লেবু হচ্ছে টক জাতীয় ভিটামিন সি তে ভরপুর একটি ফল। সাধারনত গরম কালে ও রমজান মাসে লেবুর কদর অনেক বেশি বেড়ে যায়। সারাদিন রোজা রেখে কিংবা গরমে এক গ্লাস লেবুর শরবত ছাড়া কোনো কিছু কল্পনা করা যায় না। ক্লান্ত শরীরে এক গ্লাস লেবুর শরবত নিমিষেই সকল ক্লান্তি উধাও করে দেয়। লেবু যে শুধু পিপাসা নিবারক হিসেবে কাজ করে তাই নয় বরং লেবু বিভিন্ন রোগের উপশম সহ রূপচর্চায় ও আদিম কাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এ আর্টিকেলে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করবো লেবুর উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে ।
লেবুর উপকারিতা
এন্টিসেপটিক ও ঠান্ডা লাগা প্রতিরোধ করে:
লেবুতে রয়েছে সাইট্রিক এসিড, ভিটামিন সি ও অন্যান্য উপাদান যা এটিকে প্রাকৃতিক ভাবে এন্টিসেপটিক হিসেবে গড়ে তোলে। এন্টিসেপটিক হওয়ায় লেবু ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য ক্ষতিকারক জীবানু গুলোকে মেরে ফেলে।
সাইট্রিক এসিড হচ্ছে একটি দূর্বল এসিড যা ব্যাকটেরিয়ার কোষে থাকা ঝিল্লিকে ভেঙ্গে দিতে পারে। লেবুতে ভিটামিন সি থাকায় এন্টি অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে যার ফলে যারা লেবু খায় তাদের শরীরে ব্যাকটেরিয়া বিস্তার লাভ করতে পারেনা, ধ্বংস হয়ে যায়। এছারাও লেবুতে রয়েছে ফ্ল্যাভোনয়েডস নামক উপাদান যা লেবুকে এন্টিসেপটিক বৈশিষ্ট্য প্রদান করে।
ক্ষত পরিষ্কার করতে:
যেহেতু লেবুতে রয়েছে এন্টিসেপটিক বৈশিষ্ট্য। তাই লেবু ক্ষত বা ঘা পরিষ্কার করতেও ব্যবহার করা যেতে পারে। লেবু ব্যবহার করার ফলে ক্ষত তে থাকা ময়লা ও জীবানু পরিষ্কার করে দ্রুত ক্ষত সেড়ে উঠতে সাহায্য করে। এছাড়াও লেবুর মাধ্যমে ত্বকের সংক্রমণও নিরাময় করা সম্ভব। ত্বকে যে কোনো ক্ষত হলে লেবু ব্যবহার করলে ত্বকের ক্ষত নিরাময় হয়।
জিহবা ও অন্যান্য ঘা উপশম করতে:
ভিটামিন সি এর অভাবে দাতের মাড়ি ফুলে যাওয়া, জিহবায় ঘা হয়৷ এরকম সমস্যায় নিয়মিত লেবু খেলে ঘা সেড়ে যায়। এছাড়াও যে কোনো অপারেশন এর ঘা দ্রুত শুকাতে অথবা যে কোনো ঘা দ্রুত শুকাতে চিকিৎসক গন লেবু খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। মুখে যদি ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হয় তাহলে লেবুর রস দিয়ে মুখ ধুয়েও ব্যাকটেরিয়া থেকে নিস্তার পাওয়া যায়। এছাড়াও লেবুর রস দিয়ে ত্বকের সংক্রমণ যেমন ফোড়া ও ফুসকুড়ি থেকেও নিরাময় পাওয়া যায়।
লিভার সুস্থ রাখতে সাহায্য করে:
- লেবুতে থাকা ভিটামিন সি, এন্টি অক্সিডেন্ট সহ অন্যান্য উপাদান লিভার সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
- সকালে খালি পেটে লেবুর রস ও পানি মিশিয়ে খেলে শরীরের বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেয় লেবুতে থাকা এন্টি অক্সিডেন্ট।
- ভিটামিন সি লিভারের কোষের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে এবং লিভারের কোষের বৃদ্ধি বাড়িয়ে দেয় সেইসাথে মজবুত করতে সাহায্য করে।
