প্রকৃতির অফুরন্ত ভান্ডার থেকে প্রতিনিয়ত নানা রকম পুষ্টিগুন সমৃদ্ধ খাবার সংগ্রহ করে আমরা সুস্থ থাকি। এই অফুরন্ত ভান্ডারের অনেক উপাদান আছে যেগুলোর বিস্ময়কর গুনাবলি আমরা অনেকেই জানিনা। সেরকম একটি বিস্ময়কর উপাদানের নাম হচ্ছে আখরোট। যাতে রয়েছে প্রচুর পরিমান আয়রন,খনিজ এবং ভিটামিনের উৎস। যা মানবদেহের শরীর এবং ত্বকের সুস্থতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চলুন জেনে নেয়া যাক বিস্ময়কর আখরোট কি এবং এর পুষ্টিগুন সহ নানান রকম উপকারিতা-
আখরোট কি?
আখরোট বাদাম জাতীয় এক প্রকার দানাদার খাবার এর ইংরেজি নাম Walnuts. দেখতে কিছুটা মস্তিষ্কের আকারের মত এই আখরোট বাদামি এবং কালো দুই প্রকারের হয়ে থাকে। এটি juglans গোত্রীয় উদ্ভিদ।
আখরোটের পুষ্টিগুন এবং উপাদান:
আখরোট এর মধ্যে ৬৫% চর্বি এবং ১৫% প্রোটিন রয়েছে৷ এছাড়াও রয়েছে এন্টি অক্সিডেন্ট, ফাইবার, প্রোটিন, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, ওমেগা -3 ফ্যাটি এসিড, ফসফরাস ও ভিটামিন বি-৬ সহ নানা রকম পুষ্টিগুন সমৃদ্ধ উপাদান যা মানব শরীরের জন্য অত্যাবশকীয়।
উপকারিতা:
১।মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে:
আখরোটে থাকা ফ্যাট এসিড, ডি এইচ এ ও অন্যান্য উপাদান মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়, বয়স জনিত স্নায়ু ক্ষয় রোধে সাহায্য করে এর ফলে মস্তিষ্কের অক্সিডেটিভ চাপ কমে এবং স্মৃতি শক্তি উন্নত হয়।
২। হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়:
আখরোটে থাকা ওমেগা-3 ফ্যাটি অ্যাসিড হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে ও কার্ডিওভাস্কুলার সিষ্টেমের জন্য অনেক উপকারী। ওমেগা-3 ফ্যাটি অ্যাসিড এর কাজ রক্তচাপ কমানো যার ফলে আখরোট নিয়মিত খেলে সেই ব্যক্তির রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে থাকে। হৃদপিণ্ডের অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমিয়ে রক্ত জমাট বাঁধা কমায় ফলে হৃদ রোগের ঝুকি কমে। আখরোটে ওমেগা-3 ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ফাইবার থাকায় LDL কোলেস্টেরল (খারাপ কোলেস্টেরল) কমায় এবং HDL কোলেস্টেরল (ভাল কোলেস্টেরল) বাড়ায়।
৩। রক্তচাপ কমায়:
আখরোট রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে কারন আখরোটে উপস্থিত ওমেগা-3 ফ্যাটি অ্যাসিড এবং পটাশিয়াম রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।
৪। ওজন নিয়ন্ত্রণ করে:
অনেকের ধারনা আখরোটে থাকা ফ্যাট শরীরের ওজন বাড়াতে সাহায্য করে। কিন্তু আখরোট মুলত ওজন নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে। আখরোটে থাকা ফাইবার মানব শরীরের হজম শক্তি এবং লিপিড পরিপাক করার ক্ষমতাকে উন্নত করে। এতে থাকা ওমেগা 3 ফ্যাটি এসিড এবং প্রোটিন ওজন নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে। আখরোট খেলে দীর্ঘ সময় পেট ভরা থাকে ফলে ক্ষুধা কমে যায় এবং অতিরিক্ত খাবার প্রবনতা কমিয়ে শরীরের বাড়তি ওজন কমিয়ে দেয়। আখরোট আপনাকে কম ক্যালোরি গ্রহণ করতে সাহায্য করে। তাই ওজন কমাতে আখরোট এর জুরি মেলা ভার।
৫। ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে সাহায্য করে:
সুস্থ ত্বকের জন্য ভিটামিন বিবেবং এন্টি অক্সিডেন্ট অনেক প্রয়জনীয় একটি পুষ্টি উপাদান। আখরোটে থাকা ভিটামিন বি এবং এন্টি অক্সিডেন্ট ত্বককে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। বয়সের সাথে সাথে মানুষের ত্বকে বলিরেখা দেখা দেয়৷ মূলত বয়সের সাথে সাথে ত্বকে ফ্রি রেডিকেল নামক একটি উপাদান বেড়ে যায়। নিয়মিত আখরোট খেলে ফ্রি রেডিকেল কে নিয়ন্ত্রণ করে ফলে ত্বকের বলিরেখা কমে, বয়সের ছাপ কমে এবং ত্বককে উজ্বল রাখে।
৬। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রন করে:
