মেসোপোটেমিয়া সভ্যতা যুগ যুগ ধরে মানুষের কাছে অত্যাশ্চর্য একটি সভ্যতার নাম। কারন এই সভ্যতার মাধ্যমেই গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় আবিষ্কৃত হয়েছে যা আমাদের বর্তমান যুগকে উন্নত করতে কয়েক হাজার ধাপ সামনে এগিয়ে দিয়েছে। পৃথিবীর শুরু থেকে এখন অবধি যত সভ্যতা রয়েছে তাহলে সব সভ্যতাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাবে মেসোপটেমিয়া সভ্যতা।
এই সভ্যতা ঘিরে রয়েছে জানা অজানা হাজার রকমের রহস্য৷ যা আজো বিজ্ঞানীরা গবেষনা করছেন। এই সভ্যতার কথা স্বর্নাক্ষরে লিখা রয়েছে ইতিহাসের পাতায়৷ আজকের এই আর্টিকেলের মাধ্যমে জানতে পারবেন মেসোপোটেমিয়া সভ্যতা কিভাবে শুরু হয়েছিল এবং কিভাবে ধ্বংস হয়েছে। সেই সাথে জানতে পারবেন কেন এই সভ্যতা ইতিহাসের পাতায় চির সজীব হয়ে আছে।
নামকরণ ও পর্যায়
মেসোপোটেমিয়া সভ্যতা গঠন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সেই অঞ্চলটি এক প্রকার জলাভূমি ছিল। বিভিন্ন ধরনের জঙ্গল ও খেজুর গাছ দিয়ে পরিপূর্ণ ছিল। সময়ের সাথে টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেতিস নদীর পলিমাটি জমে উর্বর ভূমি তৈরি হয়। সেখানেই গড়ে উঠে মেসোপোটেমিয়া সভ্যতা। মেসোপোটেমিয়া সভ্যতার প্রথম নামকরণ করেন গ্রিকরা। ‘Mesopotamia ‘ শব্দ থেকে ‘meso’ যার অর্থ মধ্য এবং ‘potamos ‘ শব্দের অর্থ হচ্ছে নদী। অর্থাৎ Mesopotamia শব্দের অর্থ নদীর মধ্যে অবস্থিত।
মেসোপোটেমিয়া সভ্যতা টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেতিস নামক দুই নদীর মধ্যবর্তী স্থানে যে উর্বর যে উপত্যকা ছিল সেটিই মেসোপোটেমিয়া নামে পরিচিত ছিল। প্রাচীন কালে মেসোপোটেমিয়া কে বলা হত দ্বি – নদমধ্যা দেশ। মেসোপোটেমিয়া সভ্যতার মোট চারটি পর্যায় ছিল। যথা : সুমেরীয়, ব্যবিলনীয়, আ্যসিরীয় এবং ক্যালডীয়। আজ থেকে প্রায় পাচ থেকে ছয় হাজার বছর পূর্বে দুই নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল মেসোপোটেমিয়া সভ্যতা।
অনেকে ধারনা করেন আধুনিক ইরাক, তুরস্কের উত্তরাংশ, এবং ইরানের কিছু অংশ মেসোপোটেমিয়া সভ্যতার অন্তর্গত ছিল। এই সভ্যতা পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতা গুলোর মধ্যে অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা নামে পরিচিত।
মেসোপোটেমিয়া সভ্যতাকে কেন সভ্যতার আতুর ঘর বলা হয়