- লেবুতে থাকা ফ্ল্যাভোনয়েডস নামক উপাদান লিভারের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে এবং রোগের ঝুঁকি কমায়।
- লেবুতে উপস্থিত এন্টি অক্সিডেন্ট লিভারে জমা হওয়া ফ্রি র্যাডিকেল কে ধ্বংস করে লিভারকে অসুখ থেকে রক্ষা করে।
- ভিটামিন সি লিভারের এনজাইম এর কার্যকারিতাতে বিশেষ অবদান রাখে। ফলে এই এনজাইম গুলো ভালভাবে বিষাক্ত পদার্থ গুলোকে নিষ্ক্রিয় করতে পারে।
- লেবুর রস পরিপাক ক্রিয়াতেও অবদান রাখে।
লেবুর খোসার গুড়ো ব্যবহার:
লেবুর খোসা গুড়ো করে গোসলে ব্যবহার করলে গরম দূর হয় এবং শরীরকে ঠান্ডা রাখে। এছাড়াও কারো যদি মাথা ব্যথা হয় তাহলে লেবুর খোসা গুড়ো করে মাথায় দিলে মাথা ব্যথা কমে যায়।
ব্রন দূর করতে সাহায্য করে:
ব্রন এমন একটি জিনিস যা হলে মুখের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়। ব্রনের চিকিৎসায় বিভিন্ন ভাবে লেবু ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন: কয়েক ফোটা লেবুর রস এবং সাথে এক চামচ মধু সহ মিশিয়ে মুখে লাগালে ব্রন দূর হয়। এছাড়াও বিউটি এক্সপার্ট রা দুধের সর ও লেবুর রস ব্রনের চিকিৎসায় ব্যবহার করতে বলেন। ব্রনের চিকিৎসায় লেবু ব্যবহার করলে ব্রন দূর হওয়ার পাশাপাশি ব্রন ওঠার হারকেও কমিয়ে দেয়। কারন ব্রন ভিতর থেকে ত্বককে পরিষ্কার করে।
আরো বিস্তারিত পড়ুন – ব্রন দূর করার উপায়
লেবু ঠান্ডা লাগা প্রতিরোধ করে:
জ্বর সর্দিতে লেবু দীর্ঘ দিন থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে। যেহেতু লেবুর মধ্যে আন্টি অক্সিডেন্ট আছে তাই লেবু ব্যাকটেরিয়া দূর করতে সাহায্য করে। জ্বর বা সর্দিতে লেবুর রসের সাথে পানি মিশিয়ে সাথে কয়েক টুকরো দাড়ুচিনি, এলাচ এবং তেজপাতা গরম করে নিন। যখন পানির রং পরিবর্তন হবে তখন নামিয়ে খেয়ে নিন। দেখবেন খাওয়ার পর সর্দি বা ঠান্ডা কমে যেতে শুরু করবে।
লেবু ওজন কমাতে সাহায্য করে:
লেবুতে থাকা সাইট্রিক এসিড, ভিটামিন সি ওজন কমাতে সাহায্য করে। লেবুর সাইট্রিক এসিড ক্ষুধা কমায় ফলে অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবনতা কমে যায়। সাইট্রিক এসিড মুখে থাকা স্বাদ কোষ গুলোকে উউদ্দীপিত করে ফলে ক্ষুধা হ্রাস হয় এবং অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবনতা কমে যায়। আর এ কারনেই যারা ওজন কমাতে চান নিয়মিত লেবু পানি খেলে তাদের ওজন নিয়ন্ত্রনে আনা সম্ভব। এছাড়াও লেবুতে থাকা এন্টি অক্সিডেন্ট মেটাবলিজম বাড়াতে সাহায্য করে। মেটাবলিজম শরীরের খাদ্যকে শক্তিতে রুপান্তরিত করে। যার কারনে লেবু খেলে শরীরে মেটাবলিজম বাড়লে এবং শরীর বেশি ক্যালরী পোড়ায়।
লেবু শ্বাসনালী ও গলার প্রদাহ কমায়:
লেবুতে থাকা সাইট্রিক এসিড গলার শ্লেষ্মার প্রবাহ বৃদ্ধি করে এবং শ্লেষ্মার জমাট বাধা প্রতিরোধ করে ফলে শ্বাসনালী ও গলা পরিষ্কার হয়ে যায়। এছাড়াও গলা ব্যথায় যদি লেবু দিয়ে চা করে খাওয়া হয় তাহলে গলা ব্যথারও উপশম হয়।
