পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য-গ্রেট ওয়াল অর্থাৎ চীনের মহাপ্রাচীর। মানুষের হাতে তৈরি করা সবচাইতে বড় একটি স্থাপত্য শিল্প। দীর্ঘতম এই মহা প্রাচীরটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ৮৮৫১.৮ কিলো। কথিত আছে যে এর উপর দিয়ে একসাথে ১২ জোড়া ঘোড়া দৌড়াতে পারত। এটির শুরুটা হলো চীনের সাংহাই পাসে আর শেষ হয় লোপনুরে। খ্রিষ্টপূর্ব ১৩৭৩ সালে এর মূল অংশ নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিলো মূলত সিমাটাই অঞ্চলে।
সবচেয়ে বিখ্যাত প্রাচীরটি নির্মান করা হয়েছিলো চীনের প্রথম সম্রাট কিন শি হুয়াঙের অধীনে। তবে বর্তমানের যে প্রাচীরটি সেটি নির্মান করা হয় মিং রাজবংশের শাসনামলে। প্রাচীরটি মূলত চীনের ১৫টি প্রদেশ, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশাসনিক অঞ্চল(৯৭টি) ও ছোট ছোট ৪০৪ টি শহরের মধ্য দিয়ে ঘুরেছে।
কেনো যাবেন চীনের মহাপ্রাচীর দর্শনে?
চীনের সব থেকে প্রাচীন ইতিহাস ধারণকারী জায়গাটি হচ্ছে গ্রেট ওয়াল বা চীনের মহা প্রাচীর। দূর-দূরান্ত থেকে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক এখানে চলপ আসে মধ্যযুগের সপ্তাশ্চর্য এই গ্রেট ওয়াল বা চীনের মহা প্রাচীরটি দর্শন করতে।
বিশালাকার দীর্ঘ এই প্রাচীরটি মূলত পাথর ও মাটি দিয়ে তৈরি এ বিশ্বের সবচাইতে দীর্ঘ সুউচ্চ প্রাচীরের সারি। আকাশ থেকে পাখির চোখে এটিকে দেখলে মনে হয় যেনো বিশালাকার এক সাপ এঁকেবেঁকে চলেছে বোধ হয়।
অসামান্য সুন্দর দীর্ঘ এই প্রাচীর টিকে ঘিরে পর্যটকদের মনে উৎসাহের কোনো অন্ত নেই। এর প্রতি ইঞ্চিতেই যেন এক এক ধরনের বিস্ময় অপেক্ষা করে। পৃথিবীর ইতিহাসে এই স্থানটি বিখ্যাত এবং জনপ্রিয়তার কারন হলো এর বৈশিষ্ট্য আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এখানে গিয়ে আপনি বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারবেন আর নিজের মনকে প্রশান্ত করতে তো এর সুন্দর সুন্দর কিছু অননঢ় ঐতিহাসিক স্থানগুলোই যথেষ্ট। তাই ‘কেনো যাবেন’ না বলে ‘কেনো যাবেন না’ বলাটাই বরং শ্রেয়। চলুন এই স্থানটির কিছু সুন্দর ও বিখ্যাত বিষয় তুলে ধরা যাক।
১. এখানে গেলে আপনি বিষ্ময়কর ইয়ংতাই টার্টল সিটি দেখে আসতে পারবেন।
গ্রেট ওয়াল কেবল মাত্র একটি ইট ও পাথরের তৈরি প্রাচীর নয়। তার পাশের উচু উচু সব পাহাড়ের চূড়া, দুর্গ দিয়ে মনোরমভাবে সাজানো বিভিন্ন শহরের সাথে স্রোতের টানে বয়ে চলা নদীগুলোকেও এরই অংশ হিসেবে গণনা করা হয়। ইয়োলো রিভার (হলুদ নদী) মূলত ডিফেন্স লাইনের অংশ হিসেবে মিং রাজবংশের (১৩৬৮-১৬৪৪) নির্মিত এই টার্টল সিটির কাজ সম্পন্ন হয়েছিলে ১৬০৮। যেখানে প্রায় দুই হাজার মানুষ এবং পাঁচশত অশ্বারোহী ইউনিট ছিল।
