পেপার পত্রিকা , সংবাদ মাধ্যম, গণমাধ্যম, সভা -সমাবেশের বক্তৃতা -বিবৃতিতে সেই কবে থেকে পড়ে আসছি, শুনে আসছি “তিনবিঘা করিডোর”। প্রায় একই সুরে সবাই এর বন্দনা করছে। কিন্তু এর কিছু না বলা রহস্য অনেকেই হয়ত পেশাদারিত্বের কারণে বলতে চান না বা বলতে পারেন না। সেই পিছনে থাকা অনেক রহস্যের কিছু না বলা কথা এখানে তুলে ধরছি। তিন বিঘা করিডোর হলো ভারতের মালিকানাধীন তিন বিঘা জমির মধ্যে অবস্থিত একটি স্বতন্ত্র ভূমি। এই তিন বিঘা করিডর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোচবিহার (Cooch Behar) জেলার মেখলিগঞ্জ মহকুমা ও বাংলাদেশের লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার সীমান্তে অবস্থিত।
মূলত, তিন বিঘা করিডোর হলো ভারতের ভূমিতে তিন বিঘা আয়তনের জমিতে নির্মিত এমন একটি সরু পথ যা ভারতের অভ্যন্তরে অবস্থিত ‘দহগ্রাম -আঙ্গরপোতা’ নামে পরিচিত বাংলাদেশের একটি অংশে বা ছিটমহলে বাংলাদেশের মূল ভূমি থেকে বাধাহীন যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই তিন বিঘা করিডোরটিতে রয়েছে কাঁটাতারের বেড়া।
১৬ ই মে ১৯৭৪ সালে ‘ইন্দিরা গান্ধী শেখ মুজিবুর রহমান চুক্তি’ অনুসারে ভারত ও বাংলাদেশ তিন বিঘা করিডোর সার্বভৌমত্ব পরস্পরের কাছে হস্তান্তর করে। এর ফলে উভয়দেশেই তাদের ছিটমহলে যথাক্রমে দহগ্রাম -আঙ্গরপোতা ও দক্ষিণ বেরুবাড়ীর যাতায়াত সুবিধা হয়।
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ চুক্তি পত্র অনুসারে সাথে সাথেই দক্ষিণ বেরুবাড়ী ভারতের কাছে হস্তান্তর করে কিন্তু ওই সময় ভারত তিনবিঘা করিডোর বাংলাদেশের কাছে রাজনৈতিক কারণে হস্তান্তর করেনি।
পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের অনেক বিরোধিতার পর ২০১১ সালে ভারত পূর্ণভাবে তিন বিঘা করিডোর ব্যবহার করার সুযোগ দেয়। তবে এটি স্থায়ীভাবে ব্যবহারের কোনো সুযোগ নয় বরং বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকার করতে হয়েছে যে, বাংলাদেশ এটি ইজারা হিসাবে নিয়েছে এবং সময়ে দক্ষিণ বেরুবাড়ি ভারতের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে। তিনবিঘা করিডোর হস্তান্তর করা বা ইজারা প্রদান করার জন্য ভারতের সংবিধান পরিবর্তন করতে হয়েছিল।
বেরুবাড়ী ১২ নং দক্ষিণ ইউনিয়নের মোট আয়তন ৮.৭২ বর্গমাইল বা ২২.৫৮ বর্গ কি. মি., যার ১১.২৯ বর্গ কি. মি. (৪.৩৬ বর্গমাইল) বাংলাদেশ পেয়েছিল। এছাড়াও পূর্বের ভাগ অনুসারে কোচ বিহারের ৪ টি ছিটমহল বাংলাদেশে পড়েছিল যার আয়তন ৬.৮৪ বর্গ কি. মি. (২.৬৪ বর্গমাইল), এভাবে মোট আয়তন ১৮.১৩ বর্গ কি. মি. যা বাংলাদেশে স্থানান্তর হওয়ার কথা ছিল।
আরো পড়ুন…..দেবী চৌধুরানীর রাজবাড়ি
