Dreamy Media BD

ভাষা আন্দোলন – সূচনা, ইতিহাস ও পটভূমি

ভাষা আন্দোলন

১৯৪৭ সাল। এশিয়া উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটার মাধ্যমে ভারত এবং পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। স্বাধীনতার পরই ভারতের রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা নিয়ে কোনো দ্বৈতমত না থাকলেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এবং উর্দুভাষী বুদ্ধিজীবীরা বলেন, উর্দু হচ্ছে আমাদের মুখের ভাষা, তাই উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। অন্যদিকে পাকিস্তানের খন্ড অংশ পূর্ব পাকিস্তান থেকে দাবি ওঠে, বাংলাকেও তবে অন্যতম রাষ্ট্রভাষাব হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।

কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের এই দাবি অর্থাৎ বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দেবার এ দাবিকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে। তাদের এই দাবি অস্বীকার করায় ঢাকার ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীরা ক্ষুব্ধ হন এবং ভাষা বিবেচনার ব্যাপারে একটি চূড়ান্ত দাবিনামা প্রস্তুত করেন তাঁরা। সেই চূড়ান্ত দাবিনামায় তাদের দাবি হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষা ও সরকারি কার্যাদি পরিচালনার মাধ্যম হবে বাংলা।

পশ্চিম পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সরকার পর্যায়ে গোটা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে দুটি, বাংলা ও উর্দু। কিন্তু এরপর কি হয়েছিলো? তাদের দাবি কি মেনে নিয়েছিলো পাকিস্তান সরকার? পাঠক, তাইই যদি হতো তবে বাংলা ভাষা আন্দোলন নামে কোনো আন্দোলনের পটভূমি রচিত হতো কি? 

মূলত বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিলো, পশ্চিম পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন এবং শোষণের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের শোষিত জনগণের সুদীর্ঘ সংগ্রামের সুসংগঠিত সূচনা। এই ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই পূর্ব পাকিস্তানে তথা বাংলাদেশে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই ১৯৪৭ সালে ভাষা আন্দোলনের পটভূমি রচিত হয়েছিলো বলেই আজ আমরা বাংলায় কথা বলতে পারি, মন খুলে গাইতে পারি। তাই বাংলা ভাষা আন্দোলন শুধু বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যেই নয় বরং সারা বিশ্বের সমস্ত ভাষা আন্দোলনের মধ্যে অন্যতম উদাহরন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। 

ভাষা আন্দোলনের সূচনা

জানলে কিছুটা অবাক হবেন হয়তো, বাংলা ভাষা আন্দোলন সক্রিয়ভাবে ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে শুরু হলেও এই শুরুরও আরেকটি শুরু আছে। সেই শুরু করেছিলেন বাংলার লেখক সম্প্রদায়। 

হ্যাঁ পাঠক, বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক এবং বাংলা একাডেমির উপ-পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা লেখক আবদুল হক তাঁর  ভাষা আন্দোলনের আদি পর্ব নামক বইটিতে লিখেছেন, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসগুলির বিবরণ অনুযায়ী বাঙালি লেখকগণ বাংলা রাষ্ট্রভাষার স্বপক্ষে পত্র-পত্রিকায় লিখতে আরম্ভ করেছিলেন ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে এবং এ প্রয়াসের সূচনা ঢাকায়। কিন্তু তা ঠিক নয়। এ প্রচেষ্টার শুরু আরো আগে এবং কোলকাতায়।

তাঁর প্রাগুক্ত বইটি থেকে জানা যায়, কোলকাতা শুধু অখণ্ড বাংলাদেশের নয়, কিছুদিন খণ্ডিত পূর্ববঙ্গেরও রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রাজধানী ছিল আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত। মাউন্টব্যাটেন ঘোষণার পরে পরেই আসন্ন পাকিস্তানের বিভিন্ন সমস্যা তাদের দৈনন্দিন উত্তেজনাময় আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল।

এই সব আলোচনার একটা প্রধান বিষয় ছিল রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন, কেননা ইতোমধ্যে প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল ছিল যে, উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা চলছে। সচেতন এবং বুদ্ধিমান লেখকবৃন্দ তখনই পাকিস্তানের এ প্রয়াসের বিরোধিতা করার এবং বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত করার পণ নিয়েছিলেন।