লেবু আলসার প্রতিরোধ করে:
চিকিৎসা শাস্ত্রে আছে লেবুর রস পান করলে আলসার কমে যায় এবং বুক জ্বলা ভাবও প্রতিরোধ করে। লেবুর রস পান করার ফলে পাকস্থলীতে থাকা ক্ষতিকারক এসিড কে ধ্বংস করে ফেলে ফলে আলসার নিরাময় হয়।
লেবু কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সহায়ক:
যাদের কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যা রয়েছে তারা যদি নিয়মিত লেবু পানি অথবা সালাদ করে লেবু খায়, তাহলে কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যা দূর হবে।
আসবাবপত্র অথবা কাপড় পরিষ্কার করতে:
লেবুতে রয়েছে প্রচুর পরিমানে এসিড। যা ময়লা দূর করতে সাহায্য করে। যদি আপনার পোশাকে কোনো কিছুর দাগ লাগে তাহলে লেবুর রস দিয়ে পরিষ্কার করতে পারেন।
এছাড়াও যদি আপনার ঘরের ফার্নিচার ময়লা হয়ে যায় তাহলে পানির সাথে লেবুর রস মিশিয়ে সুতি নরম কাপড় দিয়ে মুছলে নতুনের মত পরিষ্কার হয়ে যাবে। শুধু তাই নয় থালাবাটি পরিষ্কারের কাজেও লেবুর খোসা কাজে লাগাতে পারেন। লেবুর খোসা থালা বাটিকে নতুনের মত পরিষ্কার বানিয়ে দেয়। তাই আপনার আসবাবপত্র থেকে পোশাক সব কিছু খুব সহজে কোনো ঝামেলা ছাড়া পরিষ্কার করার জন্য লেবুকে বেছে নিতে পারেন।
পোকা মাকড়ের উপদ্রব কমাতে:
পোকা মাকড়ের উপদ্রব কমাতেও লেবু সাহায্য করে। আপনার বাসা থেকে খুব সহজেই লেবু ব্যবহার করে পোকামাকড় তাড়াতে পারেন। কারন লেবুতে থাকা সাইট্রিক এসিড পোকামাকড় মারতে সাহায্য করে। পোকামাকড় দূর করার জন্য লেবুর খোসা শুকিয়ে গুড়ো করে নিন। এবার যেখানে পোকামাকড় এর উপদ্রব বেশি সেখানে ছিটিয়ে দিন। এছাড়াও পোকামাকড় তাড়াতে লেবুর রস এর সাথে পানি মিশিয়ে পুরো রুম স্প্রে করে নিন। পোকামাকড় পালিয়ে যাবে। আরো একটি উপায়ে পোকামাকড় তাড়াতে পারেন। সেটি হচ্ছে লেবু কেটে যেখানে পোকামাকড় এর উপদ্রব বেশি সেখানে টুকরো গুলো রেখে দিলে পোকামাকড় পালিয়ে যাবে।
এয়ার ফ্রেশনার হিসেবে ব্যবহার:
লেবুর সুগন্ধি ক্লান্তি দূর করে। তাই এয়ার ফ্রেশনারে হারহামেশাই লেবুর গন্ধ পাওয়া যায়। ঘরে বসে এয়ার ফ্রেশনার বানাতে চাইলে লেবুর রসের সাথে তেল মিশিয়ে পুরো রুমে স্প্রে করে নিন।
লেবুর অপকারিতা:
বুক জ্বালা করে:
লেবু শুধু আমাদের উপকার করে এমনটা ভেবে থাকলে আপনি ভুল। লেবু উপকার করার পাশাপাশি অনেক অপকার করে। তাই লেবু খাওয়ার আগে সতর্কতা অর্জন করতে হয় এবং পরিমান মত খেতে হয়। অতিরিক্ত লেবু খেলে বুক জ্বালা করতে পারে। যাদের গ্যাসের সমস্যা রয়েছে তাদের অতিরিক্ত লেবু না খাওয়াই ভাল।
কার্বোহাইড্রেট সহ অন্যান্য পুষ্টিগুনের অভাব:
যারা ওজন কমানোর জন্য লেবু খেয়ে থাকে তাদের শরীর ক্লান্ত হতে পারে ও অন্যান্য পুষ্টিগুনের অভাব দেখা দিতে পারে।
হজমে সমস্যা:
লেবু সকালে খালি পেটে খেলে হজমে সমস্যা হতে পারে। কারন লেবু আমাদের শরীরের পেপসিন হরমোন কে বিচ্ছিন্ন করে দেয়, আর পেপসিন এর কাজ হলো হজমে সাহায্য করা। তাই সকালে খালি পেটে লেবু পানি খেলে হজমে সমস্যা হতে পারে।
