ফুল ভালোবাসে না এমন মানুষ পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। প্রকৃতির আশির্বাদ হয়ে যেন সারাবছর গাছে গাছে নানান বর্ণের-গন্ধের ফুল ফোটে ফুলের রাজধানী গদখালীতে । রঙ-বেরঙের ফুল এক মুহূর্তে সৌন্দর্য ও সুভ্রতার পরশ দিয়ে আলতো করে হাত ভুলিয়ে আমাদের মন ভাল করে দেয়।
তাইতো যুগ যুগ ধরে ফুল আর মানুষের সখ্যতা গড়ে উঠেছে। শুধু সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে না থেকে ফুলের ব্যবহার ছাড়িয়েছে জীবনের আরো নানা ক্ষেত্রে। সকল উৎসব আনন্দের পাশাপাশি প্রিয়তমার প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ কিংবা পরম ভক্তিতে দেবপ্রতিমার পূজোয়; যেখানেই মানুষের মন শুভ্রতা, ভালোবাসা, ভক্তি, যত্ন কিংবা শ্রদ্ধায় ভরে উঠেছে , সেখানেই ফুল তার মহত্বের প্রমাণ দিয়ে চলেছে।
আরো পড়ুন…..নবরত্ন মন্দির
আমাদের দেশে প্রায় সারাবছর নানাবিধ অনুষ্ঠান, মঞ্চ সাজানো, ঘর-অফিস সাজানো, রমণীদের শাড়ির সাথে মাথার কালো চুলের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা কিংবা উপহার ও শুভকামনা সরূপ ফুল ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন দিবস যেমন একুশে ফেব্রুয়ারী, ভালোবাসা দিবসের মতো দিনগুলোতে ফুলের আদানপ্রদান, ব্যবহার, ক্রয়-বিক্রয় স্বাভাবিকের তুলনায় শতগুণ বেড়ে যায়। আর আমাদের দেশে ফুলের এই বিশাল চাহিদার একটি ভিরাট অংশ পূরণ করে যশোরের ফুল চাষিরা। বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ভাবে একমাত্র যশোরেই ফুল চাষ করা হয়।
যশোর-বেনাপোল স্থলবন্দর রোড ছেড়ে সামনে এগোলে ডানে বায়ের গ্রামগুলোতে ঢুকলেই চোখে পড়ে বিস্তৃর্ণ ফুলের মাঠ। গোলাপ, গাঁদা, রজনীগন্ধাসহ আরো নানান জাতের দেশে-বিদেশি ফুলের সমাহার দেখা যায় দিগন্ত জুড়ে। ফুলের গন্ধ আর চারিদিকে দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ , পাখিরা মধুর সূরে গান গাইছে, ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াচ্ছে মৌমাছি আর মধু সংগ্রহ করে যাত্রা করছে মৌছাকে, মাঠের মাঝখানে এদিকে-ওদিকে কৃষক-কৃষকিণীরা যত্ন নিচ্ছেন ফুল চারার, এমন চোখজুড়ানে দৃশ্য সকলের হৃদয়কে মুহূর্তেই মাতাল করে দিবে। এক মুহূর্তে যে কারো মনে হতে পারে তিনি ইহযগতকে বিদায় জানিয়ে স্বর্গজগতে পদার্পণ করেছেন। এসব গ্রামে উৎপাদীত ফুল কৃষকরা স্থানীয় ‘গদখালী’ নামক আড়ৎ বা বাজারে বিক্রি করার উদ্দ্যেশ্যে নিয়ে যান। সেখান থেকে ব্যবসায়ীরা পাইকারি ক্রয় করে সারা দেশে সরবরাহ করেন। বাংলাদেশের ফুলের চাহিদার প্রায় ৭০% এই গদখালী বাজার থেকে সরবরাহ করা হয় যা উৎপাদীত হয় গদখালী বাজারের আশেপাশের গ্রাম গুলোতেই।
প্রতিবছর ৫-৬ কোটি স্টিক ফুল এই বাজার থেকে সারাদেশে সরবরাহ করা হয়। তাইতো যশোর জেলার গদখালী বাজার বাংলাদেশের ফুলের রাজধানী হিসেবে পরিচিত।
যার দরুন এই অঞ্চলের আরেক নাম ‘ফুলের রাজধানী গদখালী’।
যশোর থেকে ২৫ কিঃমিঃ দূরে ঝিকরগাছা ও শার্শা থানার প্রায় ৪ হাজার বিঘা জমি জুড়ে বাণিজ্যিক ফুলের আবাদ গড়ে তুলেছেন সেখানকার কৃষকরা।
বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামের মতো এই গ্রাম গুলো ও ছবির মতো সুন্দর ও সবুজে ঘেরা। কিন্তু এই ১০০ টি গ্রামে রয়েছে খানিক বৈচিত্রিতা। শুধু সবুজ নয় এর সাথে মিশে আছে সাদা, হলুদ,লাল ও ইত্যাদি বাহারি ফুলের রঙ। দেখে মনে হতে পারে হাজারো বছর আগে বিলুপ্ত হওয়া ব্যবিলনের শূন্য উদ্দ্যানের একাংশ!