বর্তমান সময়ে টাইপ টু ডায়াবেটিস একটি আতংকের নাম। আখরোটে রয়েছে ওমেগা-3 ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ফাইবার যার ফলে নিয়মিত আখরোট খেলে ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়িয়ে তোলে এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। চিকিৎসকদের মতে যারা নিয়মিত আখরোট খায় তাদের অন্যদের তুলনায় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুকি কম থাকে।
৭। অনিদ্রা দূর করে:
যারা অনিদ্রা সমস্যা ভুগছেন তাদের জন্য আখরোট হতে পারে অন্যতম সমাধান। মানুষের ভাল ঘুমের জন্য মেলাটোনিন নামক একটি উপাদান বিশেষ ভূমিকা পালন করে। শরীরে পর্যাপ্ত পরিমান মেলাটোনিন থাকলে ঘুম ভাল হয়। আখরোটে রয়েছে বিপুল পরিমান মেলাটোনিন তাই যারা নিয়মিত আখরোট খায় তাদের শরীরে মেলাটোনিন যথেষ্ট পরিমান থাকায় অনিদ্রা সমস্যা হয়না। ঘুম ভাল হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় তাই নিয়মিত গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে চাইলে নিয়মিত আখরোট খান এবং শরীর কে সুস্থ রাখুন।
৮। ক্যান্সারের ঝুকি কমায়:
আখরোটে ওমেগা 3 এসিড,পলিফেননস ও অন্যান্য উপাদান প্রচুর পরিমানে লাওয়া যায়। এই উপাদান গুলোর এন্টি ক্যান্সার বৈশিষ্ট রয়েছে যা ক্যান্সার দূর করতে সাহায্য করে। বিশেষ করে কোলন ক্যান্সার এবং স্তন ক্যান্সারের জন্য আখরোট অনেক ভাল একটি উপাদান। “আমেরিকান ক্যান্সার এসোসিয়েশন” এর প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতিদিন তিন থেকে চারটি আখরোট খেলে স্তন ও কোলন ক্যান্সারের ঝুকি অনেকটাই কমে যায়।আখরোটে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি এবং বিস্তার রোধ করে।
৯। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে:
যেহেতু আখরোট একটি সুপার ফুড তাই নিয়মিত আখরোট খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। আখরোটে থাকা ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ যেমন তামা এবং ভিটামিন বি সিক্স শরীরের ইমিউনিটি কে বৃদ্ধি করে দেয়।
১০। শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটায়:
আখরোটে থাকা ভিটামিন ই, মেলাটোনিন, ওমেগা 3, ফ্যাটি এসিড এগুলো শিশুর মস্তিষ্ক গঠনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তাই ছোটবেলা থেকে শিশুর খাদ্য তালিকায় আখরোট রাখলে অন্য শিশুদের তুলনায় আখরোট খাওয়া শিশুদের মস্তিষ্ক ভালভাবে বিকশিত হয় এবং স্মৃতি শক্তি অন্য শিশুদের তুলনায় ভাল হয়। আখরোট বয়স্ক মানুষদের স্মৃতি শক্তি স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে।
১১। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে:
আখরোটে থাকা ফাইবার এবং ম্যাগনেশিয়াম উচ রক্ত চাপ নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে। আপনি যদি নিয়মিত আখরোট খান তাহলে আপনার উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে রেখে আপনার হার্টকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে।
১২। শুক্রানুর মান বজায় রাখে:
পুরুষ দেহের জন্য শুক্রাণু অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। কারন শুক্রানুর মান ঠিক না থাকলে সেই পুরুষ সন্তান জন্মদানে অক্ষম হয়ে থাকে। খাদ্য তালিকায় নিয়মিত আখরোট রাখলে তা শুক্রানু এবং বীর্যের উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। প্রতিদিন মধুর সাথে আখরোট খেলে সুফল পাওয়া যায়। এক গবেষণায় দেখা গেছে আখরোটে থাকা এন্টি অক্সিডেন্ট শরীরের এন্টি অক্সিডেটিভ চাপ কমায় ফলে যৌন সমস্যা দূর হয়। ১১৭ জন স্বাভাবিক সুস্থ পুরুষ দের নিয়ে একটি পরিক্ষা করা হয়। তাদের ৭৫ গ্রাম কিরে আখরোট খেতে দেয়া হয়েছিল। গবেষণা থেকে দেখা যায়, ৭৫ গ্রাম আখরোট দৈনিক খাওয়ার ফলে তা শুক্রাণুর আকার, গতিশীলতা এবং জীবনীশক্তি তিন মাসের মধ্যে বাড়িয়ে তুলেছে।
