ছুটির দিনে ঘরে বসে বসে যখন বোর হয়ে যায়, তখন মনকে প্রফুল্ল করতে ঘুরে আসতে পারেন কোন এক প্রকৃতির মাঝে মায়া ভরা পার্কে। তেমনি একটি পার্ক সীতাকুন্ড ইকো পার্ক (sitakunda eco park) । এই পার্কটি একটি প্রাকৃতিক পার্ক যা সীতাকুন্ড নামক একটি জলারণ্যের পাশে অবস্থিত। সুন্দর এবং পরিপাটি হওয়ায় দিনে দিনে পছন্দের পার্ক হয়ে উঠেছে সীতাকুণ্ড ইকো পার্কটি।
বাংলাদেশের বান্দরবান জেলার সীতাকুণ্ড উপজেলায় ১৯৯৬ একর জমির উপর অবস্থিত এই ইকো পার্ক। পার্কটি আকর্ষণীয় বাগান বা বোটানিক্যাল গার্ডেন ১০০০ একর জায়গা নিয়ে বিস্তৃত। বাকি ৯৯৬ একর জমির উপর রয়েছে পানির ঝর্ণা, প্রাকৃতিক পান্ডুলিপি এলাকা, জলপ্রপাত, পাহাড়, বন্য প্রাণী, এবং নৈসর্গিক সৌন্দর্যের সাথে প্রসিদ্ধ।
আজকের এই আর্টিকেলটা সাজিয়েছি সীতাকুন্ড ইকো পার্কের যাবতীয় সকল তথ্য নিয়ে। সীতাকুণ্ড ইকো পার্ক টুর প্ল্যান এর আগে আমার আর্টিকেলটা পুরোপুরি জেনে নিলে আশা করি আপনার কোনরকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে না।
আরো পড়ুন – রংপুরের সেরা হোটেল,রিসোর্ট এর সুবিধা এবং খরচ
সীতাকুন্ড ইকো পার্কের আকর্ষণীয় দিক
পার্কটি অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে বিভিন্ন প্রাণী ও প্রজাতি পর্যটন কার্যক্রম দেখার জন্য জনপ্রিয়। বাচ্চা থেকে বড় সকলেরই মনোরঞ্জনের সমস্ত রকম আয়োজনে সুসজ্জিত পার্কটির ভেতর বাহির। সীতাকুণ্ড ইকো পার্কে আপনার মনকে আকর্ষণ করার জন্য অনেক কিছুই পাবেন।
১. সীতাকুন্ড জলপ্রপাত: সীতাকুন্ড ইকো পার্কের একটি প্রমুখ আকর্ষণীয় জিনিস হলো সীতাকুন্ড দুটি জলপ্রপাত। সুপ্তধারা জলপ্রপাত ও সহস্রধারা জলপ্রপাত নামে দুইটি জলপ্রপাত নিয়ে গঠিত সীতাকুণ্ড ইকো পার্কের দৃশ্য। এটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অবাক করা দৃশ্য প্রদান করে।
২. বন্য প্রাণী সঞ্চয়ন: সীতাকুন্ড ইকো পার্কে বিভিন্ন বন্য প্রাণী সঞ্চয়ন দেখা যায়, যার মধ্যে মায়া হরিণ, কাঠবিড়ালী, বানর, হনুমান, বন সাপ, ম্যাকাক মঙ্গলস, বাংলা তিতাস, ওয়াইল্ড পিজন, মেছো বাঘ, এবং বিভিন্ন প্রকারের পাখি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যারা খুব বন্যপ্রাণী দেখতে পছন্দ করে তাদের জন্য এটি উপযুক্ত স্থান।
৩. প্রকৃতির সৌন্দর্য: আপনি যদি কোন প্রকৃত প্রেমী তাহল সীতাকুণ্ড ইকো পার্ক আপনার জন্য শ্রেষ্ঠ স্থান। সীতাকুন্ড ইকো পার্কে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনেক উপভোগ করা যায়। যেমন ঘন জঙ্গল, পাহাড়, পানির নদী, জলপ্রপাত, এবং প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি করা বাগান। প্রিয় মানুষটার রাগ ভাঙ্গাতে এটি উপযুক্ত স্থান।
