এলার্জি নামটি আমাদের সকলেরই পরিচিত। এলার্জি খুবই মারাত্মক যন্ত্রণাদায়ক একটি ব্যাপার। এটি একটি চুলকানি জাতীয় রোগ। আসলে যারা এলার্জিতে আক্রান্ত তারাই একমাত্র জানে এর যন্ত্রণা কতটুকু। প্রায় সকলের মাঝেই কোন না কোন সময় এই রোগটি দেখা যায়। এলার্জির প্রভাবে শরীরের বিভিন্ন স্থানে চুলকায়। চুলকানি যুক্ত স্থান লাল হয়ে যায় ও কিছুক্ষণ পর ফুলে ওঠে। এই সমস্যাটি মূলত খাবারের এলার্জির কারণে হয়ে থাকে।
চিংড়ি মাছ, গরুর মাংস ,হাঁসের মাংস, হাঁসের ডিম ,পুটি মাছ ও বিভিন্ন শাকসবজি খাওয়ার পরে এলার্জি আক্রমণ বেড়ে যায়। এলার্জির কারণে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এবং এলার্জি থেকে বিভিন্ন ধরনের রোগ ছড়ায় যেমন শ্বাসকষ্ট ও একজিমা এলার্জির কারণে হয়ে থাকে। তাই এলার্জির সঠিক চিকিৎসা ও এর দূর করার উপায় গুলো সম্পর্কে আমাদের সকলেরই ধারণা রাখা উচিত। তাই চলুন জেনে নিন এলার্জি দূর করার উপায় গুলো সম্পর্কে:
এলার্জি কি
সাধারণ ভাষায় এলার্জি বলতে বোঝায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি। আমাদের শরীরের যদি কোন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ,ছত্রাক ,পরজীবী প্রবেশ করে তাহলে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তার বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করে। একে রোগ প্রতিরোধ প্রক্রিয়া বা ইমিউন বলা হয়।
কিন্তু এই সাধারণ বিষয়গুলো যখন আমাদের দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রতিরক্ষা করতে পারে না তখন এটাকে বলা হয় এলার্জি। যেমন আমরা মাংস ,মাছ, দুধ ,ডিম খেয়ে থাকি। কিন্তু এমন মানুষ আছে যারা এই সাধারণ খাবারগুলো খেলে তাদের দেহে বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ তাদের এসব খাবারের প্রতি এলার্জি আছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে ইউরোপের জনসংখ্যার ২০% মানুষ দৈনন্দিন এলার্জির সমস্যায় ভুগছে।
who এর তথ্য মতে একটি দেশের মোট জনসংখ্যার ১০% থেকে 40% মানুষের এলার্জি আছে। ও পুরো পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৩০% মানুষের এলার্জির সংক্রান্ত সমস্যা আছে। অন্য আরেকটি গবেষণায় দেখা যায় ভারতবর্ষের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ থেকে ৩০% মানুষ এলার্জি রোগে ভোগে। যে সকল অক্ষতিকর বহিরাগত বস্তুর ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটি লড়াই করে তাদের এলার্জেন বলা হয়।
সাধারণত শিশুদের এলার্জির সমস্যাটি বেশি হয়ে থাকে। কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা যায় বয়স বাড়ার সাথে সাথেই সমস্যাটি দূর হয়ে গেছে কারণ তখন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। আবার অনেক প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে দেখা যায় যাদের কোন খাবার বা জিনিসের প্রতি পূর্বে এলার্জি ছিল না কিন্তু হঠাৎ করেই তৈরি হয়েছে।
এলার্জির প্রকারভেদ
