হাসন রাজা পিয়ারির প্রেমে মজিল রে
হাসন রাজা পিয়ারির প্রেমে মজিল রে।
নিশা লাগিল রে, নিশা লাগিল রে,
বাঁকা দু’নয়নে নিশা লাগিলে রে।“
শুধু হাসন রাজাকেই নয়, বাংলাদেশের লোক গীতি প্রতিটি প্রাণ কে করেছে প্রেমে পড়তে বাধ্য । এর অনবদ্য রূপক, সুর,তাল যা অন্য ভাইরাল গানে খুঁজে পাওয়া বড্ড দায়।
এজন্য গবেষক রুমানা চৌধুরী তার গবেষণা পত্রে উপাখ্যান দিয়েছেন ” লোকসঙ্গীত জাতীয় বিষয় ” ।
অনেক তো শিবের গীত গাইলাম, এবার জানা যাক লোক গীতি সম্পর্কে,
যা মৌখিক ভাবে প্রচারিত তাকেই বলে লোক গীতি বা লোক সংগীত সহজ অর্থে লোকের গীত। সাধারণত গ্রামীণ মানুষের জীবন তুলে ধরাই হল লোকগীতির উপজীব্য বিষয়। লোক গীতি কেবল গানই নয় এ যেন মানুষের জীবন গাথা। বিভিন্ন সময়ের সমাজ ব্যবস্থা ,ধর্ম বিশ্বাস, বিরহ,বিচ্ছেদ ফুটে উঠেছে লোক গীতিতে বারংবার।
ইতিহাসবিদদের মতে,মহাভারত,রামায়ণ, পাঁচালী থেকেই লোক সঙ্গীত এর আগমন। বিভিন্ন পুঁথি সাহিত্যই এর দৃষ্টান্ত । তবে দুঃখের বিষয় বেশীরভাগ গানের রচয়িতা/গায়কই অজ্ঞাত । তবুও এই অজ্ঞাতের ভিড়ে কিছু জাদুকরের নাম জানা যায় । তাদের মধ্যে শাহ আব্দুল করীম,আব্দুল গাফুর হালি অন্যতম।
যদিও আদিকাল হতে যেমন পরিবর্তন হয়েছে কালের। তেমনি যুগে যুগে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে লোকগানেও। ১৯৬০ সালের দিকে লোকগীতিতে আধুনিকতার হাওয়া লাগে। অতঃপর কোক স্টডিও , নগর বাউল ,লালন ব্যান্ড বিভিন্ন পরীক্ষা করলেও, লোক গীতির সেই চিরচেনা সুর মানুষ জীবিত রেখেছে এই যান্ত্রিক মৃত প্রানে। আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এক গবেষণায় ওঠে আসে,সুর তাল,লয় এর ভিত্তিতে প্রায় ৯৪দশমিক ৯৩% মধুরতা বহন করে পল্লীগীতি (তথ্যসূত্র :রিসার্চ গেইট)
আরো পড়ুন – ফুলের রাজধানী গদখালী
লোকগীতির অনেক শ্রেণী বিভাগ রয়েছে যার একটি অপেক্ষা অন্যটি অনন্য। যেমন:-
লালনঃ-
কুষ্টিয়া অঞ্চলের লালন ফকিরের আধ্যাত্মিক জীবনাদর্শ ই এই গানের মুখ পাদ্য।
” জাত গেল.. জাত গেল বলে… জ্যা তের একি কারখানা । “-লালন ফকির
বাউল ঃবাউল ফকিরের কণ্ঠে এই গানের আগমন হলেও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের হাতে ধরেই এই গান জনপ্রিয়তা পেয়েছে এই বাংলায়_
” সোনা বন্ধু রে আমারে করলি দি বানা ।” _বাউল ফকির
“আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি”_ এর মধ্যে উল্লেখ্য।
ভাটিয়ালিঃ-
ধমনীর মত ছড়িয়ে থাকা নদী মাত্রিক এই দেশে, নদী ই যখন মাঝির জীবন। তখন ভাটিয়ালি গান তাদের অবসরে একমাত্র উপজীব্য।
” কই যাও রে
পদ্মার ঢেউ কোথায়
লইয়া যাও রে ।”
ভাওয়াইয়াঃ-
বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের গরুর গাড়ি আরোহণকারী মূলত এই গানের স্রষ্টা। তাদের পথের পানের অপেক্ষমাণ সঙ্গী গেয়ে ওঠে_
” ওগো গাড়িয়াল ভাই
কত রব আমি পন্থের দিকে চাহিয়া রে।”
সারিঃ-
সাধারণত নৌকাবাইচের সময় এই গানের প্রচলন রয়েছে।
গম্ভীরা :-
” হে নানা ঘরে বসে থাকিস না আর ঘরেতে ,
নানা চল যাই ব্ক্ষরোপন করতে । ”
