Dreamy Media BD

প্রেম ও ধ্যানে সন্ধান মিলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের

প্রেম ও ধ্যানে সন্ধান মিলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের

বাংলা সাহিত্য জগতে সকল কবিদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে যদি কেউ থাকেন তাহলে সেটা অবশ্যই সর্বকালের সেরা আমাদের সকলের প্রিয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত প্রথম বাঙালি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জীবন দশায় দুই হাজারেরও বেশি গান রচনা করে গিয়েছেন। তার লেখা অসাধারণ সব গান এবং কবিতা আজও প্রত্যেকটি বাঙালির মনে জায়গা নিয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত “গীতাঞ্জলি” এবং “জীবনস্মৃতি”সারা জীবন বাঙালির মনে স্থায়ী হয়ে থাকবে।

 তিনি একাধারে ছিলেন কবি, উপন্যাসিক, সংগীত স্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকার, ছোট গল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী এবং দার্শনিক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে “গুরুদেব” “কবিগুরু”এবং “বিশ্বকবি” অভিধায় ভূষিত করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মোট ৫২ টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮ টি নাটক, ১৩ টি উপন্যাস ও ৩৬ টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গান সংকলন রয়েছে।

 এছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায় দুই হাজার ছবি এঁকেছিলেন। ২০১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এশিয়াদের মধ্যে সর্বপ্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। প্রত্যেক বছর বই মেলায় এই কবির বই কেনার জন্য হাজার হাজার মানুষ দোকানে ভিড় করে। কারণ তার  কবিতার মধ্যে মিলে প্রেম এবং ধ্যানের সন্ধান। যদি কেউ প্রেম এবং ধ্যানের সন্ধান করতে চান তাহলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা অনুসরণ করতে পারেন। আজ আমরা সকলের ভালোবাসার এই কবির সম্পর্কে আপনাদের জানাবো। এজন্য আর দেরি না করে আর্টিকেলটি পড়া শুরু করুন:

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মস্থান:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালে কলকাতার এক ধনী ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল দেবেন্দ্রনাথ ও তার মাতার নাম ছিল সারদা দেবী। তিনি তাদের অষ্টম পুত্র ছিলেন। তার পিতা দ্বারকানাথ  ঠাকুর ছিলেন একজন ধনী জমিদার এবং সমাজ সংস্কারক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করে ওরিয়েন্টাল  সেমিনার স্কুল থেকে। কিন্তু তার প্রচলিত শিক্ষা পছন্দ না হওয়ায় বেশ কয়েকজন শিক্ষকের অধীনে তিনি বাড়িতেই লেখাপড়া করতেন। ৭ই আগস্ট ১৯৪১ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৮০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যু বরণ করার  দুই সপ্তাহ আগে ২৫ শে জুলাই ১৯৪৮ সালে চিকিৎসার জন্য তাকে কলকাতাতে নিয়ে আসা হয় সেখানে তিনি ৩০ শে জুলাই শেষ কবিতাটির বর্ণনা করেন।

 

রবীন্দ্রনাথের শৈশবকাল:

শৈশবকাল থেকেই অন্যান্য সন্তানদের মতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অভিজ্ঞ পরিচালকদের দ্বারা লালিত পালিত হন। একজন জ্যেষ্ঠ ভাতা এবং কয়েকজন গৃহ শিক্ষকদের কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রাথমিক বিদ্যা লাভ শুরু হয়। বিভিন্ন স্কুলেও পড়েন কিছুদিন। কিন্তু স্কুলের বাধা করা নিয়ম ও আবহাওয়া তার ভালো না লাগার কারণে বাড়িতেই তার পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়। বাড়িতেই বিশ্ববিদ্যার সকল দুয়ার তার সম্মুখে উন্মুক্ত হয়ে যায়।

শৈশবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি,নর্ম্যাল স্কুল, বেঙ্গল অ্যাকাডেমি এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে অল্প কিছুদিন লেখাপড়া করেছিলেন। কিন্তু বিদ্যালয় এবং শিক্ষায় অনাগ্রহী হওয়ার কারণে বাড়িতে শিক্ষক রেখে তার শিক্ষা পরিচালনা করা হয়েছিল। ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জোড়াসাঁকোর বাড়িতে অথবা বোলপুর এবং পানিহাটির বাগান বাড়িতে প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘুরে বেড়াতে অনেক স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা:

