Dreamy Media BD

জমিদার সাহেব বাড়ি

জমিদার সাহেব বাড়ি

বাড়িটির বয়স প্রায় ২০০ বছর। বেচারাম দেউড়ির লাল রঙের দোতলা বাড়িটির মহল্লার মানুষ বাড়িটিকে ‘সাহেব বাড়ি’ নামেই চেনে। অনেকে বলেন ‘জমিদার বাড়ি’। সব মিলিয়ে জমিদার সাহেব বাড়ি। পুরান ঢাকার বেচারাম দেউড়ির লাল রঙের দোতলা বাড়িটির পাশের চারটি সড়কের নাম এই বাড়ির সদস্যদের নামে— নূর বকস রোড, আবুল খায়রাত রোড, আবুল হাসনাত রোড ও নাবালক মিয়া লেন। বহু যুগের স্মৃতিবিজড়িত ওই বাড়িটির পরিচিতি ‘জমিদার সাহেব বাড়ি’ নামে। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা হিসেবে বাড়িটির একাংশ এখনো টিকে আছে। তবে আরেক অংশে চলছে নতুন বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ। এটি নির্মিত হলে প্রাচীন স্থাপনাটি আড়ালে পড়ে যাবে।

জানা যায়, আঠারো শতকের দিকে ঢাকা ও সোনারগাঁয়ের জমিদার ছিলেন মৌলভী আবুল খায়রাত মোহাম্মদ। সে সময় তিনি ছয় বিঘা জমির ওপর এই বাড়িটি নির্মাণ করেন। আবুল খায়রাতের বাবা ছিলেন মুন্সি নূর বকস। আর আবুল খায়রাতের দুই ছেলে আবুল হাসনাত ও আবু জাফর জিয়াউল হক ওরফে নাবালক মিয়া। তাঁদের নামেই এখন এই বাড়ির আশপাশের সড়কের নামকরণ করা হয়েছে।

সাবেক ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল ফটক পেছনে ফেলে সামনে এগোলে আবুল হাসনাত রোড। এর ডান দিকে আবুল খায়রাত রোড। এই রোড মিলেছে নূর বকস রোডে। মাঝখানে আছে নাবালক মিয়া লেন। স্টিল দিয়ে তৈরি করা মূল ফটক পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেই দেখা মেলে লাল রঙের জমিদারবাড়ি। বাড়িটির দুটি অংশ। এক অংশ লাল আরেক অংশ সাদা রঙের। বাড়ির সামনেই মৌসুমি ফুলের বাগান। ভেতরে একটি ফোয়ারা তবে এখন এটি চালু নেই। বাগানের পর বাহারি নকশা করা আর্মেনিয়ান স্থাপত্যরীতির লাল রঙের বাড়ি। চুন– সুরকিতে গাঁথা চওড়া দেয়াল, খড় খড়ি লাগানো দরজা -জানালা, ছাদে ফুল, লতাপাতার নকশা করা রেলিং সবকিছুই যেন কালের সাক্ষী হয়ে আছে । সামনে লাল রঙের এক তলা ভবনটি বাহিরে এবং ভেতরে সাদা রঙের দোতলা অন্দরমহল। এই দুই অংশ মিলিয়ে তিন বিঘা আয়তনের জমিদারবাড়িটিতে এখন বসবাস করছেন আবুল খায়রাতের ষষ্ঠ প্রজন্মের সদস্যরা। বাকি তিন বিঘা ছিল খোলা জায়গা, আর পারিবারিক কবরস্থান। বিভিন্ন সময়ে পরিবারের সদস্যরা তা বিক্রি করে দিয়েছেন।

আরো পড়ুন – জগতি ষ্টেশন

সম্প্রতি জমিদারবাড়িতে গিয়ে জানা গেল, বাহিরমহলে বসবাস করছেন জিয়াউল হক ওরফে নাবালক মিয়ার বংশধরেরা। আর অন্দরমহলে থাকেন আবুল হাসনাতের বংশধরেরা। ১৯৫০- ১৯৬০ সালের দিকে দুই মহলের সামনের প্রশস্ত বাগানের মাঝ দিয়ে দুই পরিবারের সদস্যরা দেয়াল তুলে বাহিরমহল ও অন্দরমহলকে আলাদা করে দেন । অন্দরমহল অংশের বাগানের জায়গায় এখন গড়ে তোলা হচ্ছে ১০ তলা ভবন। ভবন তৈরির জন্য জায়গাটি একটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছেন আবুল হাসনাতের মেয়ের নাতিরা। এখন চলছে ভিত্তি তৈরির কাজ।