বর্তমানে এই দুর্গ শহরটি রয়েছে চীনের উত্তরের কেন্দ্রীয় গানসু প্রদেশের জিংতাই এ অবস্থিত সিতান শহরে অবস্থিত। জিংতাই থেকে দূরত্ব মাত্র ৩০ মিনিটের।। টার্টল সিটি তে যদিও অনেকগুলো আসল কচ্ছপ নেই, তবে এটি অনন্য এর আকৃতির কারণে তার এই ডাকনাম পেয়েছে। এর দক্ষিণ গেট হচ্ছে শহরটির প্রবেশদ্বার। ডিম্বাকৃতি প্রাচীর হচ্ছে শহরটির দেওয়াল। আর উত্তর গেটটি হলো শেষ অংশ। বর্তমানে চীনের সবচেয়ে সংরক্ষিত ও প্রাচীরযুক্ত শহরগুলোর মধ্যে টার্টল সিটি একটি। আপনি এখানে গিয়ে অনেক ঐতিহাসিক জিনিস দেখতে পাবেন।
২.এখানে আপনি মিং রাজবংশের আমলে টিকে থাকা ঐতিহাসিক মুতিয়ানু এবং জিয়ানকু দেখতে পাবেন।
মুতিয়ানু এবং জিয়ানকু হচ্ছে মহাপ্রাচীরটির দুটি সংলগ্ন অংশ। এটি বেইজিংয়ের হতে পাহাড়ের চূড়া বরাবর প্রসারিত প্রায় ২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত । এখানে আপনি ৯০ মিনিটেরও কম সময়ে পৌঁছে যেতে পারবেন। ইতিহাস থেকে জানা যায় এই অংশটুকু নির্মান করার জন্যে লাখ লাখ শ্রমিক প্রায় শতাব্দী ব্যয় করেছে। এর একবারে চূড়ায় দাড়ালে আপনি মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অনুভব করতে পারবেন।
মুতিয়ানু ও জিয়ানকুও কিন্তু মিং রাজবংশের টিকে থাকার ঐতিহাসিক দুটি বড় অস্ত্র হিসাবে কাজ করেছে। এর যে কোনোটিতে আরোহণ করলে তা ভ্রমণপিয়াসীদের জীবনের এক অন্যতম এক অভিজ্ঞতার সঞ্চার করে। আর মুতিয়ান কিন্তু পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে প্রাচীরের একটি সেরা অংশ। আপনি অসাধারণ সুন্দর এ অংশের একেবারে শীর্ষে যেতে পারবেন যেমনটা দর্শনার্থীরা করে। জিয়ানকু অংশটুকু হচ্ছে বন্য প্রাচীর নামেও বেশ পরিচিত। এখানে যেতে কোনো ধরনের টিকিটের প্রয়োজন হয় না। কারণ এখনও এটি বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়নি। তবে ২০২০ সাল পর্যন্ত নিরাপত্তাজনিত কারণে স্থানীয় সরকার এখানে হাইকিং নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলো।
৩.বিস্ময়কর বাতাইজি গ্রামটি দেখার জন্যে হলেও আপনাকে চলে আসতে হবে এই স্থানটিতে।
বাতাইজি গ্রামটি অবস্থিত মহাপ্রাচীরের মতিয়ানলিং শহরের ঠিক ভেতরে। ১৮৭৬ সালে নির্মান করা একটি গির্জার ধ্বংসাবশেষ রয়ে গেছে। এটির ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, এটি নির্মান করা হয়েছিলো একজন জার্মান ধর্মপ্রচারকের নির্দেশে। ১৫০ বছরের ইতিহাসে বহুবার এরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে বর্তমানে এটিকে খুব সুন্দর করে মেরামত করা হয়েছে। গির্জার বেল টাওয়ারটিই এর একমাত্র অংশ, যা কি না এখনো বিদ্যমান রয়েছে। সুন্দর একটি সকাল বা বিকাল কাটানোর জন্য কিন্তু বাতাইজি একদম অনন্য একটি জায়গা।এ গ্রামটি দেখার জন্য একটি আদর্শ সময় হচ্ছে গ্রীষ্মের শেষের দিক। কারণ এ সময় প্রাচীর এবং এর পাশের সবুজ পাহাড়ের মধ্যে দেখা যায় এক বিস্ময়কর বৈসাদৃশ্য।