১৯৬৭ সালের হিসেব অনুযায়ী এই ভূখণ্ড গুলোর মোট জনসংখ্যার ৯০% ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের ছিটমহল দহগ্রাম -আঙ্গরপোতা ভারতে হস্তান্তরের কথা ছিল। যার মোট আয়তন ১৮.৬৮ বর্গ কি. মি. (৭.২১ বর্গমাইল) ও ১৯৬৭ সালের হিসেব অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার ৮০% ছিল মুসলমান। যদি এই হস্তান্তর সফল হতো তাহলে এটি জাতিগত দাঙ্গা সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকত। ফলে তখন বেরুবাড়ীর জনগণ এই হস্তান্তরের বিরোধিতা করেছিল।
১৯৭১ সালের পর ভারত বাংলাদেশকে প্রস্তাব দেয়— বেরুবাড়ীর অর্ধাংশ ভারতের অধীন থাকবে এবং দহগ্রাম -আঙ্গরপোতা বাংলাদেশেই থাকবে। এই চুক্তি অনুসারে ভারত দহগ্রাম -আঙ্গরপোতাবাসীর বাংলাদেশের মূল ভূখন্ডের সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য একটি তিনবিঘা আয়তনের জায়গা ইজারা হিসেবে দেওয়া হয়। তখন এটি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত হয়েছিল এবং তিন বিঘার চারপাশে সতর্কতার সাথে বেষ্টনী দেওয়া হয়েছিল।
১৯৭৪ সালের মে মাসের ১৬ তারিখ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়; সে চুক্তিতে বেরুবাড়ী বিরোধের অবসান ঘটে ১.১৪ ধারা অনুসারে । সেই চুক্তি অনুসারে আঙ্গরপোতা বাসীদের বাংলাদেশের মূল ভূখন্ডের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য ১৭৮ বাই ৮৫ মিটার (৫৮৪ ফুট × ২৭৯ ফুট) আয়তনের একটি ভূমি বাংলাদেশকে ইজারা হিসেবে দেবে” ।
বাংলা আয়তন পরিমাপের একটি একক হলো ‘বিঘা’ এবং এই ভূমিটির মোট আয়তন ১,৫০০ বর্গ মি. থেকে ৬,৭৭১ বর্গ মি. (১৬,১৫০ থেকে ৭২,৮৮০ বর্গফুট) যা ৩ বিঘা পরিমাপের সমান; এ থেকে ‘তিনবিঘা’ নামের উৎপত্তি।
পূর্বে করিডোরটি দিনের ১২ ঘণ্টা সময়ের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হত, এতে দহগ্রাম অধিবাসীদের কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো কারণ সে সময় সেখানে কোনো হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। ২০১১ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর ঢাকায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মনমোহন সিং এর মধ্যকার ১ টি চুক্তি অনুযায়ী বর্তমানে করিডোরটি ২৪ ঘণ্টাই উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। ২০১১ সালের ১৯ শে অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে তিনবিঘা করিডোরটিকে উন্মুক্ত ঘোষণা করেন।
দহগ্রাম ইউনিয়নকে অনেকেই বলে থাকেন, ‘ভারতের বুকে একটুকরো বাংলাদেশ’। দহগ্রাম হলো ২০১৫ সালে ছিটমহল বিনিময়ের পরে ভারতের মধ্যে থেকে যাওয়া বাংলাদেশের একমাত্র ছিটমহল।
বাংলাদেশের মূল ভূ -খন্ড( পাটগ্রাম)থেকে তিনবিঘা করিডোরে ঢুকতে হাতের বাম পাশে যে মাইল ফলক সেখানে লেখা দহগ্রাম ৬ কি.মি।তিন বিঘা বাংলাদেশের মূল ভূ -খন্ড থেকে তিনবিঘা করিডোরে ঢুকতে লেখা দহগ্রাম ৬ কি. মি. করিডোরের দৈর্ঘ্য ১৭৮ মিটার। এই ১৭৮ মিটার দৈর্ঘ্যের করিডোর পার হয়ে দহগ্রামে ঢুকতে রোডের ডানপাশে আরেকটা মাইল ফলক। সেখানে লেখা দহগ্রাম ০১ কি. মি। মাত্র ১৭৮ মিটার দৈর্ঘ্যের করিডোর পার হয়ে ৫ কি. মি. উধাও! করিডোর পেরিয়ে দহগ্রামে ঢুকতে লেখা দেখা যায় দহগ্রাম ১ কি.মি.।