জমিদারবাড়ির এই বাগানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতি। নাবালক মিয়ার নাতি আবু মোহাম্মদ ইমরানের তিনি বলছিলেন, এই পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কবি কাজী নজরুল ইসলামের। ঢাকায় এলে কবি এই বাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণ করতেন। এই বাগানে বসেই তিনি ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’ ও ‘কে বিদেশী মন উদাসী’র মতো কালজয়ী গান রচনা করেছিলেন।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম এই বাড়ির বাগানে বসেই ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’ ও ‘কে বিদেশী’ গানের সাথে সাথে আরো অনেক গান লিখেছিলেন।

বেচারাম দেউড়ির জমিদারবাড়িসহ পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ২ হাজার ২০০টি ভবনের তালিকা করেছে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা নিয়ে কাজ করা সংগঠন আরবান স্টাডি গ্রুপ (ইউএসজি)। তাদের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের আগস্টে এই ঐতিহ্যবাহী ভবনগুলোর কোনো পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন উচ্চ আদালত। একই সঙ্গে এসব বাড়ির জায়গায় কোনো স্থাপনা বা ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদন না দিতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (রাজউক) নির্দেশ দেওয়া হয়।

Zamindar Sahib house
ইউএসজির প্রধান নির্বাহী তাইমুর ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘জমিদার সাহেব বাড়িতে বহুতল ভবন নির্মাণ বন্ধ রাখা উচিত। কারণ, সুউচ্চ এই ভবন নির্মাণ করা হলে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাটি আড়ালে পড়ে যাবে। আর্থিক সংকটের কারণে এই ভবনসহ আরও অনেক ভবনের রক্ষণাবেক্ষণ করতে না পেরে মালিকেরা নির্মাতাপ্রতিষ্ঠানের কাছে দিয়ে দিচ্ছেন। সরকারি উদ্যোগে অঞ্চলভেদে অথবা পৃথকভাবে এগুলো সংরক্ষণ করা উচিত। তাতে পরবর্তী প্রজন্ম অন্তত ঢাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারবে।

জমিদারবাড়ির বাহিরমহল ঘুরে দেখা গেল, মূল ভবনের ভেতরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকা আসবাব ও অন্যান্য জিনিসপত্র। অতিথিকক্ষে পুরোনো সোফা, পালঙ্ক, আলমারি, বই রাখার তাক, ফুলদানি, তাসের টেবিল। আর দেয়ালজুড়ে টাঙিয়ে রাখা আছে বংশপরম্পরায় পরিবারের সদস্যদের ছবি। পাশে বিশাল ‘হলরুম’। জানানো হলো, যুক্তফ্রন্ট গঠনের পর বিভিন্ন সময় এই কক্ষে বৈঠক করেছেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ ও শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক তৎকালীন নেতারা।

আবু মোহাম্মদ ইমরান বলছিলেন, ‘এই বাড়ির ঐতিহ্য ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। আমার বাবা আবু মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বেঁচে থাকা পর্যন্ত পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন। আমিও নিজ চেষ্টায় বর্তমান অবস্থা পর্যন্ত রাখতে পেরেছি। বাকিটা পরের প্রজন্মের ওপর নির্ভর করছে।’

খাবারের ঐতিহ্য আর ঐতিহ্যের সঙ্গে খাবার পুরান ঢাকার বেচারাম দেউরী জমিদার বাড়িতে এই দু’য়ের সম্মিলন ঘটেছে। রাজধানীর জমিদার সাহেব বাড়িতে’। বেচারাম দেউরী জমিদার বাড়িতে চালু হয়েছে লাঞ্চ এট হেরিটেজ হোম। জমিদার সাহেব বাড়ির একাংশে চালু হয়েছে ব্যতিক্রমী এক রেস্তোরাঁ। যেটি এখন পরিচিত ইমরানস হেরিটেজ হোম নামে। এখানে মিলবে পারিবারিক আবহে রকমারি ঢাকাই খাবারের স্বাদ। সঙ্গে ভোজন রসিক পাবেন ঐতিহ্যের সংস্পর্শ।