বিজ্ঞানীরা ধারনা করেন, প্রায় ১৬০০০ বছর আগে থেকেই মানুষ বসবাস শুরু করেছিল৷ খৃষ্ট পূর্ব ৩৫০০ – ৩০০০ অব্দের মধ্যে মেসোপোটেমিয়া সভ্যতার সর্বচ্চ বিকাশ হয়েছিল। মেসোপোটেমিয়া সভ্যতা সভ্যতার আতুরঘর নামে পরিচিত। কারন এই সভ্যতার হাত ধরেই সময় তথা মিনিট নির্ধারন, বছর হিসেব এবং বীজ গনিত ও পাটি গনিত এর মত গুরুত্বপূর্ণ অংক আবিষ্কার হয়।
খৃষ্টপূর্ব ১৫০ বছর পূর্বে মেসোপটেমিয়া সভ্যতা যদিও পারশিয়ানদের নিয়ন্ত্রনে ছিল পরে রোমান দের সাথে যুদ্ধে পারশিয়ানরা যুদ্ধে হেরে যায়। ফলে মেসোপোটেমিয়া সভ্যতা রোমানদের দখলে আসে। কিন্তু পরে আবারো পারশিয়ানরা এই অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে নেয় এবং সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত রোমানরা শাসন করে। এরপরে শুরু হয় মুসলিম শাসনামল। মুসলিমদের শাসনামলে এই অঞ্চল ইরাক নামে পরিচিতি লাভ করে।
মেসোপোটেমিয়া সভ্যতায় প্রাকৃতিক কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকায় বিভিন্ন সময়ে আক্রমনের শিকার হয়। বিভিন্ন সময়ে আক্রমনের শিকারের ফলে কয়েকটি এই সভ্যতায় কয়েকট সভ্যতার উন্মেষ ঘটে। উত্তর অংশের নাম আ্যসিরীয় দক্ষিন অংশের নাম ব্যবিলনীয়। ব্যাবলনীয়ের উত্তরে আক্কাদ এবং সুমের নামে বিভক্ত ছিল। এই দুটি অংশই ছিল মেসোপোটেমিয়া সভ্যতার মূল অংশ।
অধিবাসী
মেসোপোটেমিয়া সভ্যতা শুরুর প্রথম দিকে অধিবাসীরা পর্বতের পাদদেশে বাস করা শুরু করেছিল। কিন্তু সেই পাদদেশে বাস করা ছিল বিপদজনক কারন তখন প্রাকৃতিক দূর্যোগ এর কারনে পাহাড় ধ্বসে মানুষ মরে যেত। তাই অধিবাসীরা ৯০০০ অব্দের দিকে মেসোপোটেমিয়ার দক্ষিন দিকে চলে যায়। দক্ষিন দিকে স্থানান্তরিত হওয়ার পর এখানেই গড়ে ওঠে তাদের বসতি। সেখানে পাথর না থাকলে নদীর কারনে সেখানকার মাটি ছিল অত্যন্ত উর্বর। উর্বর মাটিতে ভাল ফষল ফলার কারনে কৃষি কাজের জন্য তারা দক্ষিনাঞ্চল কে বেছে নেয়।
৭- ৬ সহস্রাব্দের দিকে তারা কৃষি কাজ করার পাশাপাশি গরু, ছাগল, ভেড়া পালন শুরু করে। নদীর উর্বর অংশে যে ধরনের গাছ গাছালি জন্মাত সেগুলো দিয়ে তারা কুড়েঘর বানিয়ে বাস করত। বেচে থাকার জন্য প্রতি মুহূর্তে প্রতিটি দিন সংগ্রাম করত তারা। কারন প্রাকৃতিক জলোচ্ছাস, বন্যা, ভূমিকম্পের কারনে তাদের ঘর বাড়ি, ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হত। আবার বুনো পশুর আক্রমনে গৃহপালিত পশুর ক্ষতি করত অনেক সময় নিজেরাও জীবন হারাত।