১৮৭৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১১ বছর বয়সে উপনয়ন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর তিনি কয়েক মাসের জন্য তার পিতার সঙ্গে দেশ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। প্রথমে তারা আসেন শান্তিনিকেতনে। এরপরে পাঞ্জাবের অমৃতসরে কিছুকাল সময় কাটিয়ে শিখদের উপাসনা পদ্ধতি প্রদর্শন করেন। সর্বশেষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে দেবেন্দ্রনাথ যান পাঞ্জাবেরই ডালহৌসি শৈলশহরের নিকট বক্রোটায় । 

এখানকার বক্রোটা বাংলোয় বসে রবীন্দ্রনাথ তার পিতার কাছ থেকে সংস্কৃতি ব্যাকরণ, ইংরেজি, জ্যোতিবিজ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান, ইতিহাসের নিয়মিত পাঠ নিতে শুরু করে দেন। অল্প বয়স থেকেই রবীন্দ্রনাথের কবি প্রতিভার উন্মেষ ঘটে। ফলে কিশোর কাল থেকে শুরু করে দেন নিরবিচ্ছিন্ন কাব্য চর্চা। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তার প্রথম কবিতা ছাপা হয় তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায়।

১৮৭৮ সালে তিনি পড়াশোনার জন্য বিলেত যান। তিনি ব্যারিস্টার হবেন এই আশায় তাকে লন্ডনে পাঠানো হয়।  কিন্তু সেখানে অল্প সময় অবস্থানের পর পাশ্চাত্য জীবনধারণ, সেখানকার সাহিত্য সংস্কৃতির খবর এবং পাশ্চাত্য সংগীতের সুরমূছনা নিয়ে তিনি আবার কলকাতায় ফিরে আসেন। বড় ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের প্রেরণায় এরপর কবির মনে আসলো গানের জোয়ার। এরপর তিনি রচনা করলেন অনবদ্য গীতিনাট্য বাল্মিকী প্রতিভা ।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যৌবনকাল:

১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে তার প্রথম বই ‘কবি কাহিনী ‘প্রকাশিত হয়। এরপর একে একে প্রকাশিত হতে থাকে সন্ধ্যাসঙ্গীত , প্রভাত সঙ্গীত , ছবি ও গান , কড়ি ও কোমল , মানসী , সােনার তরী কাব্যসমূহ । তারপর বের হলাে চিত্রা , চৈতালী , কণিকা , কল্পনা , কথা ও কাহিনী , নৈবেদ্য , খেয়া , গীতাঞ্জলি , গীতালি ইত্যাদি । 

শুধু কাব্যই নয় , নাটক , গল্প , উপন্যাস , রসরচনা , রূপক নাটক , শিশুসাহিত্য , বিজ্ঞান , সমাজতত্ব , শিক্ষাতত্ব , সঙ্গীত , ভ্রমণকাহিনী ,  প্রবন্ধ , সমালােচনা , স্কুলপাঠ্য , সাহিত্য ও শিল্পের প্রায় সব ক্ষেতেই তার বিচরণের ফলে বাংলা সাহিত্যের বর্তমানে চরম উন্নতি সাধিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায় দুই হাজার বেশি ছবি এঁকেছেন।

১৯১২ সালে গীতাঞ্জলির ইংরেজি ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় লন্ডনের ইন্ডিয়ান সোসাইটি থেকে।সঙ্গে সঙ্গে প্রতীচ্যের বিদগ্ধ সমাজে সাড়া পড়ে যায় । আইরিশ কবি ডব্লিউ . বি . ইয়েস ইংরেজি গীতাঞ্জলির ভূমিকা সম্পর্কে লেখেন ।

১৯১৫ সালে ব্রিটিশ রাজ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করেন।১৯১৯ খ্রীঃ জালিওয়ালাবাগে নিরস্ত্র ভারতীয়দের ব্রিটিশ সৈন্যরা নির্মমভাবে হত্যা করার কারণে তিনি ঐ উপাধি পরিত্যাগ করেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান, চীন, রাশিয়া, পারস্য, মালয় সহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন এবং এই সকল দেশের বহু বক্তৃতা ও রচনা তিনি পাঠ করেন। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ভাষাতেই তার রচনা প্রকাশিত হয়েছিল। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের মানুষ, কবি, লেখক, বুদ্ধিজীবীরা তাকে মনীষী হিসেবে অনেক শ্রদ্ধা করে।

