দিঘির নাম নীলসাগর! কিন্ত এ দিঘির পানির রঙ নীল নয়, আকাশের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে কখনও নীল, কখনো ধূসর, কখনো বা কালো। সাগর তো নয়ই, সাগরের উত্তাল ঢেউ নেই তবুও নাম নীলসাগর। এতে সিদ্ধ -সচ্ছ জলে পূর্ণিমার রূপালি চাঁদ এসে যখন ধরা দেয়, তখন সেই চাঁদ ছুঁতে ব্যাকুল হয়ে উঠতে যেকোন প্রেমিকের হৃদয়। সমুদ্র নয়; তবুও সমুদ্রের নামের সঙ্গে মিল রেখে এর নাম রাখা হয়েছে নীলসাগর। ওপরে আদিগন্ত নীলাকাশ, চারদিকের সবুজের সমারোহের ছায়া যখন জলে পড়ে, এক অভিনব মায়ার দৃশ্যপট জন্ম হয় তখন। দূর আকাশের পূর্ণিমার চাঁদ যখন ধরা দেয় নরোম কোমল হয়ে, মন তখন আর ঘরে থাকে না। নীলসাগরের উদার -উচ্ছল পরিবেশ যেকোনো প্রকৃতিপ্রেমীর উদাস মন নিমেষেই অজানা অপ্রত্যাশিত প্রশান্তিতে ভরিয়ে দিতে পারে।
শীতের কুয়াশাভেজা ভোরে নীলসাগর দেখার আনন্দই আলাদা। আপনি খুব সকালে মোরগ ডাকার আগে ঘুমের আড়মোড় ভেঙে নীলসাগরের পাড়ে গিয়ে দাঁড়াবেন। তখন কুয়াশার মৃদু স্পর্শ আর হিমের হালকা শীতলতা আপনাকে ঘনঘোরের মধ্যে রাখবে। গাছের ফাঁক গলে আপনার চোখের সামনে আলো ছড়িয়ে উঠবে পূবাকাশের দিনমণি। সাগরের চারপাশে ছড়ানো সবুজ বৃক্ষ আর ফুলেরা হেসে উঠবে নতুন ভোরের জয়গানে। ইচ্ছে করবে, নতুন পৃথিবীর প্রথম বৃক্ষ ও ফুলকে ছুঁয়ে দিতে। আর তখনই ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়াবে অতিথি পাখি। আপনারও মন তখন উড়ে বেড়াবে মুক্তাআকাশে। বৃক্ষের পাতায় বা দিনমণির নতুন আলোয় কিংবা কুয়াশার শাড়ির ভেতর অথবা পাখির সঙ্গে হয়ে। এই শীতে ঘুরে আসুন নীলসাগর। একলা কিংবা দলবেঁধে যেতে পারেন। নিজের মন বা বন্ধুকে বলতে পারেন, চলো বন্ধু নীলসাগর যাই।
শীত মৌসুমে মনোহরিণী নীলসাগরে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে হাজার মাইল পেরিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসে বিচিত্র সব অতিথি পাখি। রাজহাঁস, মার্গেঞ্জার, মাছরাঙা, ভুবনচিল, সবুজ চান্দি ফুটকি, বাচাল নীল ফুটকি ইত্যাদি বিচিত্র পাখি। পুরো শীতকাল জুড়েই এদের অবাধ বিচরণ নীলসাগরকে করে তোলে আরো আকর্ষণিয় ।
আরো পড়ুন…….তিনবিঘা করিডোর
নীলফামারী জেলা শহর থেকে ১৪ কি. মি. উত্তর- পশ্চিমে গোড়গ্রাম ইউনিয়নের ধোবাডাঙ্গা মৌজা প্রায় ৫৪ একর জমি নিয়ে অবস্থিত সুবিশাল এ জলাশয়টির নাম নীলসাগর। তৎকালীন উপ -মহাদেশের ধীরাজ রাজার সময়কালে খননকৃত ঐতিহাসিক নীলসাগর এখন চিত্তবিনোদন ও মাছ শিকারীদের অতি আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। এর দুপাড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে নারিকেল, বনবাবুল, আকাশমণি, মেহগনি, শিশুসহ অজানা অচেনা অনেক রকম ফুল ও ফলের সারি সারি বৃক্ষরাজি।
