের সাহসী নেতা।” – প্রণব মুখার্জি
  • “শেখ মুজিবুর রহমান ভিয়েতনামী জনগনকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।” – কেনেথা কাউণ্ডা
  • “মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনই জন্ম নিতনা।” -ফিনান্সিয়াল টাইমস
  • “শেখ মুজিব নিহত হবার খবরে আমি মর্মাহত। তিনি একজন মহান নেতা ছিলেন।তার অনন্যসাধারন সাহসিকতা এশিয়া ও আফ্রিকার জনগনের জন্য প্রেরণাদায়ক ছিল।” – ইন্দিরা গান্ধী
  • “যদি রাত পোহালে শোনা যেত, বঙ্গবন্ধু মরে নাই। যদি রাজপথে আবার মিছিল হতো, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই। তবে বিশ্ব পেত এক মহান নেতা, আমরা পেতাম ফিরে জাতির পিতা।” – হাসান মতিউর রহমান
  • “শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে,আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে।” – ফিদেল কাস্ত্রো
  • “শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণী বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।” – গৌরী প্রসন্ন মজুমদার
  • “আপোষহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুম কোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ঠ্য।” – ইয়াসির আরাফাত
  • “শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহী ছিলেন না, কিন্তু তাঁকে সেই পথে যেতে বাধ্য করা হয়।” – নওয়াজ শরীফ
  • “যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।” – অন্নদাশঙ্কর রায়
  • “আমি কিংবদন্তির কথা বলছি আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি। তিনি স্বপ্নের মত সত্য ভাষণের কথা বলতেন সুপ্রাচীন সংগীতের আশ্চর্য ব্যাপ্তির কথা বলতেন তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।” – আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ

সবশেষে, 

বাঙালি জাতি কখনোই এই মহান নেতার ঋণ শোধ করতে পারবে না। আমাদের শহীদ নেতা বঙ্গবন্ধু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বাঙ্গালীর কল্যাণের জন্য কাজ করে গিয়েছেন। তার হাত ধরেই আমরা অর্জন করেছি স্বাধীনতা। প্রতিটি বাঙালি হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবেন প্রিয় বঙ্গবন্ধু। আজ শোকাহত ১৫ই আগস্ট। বঙ্গবন্ধুর স্মরণে ব্যথিত হবে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়। আমরা আমাদের প্রাণের প্রিয় এই নেতাকে আজীবন ভালোবেসে যাবো। প্রজন্মের পর প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুর দেখানো আদর্শে জীবন পরিচালনা করবে। প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে, বাংলার আকাশে বাতাসে, নদীর ঢেউয়ে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ছায়া। তাইতো কবি বলেছেন-

“যতকাল রবে পদ্মা-মেঘনা-গৌরী যমুনা বহমান,

ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।”

Related Post

মৃত্যু নিয়ে উক্তি

150+মৃত্যু নিয়ে উক্তি, বাণী, ক্যাপশন 2024

মৃত্যু নিয়ে উক্তি জন্মিলে মরিতে হবে আর এটাই সত্যি। মৃত্যু হচ্ছে সবচেয়ে চিরন্তন সত্যি। পৃথিবীতে প্রতিটি প্রাণীর মৃত্যুর স্বাদ অনুভব করতে হবে। সবসময় মৃত্যুর জন্য

Read More »
খুশির স্ট্যাটাস

200+ স্টাইলিশ খুশির স্ট্যাটাস | হাসি নিয়ে ক্যাপশন

খুশির স্ট্যাটাস | হাসি নিয়ে ক্যাপশন জীবনের সুন্দর খুশির মুহূর্ত আমরা সবাই বাঁধাই করে রাখতে চাই। আর এই খুশির মুহূর্তকে ধরে রাখার সবচেয়ে সহজ উপায়

Read More »

স্টাইলিশ ভালোবাসার ছন্দ | রোমান্টিক ছন্দ | Love Status Bangla

❤❤ভালোবাসার ছন্দ | ভালোবাসার ছন্দ রোমান্টিক | ভালোবাসার ছন্দ স্ট্যাটাস❤❤ ভালোবাসা হলো এক অন্যরকম অনুভূতির নাম, যা শুধুমাত্র কাউকে ভালবাসলেই অনুভব করা যায়। আমরা বিভিন্নভাবে

Read More »
মন খারাপের স্ট্যাটাস

মন খারাপের স্ট্যাটাস, উক্তি, ছন্দ, ক্যাপশন, কিছু কথা ও লেখা

মন খারাপের স্ট্যাটাস মন খারাপ – এই কষ্টের অনুভূতি কার না হয়? সবারই কখনো না কখনো সবারই মন খারাপ হয়। জীবনের ছোটোখাটো অঘটন থেকে শুরু

Read More »

Leave a Comment

Table of Contents