Dreamy Media BD

জগতি ষ্টেশন

জগতি ষ্টেশন

শিল্প বিপ্লবের ডামাডোল যখন পুরো ইউরোপ জুড়ে বাঁজছে, তখন ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার জর্জ স্টিফেন্সনের স্টিম ইঞ্জিন আবিস্কার সাধারণ মানুষের চলাচলের গতিকে বাড়িয়েছে অনেক গুন। ১৯২৫ সালে গতির এই নব যাত্রার সাক্ষী হয়েছে তৎকালীন গ্রেট ব্রিটেনের হাজার হাজার মানুষ। এই যাত্রা ভারতীয় উপ-মহাদেশে পৌছাইতে খুব বেশি সমই লাগেনাই। ১৮৫৩ সালে মুম্বাইয়ে স্টিম ইঞ্জিন চালিত রেল চলাচলের মাধ্যমে গতির এক নব যুগের যাত্রা শুরু করে এই উপো মহাদেশ। তারই ধারাবাহিকতাই বাঙলাতেও শুরু হয় রেলপথ নির্মাণ। তার মাধ্যমে এই অঞ্চলের মানুষের সাথে পরিচিতি পায় চলাচলের গতির এক নব দিনের। ১৮৫৪ সালে হাওড়া থেকে যে যাত্রা শুরু হয়েছে, ক্রমেই সেটা ছড়িয়েছে বাঙলার আনাচে কানাচে। ১৮৬২ সালটা অবিভক্ত পূর্ব বাঙলার জন্য একটি বিশেষ বছর হয়ে থাকলো। স্থাপিত হলো রেল লাইন ও স্টেশন। পশ্চিম বঙ্গের রানা ঘাট থেকে দর্শনা হয়ে তৎকালীন নদিয়া জেলার ( বর্তমানে কুষ্টিয়া) জগতিতে পৌঁছে যায় রেল লাইন। স্থাপিত হয় বাংলাদেশের প্রথম রেল ষ্টেশন, জগতি ষ্টেশন।

ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে
রাত দুপুরে অই।
ট্রেন চলেছে,ট্রেন চলেছে
ট্রাইনের বাড়ী কই ?

একটু জিরোয়, ফের ছুটে যায়
মাঠ পেরুলেই বন।
পুলের উপর বাজনা বাজে ঝন ঝনাঝন ঝন।

ট্রেনের আসলে নির্দিষ্ঠ বাড়ী নেই। অনবরত ছুটে চলাই তার কাজ। এখন এখানে, তো তখন সেখানে। কবি শামসুর রাহমানের কবিতার এই লাইন গুলোতে ট্রেনের অনবরত ছুটে চলার বৈশিষ্ঠকে তুলে ধরা হয়েছে। আসলে ট্রেনর বাড়ী হলো তার থেমে যাবার জায়গা, ষ্টেশন । ষ্টেশনে ভোর হয়, দুপুর গড়াই, সন্ধ্যা নামে, রাত্রী যাই। কোলাহল বাড়ে, কোলাহল কমে। রোদ নামে,বৃষ্টি হয়,ঝড় হয়,শীতে কাপে। কিন্তু ষ্টেশন থেকে যাই বছরের পর বছর। বাঙ্গালী জাতির জীবনের সাথে রেল আর রেল ষ্টেশন জড়িত ওতপ্রোত ভাবে। ষ্টেশন মানেই লোকে লোকারণ্য, অবারিত কোলাহল, অপেক্ষা, কান্না-খুশি, জীবিকা আর আশ্রয় স্থল। রেল আর রেল ষ্টেশন স্থান করে নিয়েছে গান ও কবিতাই। পথের পাঁচালী ছিনেমাতে অপু দুর্গার মাঠের ভিতর দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে ট্রেন দেখতে যাবার দৃশ্য মনে ধরেছিলো প্রতিটা দর্শকের। একই ভাবে শিল্পের প্রতিটা ক্ষেত্রে রেল আর রেল ষ্টেশন জায়গা করে নিয়েছে সুনিপুণ ভাবে। কোন এক ভোরে প্রিয়জন এসে নেমেছিল, না হয় কর্ম স্থলে যাবার জন্যে এসেছিলো, কিম্বা ঘুরতে যাবার উদ্দেশ্যে এসেছিলো, অথবা নতুন বার্তা নিয়ে কেও এসে নেমেছিলো। এগুলাই ষ্টেশনের কমন চিত্র। ষ্টেশনে মানুষ অপেক্ষা করে কোথাও যাবার জন্যে কিম্বা অন্য কোন জায়গা থেকে আসবার গন্তব্য হিসেবে। ট্রেন আসে ট্রেন যায়, ষ্টেশনের প্লার্টফরম পরে থাকে কোলাহল আর অসংখ্য মানুষের আনাগোনা নিয়ে।