৪.গ্রেট ওয়ালের সবচেয়ে আশ্চর্য জনক স্থান ঐতিহ্যবাহী লাওনিউওয়ান দেখতে পারবেন।
লাওনিউওয়ানের অপর আরেক নাম হলো ওল্ড অক্স বেন্ড গ্রেট ওয়াল। এখানকার স্থানীয়রা মনে করেন যে লাওনিউওয়ান এমন একটি গ্রাম যেখানে কি না প্রাচীর আর শক্তিশালী হলুদ নদী এক সাথে হাত মেলায়। এটি নির্মান করা হয়েছিলো মূলত ১৪৬৭ সালে।এই এলাকার গ্রেট ওয়ালের সবচেয়ে বিখ্যাত টাওয়ার অবস্থিত যার নাম হলো ওয়াংহে (আক্ষরিক অর্থে নদী দেখার টাওয়ার)। যেটি নির্মান করা হয় ১৫৪৪ সালে। লাওনিউওয়ান গ্রামটি অবস্থিত শানসি প্রদেশের শিনঝো শহরের পিয়াওইয়াং এলাকায়। গ্রীষ্মের শেষের দিক অথবা শরতের শুরুতে ভ্রমণ করার জন্য কিন্তু এটি একটি উপযুক্ত সময়। গ্রেট ওয়াল বরাবর কয়েকটি মাত্র জায়গা রয়েছে যেখানে এটি কি না নদীর সঙ্গে মিলিত হয়। তার মধ্যে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক হচ্ছে লাওনিউওয়ান। এই স্থানটি দেখার অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যেও আপনাকে চলে আসতে হবে গ্রেট ওয়াল ভ্রমনে।
৫. অবিশ্বাস্য সুন্দর পরি টাওয়ার দেখতে আপনাকে চলে আসতে হবে গ্রেট ওয়ালে।
সিমাতাই (যেখানে মূলত গ্রেটওয়াল নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল) অংশের সবচেয়ে পরিচিত টাওয়ারগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে পরি টাওয়ার। কিন্তু এখানে প্রবেশ করা একটু কঠিন বটে। তাই খুব বেশি পর্যটক এই স্থানে আসেন না। এর পরিবর্তে পর্যটকরা ওয়াংজিং টাওয়ার (পরি টাওয়ার থেকে কেনল কয়েকশ কিলো দূরে) থেকেই পরি টাওয়ারের অবিশ্বাস্য সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করতে চলে আসেন। মুতিয়ানু এবং জিয়ানকুর মতো প্রাচীরের এই অংশটিও কিন্তু বছরের যে কোনো সময় এক অপরূপ অনাবিল সৌন্দর্য অবলোকনের একদম নিশ্চয়তা দেয়।
৬.দুশিকৌ-এর ঘন সবুজ সুন্দর পাহার আর প্রকৃতির মাঝে একটু নিঃশ্বাস নিতে হলে আপনি চলে আসতে পারেন গ্রেট ওয়াল ভ্রমনে।