দেহের রোগ প্রতিরোধ সিস্টেমের কাজ হল ক্ষতিকারক জীবাণুগুলোর সাথে লড়াই করে দেহকে সুস্থ রাখা। কিন্তু অনেক সময় এটি অসতিকারক জিনিসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এটি মূলত এলার্জি। অনেক রকমের এলার্জি হতে পারে যেমন:
১) এলার্জিক রাইনাইটিস
২) ডাস্ট এলার্জি
৩) আর্টিকেরিয়া বা আমবাত
৪) আ্যকুয়োজনিক আর্টিকেরিয়া।
৫) সংস্পর্শজনিত এলার্জি ত্বক প্রদাহ
৬) এটপিক ডার্মাটাইটিস বা একজিমা
৭) ফুড এলার্জি
৮) ল্যাটেক্স এলার্জি
৯) সান এলার্জি
১০) এলার্জিক কনজাংটিভাইটিস
- সাধারণ এলার্জিক কনজাংটিভাইটিস
- ‘ভারনাল এলার্জিক কনজাংটিভাইটিস
কোন এলার্জির কি কাজ
১) এলার্জিক রাইনাইটিস: এটি হলো এলার্জিজনিত নাকের প্রদাহ। এটা দুই ধরনের হয়ে থাকে। ১. সিজনাল এলার্জিক রায়নাটিস যা বছরের যেকোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে হয়। ২. পেরিনিয়াল এলার্জি রায়নাটিস যা সারা বছর ধরেই হয়ে থাকে। আমাদের দেশে ১০ থেকে ১৫% মানুষ এই সমস্যায় ভোগে।
২) ডাস্ট এলার্জি: ঘরের কোন জিনিসের যদি ধুলোর আস্তরণ পড়ে থাকে যেমন তোষক, বালিশ, বইপত্র, পুরনো বাড়ি, পুরনো কাপড় সেখান থেকে এলার্জি হতে পারে।
৩) আর্টিকেরিয়া বা আমবাত: এই এলার্জি ত্বকের বিভিন্ন প্রকার এলার্জির মধ্যে অন্যতম। একে ইংরেজিতে RASH বলা হয়। শতকরা ২০ জন জনগতভাবেই আর্টিকেরিয়া রোগী হয়।আর্টিকেরিয়া দুই ধরনের। ১. একিউট আর্টিকেরিয়া, এতে খুব দ্রুত উপসর্গ দেখা যায় সেইসাথে দ্রুতই মিলে যায়। ২. ক্রনিক আর্টিকেরিয়া, এতে ৫, সপ্তার বেশি বা কখনো কখনো মাসের পর মাস এর উপসর্গ দেখা যায়। সাধারণত স্বল্প স্থায়ী আর্টিকেরিয়া বাচ্চাদের মধ্যে ও দীর্ঘস্থায়ী বড়দের মধ্যে দেখা যায়।
৪)আ্যকুয়োজনিক আর্টিকেরিয়া: এই ধরনের এলার্জি পানির কারণে হয়ে থাকে। শরীরে পানি লাগলে অথবা গোসলের পরে এলার্জির উদ্ভব হয়।
৫)সংস্পর্শজনিত এলার্জি ত্বক প্রদাহ: যদি এলার্জনের সংস্পর্শে ত্বকে কোথাও খসখসে শুকনো ও ছোট ছোট দানার মত হয়ে ওঠে তাহলে তাকে এলার্জিক কন্টাক্ট ডারমাটাইটিস বলে।
৬) এটপিক ডার্মাটাইটিস বা একজিমা: আমাদের দেশে এই রোগটি বিখাউজ, কাউর ঘা,পামা নামে পরিচিত। এটি হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে বংশগত। সাধারণত ত্বক যদি কোন কিছু সহ্য না করতে পারে তাহলে ইরিটেশন থেকে একজিমা হতে পারে।
৭) ফুড এলার্জি: খাবার থেকে যেমন দুধ, ডিম ,ময়দা ,সি ফুড ইত্যাদি থেকে এলার্জি হতে পারে। উন্নত বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪% থেকে ৮% লোকের অত্যন্ত একটি করে খাবারে ফুড এলার্জি আছে। এটি প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় বাচ্চাদের বেশি হয়ে থাকে। মেয়ে শিশুদের তুলনায় ছেলে শিশুরা এতে বেশি আক্রান্ত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই এলার্জি ১% থেকে ২% পার্সেন্ট প্রাপ্তবয়স্কদের এবং ৩% থেকে ৬% শিশুদের আক্রান্ত করে।