অন্যদিকে, জুলাই মাসে ঢাকায় মুসলিম লীগের বামপন্থীদের নিয়ে গণ আজাদী লীগ নামক একটি ক্ষুদ্র সংস্থা গঠিত হয় এবং এই সংস্থার ম্যানিফেস্টোতে বলা হয় বাংলা হইবে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। 

এরপর ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিশ একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে যার নাম ছিলো, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা নাকি উর্দু?। এই  পুস্তিকাতে বাংলাকে পাকিস্তানের একটি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করার দাবী করা হয়। 

অতএব বলা যায় যে, সর্বপ্রথম লেখক সম্প্রদায়ই উর্দু রাষ্ট্রভাষার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন এবং সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন যা প্রথমে শুরু হয়েছিলো কোলকাতায় এবং তারপর ঢাকায়। মূলত তাদের এই প্রয়াসেই শিক্ষিত ও ছাত্র সমাজ বাংলাভাষার দাবি সম্পর্কে সচেতন হয়েছিলো এবং এভাবেই পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল। 

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও পটভূমি

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রাথমিক পর্যায়ে এই রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন দানা বাধে কিছু সরকারী প্ররোচনার প্রতিক্রিয়া হিসাবে।

১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তান ক্ষমতায় আসলে দুমাস বাদেই নভেম্বর মাসে পাকিস্তানের শাসকরা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তথা বাঙালিদের ভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে সগৌরবে উর্দুর সাথে ইংরেজিতে লেখা খাম, পোষ্ট কার্ড, ডাকটিকেট, রেল-টিকেট, মানি অর্ডার ফর্ম ইত্যাদি ছাপিয়ে সেগুলো চালু করে দেয়।

এমনকি এসময়ে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের আন্ডারে থাকা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার বিষয়াদি সম্পর্কে একটি সার্কুলার প্রেরণ করা হয়। সেই সার্কুলারে ঐ পরীক্ষার জন্য মোট ৩১টি বিষয় দেয়া হয়, যার মধ্যে নয়টি ছিল ভাষা। কিন্তু এই নয়টি বিষয়ের মধ্যেও স্থান পায়নি বাংলা ভাষা যা তৎকালীন সময়ে অধিকাংশ মানুষের মুখের ভাষা ছিলো। এই সার্কুলারটি যেন নিজ ভাষার জন্য মানুষের বুকে ধিকধিক করে জ্বলা আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করেছিলো কেননা স্পষ্টতই পাকিস্তানীরা চাচ্ছিলো না দ্বৈতভাবে হলেও রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃতি পাক। 

একই বছরের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের রাজধানী করাচীতে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। মর্নিং নিউজ নামে এক পত্রিকা এই শিক্ষা সম্মেলনের উদ্দেশ্যকে বিকৃত করে প্রচার করায় প্রতিবাদে ঐদিনই দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ ঢাকার অন্যান্য কলেজ এর শিক্ষার্থীরা এক প্রতিবাদ সভা করে, যে সভার সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং তমদ্দুন মজলিশের সম্পাদক আবুল কাসেম। এটিই ছিলো মূলত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সর্বপ্রথম সাধারণ ছাত্র সভা।

বাংলাদেশের অন্যান্য সকল আন্দোলনের মত ভাষা আন্দোলনের সূচনাও হয়েছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। এদিকে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ভয়াবহ এবং দূর্বিষহ ভবিষ্যৎ অনুধাবন করে এই অস্থিরতার প্রতিকারের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জন্ম হয়। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত এই দলের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচীতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের কংগ্রেস দলের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে পরিষদের অন্যতম ভাষা করার দাবি জানান। অথচ অধিবেশনে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন দম্ভের সাথে ঘোষণা করেন যে,পূর্ব বাংলার অধিকাংশ মানুষেরই এই চাওয়া যে, একমাত্র উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করা যাইতে পারে। তার এই বক্তব্যের প্রতিবাদে ঢাকাসহ পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ শুরু হয়।

এরপর ২রা মার্চ গণ আজাদী লীগ, তমদ্দুন মজলিস, ছাত্রলীগ ও বিভিন্ন ছাত্রাবাসের যৌথ উদ্যোগে ফজলুল হক হলে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের এক সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সেদিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের এক প্রস্তাবে ১১ মার্চ দেশজুড়ে সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়।