৫. পানির ঝর্ণা: পার্কের ভেতরে অনেক কৃত্তিম ছোট ছোট পানির ঝর্ণা রয়েছে, যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুভব করার জন্য। সব কিছু মিলে পরিপূর্ণ পার্কের সর্বত্র।
৬. পিকনিক স্পট: অনেকেই এইখানে টুর প্লান করে তাদের জন্য পার্কের অনেক বড় পিকনিকের জায়গা রয়েছে। কাছে বা দূরের সকল ধরনের ভ্রমণার্থীদের জন্য এখানে তৈরি করা আছে তিনটি পিকনিক স্পট। এবং তাদের জন্য রয়েছে অনেক রকমের সুযোগ সুবিধা।
৭. বিশ্রাম ছাউনি:- দূর দূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থী কিংবা পার্কে বেড়াতে এসে ক্লান্ত দর্শনার্থীদের বিশ্রামের জন্য রয়েছে আটটি বিশ্রাম ছাউনি।
৮.চন্দ্রনাথ মন্দির:-সীতাকুণ্ড ইকোপার্কে চন্দ্রনাথ মন্দির রয়েছে। এটি বাংলাদেশের একটি প্রাচীন মন্দির এবং এটি হিন্দু ধর্মকেন্দ্রস্থল। চন্দ্রনাথ মন্দিরটি স্থাপিত অবস্থান করে সীতাকুণ্ডের নিকটে বাউঁধগুড়ি উপত্যকায় অবস্থিত।
সীতাকুন্ড ইকো পার্ক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পিপাসু ভ্রমণ পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান। যা, শান্তি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা একটি অনুভব করার সুযোগ সৃষ্টি করে।
সীতাকুণ্ড ইকো পার্কে কি কি উদ্ভিদ আছে
সীতাকুণ্ড ইকোপার্কে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ রয়েছে। ফুল, ফল, ঔষধি গুণ সম্পন্ন উদ্ভিদের সমাহার। এখানকার প্রধান উদ্ভিদের উদাহরণ দেওয়া হল:
১.ফুলের সমাবেশ:-এখানকার আবহাওয়া গড়ে তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের বাগান। সকলের পছন্দের দুর্লভ সেই কালো গোলাপ এখানেই দেখতে পাবেন। এছাড়াও এখানে আরো ৩৫ প্রজাতির গোলাপ দেখতে পাবেন। নাইট কুইন, জবা, স্থল পদ্ম, লিলি, রাধাচূড়া, রঙ্গন, কাঠমালতি, কামিনী,মোসাল্ডা, গন্ধরাজ, হাসনাহেনা, টগর, এলামেন্ডা, বাগান বিলাস, ফণিকা এ ধরনের আরো রয়েছে ১৫০ প্রজাতির ফুলের বাগান।
২ শালবন (Sal tree): বড় বড় পাতায়ালা শালবৃক্ষ খুব সাধারণ বৃক্ষ, যা পুরো দেশে পাওয়া যায় কম বেশি পাওয়া গেলেও এখানে অহরহ বিদ্যমাণ।এটি অন্যতম বিশাল আকৃতির উদ্ভিদগুলির মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৩. সেগুন (Teak tree): একটি ঐতিহ্যবাহী ও গুরুত্বপূর্ণ বড় প্রজাতির গাছ যার কাঠ দ্বারা কাঠের সরঞ্জাম তৈরির জন্য মূল্যবান হিসেবে করা হয়। সেগুন একটি একক গাছ এবং এর থেকে উদ্ধৃত কাঠ আসবাবপত্র তৈরি করার জন্য ধনী বানিজ্যিক সম্পদ হিসেবে পরিচয় করা হয়।
৪. শিরিষ (Siris tree): একটি বৃক্ষ যা কাঠের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।সেই সময়ে, এটি পরিস্কার গাছ হিসেবেও ব্যবহৃত হতো।
৫. খুবা আদ গাছপালা (Khuba cane): একটি যাবজ্জীবন কানে গাছ যা উচ্চতায় উর্ধ্বমূখি সম্পন্ন হতে পারে। এটি মুখ্যতঃ খোদাই কার্য, পাট পাতলা এবং বাণের জন্য ব্যবহৃত হয়।