৮) ল্যাটেক্স এলার্জি: অনেক সময় ইলাস্টিক বা রাবার থেকে এলার্জি হতে পারে। ল্যাটেক্স এলার্জি হচ্ছে প্রাকৃতিক রাবারের ল্যাটেক্সে পাওয়া কিছু প্রোটিনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া। বিভিন্ন রাবার বা ইলাস্টিক জাতীয় পণ্য রাবার গাছ থেকেই তৈরি করা হয়। এর কারণে এই এলার্জিতে আক্রান্ত রোগীরা এসব পণ্য ব্যবহারের সময় ল্যাটেক্স এলার্জি দেখা যায়।
৯) সান এলার্জি: কারো যদি সূর্যের আলো সহ্য না হয় তাহলে বুঝতে হবে তার সান এলার্জি আছে। সাধারণত এই রোগটি 35 বছর বয়সীদের মধ্যে বেশি দেখা যায় তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নবজাতক ও বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যেও দেখা যায়। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের মধ্যে এটি বেশি দেখা যায়।
১০) এলার্জিক কনজাংটিভাইটিস: যখন একটি চোখ এলার্জনের সংস্পর্শে আসে তখন এলার্জিক কনজাংটিভাইটিস হয়। এটি দুই ধরনের:
- সাধারণ এলার্জিক কনজাংটিভাইটিস: এটি দেহের ভিতর ও বাহিরে কোন এলার্জির জন্য হয়ে থাকে। বাইরের এলার্জন বলতে, ফুলের পরাগ, ধুলাবালি ইত্যাদি। আর ভিতরের এলার্জন, দেহের সংক্রামিত কোন স্থানের অংশের জীবাণু।
- ভারনাল এলার্জিক কনজাংটিভাইটিস: এটি সাধারনত এক ধরনের হাইপার সেনসিটিভিটি রিএকশন এর জন্য হয়। বাহিরের এলার্জন এই রোগের প্রধান কারণ। ভার্নাল এলার্জিক কনজাংটিভাইটিস গ্রীষ্ম ও বসন্তকালে বেশি হয় এইজন্য গরম ও শুষ্ক আবহাওয়ায় বসবাসকারীরা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। সাধারণত ৫ থেকে ২৫ বছর বয়সের মানুষরা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়।
এলার্জিজনিত রোগ
দীর্ঘ সময় ধরে এলার্জি আপনার দেহের ইমিউন সিস্টেমকে প্রভাবিত করে। এই কারণে আপনার দেহ খুব সহজেই অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়। বিশেষ করে দেহের বাইরের ক্ষতিকর বস্তু যেমন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এগুলো গ্রহণের সম্ভাবন আরো বেড়ে যায়। এর মধ্যে রয়েছে সাধারণ ভাইরাসজনিত ভাইরাস সর্দি ,কাশি হাসি ইত্যাদি সৃষ্টি করে।
এলার্জিতে হাঁচি থেকে শুরু করে ওষুধের ও খাদ্যের প্রতিক্রিয়া সেই সাথে মারাত্মক শ্বাসকষ্ট হতে পারে। শরীরে আগে থেকেই থাকা হাঁপানির মাঝে এলার্জির উদ্ভব বা নতুনভাবে হাঁপানির সৃষ্টি হলে একে এলার্জি হাঁপানি বলে। এই এলার্জি হাঁপানি রোগীর অবস্থা আরো বেশি খারাপ করে তোলে। বাংলাদেশ ও ভারতের এলার্জি ও এজমা ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে হাঁপানির প্রায় ৬০% লোককে এই এলার্জি হাঁপানি প্রভাবিত করে।
কোন ব্যক্তি যদি এলার্জেনের সংস্পর্শে আসে তাহলে তার শ্বাসনালী শক্ত হয়ে কাশি হতে পারে। সেই সাথে বুক শক্ত হওয়া ও শ্বাসকষ্ট হতে পারে। এই এলার্জিনের প্রতিক্রিয়া যদি বেড়ে যায় তাহলে খড় জ্বর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই জ্বরের সাথে আপনার অবিরাম হাঁচি, কাশি লেগেই থাকবে। এলার্জির ফলে ব্রংকাইটিস ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া ব্রংকাইটিস হতে পারে।