সম্রাট জিয়াজিংয়ের (১৫০৭-৬৭) শাসনামলে নির্মাণ করা প্রাচীরের এই একক অংশটি মূলত কিছু জায়গায় তৈরি করা হয়েছিলো সাত মিটার পর্যন্ত লম্বা পাথরের স্তূপ দ্বারা। শহরের ঠিক রাস্তার ঠিক পাশেই অবস্থিত চীনের হুবেই প্রদেশের চিচেংয়ের দুশিকৌ। এখানে গিয়ে আপনি দেখতে পাবেন দুশিকৌর স্তূপ পাথরের দেওয়ালটি অনন্য সুন্দর একটি স্থান। কারণ বেইজিংয়ের কাছে গ্রেট ওয়ালের অন্যান্য অংশগুলো কিন্তু নির্মান করা হয়েছিলো ভাটাচালিত ইট ব্যবহার করে। তবে একটা কথা জেনে রাখা ভালো যে এ স্থানটি সবচেয়ে বেশি সুন্দর থাকে কিন্তু গ্রীষ্মে বিশেষ করে জুলাই এবং আগস্টে। যখন আশপাশের গোলাকার পাহাড়গুলো প্রকৃতির অপরূপ সাজে ঘন সবুজ হয়ে যায়। এই সুন্দর মোহাচ্ছন্ন সময়ের শীতল সন্ধ্যা আউটডোর বা বারবিকিউ কিংবা বনফায়ারের একদম উপযুক্ত আবহাওয়া বিরাজ করে।
৭. গ্রেট ওয়াল ভ্রমনে এসে আপনি সাগরের সাথে মিশে যাওয়া এক অনন্য সুন্দর স্থান সাংহাই পাস দেখতে পাবেন।
সাংহাই পাস হচ্ছে গ্রেট ওয়ালের শেষ অংশ যা কি না সাগরের সাথে মিশেছে। অপরূপ সুন্দর এই অংশটি মূলত প্রাচীরের সীমান্ত প্রতিরক্ষক ছিল এক সময়। এখানে পুরো ১ দিন সময় হাতে নিয়ে ঘুরতে আসবেন। যেনো ভালো ভাবে উপভোগ করতে পারেন এর সৌন্দর্য।
৮. চীনের ওয়াচ টাওয়ার আর দুর্গ দেখার সাথে সাথে ঐতিহাসিক সৌন্দর্য অবলোকন করতে
অর্থাৎ আপনাকে চলে আসতে হবে গ্রেট ওয়ালে মুতিয়ান্যু নামক স্থানটির অভিজ্ঞতা নিতে হলে আপনাকে চলে আসতে হবে গ্রেট ওয়াল দর্শনে।
বেইজিং থেকে মাত্র ৭৩ কিলো দূরে অবস্থিত গ্রেট ওয়ালের এই অংশে যেতে সময় লাগবে দেড় ঘণ্টা। মূলত পুরোপুরি ভাবেই এই দিকের প্রাচীরের অংশ পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। আর সে জন্যে পর্যটকরা এই দিকে বেশী আসে। আর বাচ্চাদেরকে সাথে নিয়ে ট্রাভেল করার ক্ষেত্রেও কিন্তু এই দিকটা সবচেয়ে বেশী নিরাপদ। এখানে এসে আপনি ওয়াচ টাওয়ার ও তার সাথে সাথে বেশ কিছু দুর্গও দেখতে পারবেন। মুতিয়ান্যুতে রয়েছে টবোগান ও ক্যাবল কার রাইডের সাথে সাথে হাইকিং এরও সুন্দর ব্যবস্থাও।
৯. বাদালিং এর বিভিন্ন অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যে এখানে আপনার আসাটা প্রয়োজন।
বেইজিং থেকে কিন্তু বাদালিং গ্রেট ওয়ালে যাওয়া সব চেয়ে বেশী সুবিধাজনক। এখানে আপনি ক্যাবল কারের মজা পাবেন। আর গ্রেট ওয়াল মিউজিয়ামটিও আপনি ঘুরে দেখতে পারবেন। বাদালিং ওয়ালের উত্তর দিক থেকে আবার ওয়াচ টাওয়ার পর্যন্ত হাইকিং করারও সুন্দর সুব্যবস্থা রয়েছে। তবে একটা কথা হচ্ছে ভিড় এড়ানোর জন্য এখান থেকে সরাসরি গ্রেট ওয়ালে প্রবেশ না করে বরং আপনি মুতিয়ান গ্রেট ওয়াল থেকে এখানে প্রবেশ করবেন।
১০.আপনি এখানে এসে হুয়াংহুচেং গ্রেট ওয়ালর মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন।
যদিপ এই স্থানটিতে টুরিস্ট কম যায় আর শহর থেকে আসা যাওয়া করাটাও বেশ কষ্ট সাধ্য। তবে এখানে সুযোগ রয়েছে চ্যালেঞ্জিং হাইকিং-এর। পানির ভিতর ডুবে গেছে প্রাচীরের কিছু অংশ। তাই এখানে এসে আপনি কিন্তু লেকের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন।