তাইতো এই গাঢ় সুন্দর প্রকৃতির রূপ দেখতে সারাবছর দেশের নানা অঞ্ছল থেকে প্রকৃতিপ্রেমিক পর্যটকরা ভীড় জমান যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার এই গ্রামগুলোতে।
ঐ খান কার কৃষকরাও বেশ আন্তরিক। আপনি গেলেই আপনাকে একগাল হাসি নিয়ে শুভেচ্ছা জানাবে।
আপনি ছবি তোলেন , প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করেন এতে কৃষকদের আপত্তি নেই। তবে ফুল গাছের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিত এবং বাগানে ঢোকার সময় অবশ্যই অনুমতি নিয়ে ঢুকবেন।
ফুল, রং, ঘ্রাণ ও সৌন্দর্যে ভরপুর গ্রাম গুলোর নামও বেশ বাহারি। যেমন ফুলিয়া পানিসারা, পটুয়াপাড়া, মাটিকুমড়া কাউরা সহ আরো অনেক।
ফুলের রাজ্য গদখালী যেতে আপনি যদি ইচ্ছুক হোন তবে সবচেয়ে ভাল সময় হবে শীতকাল তথা জানুয়ারি মাস। কারণ জানুয়ারী মাসে ঝড়বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে না এবং ঐ সময় অনেক প্রজাতির ফুল একসাথে ফোটে। ফলে আরো অধিক সংখ্যক ফুলের সমাহার দেখার সুযোগ থাকে অন্য সময়ের তুলনায়।
এসব গ্রামগুলোতে দেশি ফুল গোলাপ, গাঁদা, রজনীগন্ধা, চন্দ্রমল্লিকা এসবের পাশাপাশি বিদেশি লিলিয়াম, রডস্টিক, জারবেরা, গ্লাডিউলাস সহ নানা বাহারী ফুলের চাষ করা হয়। তবে গোলাপ, গাঁদা, রজনীগন্ধা ও চন্দ্রমল্লিকার চাহিদা বেশি থাকায় তুলনামূলক ভাবে এসব ফুলের চাষ বেশি করা হয়।
এই ফুল চাষ ও উৎপাদনের সাথে এইসব গ্রামের প্রায় ৬ হাজার কৃষক- কৃষাণী জড়িত। কৃষিক্ষেত্রে অন্যান্য অঞ্ছলের বিভিন্ন ফলন উৎপাদনের সাথে ঝিকরগাছা উপজেলার গ্রামগুলোতে ফুল উৎপাদনের সাথে একটা বৈচিত্রতা লক্ষ করা যায়। অন্যান্য ফসল উৎপাদনে নারী কৃষাণী সেভাবে অংশ না নিলেও ফুল চাষে একই পরিবারের নারী-পুরুষ-শিশু- বৃদ্ধ সবাইকে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। তুলনামূলক অন্য ফসল উৎপাদন থেকে ফুল চাষ কম পরিশ্রমের বিদায় সেখানে সকল বয়সে নারী পুরুষ সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে।
তাই ফুল চাষের মাঠ গুলোতে তাকালে দেখা যায় পরিবারের পুরুষরা কোদাল দিয়ে গাছের গোড়ার মাটি নিঙ্গড়ে দিচ্ছে অথবা সেচ কাজের মতো ভারী কাজ গুলো করছে, নারী সদস্যটি গাছের ডালপালার বাড়টি অংশ কেটে দিচ্ছে কাঁচি দিয়ে এবং পরিবারের বৃদ্ধ ও শিশুরা মনের আনন্দে উপযুক্ত ফুল গুলো সংগ্রহ করছে। পরিবারের নারী পুরুষ সকলেই আয়ের উৎসে শ্রম দেয়ায় কারণে এ অঞ্চলে লিঙ্গবৈসম্য কম । এছাড়া অনেক নারী উদ্দোগতা এই পেশায় জড়িত থাকায় নারীদের বিকল্প আয়ের উৎস তৈরি হয়েছে। এতে অনেক প্রান্তিক নারী আর্থিকভাবে স্বাভলম্বী হওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
তবে এততস্তত্বেও এখানে ফুলের চাষ হুট করে স্মতঃস্ফূর্তভাবে শুরু হয়নি। বরং তা শুরু হয়েছে একজন চাষীর হাত ধরে। সচরাচর গ্রামীণ জমিতে ধান,গম,সবজি,বাদাম ইত্যাদি ফসলের পরিবর্তে এখানকার জমিগুলোতে যে ফুল চাষ করা হচ্ছে, তার শুরু হয়েছিল শের আলী সরদারের হাত ধরে।