যদি আপনি ব্রঙ্কাইটিসে আক্রান্ত হন তাহলে কয়েক দিন ,কয়েক সপ্তাহ পরে শেষ হয়ে যায়। আর যদি আপনি দীর্ঘস্থায়ী ব্রংকাইটিসে আক্রান্ত হন তাহলে এটা কয়েক মাস দীর্ঘায়িত হতে পারে। এবং কি ঘনঘন ফিরেও আসতে পারে। বায়ু দূষণ, সিগারেটের ধোঁয়া, রাসায়নিক ধোঁয়া, ধুলো, এই এলার্জিনের সংস্পর্শ সাধারণ ক্রনিক ব্রংকাইটিস এর প্রধান কারণ। অতিরিক্ত এলার্জির কারণে আ্যনাফ্লাক্সিস হতে পারে। যা আপনার জীবন নাশের কারণ হতে পারে
এলার্জির কারণ
আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বিভিন্ন ক্ষতিকর জিনিস থেকে আমাদের শরীরকে সুরক্ষা দেয়। তবে অনেক সময় কিছু অক্ষতিকর জিনিসকে এটি ক্ষতিকর ভেবে বসে। এ সকল জিনিসের বিরুদ্ধে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়ায় এলার্জির লক্ষণ দেখা দেয়। সাধারণত যেসব জিনিসের সংস্পর্শে আসলে শরীরে এলার্জির দেখা দেয় সেগুলো হচ্ছে:
- গরম অথবা ঠান্ডা আবহাওয়া
- ধুলাবালি
- নির্দিষ্ট কিছু খাবার
- ঘাম।
- গৃহপালিত পশু পাখি।
- সূর্যের আলো।
- কীটনাশক।
- মোল্ড বা ছত্রাক।
- ডাস্ট মাইট
- বিভিন্ন ঔষধ।
- স্ট্রেস বা মানসিক চাপ।
- ডিটারজেন্ট ও বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ।
- বিভিন্ন ধরনের রাবারের তৈরি গ্লাভস ও কনডম।
এলার্জির লক্ষণ
শরীর এলার্জিক উপাদানের সংস্পর্শে আসলে তা খুব কম সময়ের মধ্যে প্রতিক্রিয়া করে। এলার্জির বিভিন্ন লক্ষণ রয়েছে এগুলো হচ্ছে:
১) চামড়ায় চুলকানি, রেশ বা ফুসকুড়ি হওয়া।
২) চোখ, জিব্বা, ঠোঁট ও মুখ ফুলে যাওয়া।
৩) শরীরের কিছু অংশ চাকা চাকা হয়ে যাওয়া বা ভুলে যাওয়া।
৪)ফোসকা পড়া ও চামড়া ঝরে যাওয়া।
৫) হাঁচি ,কাশি নাকে ও গলায় চুলকানি ও নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া।
৬) চোখ থেকে পানি পড়া, চোখে চুলকানি, চোখ লাল হয়ে যাওয়া ও ফুলে যাওয়া।
৭) শ্বাস নেওয়ার সময় শো শো শব্দ হওয়া, শ্বাসকষ্ট, ও বুকে চাপ চাপ লাগা।
৮) বমি, বমি বমি ভাব, পেটে ব্যথা ,পেট কামড়ানো ও ডায়রিয়া।
এলার্জি জাতীয় খাবারের তালিকা
সাধারণত যেসব খাবারে এলার্জি দেখা যায় সেগুলো হচ্ছে:
১) বেগুন
২) ইলিশ মাছ
৩) চিংড়ি
৪) গরুর মাংস
৫) বাদাম
৬) ডিম
৭)দুধ ইত্যাদি।
কখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে
১) ওষুধ খাওয়ার পরও লক্ষণ দূর না হলে
২) ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ খাওয়ার পর যদি নতুন লক্ষণ দেখা দেয় আর সমস্যা বেড়ে যায়।
৩) মারাত্মক এলার্জিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে।
এলার্জির চিকিৎসা
এলার্জির চিকিৎসা সাধারণত এন্টিহিস্টামিন জাতীয় ঔষধ ব্যবহার করা হয়। এই ঔষধ গুলো এলার্জির লক্ষণ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে ও দেখা দেওয়ার পূর্বেও সেবন করা যায়। যেমন, কারো ধুলোবালিতে এলার্জি আছে কিন্তু কোন প্রয়োজনে তাকে ধুলাবালি পরিষ্কার করতে হবে সে ক্ষেত্রে সে আগে থেকেই এন্টিহিস্টামিন জাতীয় ঔষধ সেবন করতে পারবে।