১১. আপনি যদি ভ্রমনপ্রেমী হোন আর পর্যটকদের সব চেয়ে প্রিয় জিনশানলিং এ হাইকিং এর এডভেঞ্চার নিতে চান তাহলে অবশ্যই চলে আসতে হবে গ্রেট ওয়াল পরিদর্শনে।
বেইজিং থেকে জিনশানলিং যেতে সময় লাগে মাত্র ২-৩ ঘণ্টার মতো। এখানের অর্ধেক অংশ যদিও পুনরুদ্ধার করা হয়েছে, তবে বাকি অংশ কিন্তু এখনো জঙ্গলে ঘেরা। পর্যটকরা জিনশানলিং থেকে সিমাতাই পর্যন্ত হাইকিং করতে অনেক বেশি পছন্দ করে। যদিও আপনি চান এই অভিজ্ঞতা নিতে তাহলে অবশ্যই চলে আসবেন এ স্থানটিতে।
এছাড়াও বেইজিং এ অবস্থিত গ্রেট ওয়াল পরিদর্শনে গিয়ে আপনি বেইজিংয়ের অসাধারণ সুন্দর একটি জায়গা শিচাহাই লেক ও পরিদর্শন করতে পারবেন। এই লেকের তীরে আপনি দেখতে পাবেন একটি দীর্ঘ হাঁটাপথ। এই জায়গাটি মূলত শহরের একদমই প্রাণকেন্দ্রে। ওখানে রয়েছে মূলত তিনটি লেক যেগুলোর একটির সাথে অন্যটি সংযুক্ত। আর এখানকার সবচেয়ে বড় লেকটির নাম হচ্ছে হোওহাই। আর অন্য দুটির নাম হলো ছিয়ানহাই এবং শিহাই। একসঙ্গে এই তিনটিকে বলা হয় শি চাহাই। বিশাল লম্বা একটি লেক এটি। এর কাছেই আবার আছে নানলোকুশিয়াং হুথোং। হোওহাই লেক আর নানলোকুশিয়াং হুথোং মিলেই কিন্তু বিশাল এক এলাকা। লেকের তীর ধরে যে হাঁটা পথ সেখানে একা আনমনে হাঁটতে আপনার খুব ভালো লাগবে। এখানে আপনি দেখতে দুই তীরে শুধু রেস্টুরেন্ট আর বার।
আবার লেকের সৌন্দর্য যঅতে নষ্ট না হয়, সে জন্য এখানে কোন ধরনের হাইরাইজ ভবন কিন্তু নেই। আপনি এখানে ভবন তোলার অনুমতিও পাবেন না। আপনি দেখতে পাবেম এই লেকগুলোর ছোট ছোট কিছু জায়গায় দেখানো হয় বিভিন্ন ধরনের লোকজ খেলা বা ম্যাজিক।
লেকের বুকে ভাসতে থাকে নৌকা আর প্যাডেলবোট । বিকেলের যখন রোদ মিলিয়ে যায়, তখন অপূর্ব এক শোভা ছড়িয়ে একটা সময় টুপ করে ডুব দেয় সুয্যিমামা। তারপর ধীরে ধীরে যখন সন্ধ্যা নেমে আসে লেকের বুকে, চারিদিকে তখন জ্বলে উঠে ঝলমলে কি দারুণ দারুণ সব আলো।
সেই আলোর প্রতিফলন ঘটে আবার রেস্টুরেন্টগুলো আর নৌকা এবং ছোট্ট বোট থেকে একদম লেকের বুকে। এরপর সব সৌন্দর্য নিয়ে যখন আকাশে চাঁদ উঁকি দেয়, তার শোভা একদম ম্লান করে দেয় অন্য সব আলো গুলোকে। এখানে আসলে আপনি এই সৌন্দর্যগুলোতে একদম বিমোহিত হয়ে যাবেন। অসাধারন এই পরিবেশে কিছু অনন্য সুন্দর মুহূর্তের স্বাক্ষী হতেই মূলত এখানে বিদেশি লোকের অনেক বেশি ভিড় হয়। অবশ্য স্থানীয় লোকজনের সংখ্যা যে খুব বেশি না,তা মোটেই না।