শের আলী সরদার ছিলেন একটি গাছের নার্সারির মালিক। তিনি ১৯৮২ সালে একদিন গ্রীষ্মের গরমের দিনে তার নার্সারীতে কাজ করছিলেন। এসময় একজন পথিক এসে ওনার কাছে পানি চাইলেন। শের আলী সরদার তাকে পানি দিলেন এবং লক্ষ করলেন ভদ্র লোকের হাতে রয়েছে কয়েকটি ফুল। শের হলে সরদার এই ফুল সম্পর্কে জানতে চাইলে ভদ্রলোক জানান তিনি এসেছিলেন কলকাতা থেকে এবং ওনার হাতের ফুলের নাম রজনীগন্ধা যা ভারতের কলকাতা এলাকায় প্রচুর চাষ হয়। ভদ্রলোককে শের আলী সরদার নিজ বাড়িতে নিয়ে আপ্পায়ন করে খাওয়ালেন এবং তার থেকে কলকাতায় ফুল চাষের বিস্তারিত শুনলেন। শের আলী সরদার ভাবলেন কলকাতা ও বাংলাদেশের আবহাওয়া ও মাটির ধরণ প্রায় একই রকম, কলকাতায় এসব ফুল চাষ হলে বাংলাদেশেও নিশ্চয়ই সম্ভব। যে ভাবনা সে কাজ। শের আলী সরদার শুরুতে ১ বিঘা জমিতে রজনীগন্ধা চাষ করেন। শুরুর বছর অতো বেশি লাভ না হলেও ফুল ও এর ঘ্রাণ ও সুভ্রতার প্রেমে পড়ে যান নার্সারীর চারা উৎপাদনকারী শের আলী সরদার। সেই থেকে হাল ছাড়েননি, পরেরবছর আবারো অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে চাষ করেন রজনীগন্ধার । সেবার ফলনও হলো আগের বারের থেকে ভাল। এভাবে বছরে বছরে বাড়তে থাকল ফুল চাষের জমির পরিমাণ। বেশ কয়েকবছর লাভের দেখা পান শের আলী সরদার। তার দেখাদেখি অন্যরাও ফুলের চাষ করতে থাকে। শুরুতে রজনীগন্ধা দিয়ে শুরু হলেও পরে তা গোলাপ, গাঁধা, বেলি, চামেলি, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়াসহ আরো নানা দেশি বিদেশি ফুলে ভরে উঠে সব মাঠ। এভাবে তা বিস্তৃৎ হতে হতে আজ তা ১০০ টি গ্রামে ছড়িয়েছে এবং ঐ অঞ্চলের মানুষের প্রধান আয়ের উৎসে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন এনজিও থেকে প্রশিক্ষণ, ঋণ ও পরামর্শ দিয়ে সেখানকার কৃষকদের সাহায্য করে থাকেন নিয়মিত। ভারত ও চীন থেকে কৃষকদের বাংলাদেশ সরকার নিয়ে আসেন সেখানকার কৃষকদের সাথে মতবিনিময় ও সাহায্য পরামর্শের জন্য। এই ফুল চাষ্ কে কেন্দ্র করে ‘ফ্লাওয়ার সোসাইটি’ নামে একটি সংস্থা গড়ে উঠেছে যা ফুল চাষী ও ব্যবসায়ী এবং বিক্রেতারের মাঝে সামঞ্জস্য রক্ষা করে ও এই পেশার সাথে জড়িত সকলের স্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করে।
যেভাবে যাবেন গদখালী বাজারঃ–
ঢাকা থেকে বাস, ট্রেন অথবা আকাশ পথে যশোর যাওয়া যায়। সেখান থেকে মাইক্রো,জীপ,সিএনজি করে চলে যাওয়া যায় গদখালী বাজার।
আর থাকার জন্য যশোরই উত্তম। সেখানে রয়েছে আধুনিক মানসম্মত হোটেল ও খাওয়াদাওয়ার জন্য রেস্তোরা।
গদখালী যাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময় জানুয়ারি মাস। ঢাকা থেকে সড়ক, রেল ও আকাশপথে যশোর যাওয়া যায়। যশোর বাস স্ট্যান্ড থেকে রিক্সা নিয়ে চলে যান লোকাল বাস স্ট্যান্ডে। এখান থেকেই পেয়ে যাবেন গদখালি যাবার বাস। গদখালি নেমে ক্ষেত দেখার জন্য ভ্যান নিয়ে নিতে পারেন। ভ্যান ভাড়া নিবে ১০০-১৫০ টাকা। গ্রামের রাস্তা দিয়ে যাবার সময় রাস্তার দুপাশে চোখে পড়বে ফুলের ক্ষেত। বাসস্ট্যান্ডের রাস্তার পাশেই সকালে বসে দেশের সর্ববৃহৎ ফুলের পাইকারি বাজার।
থাকার জন্য যশোর শহরকেই বেছে নিতে হবে। সেখানে থাকা এবং খাবারের জন্য হোটেল পেয়ে যাবেন। আবাসিক হোটেলের মধ্যে হোটেল আমিন এবং হোটেল মিডটাউন উল্লেখযোগ্য।