বাংলাদেশের মূল ভূ -খন্ড থেকে তিনবিঘা করিডোরে ঢুকতে গেটে ভারতের পতাকার রঙে রং। আবার দহগ্রাম থেকে তিনবিঘা করিডোরে ঢুকতেও ঐ গেটে ভারতের পতাকার রঙে রং। যেন মনে থাকে আপনি ভারতের ভূ -খন্ডে প্রবেশ করছেন। অথচ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের (লীজ) মাধ্যমে বাংলাদেশ তিন বিঘা করিডোর সহ আগমণ নির্গমন উভয় গেটের মালিক। তিনবিঘা করিডোরের উভয় গেটে ভারতের পতাকার রঙে রং।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের (লীজ) মাধ্যমে বাংলাদেশ পুরো তিন বিঘা করিডোরের মালিক। কিন্তু এর রক্ষনাবেক্ষণ,শাসন, ভক্ষণ,পর্যবেক্ষণের পুরো দায়িত্ব ভারতের। বাংলাদেশ যে রোডটি দিয়ে করিডোর অতিক্রমের অনুমতি পেয়েছে সেই রোডে রাতের বেলার লাইটের সুইচ টেপার অধিকার বাংলাদেশের নেই ।
বাংলাদেশ ও ভারতের মূল ভূ -খন্ডে বিদ্যুৎ আসা যাওয়া করলেও ভারত যে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে বাংলাদেশকে ঘিরে রেখেছে তার উপর স্থাপিত লাইট পোস্টে সন্ধ্যার আগে থেকে সকাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ নিরবিচ্ছিন্ন থাকে । দহগ্রাম থেকে তিনবিঘা করিডোরে ঢুকে হাতের ডানপার্শ্বে বি এস এফের যে চেকপোস্ট রয়েছে তার সাথেই রয়েছে একটি জেনারেটর রুম। কেবল করিডোর এলাকায় ২৪ ঘন্টা নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ব্যবস্থার জন্যই ভারত আলাদাভাবে এ জেনারেটর বসিয়েছে।
করিডোরের গেটে ভারতের পতাকার রঙে রঙ। করিডোরের চারকোনায়ও পতপত করে উড়ছে ভারতীয় পতাকা। করিডোরের চার কোণায় ভারতীয় পতাকা পতপত করে উড়ছে।
তিনবিঘা করিডোরের একটি সতর্কবাণী, তিনবিঘা করিডোরের ভেতর দিয়ে কেবল পিচ ঢালা রাস্তা ধরেই বাংলাদেশীদের চলার অধিকার রয়েছে। ঘূণাক্ষরেও এর নীচে নামা যাবে না। আগন্তুকদের এ কথা বিজিবি দু’ পাশ থেকেই স্বরণ করে দেয়। আর যারা নিত্য যাতায়াত করে দেখলাম তারা সতর্কবাণীটি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। দর্শণার্থীদেরকে বিজিবির মতন তারাও কথাটি স্বরণ করিয়ে দিচ্ছে। দর্শনার্থীদের এই রাস্তার ডানে বামে নামা নিষেধ।
২০১১ সাল থেকে দহগ্রাম আঙ্গরপোতার মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনা গেছে। তবে ভারতের বাঁধায় বিদ্যুৎ লাইনটি নিতে হয়েছে মাটির নীচ দিয়ে। অথচ ভারতীয় লাইনগুলি করিডোর পার হয়েছে মাথার উপর দিয়ে। করিডোরে মাথার উপরে ভারতীয় খুঁটি ও তার।
বাংলাদেশের উভয় পার্শ্বে( পাটগ্রাম ও দহগ্রাম) তিন বিঘা করিডোরে ঢুকতে গেটের ব্যবস্থা রয়েছে যা ইচ্ছা করলেই ভারত যখন তখন বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু ভারতের দু’ পাশ থেকে করিডোরে ঢুকতে কোন গেট নেই। দুই পাশই উম্মুক্ত। বাংলাদেশের দুই দিকে লোহার গেট থাকলেও ভারতের দুই দিকে কোন গেট দেওয়া নেই।