যেসব বিদেশি বেইজিং এ অনেকদিন ধরে আছেন হয়তো লেখাপড়া বা চাকরি বা অন্য কোনো কারণে, তাদের অনেকেই এখানে চলে আসেন প্রায়ই সন্ধ্যা কাটাতে। বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে তো আছেই, পথের পাশেও কিন্তু এখানে গানের আড্ডা আর আয়োজন চলতে থাকে সবসময়। আর এখানে গান পরিবেশন করে থেকেন মূলত চীনা শিল্পীরা। কেউ গল্প করেন পাথরের বেদীতে বসে আবার কেউ বা গানও শোনেন, যার যেমন ভালো লাগে। কোথাও আবার দেখতে পাবেন কয়েকজন মিলে নাচছে। অনেক রাত পর্যন্ত এই স্থানে লোক সমাগম থাকে।
আর রেস্টুরেন্টগুলোতে ঐতিহ্যবাহী চীনা খাবার যেমন ধরুন শামুক, হটপট, বেইজিং ডাক, ঝিনুক ও সাপের মাংসের ডিশ ইত্যাদি আছে। আছে আরও উইগুর তিব্বতীও মোঙ্গোলীয় খাবার।
সবচেয়ে ভালো লাগার ব্যপার হলো, কোনো টিকেট লাগে না শিচাহাই লেক এলাকায় ঢুকতে। মন চাইলেই যে কোন সময় পর্যটকরা এখানে চলে যেতে পারেন আর এই এলাকার সুন্দর সৌপ উপভোগ করতে পারেন।
চীনের রাজধানী বেইজিং থেকে আপনি পাবলিক বাস বা প্রাইভেট গাড়িতে সরাসরি চলে যেতে পারবেন গ্রেট ওয়াল চায়নাতে। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যদিও খরচ কম পড়বে, তবে প্রাচীরের সকল অংশ যেহেতু এক স্থানে নয় তাই ভিন্ন ভিন্ন অংশে যাওয়ার পথ কিন্তু একেক রকম।
শেষ কথা,
ঋতুর সাথে পরিবর্তিত হতে থাকে চীনের প্রাচীর এর প্রাকৃতিক দৃশ্যও। বসন্তকালে, গাছপালা দ্বারা সুন্দর ভাবে পরিবেষ্টিত হয়ে ওঠে প্রাচীরটি। এইসময় গাছপালাগুলি ঘন সবুজ আকার ধারণ করে আর সমস্ত কিছুই খুব সতেজ দেখায়। এছাড়াও এটি উপযুক্ত সময় বিপূল পর্যটক ও জমায়েত এড়াবার জন্যও, তাদের মধ্যে এখানে সাধারণত গ্রীষ্মকাল এবং শরৎকালে ঘুরতে আসার বেশ ঝোঁক দেখা যায়। শীতকাল হচ্ছে এই প্রাচীরটির পরিপূর্ণ দৃশ্য পরিদর্শনের জন্য সবচেয়ে সেরা সময়। এই সময় প্রাচীর আর পর্বতগুলি একদম সাদা ধবধবে সুন্দর তুষারাবৃত থাকে।
দুপাশের অপরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশ এর সৌন্দর্যে যোগ করে দিয়েছে বাড়তি মাত্রা। বছরের চারটি ঋতুতে উপভোগ করতে পারবেন চার ধরনের সৌন্দর্য। শীতকালে শুভ্র তুষারে ঢাকা প্রাচীর মনে ঠিক যেমন এনে দিতে পারে এক ধরনের পবিত্র প্রশান্তি, তেমনি কিন্তু বসন্তের রংবেরঙের ফুল উৎফুল্ল করে দেয় মনকে। গ্রেট ওয়ালের চারপাশের সবুজ স্নিগ্ধ পরিবেশ আর ঝিরিঝিরি বাতাস গ্রীষ্মে প্রশান্ত করে মন ও হৃদয়কে ।
চীনের একটি বিখ্যাত কথা প্রচলিত। সেটি হচ্ছে- কখনও যিনি আরোহন করেন নি চীনের মহাপ্রাচীর,তিনি সত্যিকারের পুরুষ নন! এ থেকেই বুঝতে পারি, চীনের মানুষের অন্তরে এই মহা প্রাচীরের অবস্থান যে কতোটা গভীর,কতোটা মহিমান্বিত! কালের বিবর্তনে বিশ্ব স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন এবং চীনের সভ্যতা ও ইতিহাসের উত্থান-পতনের সাক্ষী এ মহাপ্রাচীরের দর্শনে আপনি কেনো যাবেন না?
আরো পড়ুন –