বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটি হচ্ছে পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এটি বাংলাদেশের পটুয়াখালী জেলার অন্তর্গত কলাপাড়া উপজেলার পায়রায় নির্মিত। পায়রায় নির্মিত হওয়ায় এটির নাম রাখা হয় পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এই কেন্দ্রটি স্থাপনের উদ্দেশ্যে ২০১৪ সালে চীনের চায়না মেশিনারিজ কোম্পানি এবং বাংলাদেশের নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড এর মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৬ সালে পরিবেশগত ছাড়পত্র পাবার পর ২০১৭ সালে যৌথ পরিচালনায় এই পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পটি নির্মানের কাজ শুরু হয়।
পায়রায় আন্ধারমানিক নদীর তীরের ধানখালী গ্রামে প্রায় ১ হাজার একর জমির উপর নির্মান করা হয়েছে এই তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। এরপর ২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি এই কেন্দ্রে প্রথম ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করা হয়য়। ২০২২ সালের ২১ ই মার্চ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করার মাধ্যমে বাংলাদেশের একটি নতুন অধ্যায় শুরু করেন।
পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বর্তমান অবস্থা
পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু হবার পর প্রতি মাসে কেন্দ্রটির জন্য পর্যাপ্ত কয়লা পরিবহনে মিনিমাম ৮-১০ টি কয়লা বোঝাই বড় জাহাজ পায়রা বন্দরের মাধ্যমে কয়লা সরবরাহ করতো। হঠাত ডলার সংকটের কারণে কয়লার দাম পরিশোধ করতে না পারায় কয়লা সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে। ফলে ২০২৩ সালের ২৫ মে থেকে এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ২টি ইউনিটের মধ্যে ৬৬০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ইউনিট বন্ধ হয়ে যায়। এর ১০ দিন পর অর্থাৎ ৫ ই জুন একই কারনে এই কেন্দ্রটির অপর ইউনিটও বন্ধ হয়ে যায়। এধরনের সমস্যার মুখে পড়ায় এ বছর পায়রা বন্দরের রাজস্ব আয়ও কিছুটা কমে গেছে বলে জানান কর্তৃপক্ষ।
ডলার সংকটের কারনে সরকার গত ৬ মাস ধরে বিল শোধ করতে না পারায় প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার বকেয়া রয়ে গেছে জানায় কর্তৃপক্ষ। এরপর বকেয়ার ১০০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধের পর পুনরায় কয়লা পাঠাতে শুরু করে কেন্দ্রটির কয়লা আমদানীকারক প্রতিষ্ঠান সিএমসি। কয়লা বাংলাদেশে পৌছানোর পর কেন্দ্রটি আবার সচল হলে বিদ্যুৎ নিয়ে আর কোনো সমস্যা থাকবে না বলে আশাবাদী কেন্দ্রটির পরিচালনা কেন্দ্র।
পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা
জানা গেছে, কয়লাভিত্তিক পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জন্য প্রতিদিন গড়ে ১২ হাজার টন কয়লার দরকার হয়। এই কয়লার পুরোটাই আমদানী করা হয় ইন্দোনেশিয়া থেকে। ইন্দোনেশিয়া থেকে এই কয়লা আমদানী করে সিএমসি নামক প্রতিষ্ঠান।
প্রতিদিন ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে এই তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির যা বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এক নতুন সংযোজন। বর্তমানে প্রতিদিন এই কেন্দ্রে ৭০০ থেকে ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে যা বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে যথেষ্ঠ। সম্প্রতি সময়ে, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে গোপালগঞ্জ, এবং আমিনবাজার-মাওয়া- মোংলা পর্যন্ত সঞ্চালন লাইন তৈরি করা হয়েছে।
প্রায় ২৫০ কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মিত এই কেন্দ্রটি নির্মাণের বেশিরভাগ অর্থায়ন ছিলো চীনের।
বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চলের বিদ্যুৎ সংকট দূর করবে পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র
বাংলাদেশ সরকারের মতে, দেশের বিদ্যুতের বিপুল চাহিদার এক দশমাংশ পূরণ হতে পারে পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি থেকে। আশা করা যাচ্ছে, এই কেন্দ্রটি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে দক্ষিণাঞ্চল বিদ্যুতের সমস্যা অনেকটাই কাটিয়ে উঠবে। দক্ষিণাঞ্চলে শিল্প-কারখানা ও উন্নয়ন যেভাবে ত্বরানিত হচ্ছে, বিশেষ করে পদ্মা সেতু হওয়ার পর, তাই সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এই কেন্দ্রটি, এমনটাই মনে করছে বাংলাদেশ সরকার।
বাংলাদেশ পাওয়ার সেলের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে মোট বিদ্যুৎ গ্রাহকের সংখ্যা ৪ কোটি ২১ লাখ। অন্যদিকে, বর্তমানে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার ৫১৪ মেগাওয়াট।
অভিযোগ উঠেছে, পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ থাকা স্বত্ত্বেও অনেক গ্রাহক বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। আসলে কেন্দ্রটির বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা থাকলেও সঞ্চালন এবং সরবরাহ লাইনের অভাব থাকায় বিদ্যুৎ গ্রাহকদের কাছে ঠিকমতো সরবরাহ করা যায় না। বিশেষ করে দক্ষিনাঞ্চলের গ্রামের বাসিন্দারা এ ব্যাপারে খুব ভুগছেন।
কয়লা কি পরিবেশবান্ধব?
পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হওয়ায় এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানী হিসেবে প্রতিদিন ১২ হাজার টনের বেশি কয়লা পোড়ানো হয়, যা পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ যখন শুরু হয়, তখন থেকে এই এলাকার পরিবেশের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে আলোচনা ওঠে। তবে বাংলাদেশ সরকার সর্বশেষ জলবায়ু সম্মেলনে কয়লার এই অতিরিক্ত ব্যবহার থেকে বেরিয়ে আসার কথা দিয়েছে।
২০১৬ সালের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সরকার। এতে ৩৫ শতাংশ আমদানি ও নিজস্ব গ্যাসে, ৩৫ শতাংশ আমদানি নির্ভর কয়লায়, এবং বাকি ৩০ ভাগ তেল, বিদ্যুৎ আমদানি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
পায়রা পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের আশেপাশের পরিবেশের ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে স্থানীয় মানুষেরা।
ধানখালী গ্রামের বাসিন্দা স্কুল শিক্ষক মুস্তাফা তুহিন এক প্রতিবেদনে বলেছিলেন, এখানকার এলাকায় গাছপালায় কালো ছোপ ছোপ পড়ে গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে এটাকে ছত্রাক বা ফাঙ্গাস নামে চালিয়ে দিলেও তাতে ওখানকার মানুষ সন্তুষ্ট নয়। তাদের মতে, নারকেল ও অন্যান্য গাছে আগে তো ছত্রাক বা ফাঙ্গাস ছিলো না, হঠাৎ ২/৩ বছরে ছত্রাক আসলো কোথা থেকে? এটা দূরীকরনে উপায়ই বা কি? এছাড়াও এই এলাকায় গাছপালার ফলন অনেক কমে গেছে বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা।
পরিবেশের ক্ষতির ঝুঁকি কমাতে পায়রা তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রে আলট্রা সুপার ক্রিটিকাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে সরকার। তবে এতেও কিন্তু ঝুকির মাত্রা কমছে না বলে জানিয়েছেন পরিবেশ বিদ রা।
বিশ্বব্যাংকের নির্ধারিত মানদণ্ড মেনেই বিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে এখানে এবং কার্বন ও সালফার নিঃসরণের মাত্রা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করছে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান- এমনটাই দাবী বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ.এম খোরশেদুল আলমের।
পরিবেশ বিদদের মতে, সরকারের এই উদ্যোগের ফলে ক্ষতির পরিমাণ কমবে, কিন্তু নির্মূল হবে না। অন্যদিকে, ফ্লাই-অ্যাশের পরিমাণ কমলেও যে পরিমাণ নিঃসরণ হচ্ছে আর হবে সেটির ব্যবস্থাপনা কঠিন।- বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের বৈদেশিক দেনা বিষয়ক কর্মজোটের সদস্য-সচিব হাসান মেহেদী।
তিনি আরো বলেছেন, ” ধরুন আগে হয়তো ১০০ গ্রাম ছাই হতো এখন ৭০ গ্রাম হবে। শুধু তাই নয়, এখনো বছরে প্রায় ২০ লাখ টন ছাই হবে, সেই ছাইয়ের ব্যবস্থাপনা খুব কঠিন কাজ হয়ে যাবে। এ ছাড়াও বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা ঠাণ্ডা করার জন্য যে পানি ব্যবহার হবে সেটি ডিসচার্জ করা হবে রামনাবাদ চ্যানেল এবং পাশের নদীতে। ইলিশের একটি অভয়ারণ্য এই নদীগুলো তাই মারাত্মক ঝুকিতে। স্থানীয়রা বলেছেন, এই ক বছরে ইলিশের ফলন আগের থেকে অর্ধেকে নেমে এসেছে।
আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি
কয়লাভিত্তিক প্রকল্প বা প্ল্যান্টের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার জন্য যে বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, তাকে আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি বলা হয়। পরিবেশ রক্ষায় এ প্রযুক্তি বিশেষ ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশ এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহারকারীর দেশের তালিকায় ১৩ তম স্থান পেয়েছে।
এই প্রযুক্তিতে ঢাকনা যুক্ত কোল ইয়ার্ড ব্যবহার করার ফলে বাতাসের মাধ্যমে খোলা কয়লার গুঁড়ো পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ কমে পাবে। এর ফলে পরিবেশ দূষণের সম্ভাবনাও অনেকাংশে কমে যাবে।
বাংলাদেশ ছাড়াও এশিয়াযর বিভিন্ন দেশ যেমন ভারত, চীন, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া ও জাপানে আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির মাধ্যমে পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালনা করা সত্যি প্রশংসনীয়। পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র এই দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে অগ্রনী ভূমিকা পালন করে দেশের বিদ্যুতের ঘাটতি মেটাবে বলে খুব আশাবাদী দেশের সরকার এবং সাধারন জনগন।