১৩।হাড় মজবুত করে:
আখরোটে থাকা আলফা-লিনোলেনিক অ্যাসিড এবং ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড হাড়ের ক্ষয় রোধে সাহায্য করে। হাড়ের দূর্বলতা, হাড় ক্ষয় এবং হাড়ের অন্যান্য সমস্যা থাকলে নিয়মিত আখরোট খেলে সেই সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে।
১৪। গর্ভাবতী মায়ের সুস্থতায় সাহায্য করে:
ভিটামিন বি কমপ্লেক্স যেমন ফোলেট, রাইবোফ্লাভিন এবং থিয়ামিন এগুলো গর্ভবতী মায়েদের জন্য প্রয়জনীয় একটি উপাদান। তাই চিকিৎসকেরা প্রেগন্যান্সির সময় ভিটামিন বি জাতীয় ওষুধ বা খাবার দিয়ে থাকে। নবজাতক এবং এবং মায়ের সুস্থতার জন্য নিয়মিত আখরোট খেলে মা ও নবজাতক সুস্থ থাকে।
১৫। চুলপড়া কমাতে সাহায্য করে:
আখরোটে রয়েছে বায়োটিন বা ভিটামিন বি ৭। যাদের চুল কোকড়া তারা নিয়মিত আখরোট খেলে চুল সোজা রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও আখরোটে থাকা জিংক, ম্যাগনেশিয়াম, খনিজ চুল পড়া কমাতে সাহায্য করে।
১৬। দুশ্চিন্তা কমায়:
আখরোটে থাকা উপাদান দুশ্চিন্তা কমাতে সাহায্য করে। আখরোটে থাকা লাইলোনিক এসিড, ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড, ফাইবার ইত্যাদি উপাদান মানুষের দূশ্চিন্তায় ব্যঘাত ঘটিয়ে রিলাক্স বা দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকতে সাহায্য করে। তাই যারা অতিরিক্ত চিন্তায় ভুগে থাকেন তাদের খাদ্য তালিকায় নিয়মিত আখরোট রাখলে দুশ্চিন্তা সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
১৭। আখরোট স্ক্রাবার হিসেবে ব্যবহার:
আখরোট রূপচর্চায় অনেক জনপ্রিয় একটি উপাদান। সপ্তাহে দুই থেকে তিনদিন আখরোট পেষ্ট করে দুধের সাথে ত্বকে লাগালে ত্বকের ব্ল্যাক হেডস দূর করতে সাহায্য করে এবং ত্বককে উজ্বল ও লাবন্যময় করে তোলে।
১৮।থাইরয়েড সমস্যা দূর করে:
আখরোটে রয়েছে থাইরক্সিন নামক উপদান যা থাইরয়েড সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। হালকা কুসুম গরম পানিতে আখরোট কিছুক্ষন ভিজিয়ে খেলে থাইরয়েড সমস্যায় ভাল কাজ করে।
১৯। অন্ত্রে থাকা মাইক্রোবায়োটা উন্নত করে:
একটি গবেষনায় ১৯৪ জন পুরুষ কে নিয়মিত ৪৩ গ্রাম করে আখরোট খেতে দেয়া হয়েছিল। আট সপ্তাহ পর ফলাফলে দেখা যায় নিয়মিত ৪৩ গ্রাম আখরোট
খাওয়ার ফলে তাদের স্বাস্থ্যকর প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া বাড়িয়ে তুলেছে ফলে সেই পুরুষদের হজম ক্রিয়া অন্যদের তুলনায় অনেক উন্নত।
আখরোটের অপকারীতা:
আখরোট যেমন শরীরের জন্য অনেক উপকারী তেমনি আখরোট বেশি মাত্রায় খেলে অপকারো হতে পারে। যেমন –
- যাদের এলার্জি সমস্যা আছে তাদের ক্ষেত্রে এলার্জি বেড়ে যায়।
- লিভারে সমস্যা হতে পারে।
- হজমে ব্যাঘাত হয়।
- শরীরের আয়রন হ্রাস পেতে পারে।
- গ্যাসের সমস্যা বেড়ে যেতে পারে।
- হিস্টামিনের মত অ্যালারজেন আখরোটে থাকার কারনে শরীর খারাপ হতে পারে
- হাপানি রুগিদের শ্বাসকষ্ট বেড়ে যেতে পারে
- বমিভাব ও ডায়রিয়া হতে পারে
আখরোট খাওয়ার নিয়ম:
গবেষকদের মতে দিনে চার থেকে পাচটি আখরোট খাওয়াই যথেষ্ট। বিভিন্ন ভাবে আপনি আখরোট খেতে পারেন। যেমন:
- আখরোটকে বেকিংয়ে ব্যবহার করতে পারেন। বিস্কিট বা কেকের সাথে খুব সুস্বাদু একটি খাবার।
- আখরোটকে সকালের নাস্তায়, স্ন্যাক হিসেবে বা বিভিন্ন রান্নায় ব্যবহার করুন।
- আখরোটকে তেল বা মাখন হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন।
- মধু বা দুধের সাথে সারা রাত ভিজিয়ে সকালে খেতে পারেন।
তাই নিয়মিত সুস্থ থাকতে হলে নিয়মিত পরিমিতভাবে আখরোট খান। উপরে বর্নিত উপায় অনুসরণ করে আপনি পেতে পারেন সুস্থ ও সুন্দর স্বাস্থ্য। প্রতিদিন মাঝারি পরিমাণে আখরোট সেবন করে উপভোগ করুন শরীরের বিস্ময়কর পরিনাম।