হিংস্র পশুর আক্রমন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সবাই মিলে উচু উচু প্রাচীর বানিয়ে সুরক্ষা ব্যবস্থা করত। এভাবেই তারা সংগ্রাম করে গড়ে তুলেছিল পৃথিবীর অন্যতম সেরা সভ্যতা মেসোপোটেমিয়া।
অর্থনৈতিক অবস্থা
মেসোপোটেমিয়া সভ্যতায় সবার প্রধান পেশা ছিল কৃষিকাজ এবং পশুপালন করা৷ পাশাপাশি তারা বস্ত্র শিল্পেও ভাল উন্নতি সাধন করেছিল। সেই সময় নদীর আশেপাশের অঞ্চল ছাড়া বাকি এলাকা গুলো মরুভূমির মত ছিল।৷ যার কারনে সেখানে অন্য ফষল তেমন ফলত না। তাই তারা খেজুর গাছ রোপন করত। খেজুর গাছ থেকে তারা বেশি লাভবান হতেন। কারন খেজুর দিয়ে আটা বানিয়ে খেত, খেজুরের ডাল জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করত। এরকম উপকারীতার জন্য তারা খেজুর গাছ কে প্রান বৃক্ষ বলে ডাকত।
এছাড়াও খেজুর গাছের ছাল থেকে তারা দড়ি বানিয়ে গরু ছাগল বাধার কাজ করত। তারা এই খেজুর দিয়ে বানিজ্য করত প্রতিবেশী দেশ গুলোর সাথে। খেজুরের আটা বা রসের বিনিময়ে তারা বিভিন্ন ধাতু নিত। যেগুলো দিয়ে পরবর্তীতে বিভিন্ন তৈজসপত্র বানাত। ইতিহাস বলে প্রথম সুমেরীয়রাই শহর কেন্দ্রিক বানিজ্য শুরু করেন।
ধাতুর ব্যবহারেও তারা অনেক এগিয়ে ছিল। তারাই প্রথম ব্রোঞ্জ এবং লোহার ব্যবহার শুরু করেন। খৃষ্টপূর্ব আড়াই হাজার বছর পূর্বে তামা ও লোহা ব্যবহার করে বিভিন্ন ধাতব দ্রব্য বানান তারা। মেসোপোটেমিয়া সভ্যতার মন্দির এবং অন্যান্য স্থান থেকে যে ধরনের বাসন কোসন পাওয়া যায় সেগুলো পর্যবেক্ষন করে দেখা যায় তারাই প্রথম তামা ও টিনের সংমিশ্রণে ব্রোঞ্জ আবিষ্কার করেন। শুধু তাই নয় মেসোপোটেমিয়ান সভ্যতাই ১৬০০ বছর পূর্বে প্রথম কাচ আবিষ্কার করেছিল।
উড়ুক শহর
খৃষ্টপূর্ব ৩০০০ বছর পূর্বে সুমেরীয়রা পুরো মেসোপোটেমিয়ায় রাজত্ব শুরু করে। তখন কোনো রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা না থাকার পরেও সকল শহর সমান সুযোগ সুবিধা পেত। ইরিদু, নিপ্পুর, লাগাশ, উড়ুক, কিশ শহরগুলো তে কোনো সরকার ব্যবস্থা ছিলনা। অবাক করার মত বিষয় হচ্ছে সরকার ব্যবস্থা না থাকার পরেও সবাই সমান সুবিধা ভোগ করত।
উড়ুক শহর নগর ও শহর ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করত। উড়ুক শহর ৬০০০ জায়গা নিয়ে পৃথিবীর সব চেয়ে বড় শহর নামে পরিচিত ছিল। আয়তনেই যে শুধু বড় ছিল তা নয়। জনসংখ্যার দিক দিয়েও অনেক এগিয়ে ছিল। প্রায় ৬০০০০ থেকে ৮০০০০ জনসংখ্যা ছিল উড়ুক শহরে।
শ্রেনিবিন্যাস
মেসোপোটেমিয়া সভ্যতায় ধনী গরীবের বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। যারা যুদ্ধে গৃহবন্দি হত তাদের দাস দাসি বানানো হত এবং অত্যাচার করা হত। তারা মনিবদের এত ভয় পেত যে তাদের কথার অবাধ্য হতে পারত না।