 

রবীন্দ্রনাথের কর্মজীবন:

ভারতীয় পত্রিকায় ১৮৭৭ সালে তার বয়স যখন মাত্র ১৬ বছর বয়স তখন রবীন্দ্রনাথ কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ রচনা প্রকাশ করেন। সেগুলো ছিল ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী, মেঘনাদবধ কাব্যের সমালোচনা আর ভিখারিণী ও করুণা নামে দুটি সুন্দর ছোট গল্প। এই সকল রচনার মধ্যে ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পায়।

তারপর ১৮৭৮ সালে  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম কাব্যগ্রন্থ “কবি কাহিনী”প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি “সন্ধ্যা সঙ্গীত” নামে আরেকটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন।”নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ” নামে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত কবিতা এই কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ছিলো।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়ে:

ইংল্যান্ড থেকে ফিরে আসার পর ১৮৩০ সালের ৯ ডিসেম্বর তারিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়ে হয় বেণীমাধব রায়চৌধুরী নামে ঠাকুরবাড়ির এক কর্মচারীর কন্যা ভবতারিণীর সঙ্গে। বিয়ের সময় ভবতারিণীর পুনরায় নামকরণ করা হয় এবং তার নাম পাল্টে তার নাম রাখা হয় মৃণালিনী দেবী।

এরপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মৃণালিনী দেবীর মোট পাঁচ সন্তান হয়। তাদের নাম ছিলো – মাধবীলতা (১৮৮৬-১৯১৮) রেণুকা ( ১৮৯১- ১৯০৩), রথীন্দ্রনাথ ( ১৮৮৮-১৯৬১) মীরা ( ১৯৯৪-১৯৬৯), এবং শমীন্দ্রনাথ (১৮৯৬–১৯০৭) ।

কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত রেণুকা এবং শমীন্দ্রনাথ খুবই অল্প বয়সে মারা যান।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্য জীবন :

১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে একটি আদর্শ বিদ্যালয় স্থাপন করেন। দেশে-বিদেশের বিভিন্ন বহু জ্ঞানী গুণী ব্যক্তিরা এই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। বর্তমানে তা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় রূপে খ্যাত।

তার রচিত দুটি বিখ্যাত সংগীত “জনগণমন অধিনায়ক জয় হে ” এবং” আমার সােনার বাংলা” যথাক্রমে ভারত এবং বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জমিদারি পরিচালনা করার জন্য দীর্ঘদিন বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার শিলাইদহে কাটিয়েছেন। তার সোনার তরী কাব্যগ্রন্থ ও বহু ছোট গল্পের রচনা পটভূমি এই কুষ্টিয়ার শিলাইদহে।

১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ছিলেন নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত প্রথম ভারতীয় এবং প্রথম এশিয়াবাসী।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্ব ভ্রমণ:

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মোট ১২ বার বিশ্ব ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। ১৮৭৮ – ১৯৩২ সালের মধ্যে তিনি পাঁচবার মহাদেশে ৩০ টি দেশ ভ্রমণ করেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে সকল বইতে তার বিশ্ব ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন সেগুলো হচ্ছে: য়ুরোপ যাত্রীর ডায়েরি (১৮৯১,১৮৯৩) , য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র ( ১৮৮১), যাত্রী (পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি ও জাভা-যাত্রীর পত্র, ১৯২৯), জাপান যাত্রী (১৯১৯), রাশিয়ার চিঠি (১৯৩১), পারস্যে (১৯৩৬) ও পথের সঞ্চয় (১৯৩৯)।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিকর্ম:

রবীন্দ্রনাথ মূলত ছিলেন একজন কবি। তার বয়স যখন মাত্র আট বছর তখন থেকে তিনি কাব্য রচনা শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রকাশিত মৌলিক কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা মোট ৫২ টি। কিন্তু বাঙালি সমাজে তার জনপ্রিয়তা প্রধানত সংগীত স্রষ্টা হিসেবে। তিনি প্রায় দুই হাজার গান লিখেছেন। কবিতা গান ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ তেরোটি উপন্যাস, ৯৫ টি ছোটগল্প, ৩৬ টি প্রবন্ধ ও গদ্যগ্রন্থ এবং ৩৮ টি নাটক রচনা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সমস্ত রচনা রবীন্দ্র রচনাবলী নামে ৩২ টি খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। তার প্রবর্তিত নৃত্যশৈলী “রবীন্দ্রনৃত্য”নামে পরিচিত।