দাত ক্ষয় হয়:
অতিরিক্ত লেবু খেলে দাত ক্ষয় হতে পারে। কারন লেবুতে থাকা সাইট্রিক এসিড দাতের এনামেল হ্রাস করে যার ফলে দাত ক্ষয় হয়ে যায়। কিছুদিন আগে করা ব্রাজিলের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডেন্টাল অ্যান্ড ক্র্যানিওফেসিয়াল রিসার্চের একটি গবেষনায় দেখা গেছে, ” যারা নিয়মিত সফট ড্রিংক করেন তাদের দাত যেমন ক্ষয় হয়, তেমনি যারা নিয়মিত লেবু খান তাদের দাত ক্ষয় হওয়ার প্রবনতা একই রকম।”
মুখের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে:
দীর্ঘ দিন ধরে যারা লেবু খান তাদের মুখের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ফলে খুব সহজেই মুখে ফোড়া বা ফুসকুড়ি উঠতে পারে। লেবুতে থাকা সাইট্রিক এসিডের কারনেই সাধারণত এমন হয়ে থাকে।
বমি হতে পারে:
লেবু পানি অতিরিক্ত হলে হজমে সমস্যা হয় তাই বমিও হতে পারে। তবে সাধারণত যে কোনো ধরনের ডিটক্স ডায়েট থেকেই এমন হতে পারে।
মাইগ্রেনের ব্যথা বাড়িয়ে দেয়:
লেবুতে থাকা সাইট্রিক এসিডে টাইরামাইন নামক একটি উপাদান থাকে। এই উপাদানের কারনেই মাইগ্রেনের ব্যথায় আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি লেবু খেলে ব্যথা বেড়ে যেতে পারে।
ডিহাইড্রেশন:
কি খুব অবাক হচ্ছেন নিশ্চই! ডিহাইড্রেশন থেকে বাচার জন্য লেবু পানি খাই আবার সেই লেবুই কি না ডিহাইড্রেশন এর কারন? হ্যা! যদি আপনি অতিরিক্ত লেবু পানি খান তাহলে আপনার ঘন ঘন প্রস্রাব হবে যার ফলে শরীরে ডিহাইড্রেশন হতে পারে। প্রস্রাবের সাথে আমাদের শরীর থেকে ইলেকট্রোলাইডস ও সোডিয়াম বেড়িয়ে যায় যার ফলে ডিহাইড্রেশন সৃষ্টি হয়।
সানবার্ন:
অনেকেই না জেনে বুঝে লেবুর প্যাক ব্যবহার করার পরে বাইরে যায়। যার ফলে রোদে যাওয়ার কারনে স্কিন লাল হয়ে র্যাশের মত দেখা যায়। অনেক সময় আমরা একে ছোপ ছোপ দাগও বলে থাকি। তবে ডাক্তারি ভাষায় এটাকে সাইটোফোটোডার্মাটাইটিস বলা হয়। এছাড়াও অতিরিক্ত লেবুর রস ব্যবহার করার কারনে স্কিন ক্যান্সারও হতে পারে।
আয়রনের পরিমান বেড়ে যায়:
অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভাল নয়। যারা অতিরিক্ত লেবু খান তাদের রক্তের আয়রনের পরিমান বেড়ে যায়, যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
পরিশেষ
লেবু আমাদের সবার অনেক পছন্দের। লেবু দিয়ে আমরা আমাদের শরীরের যত্ন করা পাশাপাশি গৃহস্থালি নানান কাজে ব্যবহার করে থাকি। এটি যেমন আমাদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, রোগ উপশম করে ঠিক তেমনি লেবু অতিরিক্ত খেলে হতে পারে হীতে বিপরীত। তাই লেবু খাওয়ার আগে ভালভাবে জেনে নিতে হবে কতটুকু কোন সময় এবং কি পরিমানে খেতে হবে। নিয়ম মেনে পরিমিত ভাবে লেবু খেলে আমরা উপকৃত হতে পারি এবং সেই সাথে এর অপকার হতে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে পারি।
আরো পড়তে পারুন –