সেই সময়ের আর একটি ব্যপার লক্ষনীয় হচ্ছে চড়া দামে কৃষকদের সুদ দেয়া হত। সেই সুদ বেশিরভাগ কৃষকরা শোধ করতে পারত না। ফলে পুরো পরিবার মনিবের দাস হয়ে যেত। যেসব কৃষকদের জমি ছিলনা তারা জমিদারের জমিতে চাষ করত এবং নিজের ফসলের বেশিরভাগই জমিদারকে দিয়ে দিত।
শাসনব্যবস্থা
ব্যবিলন সম্রাজ্যের সম্রাট হাম্বুরাবি মেসোপোটেমিয়ান শাশন ব্যবস্থার শাসক হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি ৪২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন( ১৭৯২- ১৭৫০)। তিনি ছিলেন অত্যন্ত কুটনৈতিক বুদ্ধি সম্পন্ন একজন সম্রাট৷ ব্যবিলনের ধন সম্পদ কে কাজি লাগিয়ে গড়ে তুলেছিলেন বিশাল বড় সৈন্যবাহিনী। সুযোগ বুঝে তার মিত্রপক্ষ দেশের উপর ঝাপিয়ে পড়ে সবকিছু লুন্ঠন করে নিতেন। তার এই সুক্ষ বুদ্ধির কাছে সবাই হার মেনে নিত। যার কারনে এক সময় পুরো মেসোপোটেমিয়া তার হাতের মুঠোয় চলে আসে।
হাম্মুরাবি নিজেই কিছু আইনের ব্যবস্থা জারি করেন যা ইতিহাসে হাম্বুরাবি কোড বলে পরিচিত। এই কোডের বিশেষত্ব ছিল প্রতিটি অন্যায়ের জন্য আলাদা আলাদা শাস্তি লেখা থাকত। এই হাম্বুরাবি কোড মানতে সবাই কে বাধ্য করা হত। না মানলে তাদের জন্য ছিল কঠিন সব শাস্তি। এই নীতিমালা গুলোকে স্থায়ী করার জন্য পাথরে খোদাই করা হয়েছিল। এই কোডে প্রায় ২৮২ টি নীতিমালা ছিল। কিছু আইন এমন ছিল যেমন:
- মন্দিরের দেব দেবি যে চুরি করবে সেই চোর এবং যে কিনবে বা যার কাছে পাওয়া যাবে তাদের দুজনকেই মৃত্যুদন্ড দেয়া হবে।
- কেউ যদি দাসি হরন করে তার জন্য রয়েছে মৃত্যুদন্ডের বিধান।
- কোনো দাস পালালে বা তাকে যদি কেউ তাকে আশ্রয় দেয় তার শাস্তি মৃত্যুদন্ড।
- যদি কোনো ব্যক্তি টাকা ধার করে সেটা ফেরত দিতে ব্যর্থ হয় তাহলে তার পরিবার অর্থাৎ স্ত্রী এবং সন্তান মালিকের কাছে তিন বছর দাস জীবন যাপন করতে হবে।
লিপিকথন
মেসোপোটেমিয়ায় লিপির ব্যবহার শুরু হয়েছিল চতুর্থ সহস্রাব্দে। তারা মৃত্তিকাফলকে লেখালিখি করত৷ এটেল মাটি দিয়ে শ্লেট বানিয়ে সেগুলো রোদে শুকিয়ে লেখালিখি করত। মেসোপোটেমিয়ানরা যে ভাষায় কথা বলত তাকে সিমেটিক ভাষা বলা হয়। এই ভাষার মাধ্যমে তারা একে অন্যের সাথে আলাপ আলোচনা বা ভাব আদান, বিজ্ঞান চর্চা করত।