এরই জের ধরে শেখ মুজিব, শামসুল হক, অলি আহাদসহ ৬৯ জনকে গ্রেফতার করলে ঢাকায় পুনরায় ১৩-১৫ মার্চ ধর্মঘট পালিত হয়। এমতাবস্থায় প্রায় বাধ্য হয়েই খাজা নাজিমুদ্দিন ১৫ই মার্চ ৮ দফা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ১৫ই মার্চ বিকেলের মধ্যেই ভাষা-আন্দোলনের বন্দী ছাত্র ও কর্মীদের মুক্তি দেয়া হয়। 

এরই মধ্যে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তার এই সফর উপলক্ষে আয়োজিত একটি বিশাল সমাবেশে তিনি বলেন, উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে, অন্য কোনো ভাষা নহে। যে কেহ অন্য পথে চালিত হইবে সেই পাকিস্তানের শত্রু। ২৪ মার্চ কার্জন হলে অনুষ্ঠিত ঢাবির সমাবর্তনে পুনরায় তিনি বলেন, Urdu and Urdu alone shall be the state language of Pakistan। এই সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জিন্নাহ যখন এবং যতবারই বলেন, উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা, তখন সেখানে উপস্থিত বহু ছাত্র না,না বলে চিৎকার করতে থাকেন।  

১৯৪৮ সালের পর বাংলা ভাষা আন্দোলন কিছুটা থেমে গেলেও পাকিস্তান শাসক গোষ্টির বাংলা ভাষা বিরোধী ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। নানান সময় নানান কায়দায় তারা বাংলা ভাষাকে সমূলে উৎপাটন করতে চেয়েছিলো। এতোকিছুর মধ্যেও ১৯৫০ সালের ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি। ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে এই কমিটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা প্রত্যক্ষ করা যায়।

১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে পাকিস্তানের নয়া প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একমাত্র উর্দু এবং উর্দু হরফে বাংলা লিখনের প্রচেষ্টা সাফল্যমণ্ডিত হচ্ছে বলে হাস্যরসের জন্ম দেন। তার এই জ্বালাময়ী বক্তৃতায় দেশব্যাপী পুনরায় বিক্ষোভ সৃষ্টি হয়। এরপর থেকে নানান সময়ে নানান আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় সাধারন জনগনকে।

উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা এবং আরবি অক্ষরে বাংলা ভাষার প্রচলন করার বিরুদ্ধে ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শহরের সকল স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীগণ ধর্মঘট পালন করে। ছাত্রছাত্রীগণ রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, আরবি হরফে বাংলা লেখা চলবে না প্রভৃতি স্লোগান দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন মুখরিত করে তোলে।

ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারার আদেশ জারি করে এক মাসের জন্য শহরে সভা, শোভাযাত্রা প্রভৃতি নিষেধ করেন। এসময়ে ভোটাভোটির মাধ্যমে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত জয়যুক্ত হয়।

student rally and monajat 21 feb
student rally and monajat 21 feb

এরপর নানান পর্যালোচনার পর ভাষার দাবিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য পরিস্থিতির মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ছাত্ররা দৃঢ় আত্মসচেতনতায় ঐক্যবদ্ধভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে অভিমত ঘোষণা করে। বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বরে এসময় পুলিশ মোতায়েন ছিলো এবং পুলিশ এক সময় কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত ছাত্ররা কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপের প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।

এসময় রাস্তায় বের হলেই ১৪৪ ধারা অমান্য করা হয়েছে বলে পুলিশ অনেক ছাত্রকে গ্রেফতার করে এবং ৬২ জনকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে আটক রাখে। গ্রেফতারের ফলে ছাত্র মহলে দারুণ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এসময়েও পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করে এবং ছাত্ররা পুলিশের উপর ইট, পাথর নিক্ষেপ করতে থাকে। ইট পাটকেলের বিপরীতে  কাঁদুনে গ্যাস আর লাঠিচার্জ আসার এক পর্যায়ে পুলিশ ছাত্রদের দিকে গুলি চালাতে শুরু করে। ঘটনাস্থলেই আবদুল জব্বার ও রফিকউদ্দিন আহমদ শহীদ হন এবং আরোও ১৭ জনের মতো আহত হন। 