৬.গর্জন:- এটিও কাঠ জাতীয় বৃক্ষ।এটি বাণিজ্যিকভাবে খুবই মূল্যবান বৃক্ষ। যেটি দ্বারা আসবাবপত্র নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত হয়।
৭.হরিতকি:- ঔষধি গুণ সম্পন্ন বৃক্ষ।এটির ফল শরীরের জন্য উপকারী।ইকো পার্কে এই অমূল্য বৃক্ষরাজি দেখতে পাবেন।
এছাড়াও এখানে আরো আছে, আম, জাম, কাঁঠাল, চাম্পা সহ আরো বৃক্ষের সমাবেশ।
এইগুলো কেবলমাত্র কিছু উদ্ভিদের উদাহরণ, সীতাকুণ্ড ইকোপার্কে আরও অনেক উদ্ভিদ রয়েছে যেগুলো আপনি হয়তো কখনো দেখননি। এখানে এলে এগুলো পর্যবেক্ষণ করতে পারেন।
সীতাকুণ্ড ইকো পার্কে কিভাবে যাবেন এবং খরচ
এবার সীতাকুণ্ড ইকো পার্কে কিভাবে যাবেন এটা নিয়ে আলোচনা করা যাক। সীতাকুণ্ড বাজারের থেকে মেইন রোড ধরে চট্টগ্রাম শহরের দিকে যেতে হবে। হাইওয়ে ধরে ২কিলোমিটার যাওয়ার পর ফকিরহাট বাজার যাওয়ার পর পূর্ব দিকের রাস্তার দিকে আরো দেড় কিলোমিটার গেলে দেখতে পাবেন সীতাকুণ্ড ইকো পার্ক বা সীতাকুণ্ড বোটানিক্যাল গার্ডেন।
যদি গাড়ীতে করে যেতে চান তাহলে আপনি খুব সহজেই সীতাকুণ্ড ইকো পার্ক পৌঁছাতে পারবেন। চট্টগ্রামের এ,কে খাঁন মোড়, অলংকার মোড়, কদমতলী থেকে ফেনীর বাসে উঠে খুব সহজেই যেতে পারেন সীতাকুন্ড ইকো পার্কে। সে ক্ষেত্রে ভাড়া পড়বে ৪০/৮০ টাকা।
এছাড়াও আপনি প্রাইভেটকার কিংবা সিএনজিতে করেও ইকোপার্কে রিজার্ভ করে যেতে পারেন। সিএনজি ভাড়া জনপ্রতি – ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা প্রায়।
সীতাকুন্ড ইকো পার্কে গেলে কোথায় থাকবেন
সীতাকুণ্ড বাংলাদেশে একটি অন্যতম টুরিস্ট স্পট। এই ইকো পার্ক ছাড়াও সীতাকুন্ডে আরও অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে যা একদিনে দেখা সম্ভব নয়। এটা একটু সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে কোথায় থাকবেন এটা নিয়ে আর নয় দুশ্চিন্তা। সীতাকুণ্ডেই পেয়ে যাবেন আপনার সাধ্যমত উন্নত মানসম্পন্ন হোটেল যা আপনার রাত্রিযাপনের জন্য একেবারে উপযুক্ত এবং নিরাপদ স্থান।
হোটেল গুলোর মধ্যে সাইমুন,সৌদিয়া, শৈবাল নামকরা হোটেলের মধ্যে পড়ে। আপনি আপনার সাধ্য অনুযায়ী এই হোটেল গুলোতে যে কোন রুম বুকিং করে থাকতে পারেন। এছাড়াও আপনি এখানে কম দামে আরো কিছু ছোটখাট হোটেল পাবেন।
সীতাকুন্ড ইকো পার্কে- খাবারের তালিকায় যা যা রয়েছে
সীতাকুন্ড ইকো পার্কের প্রবেশ মুখে রয়েছে হালকা খাবারের জন্য বেশ কিছু দোকান। হালকা নাস্তা করে নেওয়ার জন্য দোকানগুলো বেশ উপকারী। চটপটি , ফুচকা,চিপস,ফিস ফ্রাই,ঠান্ডা পানীয় এবং ছোটদের জন্য রয়েছে চিপস, বিস্কিট, চকলেটসহ আরো নানান ধরনের খাবার।