মেসোপোটেমিয়ান সভ্যতারা প্রয়জনীয় তথ্য আদান প্রদান করার জন্য আদিম লেখন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। প্রথম দিকে ভাষা বোঝানোর জন্য কিছু অর্থবোধক ছবি ব্যবহার করা হত। চিত্রধর্মী এই লিখন পদ্ধতিকে বিজ্ঞানীরা পিকটোগ্রাফী বলে থাকেন। মেসোপোটেমিয়ানরা কাদামাটিতে গুরুত্বপূর্ণ লেখা লিখে সেগুলো রোদে শুকিয়ে নিত। তখনকার লেখা গুলো শুধু হিসেব করার জন্য ব্যবহার করা হত। সুমেরীয়রাই প্রথম দপ্তরীর দলিল আবিষ্কারক।
জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা
মেসোপোটেমিয়ান সভ্যতা কৃষি ক্ষেত্রে অনেক অগ্রসর হয়েছিল । কৃষকরা যে ফসল উৎপাদন করত তা মন্দিরে জমা দেয়ার রেওয়াজ ছিল। ফলে মন্দিরের পুরোহিতরা হিসেব বা মনে রাখার জন্য পাহাড়ের গায়ে দাগ কেটে মনে রাখত। সময়ের সাথে সাথে হিসেবের গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়৷ আর সেখান থেকেই উদ্ভাবন হয় গনিত শাস্ত্রের।
বর্তমানে যে গনিত ছাড়া আমরা কোনো কিছুই কল্পনা করতে পারিনা। যেমন বিভিন্ন আয়তনের জমির ক্ষেত্রে ফসল উৎপাদন এর হিসেব, যেহেতু সুদের প্রচলন ছিল সুদের হিসেবের অংক, পাহাড়ের ঢালের গভীরতা নির্নয় ইত্যাদি। এছাড়াও পাটি গনিতের বিভিন্ন অংক যেমন পুকুর খনন বা বন্ধ করার অংক, জ্যামিতির বর্গ, ত্রিভূজ, ঘনমূল, ঘনসংখ্যা, ইত্যাদি আবিষ্কার করেছিল মেসোপোটেমিয়ানরা। মেসোপোটেমিয়াদের সংখ্যা কে ষাষ্ঠিক বলা হত। ষাষ্ঠিক বলতে ষাট কে বোঝানো হয়।
সময়, দিন, মাস, বছর গননা
চাঁদ এবং সূর্যের গতিবিধি লক্ষ্য করে তারাই প্রথম দিন মাস বছর গননা শুরু করেন। গ্রহ এবং নক্ষত্রের গতিবিধির দ্বারা তারা পঞ্জিকা তৈরি করেছিলেন। সেখান থেকেই এক ঘন্টায় ষাট মিনিট, ষাট সেকেন্ডে এক মিনিট এবং ঘন্টা উদ্ভাবন হয়।
মেসোপোটেমিয়া সভ্যতার হাত ধরেই বার মাসে এক বছর গননা করা শুরু হয়। তারাই ত্রিশ দিন সমান এক মাস হিসেব শুরু করেন। সম্পদ কিভাবে রাষ্ট্র, মন্দির এবং জনগনের মধ্যে ভাগ করা হবে তা হিসবে করার জন্য গনিতের প্রয়োজন ছিল। টাকা এবং পন্য হিসেব করার জন্য তারাই প্রথম পাটি গনিত এবং বীজ গনিতের আবিষ্কার করেন। তারাই প্রথম পৃথিবীকে ৩৬০ ডিগ্রিতে ভাগ করার কথা ভাবেন।
শুভ অশুভ দিন গননার প্রচলন
বিজ্ঞানীরা ধারনা করেন তারাই প্রথম রাশি চক্রের আবিষ্কার করেন। মেসোপোটেমিয়া সভ্যতার লোকেরা শুভ ও অশুভ দিন ঠিক করার জন্য প্রথম গ্রহ এবং নক্ষত্রের ব্যবহার শুরু করেন। তখন টেলিস্কোপ আবিষ্কার না হওয়ায় খালি চোখে তারা গ্রহ এবং নক্ষত্র দেখে শুভ বা অশুভ দিন ধার্য করত। তারাই প্রথম গ্রহ নক্ষত্র দেখে ত্রিশ দিনে এক মাসের হিসেব বের করেন এবং সাত দিন সমান এক সপ্তাহের ধারনা আনেন।