ছাত্রদের উপর গুলি চালানোর সংবাদ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লে শহরের যেকোনো প্রান্ত থেকে অফিস আদালত ও বেতার কেন্দ্রের কর্মচারীরা অফিস থেকে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। শহরের সমস্ত লোক বিক্ষুব্ধ হয়ে এক জায়গায় মেডিকেল প্রাঙ্গনে হাজির হতে থাকে। রাস্তায় আর গলিতে গলিতে যেন ঢাকার বিক্ষুব্ধ মানুষের ঝড় বয়ে চলে প্রবল বেগে।

সমস্ত মানুষের মন থেকে যেন মুহুর্তেই সমস্ত ভয় মুছে গেছিলো সেদিন। চোখে মুখে এক অপ্রতিরোধ্য প্রানশক্তি নিয়ে সামনে এগিয়ে এসেছিলো শহরের সমস্ত মানুষ। এরপর ঢাকার বিভিন্ন অংশে মিছিল এবং শোভাযাত্রা বের হয়। পুলিশও তাদের কাজ করতে থাকে। পরদিন শহরের প্রত্যেক মসজিদে জুম্মার নামাজের পর শহীদের আত্মার মাগফেরাত কামনায় মুসলিম হলে বিশাল জনতার উপস্থিতিতে কোরআন তেলাওয়াতের পর এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। 

ফেব্রুয়ারীর ২১ ও ২২ তারিখে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের যেসব শহীদ পুলিশের গুলির আঘাতে বুকের রক্তে ঢাকার মাটি রাঙিয়ে দিয়েছেন তাদেরকে স্মরণীয় করে রাখার উদ্দেশ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা তাদের কলেজ প্রাঙ্গণে নিজ উদ্যোগে এক রাতের মধ্যে ১০ ফুট উঁচু ও ৬ ফুট চওড়া একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরী করে। ২৫ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পঞ্চম দিনে ঢাকা শহরে সর্বত্র পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। এদিন পুলিশ তিনবার যুবলীগ অফিসে হানা দেয়। 

এ অবস্থায় ২৫ ফেব্রুয়ারি অনির্দিষ্টকালের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং ছাত্রদের হল ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়। আন্দোলনের নেতাদের নামে প্রকাশ্যে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করা হয় এবং ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেফতার চলতে থাকে। 

ভাষা আন্দোলনের ফলাফল

এটা ঠিক যে ভাষা আন্দোলনের পরেই তাৎক্ষণিক কোন ফল পাওয়া যায়নি কিন্তু ভাষা আন্দোলনের সুদূরপ্রসারী ফল অনস্বীকার্য। এই আন্দোলনের ফলে সরকারী দল মুসলিম লীগ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ৭ মে ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগের সমর্থনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হয়।

১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয়। সংবিধানের ২১৪(১) অধ্যায়ে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে লেখা হয়: The state language of Pakistan shall be Urdu and Bengali অর্থাৎ উর্দু এবং বাংলা হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।

ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের ধ্বংসের বীজ রোপিত হয়। ১৯৬৬ এর ৬দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণআন্দোলন, ১৯৭১এর অসহযোগ আন্দোলনের সুবাদে জনগণের মনে বাঙালি জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির গভীরতার বিকাশ ঘটে। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয় এবং এই বিজয়ের মাধ্যমেই ভাষা আন্দোলনের চেতনা চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে।

ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব

ড: মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ড: এনামুল হক সহ আরো বেশ কিছু বুদ্ধিজীবীর মূখ্য ভূমিকা ছিলো বাংলা ভাষা আন্দোলনে। ইতিহাসে অমর হয়ে থাকা এই ব্যক্তিত্বগুলো পৃথিবীর ইতিহাসে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে অনুপ্রেরনা যুগিয়ে যাবে। 