কিন্তু ভারী খাবার খেতে হলে আপনাকে সীতাকুণ্ড বাজারে যেতে হবে। সেখানে গেলেই পেয়ে যাবেন বহু খাবার হোটেল। এসব খাবার হোটেল থেকে আপনি আপনার পছন্দ মতো খাবার খেতে পারেন।ডাল, ভাত, মাংস, সবজি, এবং চট্টগ্রামের বিখ্যাত মাছ সহ শুটকি মাছের আইটেম। আপনার মনের মত সকল আইটেম পেতে এবং সুস্বাদু খাবারের স্বাদ নিতে সকলে সীতাকুণ্ড বাজার থেকেই খেয়ে থাকেন।
অতি অল্প খরচে এখানে আপনি আপনার রুচি সম্মত খাবার পেতে পারেন।খাবার খরচের জন্য প্রতিবেলা আপনাকে গুনতে হবে মাত্র ১২০ থেকে ২০০ টাকার মতো।
সীতাকুন্ড ইকোপার্কের জীববৈচিত্র
ঘন বৃত্তীর্ণ পাহাড়, সবুজ মনোরম বৃক্ষরাজি, নানান ধরনের বন্যপ্রাণী, সুদীর্ঘ বিশাল ঝর্ণা, আর পাখিদের সুমধুর কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে থাকে সীতাকুন্ড ইকো পার্কের সর্বত্র। সীতাকুন্ড ইকো পার্কের বোটানিক্যাল গার্ডেনের জীব বৈচিত্র্য মনে রাখার মত।মত মাতানো সকল আয়োজন নিয়ে গঠিত পরিবেশ।
মায়া হরিণ, বানর, মেছো বাঘ, বন মোরগ ও রংবেরঙের পাখি সহ নানান রকম সেখানে দেখতে পাওয়া যায়। এ ছাড়াও গোখরা, কালন্তি, লাউডগাসহ নানান বিষধর সাপ ও জলোত প্রাণী দেখতে পাওয়া যায়। ঝর্না, পাহাড় ও ফুলের রাজ্য সবকিছু মিলেই নান্দনিক সৌন্দর্যের অধিকারী সীতাকুণ্ড ইকো পার্ক।
সীতাকুণ্ড ইকোপার্কে বিভিন্ন জীব বৈচিত্র্য রয়েছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ জীব বৈচিত্র্য হলোঃ
১.বিয়েদার: সীতাকুণ্ড ইকোপার্কে বিয়েদার সাপের অবস্থান রয়েছে। এরা মুখ্যতঃ মাদাগাস্কার এবং আশিয়ান দেশে পাওয়া যায়। এই সাপ জঙ্গলের কাছাকাছি অবস্থান করে।
২.বাণবিলাশী: সেইসাথে সীতাকুণ্ড ইকোপার্কে বাণবিলাশী পাওয়া যায়। বাণবিলাশীরা মুখ্যতঃ ইউরেশিয়া মহাদেশে পাওয়া যায়। এই প্রজাতি সাধারণত বনজাতীয় এলাকার নিচে পাওয়া যায়।
৩.পাখিবিশিষ্ট বন: সীতাকুণ্ড ইকোপার্কের মধ্যে একটি পাখির অবস্থান বিশিষ্ট বন রয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতি পাখির পরিচয় পাওয়া যায়।নাম না জানা বহু পাখীর কলকাকলিতে মুখরিত এখানের বনগুলো।
৪.নদী ও হ্রদ: সীতাকুণ্ড ইকোপার্কে নদী ও হ্রদের উপস্থিতি রয়েছে। এই জলধারার উপস্থিতি নদী ও হ্রদে বিভিন্ন প্রজাতি মাছের সন্ধান মেলে এ সকল নদী এবং হ্রদের পানিতে।
এইগুলি কেবলমাত্র কিছু উদাহরণ, সীতাকুণ্ড ইকোপার্কে গেলে দেখা যেতে পারে এরচেয়ে অধিকাংশ জীব বৈচিত্র্যের সঙ্গে পরিচয় মিলবে।এছাড়াও এই ইকোপার্কে আরও অনেক ধরণের জীব বৈচিত্রের সাথে পরিচিত হতে পারবেন স্বাচ্ছন্দে।
ইতিকথা
বান্দরবানের অবস্থিত এই সীতাকুণ্ড ইকোপার্কে গেলে আপনার প্রকৃতি এবং জীব বৈচিত্রের সাথে একটা সুনিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠবে। এমন একটি পার্কে গেলে মন ভালো না হয়ে যাবে কোথায়? পার্কটিতে ঘুরলেই বুঝবেন আপনার জার্নি সার্থক। চট্টগ্রামে অবস্থিত আকর্ষণীয় পার্ক গুলোর মধ্যে, সীতাকুন্ড ইকো পার্ক অন্যতম।