 

শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা:

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক বছর আগে বোলপুরের শান্তিনিকেতনে এক বিশাল জমি কেনেন। সেখানে তিনি ১৮৮৮ সালে একটা আশ্রম ও ১৮৯১ সালে ব্রহ্মমন্দির তৈরি করেন। এই কেনা বিশাল জমিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি শিক্ষা কেন্দ্র তৈরি করতে চেয়েছিলেন। এজন্য তিনি সেখানে তৈরি করেন “পাঠ্যভবন” নামে একটি স্কুল, এটা বাকি সব স্কুল থেকে বেশ আলাদা ছিল। কারণ এই স্কুলটি ছিল সম্পূর্ণ খোলা আকাশের নিচে একটি গাছের তলায়।

এরপর ১৯১৩ সালের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তিনি সেই স্কুলকে আরো বিস্তৃত করার উদ্দেশ্যে এটাকে একটা বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত করে। ১৯২১ সালে পরবর্তীতে তিনি যার নাম রাখেন “বিশ্বভারতী”।

সমাজের পিছিয়ে বড় মানুষদের শিক্ষা দানের উদ্দেশ্যে তিনি ১৯২৪ সালে আরো একটি বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করেন যার নাম ছিল ‘শিক্ষা সূত্র”। এই প্রতিষ্ঠানটি তিনি মাত্র সাত জন শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু করেছিলেন।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার জীবন দশায় একাধিক কবিতা লিখেছেন। এ সকল কবিতার মধ্যে রয়েছে সোনার তরী, মানসি (১৮৯৪), চৈতালি (১৮৯৬), চিত্রা (১৮৯৬), কল্পনা ও ক্ষণিকা (১৯০০) এ সকল কাব্যগ্রন্থ ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের প্রেম ও সৌন্দর্যের সম্পর্কিত রোমান্টিক চিন্তাভাবনা। এছাড়াও পলাতকা(১৯১৮) কাব্য গল্প-কবিতা আকারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নারী জীবনের সমসাময়িক সমস্যাগুলো তুলে ধরেন। বহির্বিশ্বে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সর্বপেক্ষা সুপরিচিত কাব্যগ্রন্থটি হচ্ছে গীতাঞ্জলি। এই বইটির জন্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পান।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্প:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ছোট গল্পকার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গল্প হচ্ছে “কঙ্কাল” “মনিহারা”, “নিশীথে”, “স্ত্রীর পুত্র”, “ক্ষুধিত পাষাণ”, “নষ্টনীড়”, “হেমন্তী”, “কাবুলিওয়ালা”, “দেনা পাওনা”, “মুসলমানির গল্প”ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

রবীন্দ্রনাথের একাধিক ছোট গল্প চলচ্চিত্র নাটক এবং টেলিভিশনে নির্মিত হয়েছে। আর গল্পের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রায়ন হলো সত্যজিৎ রায় পরিচালিত তিন কন্যা ও তরুলতা। পূর্ণেন্দু পত্রী পরিচালিত স্ত্রীর পত্র, তপন সিংহ পরিচালিত অতিথি, কাবুলিওয়ালা ও ক্ষুধিত পাষাণ ইত্যাদি।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মোট তেরশো উপন্যাস রচনা করেছিলেন। এগুলি হচ্ছে: বৌ ঠাকুরানীর হাট (১৮৮৩), চোখের বালি (১৯০৩), রাজর্ষি (১৮৮৭), নৌকাডুবি (১৯০৬), গোরা (১৯১০), প্রজাপতির নির্বন্ধ(১৯০৮), ঘরে বাইরে ( ১৯১৬), চতুরঙ্গ (১৯১৬), শেষের কবিতা (১৯২৯), যোগাযোগ (১৯২৯), দুই বোন (১৯৩৩), মালঞ্চ (১৯৩৪) এবং চার অধ্যায় (১৯৩৪)। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম উপন্যাস রচনা প্রচেষ্টা হল বৌ- ঠাকুরানীর হাট ও রাজর্ষি।