বিভিন্ন রূপে এসব ওষুধ পাওয়া যায়। যেমন, সিরাপ, ড্রপ, ট্যাবলেট ইত্যাদি। এলার্জির ঔষধ সেবনের পরে ঘুম ঘুম লাগা, মাথা ঝিমঝিম করা ইত্যাদি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে পারে। এইজন্য ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী উপযুক্ত ঔষধটি গ্রহণ করুন।
যদি নাক বন্ধ হয়ে যায় সে ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নাক বন্ধের ড্রপ বা স্প্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এই সকল ড্রপ বা স্প্রে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ব্যবহার করা যাবে না। অনেকদিন ব্যবহার করে লক্ষণ গুলো আবার ফিরে আসতে পারে।
ত্বকের এলার্জিতে বিভিন্ন মশ্চারাইজিং ক্রিম ও মলম ব্যবহার করতে পারেন। চুলকানির সমস্যাতে ক্যালামাইন লোশন ও ১% মেন্থল ক্রিম খুবই ভালো কাজ করে। এছাড়াও তোয়ালে তো বড় পিছিয়ে চুলকানির স্থানে ঠান্ডা সেক দিতে পারেন এতেও বেশ আরাম পাবেন।
অতিরিক্ত এলার্জিতে স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ ভালো কাজ করে। এই ঔষধ খুবই শক্তিশালী এর পার্শ্বপ্রতিক্রিও বেশি। এসব ওষুধ ইন্টারনেটে দেখে বা ফার্মেসি থেকে কিনে এনে খাওয়া একেবারেই উচিত নয়। শুধুমাত্র ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী এসব ওষুধ খাওয়া উচিত।
এলার্জি দূর করার ঘরোয়া উপায়
এলার্জির অনেক চিকিৎসা থাকলেও খুব সহজে কয়েকটি ঘরোয়া উপায় মাধ্যমে আপনি চাইলে এলার্জি দূর করতে পারবেন। নিচে কয়েকটি ঘরোয়া উপায় দেওয়া হলো:
১) কোল্ড শাওয়ার: ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করলে ত্বকের জ্বালা এবং এলার্জি রাস হয়। শরীরের যখন ঠান্ডা পানি ঢালবেন তখন রক্তনালী গুলো সংকোচিত হবে এবং হিস্টামিন বেড় হতে পারবে না। এটি এলার্জির তীব্রতা এবং ত্বকের জানা হ্রাস করে।
২) অলিভ অয়েল: অতিরিক্ত ভার্জিন জলপাই তেল দুর্দান্ত মশ্চারাইজার হিসাবে কাজ করে। এইতো ভিটামিন ই সমৃদ্ধ হয় যা এলার্জির সমস্যার পরে ত্বক নিরাময় এবং মেরামত করে ও চুলকানি হ্রাস করে। প্রাকৃতিক এই মশ্চারাইজার ত্বকের জন্য অনেক ভালো।
৩) বেকিং সোডা: বেকিং সোডা ত্বকের এলার্জির জন্য একটি দুর্দান্ত ঘরোয়া উপায়। এটি চুলকানি থেকে মুক্তি দেয় ,ত্বকের ফুসকুড়ি দূর করে এবং ত্বকের প্রদাহ রোধ করে। এর জন্য, আধা চামচ বেকিং সোডা ও অল্প একটু পানি মিশিয়ে একটি পেস্ট তৈরি করুন। এরপর এলার্জি যুক্ত স্থানে লাগিয়ে নিন ৫ থেকে ১০ মিনিট রাখার পর ধুয়ে ফেলুন। এটি বেশিক্ষণ রাখবেন না কারণ বেকিং সোডা নিজেই আরো জ্বালা করতে পারে।