আরো পড়ুন – পানাম নগর

jogoti Station

জগতি ষ্টেশন এই বাংলার প্রথম রেল ষ্টেশন। পশ্চিম বঙ্গের রানা ঘাট থেকে জপতি পর্যন্ত রেল লাইন স্থাপন এর মাধ্যমে সূচনা হয় এই বাংলার প্রথম রেল যোগাযোগ। এখানে স্থাপিত হয় দোতলা বিল্ডিঙয়ের একটা ষ্টেশন ভবন। ১৮৬২ সালে ব্রিটিশ সরকার যেই ভবন স্থাপনের মাধ্যমে ষ্টেশন ধারণার জন্ম হয়েছিল এই বাংলায়, সেই ভবনটি এখনও টিকে আছে। পরর্বতীতে জগতি থেকে রেল সম্প্রসারণ করে রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ পর্যন্ত রেল লাইন নিয়ে যায় ব্রিটিশ সরকার। তখন অবিভক্ত বাংলার পশ্চিম বাংলার কোলকাতা থেকে পুর্ব বাংলার ঢাকাতে সরাসরি এই পথেই যাতায়াত করা হতো। তখনকার মানুষ শিয়ালদাহ ষ্টেশন থেকে ট্রেনে উঠে গোয়ালন্দ ঘাটে নেমে ষ্টীমারে চড়ে ঢাকা কোলকাতা যাতায়াত করতো। আর মাঝে পড়তো জগতি ষ্টেশন। ব্রডগেজ লাইনের মাদ্ধমে ভারত বর্ষের থেকে এই বাঙলাতে রেল যোগাযোগ স্থাপন হয়েছেলো। কুষ্টিয়া জেলাতে জগতি ষ্টেশনের পরের ষ্টেশনটির নাম হলো বড় ষ্টেশন। বড় ষ্টেশন স্থাপিত হবার সাথে বাংলার আর একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা জড়িত। সেটি হল “মোহিনী মিল”, কাপড়ের মিলটি ১৯০৮ সালে স্থাপন করেন কোলকাতার বিখ্যাত কাপড়ের ব্যবসায়ী মোহিনী মোহন চক্রবর্তী। সচল অবস্থায় এটি ছিলো এশিয়ার সর্ববৃহৎ কাপড়ের মিল। কোলকাতা থেকে কাচামাল আমদানি ও কোলকাতা বন্দর হয়ে শাড়ী আর ধুতী রপ্তানীর জন্যে বড় ষ্টেশনটি স্থাপন করা হয় মোহিনী মিলের ঠিক পাশেই। পূর্ব বাঙলাতে রেল লাইন, ষ্টেশন ও রেল আগমনের পেছনে একটি পরিবারের অবদান অনেক বেশী ছিলো,সেটি হলো জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের জমিদারী ছিলো কুষ্টিয়া জেলার শিলাইদাহতে। ১৮০৭ সালে রামলোচন ঠাকুরের উইলসূত্রে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর শিলাইদাহের জমিদারীর মালিক হন। পরবর্তীতে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারীর দায়িত্ব পেয়ে শিলাইদাহতে আসেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বারকানাথ ঠাকুরের জমিদারীর দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে শিলাইদাহতে প্রথম আসেন ১৮৮৯ সালের নভেম্বর মাসে। জমিদারী দেখাশোনা করতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কৈশোরে এবং পরবর্তীতে মাঝে মাঝে শিলাইদাহতে আসতেন ও থাকতেন। ১৮৯১ থেকে ১৯০১ সালের মধ্যে একদশকেরও বেশি সময় রবীন্দ্রনাথ অনিয়মিত বিরতিতে শিলাইদাহে অবস্থান করেছেন। কোলকাতা থেকে শিলাইদাহ পর্যন্ত এই পথেই কবি গুরু যাতায়াত করতেন। শিয়ালদাহ ষ্টেশন থেকে ট্রেনে চড়ে কবি গুরু জগতি ষ্টেশনে এসে নামতেন। তারপর এখান থেকে ঘোড়ায় টানা গাড়ীতে করে শিলাইদাহতে যেতেন। জগতি ষ্টেশন স্থাপনের পর অবিভক্ত বাংলার পূর্বাঞ্চলে স্থাপিত হয় অভূতপূর্ব এক স্থাপনা। সূচনা হয় যোগাযোগের এক অন্যতম অধ্যায়। জগতি ষ্টেশনের হাত ধরে ছড়িয়ে পড়ে এ বাংলায় রেল যোগাযোগ। যাত্রী পরিবহন থেকে শুরু করে মাল পরিবহন, সর্ব ক্ষেত্রে আসতে শুরু করে এক নতুন গতি। ঘুচতে শুরু করে মানুষের দীর্ঘ দিনের কষ্টের যাত্রা। বাড়তে থাকে ব্যবসা বাণিজ্য। সাধারণ মানুষের যোগাযোগের প্রতিবন্ধকতা ঘুচতে থাকে। জগতি ষ্টেশনের হাত ধরে যে ষ্টেশন যুগে প্রবেশ করে এই বাংলা তার সুফল পেয়ে আসছে পুরো বাঙ্গালী জাতি। পরবর্তীতে রেল নেটওয়ার্ক বেড়েছে, আধুনিক হয়েছে রেল যোগাযোগ। দেশে আধুনিক ষ্টেশন স্থাপন হয়েছে, নানান সুযোগ সুবিধা যুক্ত হয়েছে। কিন্তু জগতি ষ্টেশন এই যাত্রার অগ্রপথিক হয়ে থাকবে। নদী মাতৃক এই দেশে শত শত বছর ধরে মানুষের চলাচলের একমাত্র বাহন ছিলো নৌকা। পাল তোলা অথবা দাড় টানা নৌকাতে এক জাইগা থেকে আর এক জাইগাতে যাতায়াত ছিলো সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। যোগাযোগে সময় সাপেক্ষের ব্যাপারকে ঘুচিয়েছেলো এই বাংলায় রেলের আগমন। সাধারণ মানুষের যাতায়াতের নির্ভর যোগ্য বাহন হয়ে উঠেছিল রেল। আর ষ্টেশন হয়ে উঠেছিলো প্রিয় এক স্থান।