বৌ- ঠাকুরানীর হাট ও রাজর্ষি ঐতিহাসিক উপন্যাস। চোখের বালি উপন্যাসে দেখানো হয়েছে সমসাময়িক কালে বিধবাদের জীবনের নানা রকম সমস্যা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনেও কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সত্যজিৎ রায়ের ঘরে বাইরে এবং ঋতুপর্ণ ঘোষের চোখের বালি।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাট্য সাহিত্য:

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাধারে ছিলেন নাট্যকার ও নাট্য অভিনেতা। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি পারিবারিক নাট্যমঞ্চের মাত্র ১৬ বছর বয়সে অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ  ঠাকুর রচিত হঠাৎ নবাব নাটকে এবং পরবর্তীতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথেরই অলিভবাবু নাটকে অভিনয় করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৮২১ সালে তার প্রথম গীতিনাট্য বাল্মীকিপ্রতিভা মঞ্চস্থ হয়। এই নাটকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঋষি বাল্মীকির ভূমিকায় অভিনয়  করেছিলেন। ।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজনৈতিক দর্শন:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজনৈতিক দর্শন ছিল অত্যন্ত জটিল। ১৯৯০ সালে প্রকাশিত মানসী কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম জীবনের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি নাইট উপাধি বর্জন করেছিলেন। এই উপাধি প্রত্যাখ্যান এর সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লর্ড চেমসফোর্ডকে লিখেছিলেন,”আমার এই প্রতিবাদ আমার আতঙ্কিত দেশবাসীর মৌনযন্ত্রণার অভিব্যক্তি।” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “একলা চলো রে”রাজনৈতিক রচনা হিসেবে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। “একলা চলো রে” গানটি ভারতীয় গান্ধীজীর খুবই প্রিয় গান ছিল।

 

রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠানসমূহ:

বিশ্ব ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়: 

১৯২১ সালে রবীন্দ্রনাথ  ঠাকুর বিশ্বভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্ব ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বীরভূম জেলার বোলপুর শহরে অবস্থিত।

 

রবীন্দ্র সেতু:

রবীন্দ্র সেতু হুগলি নদীর উপর অবস্থিত কলকাতা ও হাওরের শহরের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী সেতুগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি সেতু হচ্ছে রবীন্দ্র সেতু। ১৮৭৪ সালের প্রথম হাওর সেতু নির্মাণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৪৫ সালে পুরনো সেতুটি বদলে বর্তমান সেতুটি উদ্বোধন করা হয়। ১৯৬৫ সালের ১৪ জুন সেতুটির নাম পরিবর্তন করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম অনুযায়ী রবীন্দ্র সেতু নামকরণ করা হয়।

 

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়:

কলকাতার একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হলো রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৬২ সালের ৮ই মে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো এই বিশ্ববিদ্যালয়।

 

রবীন্দ্রনাথের পুরস্কার এবং অর্জন সমূহ:

*১৯৪০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে শান্তিনিকেতনে আয়োজিত এক বিশেষ অনুষ্ঠানে “ডক্টরেট অব লিটারেচার”সম্মানে ভূষিত করেন।

*বিদেশে তার কাব্য গীতাঞ্জলি বিশেষভাবে জনপ্রিয়তা পায়। এজন্য তাকে ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়।

*১৯১৫ সালে তিনি তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নাইট উপাধি পান। কিন্তু ১৯১৯ সালে ঘটে যাওয়া জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের পরে তিনি এই নাইট উপাধি ত্যাগ করেন।

*১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাখা একটি ছবি প্যারিস এবং লন্ডনে প্রদর্শিত হয়।

*রবীন্দ্রনাথ জাপানের ডার্টিংটন হল স্কুলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ।

*৭ই মে ১৯৬১ সালে ভারতীয় ডাকবিভাগ সম্মান জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে তার ছবি দেওয়া একটা ডাক টিকেট প্রকাশ করেন।

 

প্রেম ও ধ্যানে মিলে রবীন্দ্রনাথের সন্ধান:

বাংলা সাহিত্য জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন। সাহিত্যের প্রতিটি অঙ্গনে রয়েছে তার পদচারণা। তিনি যেমন ছিলেন শ্রেষ্ঠ কবি ঠিক তেমনি তার ভিতর মানুষের প্রতি ছিল আঘাত ভালোবাসা। তিনি যত জীবন বেঁচে ছিলেন মানুষের কল্যাণ করার জন্য নানারকম কাজকর্ম করে গেছেন। এজন্য কেউ যদি রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করতে চায় তাহলে তার মধ্যে অবশ্যই প্রেম থাকতে হবে। সেই প্রেম  হচ্ছে মানব প্রেম। একজন মানুষ মানব প্রেম করার মাধ্যমে সে পেতে পারে রবীন্দ্রনাথের সন্ধান। এজন্য বলা হয়ে থাকে প্রেমও ধ্যানে মেলে রবীন্দ্রনাথের সন্ধান।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু:

জীবনে শেষ কিছু বছর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধারাবাহিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। রোগ যেন তাকে কিছুতেই ছাড়তে চাইছিল না। দুইবার তিনি এমন অসুস্থ হন, যার জন্য তাকে বহুদিন বিছানায় শয্যাশায়ী অবস্থায় পড়ে থাকতে হয়েছিল।

জানা যায় যে, ১৯৩৭ সালে কবি একবার অচৈতন্য হয়ে গিয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় শিকার হয়েছিলেন। যদিও তিনি সেই সময় সেবার মাধ্যমে সুস্থ হয়ে উঠেছিল কিন্তু ১৯৪০ সালে আবার গুরুতর অসুস্থ হওয়ার পর তিনি আর সেরে উঠতে পারেনি। পরিশেষে দীর্ঘ রোগের পর ১৯৪১ সালের ৭ ই আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাসভবনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল প্রায় ৮০ বছর।

 

সবশেষে

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখন আমাদের মাঝে নেই কিন্তু তার অনন্য কীর্তির জন্য সে আমাদের ভেতরে আজীবন বেঁচে থাকবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম মানুষের তার প্রতি ভালোবাসা বাড়তেই থাকবে। তিনি বাংলা সাহিত্যের জন্য যা করে গেছেন তা হয়তো আর কখনো কোন কবি করতে পারবেন না। বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় ছিল তার পদচারণা। তারই হাত ধরে বাংলা সাহিত্য আজ এতদূর এগিয়ে এসেছে। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন অনেক আগেই কিন্তু আমরা তাকে পেতে পারি গভীর ভালোবাসা এবং ধ্যানের মাধ্যমে।

 

আরও পড়ুনঃ 

হুমায়ূন আহমেদকে কেন অনন্য লেখক বলা হয়?

Related Post

মৃত্যু নিয়ে উক্তি

150+মৃত্যু নিয়ে উক্তি, বাণী, ক্যাপশন 2024

মৃত্যু নিয়ে উক্তি জন্মিলে মরিতে হবে আর এটাই সত্যি। মৃত্যু হচ্ছে সবচেয়ে চিরন্তন সত্যি। পৃথিবীতে প্রতিটি প্রাণীর মৃত্যুর স্বাদ অনুভব করতে হবে। সবসময় মৃত্যুর জন্য

Read More »
খুশির স্ট্যাটাস

200+ স্টাইলিশ খুশির স্ট্যাটাস | হাসি নিয়ে ক্যাপশন

খুশির স্ট্যাটাস | হাসি নিয়ে ক্যাপশন জীবনের সুন্দর খুশির মুহূর্ত আমরা সবাই বাঁধাই করে রাখতে চাই। আর এই খুশির মুহূর্তকে ধরে রাখার সবচেয়ে সহজ উপায়

Read More »

স্টাইলিশ ভালোবাসার ছন্দ | রোমান্টিক ছন্দ | Love Status Bangla

❤❤ভালোবাসার ছন্দ | ভালোবাসার ছন্দ রোমান্টিক | ভালোবাসার ছন্দ স্ট্যাটাস❤❤ ভালোবাসা হলো এক অন্যরকম অনুভূতির নাম, যা শুধুমাত্র কাউকে ভালবাসলেই অনুভব করা যায়। আমরা বিভিন্নভাবে

Read More »
মন খারাপের স্ট্যাটাস

মন খারাপের স্ট্যাটাস, উক্তি, ছন্দ, ক্যাপশন, কিছু কথা ও লেখা

মন খারাপের স্ট্যাটাস মন খারাপ – এই কষ্টের অনুভূতি কার না হয়? সবারই কখনো না কখনো সবারই মন খারাপ হয়। জীবনের ছোটোখাটো অঘটন থেকে শুরু

Read More »

Leave a Comment

Table of Contents