যদিও এই গানের আতুর ঘর চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে কিন্তু এর জনপ্রিয়তা সারাদেশ জুড়ে।বলে রাখা ভালো, ব্যাঙ্গাত্মক সুরে সমাজ জাগরণী গান এই গম্ভীরা।
হাসন রাজা ঃ-
এই গানের আবাদ স্থল খুঁজতে মানচিত্রে চলে যেতে হবে সদূর সিলেটে। সেখানে হাসন রাজাকে না পেলেও খুঁজে পাওয়া যায় তার শিল্পকর্ম এর অস্তিত্ব _
“লোকে বলে ও বলে রে ঘর বাড়ি ভালা না আমার । “_হাসন রাজা
বিবাহ গীতি বিবাহে গান বাজবে না এ যেন অকল্পনীয় বাংলাদেশের মানুষের কাছে । তাই তো রচিত হয়েছে ______
“হলুদ বাট মেহেন্দি বাট,বাত ফুলের মৌ
বিয়ের সাজন সাজবে কন্যা,করম চা রঙ বউ রে। ”
” লীলা বালি
লীলা বালি
বর যুবতী সই গো
কি দিয়া সাজামু তোরে। ”
মাফতিঃ-
মাজারভীত্তিক গান যা মানুষের বিবেককে জাগ্রত করতে সক্ষম।
গীতিকা গান ঃ-
ময়মনসিংহেরও রয়েছে ময়মনসিংহের গীতিকা ।
লোক গীতি যেন সত্যি লোকের গীতি,তাই তো প্রত্যেকটি অঞ্চলের জন্যই বরাদ্দ রয়েছ।যা সত্যি অদ্বিতীয়।
এছাড়াও রয়েছে পাঁচালী গান, শ্রম সঙ্গীত, জারি,ব্রত গীত,প্রভাতী, কবিগান,রাখালী গান,মাফতি ইত্যাদি।
এসব গানের সাথে রয়েছে দেশীয় বাদ্যযন্ত্র এর মধ্যে একতারা, দোতারা, সেতার, বাঁশি, ঢোলক, খোল, মাদল অন্যতম। যদিও এখন আধুনিকতার ছোঁয়ায় অনেক আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার পরি লক্ষিত।
এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, ধর্মগীতার মত আধ্যাত্মিক গান বয়স্ক মস্তিকে উদ্দীপন জাগ্রত করতে সক্ষম। এছাড়াও মানব মস্তিকে এন্ড্রোফিন ও সেরাটনিন নিঃসরণ করে। যা মানুষকে নতুন কিছু শিখতে অনুপ্রেরণা জাগায়। (উৎস: রিসার্চ গেইট)
লোক গীতি মানুষকে শুধু প্রিয়তমার জন্য চোখের জল নিঃসরণ করে তা নয় । বরং
“যুদ্ধের সময় জুগিয়েছে সাহস।
মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েছে বিশ্বাস।
কারণ এ তো কেবল গানই নয়
বেঁচে থাকার এক নতুন আশ্বাস। ”
হারিয়ে যাওয়া নকশি কাথার বুনুনকে বেধে রেখেছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। সেই ভাগিরতীর জল শুকিয়ে গেলেও লোক গীতির জল এখনো বহমান। প্রশ্ন তো জাগতেই পারে এতো যে জয়গান করলাম কেনই বা বাংলাদেশের লোক গীতি অন্য দেশের লোক গীতি থেকে অনন্য?
কারণ হয়ত অন্য দেশের লোকসঙ্গীত এ লয়,তাল,সুর পেতে পারেন তবে ভাবের গভীরতা মেলা ভাঁড় । এ জন্যই তো ভিনদেশী ডঃ হানস হারডার চট্টগ্রামের বিখ্যাত শিল্পী আব্দুল গাফুর হালির গানে মুগ্ধ হয়ে জার্মান ভাষায় অনুদিত করেন।
পরবর্তীতে, জার্মানেও বেশ জনপ্রিয়তা পায়।
তাই তো, লোক গীতির প্রসার প্রয়োজন। প্রসার হতে পারে —-ব্যক্তি পর্যায়ে,রাষ্ট্র পর্যায়ে,লোক গীতি সম্পর্কিত লাইব্রেরি,জাদুঘর,প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে, দেশীয়/ আন্তর্জাতিক লোকগীতি উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে ।
পরিশেষে,বাংলাদেশের লোক গীতি আমাদের সংস্কৃতির অস্তিত্বের পরিচায়ক। এই লোক গানের সংস্কৃতি হারিয়ে গেলে ,আমাদের অস্তিত্ব ও একদিন বিলিন হয়ে যাবে ।তখন হয়ত একতারা,দোতারা বাজিয়ে ও আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।