নীলসাগরের আয়তন ৯৩.৯০ একর। তবে নীলসাগরের গভীরতা আজও নির্ধারণ করা যায়নি। ধারণা করা হয়, বছর জুড়ে ৮০ ফুট থেকে ৮৫ ফুট পানি থাকে এখানে। সাগরপাড়ে আছে বৃক্ষরাজি তরুলতা, সুউচ্চ পাড় বেষ্টিত বেত বন ও গুল্মলতা। শীতের দিনে অতিথি পাখির ডাকে মুখর হয়ে ওঠে এ এলাকা।
জনশ্রুতি আছে, ২০০ বছর আগে বিরাট রাজার গরুকে পানি দিতে দীঘিটি খনন করা হয়েছিল। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৮ ম শতাব্দীর কোনো এক সময়ে এ জলাশয়টির খননকাজ শুরু হয়েছিল। হিন্দু সম্প্রদায়ের মহাভারতে বর্ণিত বিরাট রাজা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে নিহত হলে তাকে এর পাড়ে সমাহিত করা হয়। আবার অনেকের ধারণা, ওই রাজার একমাত্র মেয়ে বিন্নাবতীর স্নানের জন্য দীঘিটি খনন করা হয়। তার নামানুসারে এর নামকরণ হয় ‘বিন্না দীঘি’। নীল সাগর ‘বিরাট দিঘি ’ও ‘বিন্না দিঘি’ নামেও পরিচিত। চমৎকার এই দিঘিটির অবস্থান উত্তরবঙ্গের সমৃদ্ধ জেলা নীলফামারীতে। শহরের চৌরঙ্গী মোড় থেকে প্রায় ১৪ কি. মি. দূরে গোড়গ্রাম ইউনিয়নের ডোবাডাঙ্গা এলাকায়।
হিন্দুশাস্ত্রমতে, খ্রিস্টপূর্ব ৯ ম হতে ৮ ম শতাব্দীতে পান্ডবরা কৌরবদের চক্রান্তের শিকার হয়ে ১২ বছরের বনবাস ও এক বছরের অজ্ঞাতবাসে যেতে বাধ্য হন এবং মৎস্য দেশের রাজা বিরাটের রাজধানীর এ স্থানটিতে ছদ্মবেশে বসবাস শুরু করেন। মনে করা হয়, সেসময় নির্বাসিত পান্ডবদের তৃষ্ণা মেটাতে বৈদিক রাজা বিরাট এ দিঘিটি খনন করেছিলেন। বিরাট দিঘির অপভ্রংশ হিসেবে কালক্রমে এ দিঘিটি বিরাট দিঘি, বিল্টা দিঘি এবং অবশেষে বিন্না দিঘি নামে পরিচিতি পায়।
কারো কারো মতে রাজা বিরাট তার বিশাল গরুর পালের জন্য পানির সংস্থান করতেই এ দিঘি খনন করেন এবং তার কন্যা বিন্নাবতীর নামে এর নামকরণ করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে নীলফামারীর তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক ও অবসরপ্রাপ্ত সচিব এম.এ জব্বার কর্তৃক এই দিঘিকে পর্যটনক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত করতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। তাই নীলফামারীর নামানুসারে বিন্না দিঘির পরিবর্তে এর নামকরণ করা হয় নীলসাগর।
মূলত নীলসাগর নামকরণের ক্ষেত্রে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীর কোন এক সময়ে এ জলাশয়টির খননকাজ শুরু হয়েছিল। নীল সাগর ‘বিরাট দিঘি’ ও ‘বিন্না দিঘি’ নামেও পরিচিত। বিরাট দিঘির কালক্রমে এ দিঘিটি বিরাট দিঘি, বিল্টা দিঘি এবং অবশেষে বিন্না দিঘি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। কারো কারো মতে, রাজা বিরাট তার বিশাল গরুর পালের জন্য পানির সংস্থান করতেই এ দিঘি খনন করেন এবং তার কন্যা বিন্নাবতীর নামে এর নামকরণ করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে নীলফামারীর তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক ও অবসর প্রাপ্ত সচিব এম.এ জব্বার কর্তৃক এই দিঘিকে পর্যটনক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত করতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় ও নীলফামারীর নামানুসারে বিন্না দিঘির নাম থেকে নীলসাগর নামকরণ করা হয় ।
নীলসাগরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ এর উদার উদাস পরিবেশ। এর পাড়ে রয়েছে নারকেল, বনবাবুল, আকাশমণি, মেহগনিসহ অজানা-অচেনা হরেকরকম ফুল ও ফলের সারি সারি বৃক্ষরাজি। নীলসাগরের পাশে অতিরিক্ত আকর্ষণ হিসেবে দিঘির পূর্ব পাড়ে রয়েছে একটি মন্দির। পশ্চিম পাশে এক দরবেশের আস্তানা। প্রতিদিন এখানে দেহতত্ত্ব গানের আসর জমে ওঠে। এখানে প্রতি বছর চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে সনাতন (হিন্দু) সম্প্রদায় বারুণী স্নান উৎসবের আয়োজন করে থাকে। দীঘিতে ফোটে শাপলা। শাপলার পাতায় পাখির অস্তিত্ব অসাধারণ ও প্রাকৃতিক দৃশ্যে যোগ করে ভিন্নমাত্রা। প্রকৃতির অপূর্ব দৃশ্য দেখতে শীতকালে এখানে ছুটে আসেন নানা বয়সের মানুষ। কল্পকাহিনী ঘেরা নীলসাগরে প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তিতে বসে ‘বারুনী স্নান’ মেলা। মেলায় থাকে মানুষের উপচেপড়া ভিড়। এখানে এসে পাওয়া যায় প্রকৃতির নিবিড় ছোঁয়া, শত ব্যস্ততার যান্ত্রিকতা এড়াতে ও কান্তি দূর করতে মানুষ ছুটে আসেন এখানে।
দিঘিটি দেখাভাল করে জেলা প্রশাসন। দিঘির পাশেই সরকারের অনুদানে একটি রেস্টহাউজ স্থাপন করা হয়েছিল। বর্তামান জেলা প্রশাসক বেগম নাজিয়া শিরিন দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে পর্যটনখাতে বিশেষ গুরত্ব দিয়ে নীলসাগরের রেস্ট হাউজটির ২ য় তলা নির্মাণ ও আধুনিকায়ন, শিশু পার্ক নির্মাণ করেন।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে জন্যই মূলত নীলসাগর বিখ্যাত। এছাড়াও পাশেই রয়েছে একটি ছোট পার্ক। ১৯৯৮ সালে এ এলাকাকে পাখির অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৯ সালে তৎকালীন ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী আলহাজ রাশেদ মোশারফ এ অভয়ারণ্যের উদ্বোধন করেন। এখানে প্রতি বছর চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে সনাতন (হিন্দু) সম্প্রদায় বারুণী স্নান উৎসবের আয়োজন করে থাকে। দীঘির পাশেই সরকারের অনুদানে একটি রেস্টহাউস স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে টিকিট নিয়ে সুন্দর নিরীবিলি পরিবেশে পর্য়টকগণ থাকতে পারেন। নীলসাগর দীঘির ম্যানেজার নির্মল চক্রবর্তী বলেন, প্রতিদিন এখানে শত শত লোক ভ্রমণে আসেন। আমরা এতো বড় দীঘিতে ৫ জন ব্যক্তি দেখাশুনা করে থাকি। নীলসাগর দীঘির চারিদিকে সীমানা প্রাচীরের উচ্চতা কম হওয়ায় দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা কিছুটা সমস্যা হচ্ছে বলে তিনি জানান।