উদ্ভোধোনের পর থেকে রেল নিয়মিত শিয়ালদাহ ষ্টেশন থেকে জগতি ষ্টেশনে যাতায়াত করতো। রবীন্দ্রনাথ কতোবার তার কাব্যিক চিন্তা নিয়ে এই ষ্টেশনে এসে নেমেছে। আবার বিশ্ব দরবারে যাবার জন্যে হইতো এই ষ্টেশন থেকে রেলে চড়ে কোলকাতা পৌছিয়েছে। হয়তো এই ষ্টেশন থেকে ট্রেনে চড়ে কোলকাতায় যেতেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম সারির স্বদেশী নেতা বাঘা যতীন। কিম্বা আন্দোলনের ময়দান থেকে স্বজনের সাথে দেখা করতে বাড়ীতে আসবার জন্যে ট্রেনে করে এই ষ্টেশনেই আসে নেমেছিলেন। হয়তো কখনো এই ষ্টেশনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছিলেন বাংলার প্রিন্ট মিডিয়ার যাত্রা যার হাতে শুরু, সেই কাঙ্গাল হরীনাথ। অথবা এখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছেন এই অঞ্চল তথা পূর্ব বাংলাতে জন্ম নেয়া নাম জানা অজানা অসংখ গুনিজন, যারা নিজ জাইগা থেকে ছরিয়ে হয়েছেন বিশ্ব জনীন। এই ষ্টেশনে অপেক্ষা করেছেন কতো পিতা, যে তার পুত্রের আগমনের জন্যে অপেক্ষা করেছেন। কিম্বা বাণিজ্য সেরে ঘরে ফেরেছেন কোন সদাগর। কতো নববধূ এই বাংলা থেকে বিয়ে হয়ে ওই বাংলাতে শ্বশুর বাড়ী যাবার জন্যে অপেক্ষা করেছে এই ষ্টেশনে। তা ছাড়া উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্যে কতো যুবক এই ষ্টেশন থেকে ট্রেনে চড়ে কোলকাতা শহরে গিয়েছে। কতো হাসি,কান্না,স্বপ্ন আর ইতিহাসের এই জগতি ষ্টেশন।