পৃথিবীকে উন্নত করতে চাকার ভূমিকা কত অনস্বীকার্য আমরা সবাই জানি৷ সেই চাকা আবিষ্কার করেছিল মেসোপোটেমিয়ান আদিবাসীরা। তবে তারা সেই চাকা তারা খাল খনন বা দালান নির্মানের কাজে ব্যবহার করতেন।
সাহিত্য
মেসোপোটেমিয়ান রা সেই আদিম যুগেও সাহিত্য চর্চা করত। সাহিত্যে লেখার কাজে যে ভাষা ব্যবহার করা হত বিজ্ঞানীরা সেই ভাষাকে হেমেটিক ভাষা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বিখ্যাত লেখক হোমার যে অন্ধ বলে খ্যাত ছিলেন তার ইলিয়ড লেখার ১০০০ বছর পূর্বেই তারা নিজেদের ভাষায় সাহিত্য চর্চা শুরু করেছিল। সেই সময় গিলগামেশ নামে মহাকাব্য রচনা করেছে৷ এই লেখাই প্রমান করে তারা কত বেশি চিন্তা প্রবন ছিলেন।
তাদের লেখার মধ্যে পরলৌকিক চিন্তা ভাবনাও লক্ষ্য করা যায়। আতুরঘর নামে খ্যাত মেসোপোটেমিয়ান সভ্যাতার হাত ধরেই আধুনিক শাসন ব্যবস্থা শুরু হয়। গনতান্ত্রিক চিন্তা ভাবনার শুরু হয়েছিল এই সভ্যতার হাত ধরে৷ গিলগামেশ রচিত হয়েছিল গিলগামেশ এবং তার বন্ধু এনকিদুকে নিয়ে। গিলগামেশ মহাকাব্য অমরত্ব অর্জন এবং বন্ধুত্বের গভীর মমত্ববোধের কাহিনী নিয়ে রচিত হয়েছে। এই মহাকাব্যে উড়ুক শহরের বর্ননা দেয়া আছে।
স্থাপত্যশিল্প
টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেতিস নদীর তীরে মেসোপোটেমিয়া সভ্যতা গড়ে ওঠায় তারা কাদামাটি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র তৈরি করত৷ সেই সময় নিরাপত্তার জন্য উচু জায়গায় রাজপ্রাসাদ বানানো হত এবং সেখানকার মূল ফটক পার হলেই চোখে পড়ত দৃষ্টিনন্দন বিশাল বিশাল মূর্তি। মূর্তি গুলোও ছিল ভয়ংকর। কখনো দেখা যেত মানুষের মাথা, বাঘের মাথা বা শুধু ডানা। মানুষ, পশু অথবা পাখির সংমিশ্রণে বানানো হত অদ্ভুত মনষ্টার।
বড় বড় রাজপ্রাসাদের দেয়ালে দেখা যেত নানা রকমের নজর কাড়া ফুল প্রকৃতির ছবি। দেয়ালে পাথর কেটে কেটে বানানো হত মূর্তি যেগুলোকে রিলিফ বলা হয়। সেই সময়ের বীর, দেবদেবীর মূর্তি বানানো হত দেয়াল কেটে।
জিগুরাত
সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ একটি স্থাপত্য হচ্ছে জিগুরাত। এটা প্রায় পিরামিডের সমান উচু ছিল। এই স্থাপত্যশিল্প টি প্রতিবাদ স্বরুপ বানানো হয়েছিল। সমাজের শাসক শ্রেনির পুরোহিতদের চেয়ে সাধারন শ্রেনির মানুষ বেশি ধর্ম নিবেদিত বোঝাতে বানানো
হয়েছিল। অনেকে ধারনা করেন খৃষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দ পুর্বে জিগুরাত বানানো হয়েছিল। অনেকে এটাকে স্বর্গ মর্ত্যের সংযোগ স্থল বলে থাকেন।