৪) অ্যাপেল সিডার ভিনেগার: অনেক রোগের জন্য আশ্চর্য নিরাময় অ্যাপেল সিডার ভিনেগার। এতে আছে প্রচুর পরিমাণে এসিটিক অ্যাসিড যা অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল ও অ্যান্টি ইনফ্লামেটরি বৈশিষ্ট্য যুক্ত। এটি বিভিন্ন এলার্জিজনিত সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। এর জন্য, এক কাপ গরম পানিতে এক টেবিল চামচ অ্যাপেল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে নিন। এবার এলার্জিযুক্ত স্থানে দ্রবণটি একটি পরিষ্কার কাপড়ের মাধ্যমে দিন। 15 থেকে 20 মিনিট রাখার পর পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এভাবে নিয়মিত করলে কিছুদিনের মধ্যে এলার্জি দূর হয়ে যায়।
৫) অ্যালোভেরা জেল: অ্যালোভেরা জেল অ্যান্টি ইনফ্লামেটরি বৈশিষ্ট্য যুক্ত। অ্যালোভেরা জেল দেহের ত্বকের এলার্জির অন্যতম সেরা প্রতিকার। এর জন্য, আক্রান্ত স্থানে ৩০ মিনিট ভালোভাবে অ্যালোভেরা জেল লাগিয়ে রাখুন এরপর ফেলুন । কিছুদিন নিয়মিত এভাবে এলোভেরা জেল লাগালে দ্রুত এলার্জি সমস্যা দূর হয়ে যাবে।
৬) নারকেল তেল: শিশুদের এলার্জি দূর করার একটি নিরাপদ উপাদান হলো নারকেলের তেল। নারকেলের তেল মশ্চারাইজিং বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন।এর অ্যান্টি ইনফ্লামেটরি ও আ্যনালজেসিক বৈশিষ্ট্য অনেকগুলো ত্বকের সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। এর জন্য এক চা চামচ নারকেল তেল হালকা গরম করে নিন এবার এলার্জিযুক্ত স্থানে এটি লাগান। ৩০ মিনিট রেখে দেওয়ার পর পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এভাবে নিয়মিত ব্যবহার করুন।
৭) তুলসী পাতা: তুলসী পাতার এন্টি মাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য গুলো ত্বককে বিভিন্ন সংক্রমনের হাত থেকে রক্ষা করে। বেঁচে থাকা এন্টিইনফ্লামেটরি বৈশিষ্ট্য ত্বকের চুলকানি রাস করে এবং ফুলে যাওয়া রোধ করে। এলার্জি সমস্যা দূর করতে তুলসী পাতা বেশ কার্যকর। এর জন্য একমুঠো তুলসী পাতা ভালোভাবে ধরে নিন। এবার তুলসী পাতা ও অল্প পানি মিশিয়ে ব্লেন্ডারে ভালোভাবে ব্লেন্ড করে একটি পেস্ট তৈরি করুন। এই পেস্টটি এলার্জি যুক্ত স্থানে লাগান। ৩০ মিনিট রাখার পর পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এভাবে নিয়মিত ব্যবহার করতে থাকুন।
৮)নিম পাতা: নিম পাতার বিভিন্ন ঔষধি গুনাগুন রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন চিকিৎসার জন্য নিম পাতার ব্যবহার হয়ে আসছে। নিম পাতা দিয়ে এলার্জি সমস্যা দূর করতে, অল্প কিছু নিমপাতা ও অল্প একটু পানি ব্লেন্ডার দিয়ে ভালোভাবে একটি পেস্ট তৈরি করে নিন। এই পেস্টটি নিয়মিত এলার্জি যুক্ত স্থানে লাগান।
৯) আদা: আদাতে আছে আন্টি ইনফ্লামেটরি ও এন্টি মাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য। যা এলার্জি প্রতিরোধে মারাত্মক ভূমিকা রাখে। এর জন্য একটি পাত্রে কয়েক টুকরো আদা ও পানি নিয়ে পাঁচ মিনিটের জন্য সিদ্ধ করতে দিন। আদা তরল করুন এবং এটি ঠান্ডা হতে দিন। এবার এলার্জিযুক্ত স্থানে এই তরলটি লাগান ৩০ মিনিট রাখার পর দুয়ে ফেলুন। এভাবে দিনে তিন থেকে চারবার পুনরাবৃত্তি করুন।
এলার্জিতে ইমিউনো থেরাপি