কালের বিবর্তনে আজও টিকে আছে জগতি ষ্টেশন। লাল রঙের ব্রিটিশদের তৈরি করে রেখে যাওয়া দোতলা ষ্টেশন ভবনটি আজো টিকে আছে, কিন্তু অনেকটা জীর্ণ অবস্তায়। সেই মায়াবী প্লারটফরমটি আজো টিকে আছে, কিন্তু নেই সেই কোলাহল। ষ্টীম ইঞ্জিনের রেলের যুগ শেষ হয়ে অনেক আগেই এসেছে ডিজেল ইঞ্জিনের রেল। সাথে গুরুত্ব হারিয়েছে এই ষ্টেশনের। এই লাইন দিয়ে চলাচল করা কোন ইন্টারসিটি ট্রেন আর এখানে থামেনা। হাতেগোনা কয়েকটা মেইল আর শাটল ট্রেন ছাড়া আর কোন ট্রেইন এই ষ্টেশনে আর থামেনা। দোতলা ভবনের উপর তলার রুম গুলা এখন পরীত্যাক্ত। নীচের রুম গুলা শুধু ব্যবহার হয় নির্দিষ্ট কিছু কর্মকান্ডের জন্যে। এই ষ্টেশনে নেই এখন আর কোন ওয়েটিং রুম। প্লাটফর্মে কেও আর অপেক্ষা করেনা কারো জন্যে। সময়ের সাথে সাথে পৃথেবির সব কিছু গুরুত্বহীন হয়ে যাই। জগতি ষ্টেশনও তেমন হয়েছে গুরুত্বহীন। কিন্তু বেঁচে আছে এখনো,ট্রেন এসে থামে এখনো। যাত্রী থাকুক আর নাই থাকুক, কিছু সময় থেমে আবার যাত্রা করে গন্তব্যে।

Related Post

মৃত্যু নিয়ে উক্তি

150+মৃত্যু নিয়ে উক্তি, বাণী, ক্যাপশন 2024

মৃত্যু নিয়ে উক্তি জন্মিলে মরিতে হবে আর এটাই সত্যি। মৃত্যু হচ্ছে সবচেয়ে চিরন্তন সত্যি। পৃথিবীতে প্রতিটি প্রাণীর মৃত্যুর স্বাদ অনুভব করতে হবে। সবসময় মৃত্যুর জন্য

Read More »
খুশির স্ট্যাটাস

200+ স্টাইলিশ খুশির স্ট্যাটাস | হাসি নিয়ে ক্যাপশন

খুশির স্ট্যাটাস | হাসি নিয়ে ক্যাপশন জীবনের সুন্দর খুশির মুহূর্ত আমরা সবাই বাঁধাই করে রাখতে চাই। আর এই খুশির মুহূর্তকে ধরে রাখার সবচেয়ে সহজ উপায়

Read More »

স্টাইলিশ ভালোবাসার ছন্দ | রোমান্টিক ছন্দ | Love Status Bangla

❤❤ভালোবাসার ছন্দ | ভালোবাসার ছন্দ রোমান্টিক | ভালোবাসার ছন্দ স্ট্যাটাস❤❤ ভালোবাসা হলো এক অন্যরকম অনুভূতির নাম, যা শুধুমাত্র কাউকে ভালবাসলেই অনুভব করা যায়। আমরা বিভিন্নভাবে

Read More »
মন খারাপের স্ট্যাটাস

মন খারাপের স্ট্যাটাস, উক্তি, ছন্দ, ক্যাপশন, কিছু কথা ও লেখা

মন খারাপের স্ট্যাটাস মন খারাপ – এই কষ্টের অনুভূতি কার না হয়? সবারই কখনো না কখনো সবারই মন খারাপ হয়। জীবনের ছোটোখাটো অঘটন থেকে শুরু

Read More »

Leave a Comment

Table of Contents