ইশতার তোড়ন নির্মান হয়েছিল প্রেম ও যৌনতার দেবীর জন্য। ইশতার তোড়ন ব্যবিলন শহরের প্রবেশদ্বার৷ এটাকে সাজাতে নীল রঙের দেয়াকে সিংহ, ষাড় ও ড্রাগন দিয়ে নকশা করা হয়েছিল। ফটকের ষাড় ও ড্রাগন আরদুক ও আদাদ কে নির্দেষ করে।
ঝুলন্ত উদ্যান
ব্যবলনের ঝুলন্ত উদ্যান এখনো সবার কাছে অনেক পরিচিত একটি পর্যটন কেন্দ্র। অনেকে ধারনা করেন নেতা নেবুচাদনেজার তার সম্রাজ্ঞীর একাকিত্ব কাটানোর জন্য ঝুলন্ত উদ্যান নির্মান করেন।ইউফ্রেতিস নদীর অববাহিকায় ৬০০ খ্রীষ্টপূর্বে এটি নির্মান করা হয়। প্রায় চার হাজার শ্রমিকের প্রচেষ্টায় এটি নির্মান করা হয়। সেই সাথে রয়েছে বিস্তর বাগান যা মরুভূমিতে মাটি ফেলে বানানো পাহাড়ের উপর। পুরো ঝুলন্ত উদ্যান এবং বাগান বানানো হয়েছিল শিল্পীর সুপরিকল্পিত বিজ্ঞান ও গনিতের ছোয়ায়।
ধর্মবিশ্বাস
মেসোপোটেমিয়ান যুগে ধর্মভীরু অনেক মানুষ ছিলেন। মেসোপোটেমিয়া সভ্যতার মানুষদের বিশ্বাস
মেসোপোটেমিয়া সভ্যতার আদিবাসীরা বিশ্বাস করত পৃথিবী গোলাকার বা একটি গোল চাকতির মত। স্বর্গ এবং নরক মাটির নিচে অবস্থান করছে। তারা বিশ্বাস করত পৃথিবী জল দিয়ে তৈরি এবং জল পৃথিবীকে চারপাশ দিয়ে ঘিরে রয়েছে। প্রাচীন মেসোপোটেমিয়ার সভ্যতার আদিবাসীরা ঈশ্বরকে বিশ্বাস করত এবং সময়ের সাথে সাথে তাদের বিশ্বাস পরিবর্তন হয়।
মেসোপোটেমিয়ানরা সেই সময় বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা করত বলে প্রমান পাওয়া যায়৷ ধর্ম পালনের দিক দিয়ে মেসোপোটেমিয়া সভ্যতার লোকেরা অনেক এগিয়ে ছিল। সেই আদি সভ্যতায়ও মানুষের মধ্যে শ্রেনি বৈষম্য লক্ষ করা যায়। মন্দিরে পূজা করার জন্য আসন গুলো শ্রেনি অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছিল৷ অর্থাৎ যারা শ্রেনিগত ভাবে অনেক উঁচু স্থানে ছিল তাদের বসার জায়গা এবং যারা মধ্যম না নীচু জাতের ছিল তাদের বসার জায়গা ভিন্ন ছিল।
মেসোপোটেমিয়া সভ্যতা প্রাচীন কালে কোনো ধরনের প্রযুক্তি বা আধুনিক জিনিসের সুবিধা ছাড়াই যে উন্নতি সাধন করেছে তা ভাবলে অবাক হয় মানুষ। পৃথিবীর ইতিহাসে বিষ্ময়কর একটি সভ্যতার নাম মেসোপোটেমিয়া সভ্যতা৷ যা আমাদের সভ্যতাকে আলো দেখিয়ে আধুনিক সভ্যতা হিসেবে গড়তে সাহায্য করেছে। সত্যিই মেসোপোটেমিয়া সভ্যতা এবনফ এই সভ্যতার অধিবাসীরা আজীবন ইতিহাসের পাতায় পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত জ্বলজ্বল করবেন।
আরো পড়ুন –