২০১৮ সালে বাড়িতেই রেস্তোরাঁ চালু করেন এ এম ইমরান। নাম দেন ‘ইমরানস হেরিটেজ হোম’ (Imran’s Heritage Home)। সুস্বাদু খাবার আর ইতিহাসের সাক্ষী এই প্রাচীন ভবনের শিল্পকর্ম দেখতে আসেন অনেকেই। খাবারের তালিকায় থাকে জাফরানি পোলাও, মুরগির মাংসের চপ, আনারস ইলিশ, চিংড়ি মাছের মালাই কারি, মুরগির রোস্ট, বিফ কাটা মসলা, সালাদ এবং ঘরে বিশেষ প্রক্রিয়ায় বানানো বোরহানি এবং শেষে জাফরানি জর্দা সাথে থাকছে স্পেশাল চা। সব খাবারই বাড়িতেই রান্না করা হয়ে থাকে এখানে । দিনের ও রাতের মেন্যু আলাদা আলাদা । বলা হয়ে থাকে এই জমিদার বাড়িতে একই খাবার দুবার পরিবেশন করা হয়না কখনো । ইমরানস হেরিটেজ হোম এ খেতে হলে ন্যূনতম দুই থেকে তিন দিন আগে ফেইসবুকে যোগাযোগ করতে হবে। সর্বনিম্ন পাঁচজন ও সর্বোচ্চ ২০ জনের একটা দলের জন্য দুপুর অথবা রাতের খাবারের ফরমাশ করা যাবে। খাবারের দাম জন প্রতি ৬৯৯ টাকা থেকে শুরু করে ১,০০০ টাকা।

প্রচলিত রেস্তোরাঁ থেকে অনেকটাই আলাদা ‘ইমরান’স হেরিটেজ হোম’। কারণ এখানে আপনি খাবারের সাথে সাথেই হেরিটেজের সন্ধানও পাবেন। কারুকাজ করা স্তম্ভ, শতবর্ষী আসবাব, তুরস্ক থেকে আনা বহু বছরের পুরনো ঝাড়বাতি, সোনার প্রলেপ দেয়া ২ শত বছরের পুরনো পবিত্র কোরআন শরীফ, দুষ্প্রাপ্য সব ছবি এখানে দেখা যায় , তলোয়ার এসবকিছু আর কোনো রেস্তোরাঁয় দেখতে পাবেন না তাই খেতে খেতে মনে হবে যেন আপনি টাইম মেশিন চেপে পৌঁছে গেছেন রাজা- বাদশাদের আমলে। রাজনৈতিক পটভূমি থেকেও বেচারাম দেউড়ির এই বাড়িটির ইতিহাস বেশ অভিজাত। এই বাড়িতে একসময় এসেছিলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসু, মাওলানা ভাসানী, শিল্পী এস এম সুলতান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, সোহরাওয়ার্দী সাহেবসহ অবিভক্ত ভারত ও পাকিস্তানের প্রথম সারির বহু রাজনৈতিক নেতারা।

ভোজন রসিকেরা যেমন এখানে সুস্বাদু খাবার খেতে পারবেন তেমনই যাদের ইতিহাস বা ঐতিহ্যের প্রতি ভালোলাগা কাজ করে তারাও এখানে এসে বেশ উপভোগ করবেন। কারণ অতিথিদের জন্য পুরো বাড়ি ঘুরে দেখার অনুমতি রয়েছে। রেস্তোরাঁর মালিক ইমরানের মতে যারাই এই রেস্তোরাঁতে খেতে আসেন সকলেই তাদের কাছে অতিথি, ক্রেতা নয়। তাই অতিথিদের যথাযথ আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয় এখানে। তিনি বলেন, ‘অতিথি নিজের ইচ্ছায় আসে না কখনো , আল্লাহর ইচ্ছায় আসে তাই আমরা আমাদের অতিথিদের যত্ন নিতে দ্বিধাবোধ করি না কখনো ’।