গুরুতর এলার্জিতে ইমিউনো থেরাপি একটি কার্যকরী চিকিৎসা। এই চিকিৎসাতে রোগীকে দীর্ঘদিন ধরে নির্দিষ্ট এলার্জনের উপস্থিতিতে অভ্যস্ত করে তোলা হয়। এই কারনে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের ওই সকল জিনিসের প্রতি অভ্যস্ত হয়ে যায়। যার কারণে এলার্জি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ রাখা যায়।
এলার্জি প্রতিরোধ
এলার্জি থেকে মুক্ত থাকার সবচাইতে ভালো উপায় হচ্ছে যে সকল বস্তুতে এলার্জি সে সকল বস্তু সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলা। নিচে এলার্জি প্রতিরোধের কিছু উপায় দেওয়া হলো:
১) এলার্জি আছে এমন খাবারগুলো এড়িয়ে চলুন।
২) ডাস্ট মাইট নামক এক ধরনের ক্ষুদ্র পোকা থেকে এলার্জি প্রতিরোধ করতে বাড়ির যে সকল জায়গায় দিনের অধিকাংশ সময় কাটান সে সকল জায়গা ধুলাবালিমুক্ত ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন। কাথা বিছানার চাদর লেপের খবর বালিশ জানালার পর্দা এগুলো সপ্তাহে একবার গরম পানি দিয়ে পরিষ্কার করুন। আর ঘরের যেই সকল জিনিস নিয়মিত দোয়া যায় না সেই সকল জিনিস কম ময়লা করুন বা ব্যবহার কম করুন।
৩) ছত্রাক থেকে সুরক্ষা পেতে বাড়ির পরিবেশ শুষ্ক রাখুন স্যাতসেতে পরিবেশ রাখবেন না। বাড়িতে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখুন। ঘরের ভেতরে কাপড় শুকাবেন না ঘরের মধ্যে যদি কোন গাছ থাকে সেটি সরিয়ে ফেলুন।
৪) ঠান্ডা থেকে এলার্জি হতে পারে এজন্য পুকুরে গোসল করা দীর্ঘ সময় বৃষ্টিতে ভেজা থেকে বিরত থাকুন। আরো কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করার চেষ্টা করুন।
৫) গরম ও ঘাম থেকেও এলার্জি হয়। তাই অতিরিক্ত পরিশ্রম করার পর শরীর গরম হলে বা গেমে গেলে বাতাসে বসুন ও ঢিলেঢালা পোশাক পরিধান করুন।
৬) নির্দিষ্ট কিছু ধাতুতে এলার্জি থাকতে পারে। এসব ধাতুর তৈরি গয়না, আংটি ও ঘড়ি পরলে এলার্জি হতে পারে। এজন্য আপনার যদি কোন ধাতু দে এলার্জি থাকে সেই ধাতুর তৈরি কোন জিনিস ব্যবহার করবেন না।
৭) ফুলের পরাগরেণুতে এলার্জি প্রতিরোধের জন্য ঋতু পরিবর্তনের সময়টাতে যথাসম্ভব ঘরে থাকার চেষ্টা করুন। আর বাহিরে গেলেও যে কাপড় পড়ে যাবেন বাইরে থেকে আসার পর সেই কাপড় ধুয়ে ফেলুন। যে স্থানে গাছের পরিমাণ বেশি সেই স্থান দিয়ে চলাচল করবেন না।
৮) বিভিন্ন জিনিসপত্রে কেমিক্যাল এলার্জি থাকতে পারে। যেমন, শ্যাম্পু, ফেসওয়াস, সাবান ও সুগন্ধিতে থাকা কেমিক্যাল। যে সকল পণ্যে এলার্জি হয় সে সকল পণ্য ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন
সবশেষে,
এলার্জি একটি মারাত্মক অস্বস্তিকর রোগ। এ রোগ সহজে নিরাময় যোগ্য নয়। এলার্জি থেকে রক্ষা পেতে হলে ঘরে ধুলাবালি জমতে দেওয়া যাবে না। বাইরে বের হলে ধুলাবালি থেকে দূরে থাকতে হবে। এবং বাইরে থেকে আসার পর গোসল করতে হবে। এবং এলার্জির সমস্যা যদি অতিরিক্ত বেড়ে যায় তাহলে অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হবেন।
আরো পড়ুন –