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক বটে, যা তখনকার রাজনীতির ধারাকে পুরো ঘুরিয়ে দিয়েছিলো। তাই একুশ শুধুই ভাষার জন্য দাবিভিত্তিক আন্দোলন নয়। একুশ মানেই পাকিস্তান পরবর্তী যুগে প্রথম বাঙালির জাতীয় চেতনার উন্মেষন, যার পরিণতি ছিল ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। একুশ হচ্ছে ধর্মীয় অনুভূতি বা শ্রেণিচেতনার চেয়েও অনেক বেশি প্রবল ও আবেগ সৃষ্টিকারী এক অনুভূতি এবং একুশের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য এখানেই।

Shahid Minar
Shahid Minar

খুব স্বল্প সময়ের জন্য হলেও আমাদের দেশের মুসলিম জনগন পাকিস্তানী ধর্মীয় ভাবাবেগে ভেসে গিয়েছিলো। নানাবিধ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ঐতিহাসিক কারণে মুসলমান জনগোষ্ঠীর সব শ্রেণির মানুষই আশা করেছিলো যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হলে তারা লাভবান হবে। হিন্দু জমিদারদের শোষণ থেকে মুক্তি পাবে এমনটাই আশা করেছিলো কৃষক শ্রেনির মানুষ। কিন্তু সর্বোপরি এই জনগোষ্ঠী নিজেদের বাঙালি সত্তাকে পরিত্যাগ করতে রাজি ছিলো না। এখানেই একুশের মাহাত্ম্য।

একুশের চেতনা এক অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনারই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একুশের চেতনা মানে, অবৈজ্ঞানিক এবং ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে মিথ্যা প্রমাণ করে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেক্যুলারিজমকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে তুলে ধরা। এখানেই একুশ প্রতিষ্ঠিত। 

পরিশিষ্ট

আসলে পাকিস্তানী পরাশক্তির কাছে বাঙ্গালীর মাথা নোয়াবার কোনো কারন ছিলো না। দেশের মাটিতে যেখানে সোনা ফলে, সেখানে শুধু ভাষা আর নির্বিঘ্নে শ্বাস নেবার স্বাধীনতার দরকার ছিলো মাত্র, যা বাঙালী ছিনিয়ে আনতে পেরেছে। সত্যি বলতে, একুশের সংগ্রাম এখনো অব্যাহত আছে। বাঙালি জাতির চেতনা ও আবেগই তো এই জাতির শক্তি, যা আমাদের অস্থিমজ্জায়, ভাষায় ও সংস্কৃতিতে মিশে আছে। 

Related Post

মৃত্যু নিয়ে উক্তি

150+মৃত্যু নিয়ে উক্তি, বাণী, ক্যাপশন 2024

মৃত্যু নিয়ে উক্তি জন্মিলে মরিতে হবে আর এটাই সত্যি। মৃত্যু হচ্ছে সবচেয়ে চিরন্তন সত্যি। পৃথিবীতে প্রতিটি প্রাণীর মৃত্যুর স্বাদ অনুভব করতে হবে। সবসময় মৃত্যুর জন্য

Read More »
খুশির স্ট্যাটাস

200+ স্টাইলিশ খুশির স্ট্যাটাস | হাসি নিয়ে ক্যাপশন

খুশির স্ট্যাটাস | হাসি নিয়ে ক্যাপশন জীবনের সুন্দর খুশির মুহূর্ত আমরা সবাই বাঁধাই করে রাখতে চাই। আর এই খুশির মুহূর্তকে ধরে রাখার সবচেয়ে সহজ উপায়

Read More »

স্টাইলিশ ভালোবাসার ছন্দ | রোমান্টিক ছন্দ | Love Status Bangla

❤❤ভালোবাসার ছন্দ | ভালোবাসার ছন্দ রোমান্টিক | ভালোবাসার ছন্দ স্ট্যাটাস❤❤ ভালোবাসা হলো এক অন্যরকম অনুভূতির নাম, যা শুধুমাত্র কাউকে ভালবাসলেই অনুভব করা যায়। আমরা বিভিন্নভাবে

Read More »
মন খারাপের স্ট্যাটাস

মন খারাপের স্ট্যাটাস, উক্তি, ছন্দ, ক্যাপশন, কিছু কথা ও লেখা

মন খারাপের স্ট্যাটাস মন খারাপ – এই কষ্টের অনুভূতি কার না হয়? সবারই কখনো না কখনো সবারই মন খারাপ হয়। জীবনের ছোটোখাটো অঘটন থেকে শুরু

Read More »

Leave a Comment

Table of Contents