কিভাবে যাবেন ভাবছেন পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল ফটক পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেলে আবুল হাসনাত রোড। আবুল হাসনাত রোড এর ডান দিকে আবুল খায়রাত রোড এবং এই রোড মিলেছে নূর বকস রোডে। মাঝখানে আছে নাবালক মিয়া লেন। স্টিল দিয়ে তৈরি করা মূল ফটক পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেই দেখা মেলে লাল রঙের জমিদারবাড়ি বা জমিদার সাহেব বাড়ি ।

পুরান ঢাকায় জমিদার সাহেব বাড়ি ছাড়াও রয়েছে অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে যাদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব দেশ-বিদেশের মানুষকে টেনে আনে। সদরঘাটে লঞ্চ আগমন ও প্রস্থান এবং ডিঙ্গী নৌকার উত্তাল অবস্থা আকর্ষণীয়।

⦁ লালবাগের কেল্লা
⦁ পরিবিবির মাজার
⦁ সূত্রাপুর জমিদার বাড়ি,
⦁ ঢাকেশ্বরী মন্দির
⦁ তারা মসজিদ
⦁ হোসেনি দালান
⦁ আহসান মঞ্জিল
⦁ শাঁখারিবাজার
⦁ ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল
⦁ বড় কাটারা
⦁ শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজ
⦁ ছোট কাটারা
⦁ বাহাদুর শাহ পার্ক
⦁ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
⦁ করতলব খান মসজিদ
⦁ খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদ
⦁ বিনত বিবির মসজিদ
⦁ রূপলাল হাউজ
⦁ আর্মেনীয় গির্জা
⦁ চকবাজার শাহী মসজিদ
⦁ ঢাকা মেডিকেল কলেজ
⦁ শায়েস্তা খাঁর মসজিদ
⦁ নর্থব্রুক হল বা লালকুঠি
⦁ আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়
⦁ রোজ গার্ডেন

Related Post

মৃত্যু নিয়ে উক্তি

150+মৃত্যু নিয়ে উক্তি, বাণী, ক্যাপশন 2024

মৃত্যু নিয়ে উক্তি জন্মিলে মরিতে হবে আর এটাই সত্যি। মৃত্যু হচ্ছে সবচেয়ে চিরন্তন সত্যি। পৃথিবীতে প্রতিটি প্রাণীর মৃত্যুর স্বাদ অনুভব করতে হবে। সবসময় মৃত্যুর জন্য

Read More »
খুশির স্ট্যাটাস

200+ স্টাইলিশ খুশির স্ট্যাটাস | হাসি নিয়ে ক্যাপশন

খুশির স্ট্যাটাস | হাসি নিয়ে ক্যাপশন জীবনের সুন্দর খুশির মুহূর্ত আমরা সবাই বাঁধাই করে রাখতে চাই। আর এই খুশির মুহূর্তকে ধরে রাখার সবচেয়ে সহজ উপায়

Read More »

স্টাইলিশ ভালোবাসার ছন্দ | রোমান্টিক ছন্দ | Love Status Bangla

❤❤ভালোবাসার ছন্দ | ভালোবাসার ছন্দ রোমান্টিক | ভালোবাসার ছন্দ স্ট্যাটাস❤❤ ভালোবাসা হলো এক অন্যরকম অনুভূতির নাম, যা শুধুমাত্র কাউকে ভালবাসলেই অনুভব করা যায়। আমরা বিভিন্নভাবে

Read More »
মন খারাপের স্ট্যাটাস

মন খারাপের স্ট্যাটাস, উক্তি, ছন্দ, ক্যাপশন, কিছু কথা ও লেখা

মন খারাপের স্ট্যাটাস মন খারাপ – এই কষ্টের অনুভূতি কার না হয়? সবারই কখনো না কখনো সবারই মন খারাপ হয়। জীবনের ছোটোখাটো অঘটন থেকে শুরু

Read More »

Leave a Comment

Table of Contents