করিডোরের ভেতর দিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের রাস্তার প্রশস্থতা মাত্র ৮ ফুট। একটি বড় গাড়ী পার হতে চাইলে রাস্তায় মানুষ দাঁড়ানোর জায়গা থাকে না। বিপরীতে করিডোরের ভেতর দিয়ে যাওয়া ভারতের রাস্তা মহাসড়কের ন্যায় প্রশস্থ। বাংলাদেশের ৮ ফিটের রাস্তা দিয়ে একটা বড় গাড়ী পার হতে পথচারীদের রাস্তা থেকে নেমে দাঁড়াতে হয় করিডোরের ভেতর দিয়ে ভারতের মহাসড়কের মত রাস্তা
বাংলাদেশের মূল ভূ -খন্ড থেকে করিডোরে ঢুকে সামান্য কিছুদূর এগলেই ভারতের মূল ভূ -খন্ড থেকে অপেক্ষাকৃত প্রশস্থ আরেকটা পিচ ঢালা রাস্তা করিডোরে ঢুকে বাংলাদেশের রাস্তাটি ক্রস করে কুচলিবাড়ী চলে গেছে। ভারতের মূল ভূ-খন্ডের সাথে কুচলিবাড়ীর লোকজনের স্থল যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম এই রোডটি। অর্থাৎ ভারতের মূল ভূ -খন্ডের সাথে কুচলিবাড়ীর লোকজনের স্থল যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যমও তিন বিঘা করিডোর। তিন বিঘা করিডোরের চার মাথা কারণ তিস্তা নদী ভারতের চর খড়খড়িয়াতে বাঁধা পেয়ে এর বড় মুখটা চর খড়খড়িয়ার ডান পাশ দিয়ে বাংলাদেশের দহগ্রামে ঢুকে পড়েছে। আর ছোট মুখটা চর খড়খড়িয়ার বাম পাশ দিয়ে সরাসরি বাংলাদেশের মূল ভূ -খন্ডে ঢুকেছে। ওদিকে তিস্তার বড় মুখটা দহগ্রাম থেকে বের হয়ে আবার চর খড়খড়িয়ার ডান পাশ দিয়ে ভারতীয় ভূমির উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সরাসরি বাংলাদেশের মূল ভূ -খন্ডে স্থায়ীভাবে ঢুকে পড়েছে। তিন বিঘা করিডোর ছাড়া কুচলিবাড়ীর লোকজনকে হলদিবাড়ী বা ভারতের মূল ভূ -খন্ডে যেতে হলে জলপথ( দুই বার তিস্তা পার হতে হবে) ছাড়া কোন পথ নেই। সেখানে কুচলিবাড়ীর লোকজনকে একবার তিস্তা নদী পার হয়ে চর খড়খড়িয়াতে যেতে হবে। আবার চর খড়খড়িয়া থেকে মূল তিস্তা পার হয়ে হলদিবাড়ী বা ভারতের মূল ভূ -খন্ডে প্রবেশ করতে হবে। কুচলিবাড়ী থেকে বেরুতে ২ টা রাস্তা।
গোটা বাংলাদেশের মূল ভূমিটা অনেক যত্ন ও পয়সা কড়ি খরচ করে ভারত কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে দিয়েছে। কিন্তু দহগ্রাম -আঙ্গরপোতায় ভারত কাঁটাতারের অভাববোধটা এখনও অনুভব করেনি। যে কেউ ইচ্ছা করলেই দহগ্রাম -আঙ্গরপোতা দিয়ে ভারতে যেতে আসতে পারে। করিডোরের সাথেই সীমান্ত পিলার কাঁটাতারের বেড়া এর পর থেকে আর এগোয়নি।
তিন বিঘা করিডোর এবং দহগ্রাম ইউনিয়নে লালমনিরহাট জেলা হতে সড়ক ও রেল -পথে এবং পাটগ্রাম উপজেলা হতে সড়ক পথে যাতায়াত করা যায়। সম্পূর্ণ পথ পাকা রাস্তা। লালমনিরহাট বাস স্ট্যান্ড হতে সড়ক পথে দূরত্ব প্রায় ৮৮ কি. মি. এবং পিচঢালা পথে পাটগ্রাম উপজেলা সদর হতে তিন বিঘা করিডোরের সড়ক পথে দূরত্ব প্রায় ১০ কি. মি.। ঢাকা (জিরো পয়েন্ট) থেকে তিন বিঘা করিডোরের দূরত্ব সড়ক পথে ৪০৫ কি. মি.।