তিনি আরো জানান, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রতাত্ত্বিক জাদুঘরের নির্ধারিত স্থান তৈরি করা হয়েছে। সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য এ অর্থবছরে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড কর্তৃক ৬৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এই টাকা দিয়ে সৌন্দর্য্য বাড়ানো চেষ্টা চলছে। নীলসাগর দীঘির সভাপতি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ খালেদ রহীম। এলজিইডি নির্বাহী প্রকৌশলী বেলাল হোসেন বলেন, নীলসাগড় দীঘির সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য আমরা সকলে চেষ্টা চালাচ্ছি।আমাদের চেষ্টায় ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে নীলসাগরের সৌন্দর্য্য আরো বাড়বে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো: মুজিবুর রহমান বলেন, আমরা এ বছর ৭০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ পেয়েছি যা দিয়ে সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কাজ করা হচ্ছে।
আগামীতে এলজিইডি প্রকল্পে ১০ /১৫ কোটি টাকার কাজ করা হবে, আমাদের পরিকল্পনায় আছে। আর দীঘির পূর্বদিকে ৪ একর জমির উপড় প্রতাত্বিক যাদুঘর নির্মাণ করা হবে। আমি নিজেই অনেক চেষ্টা করছি নীলসাগর দীঘিকে আরো ভালো করার। এটি যাতে দেশ সেরা পর্যটন কেন্দ্র হয় সে জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছি।
নীলসাগর যেতে বাসে, ট্রেনে কিংবা চাইলে প্লেনেও যেতে পারেন। আছে নীলসাগর দীঘির নামেই নামকরণকৃত ঢাকা -নীলফামারী আন্তঃনগর ট্রেন সার্ভিস ‘নীলসাগর এক্সপ্রেস’। এটি সোমবার ছাড়া প্রতিদিনই ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট রেলস্টেশন থেকে সকাল সাড়ে ৮ টায় নীলফামারীর উদ্দেশে ছেড়ে আসে। ভাড়া শোভন চেয়ার মাত্র ২২০ টাকা। বাসে যেতে চাইলে ঢাকা থেকে নাবিল পরিবহন, হানিফ পরিবহন, শ্যামলী পরিবহন, বাবলু, নাদের পরিবহনসহ বিভিন্ন বাস সার্ভিস আছে নীলফামারী পর্যন্ত। বাস ভাড়া জনপ্রতি ৫২০ টাকা। নীলফামারী শহর থেকে বাস, অটোবাইক, রিকশা, ভ্যান কিংবা যে কোন পরিবহনেই আঁকাবাঁকা পথ ধরে পৌঁছে যেতে পারবেন নীলসাগরে। এছাড়া আকাশপথে সৈয়দপুর বিমানবন্দর থেকে আসা যায়।
নীলের দেশ নীলফামারী জেলা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ভূ -সংস্থান বেশ সমৃদ্ধ। অতীত ইতিহাস সমৃদ্ধ নীলফামারী জেলার দর্শনীয় ও ঐতিহাসিক ভ্রমণ স্থান গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো; চীনা মসজিদ, তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প, ধর্মপালের গড়, ময়নামতির দূর্গ, ভীমের মায়ের চুলা, , সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা, সৈয়দপুর চার্চ, দারোয়ানী টেক্সটাইল মিল, উত্তরা ইপিজেড, সৈয়দপুর বিমানবন্দর, ডিমলা রাজবাড়ী, কুন্দুপুকুর মাজার, হরিশচন্দ্রের পাঠ ইত্যাদি।