Dreamy Media BD

বখতিয়ার খলজি এর জীবনী ও অজানা ইতিহাস

বখতিয়ার খলজি

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি নামটা শুনলেই হাইস্কুলে পড়ার সময়কার কথা মনে পড়ে তাই না? আরো মনে পড়ে যায়, কিছু যুদ্ধের নীরস ইতিহাস। ইতিহাস বইয়ের পাতায় ইতিহাস কিছুটা বোরিং বা নীরস হলেও মূল ইতিহাস কিন্তু মোটেও রসহীন বা বিরক্তিকর হয়না। বিভিন্ন সময়ে ঘটা নানা যুদ্ধ, বিগ্রহ, লড়াই, ধ্বংস, উত্থান কিংবা পতনের সাথে জড়িয়ে থাকে চমকপ্রদ কিছু তথ্য, যা ইতিহাসকে করে তোলে বৈচিত্র্যপূর্ন এবং রসালো। 

বাংলা জয়ের ইতিহাসের সাথে এমনভাবেই জড়িয়ে আছে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির নাম, যিনি একজন তুর্কি সেনাপতি হয়ে ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ১৭ জন অশ্বারোহী সেনা নিয়ে নদীয়ার রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করেছিলেন। 

তুর্কি বংশোদ্ভূত মুসলিম খলজি উপজাতির একজন সদস্য হয়ে তিনি কিভাবে নিজের নাম ইতিহাসের পাতায় লিখিয়েছিলেন? মাত্র ১৭ জন সেনা নিয়ে খতিয়ার লক্ষ্মণ সেনের রাজপ্রাসাদ দখল করেছিলেন কিভাবে? পুরোনো সেই ইতিহাসের বিস্তারিত আজ আবার জানবো আমরা। 

পরিচয় ও কর্মজীবনের সূচনা

বখতিয়ার খলজির পুরো নাম মালিক গাজি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি। তিনি ছিলেন আফগানিস্তানের গরমশির এলাকার অধিবাসী। তার বাল্যকাল সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা না গেলেও ইতিহাস ঘাটলে এটুকু বোঝা যায় যে, তিনি ছিলেন একজন ভাগ্যান্বেষী সৈনিক। অভাবের তাড়নায় নিজ দেশ ছেড়ে তিনি কাজের সন্ধানে বের হন।

গজনির সুলতান মুহাম্মদ ঘুরির সেনাবাহিনীতে চাকরিপ্রার্থী হিসেবে যোগ দিতে চাইলেও তখনকার নিয়ম অনুযায়ী, সামর্থ্যের অভাবে সৈনিক হিসেবে নিজ ঘোড়া ও যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবস্থা নিজে করতে পারেননি। এছাড়াও আকারে খাটো, লম্বা হাত ও কুৎসিত চেহারার অধিকারী হওয়ায় তিনি সেখানে যোগদানে ব্যর্থ হন।

গজনিতে মুহাম্মদ ঘুরির সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে ব্যর্থ হয়ে তিনি দিল্লীর সম্রাট কুতুবউদ্দিন আইবেকের কাছে আসেন এবং সেখানেও ব্যর্থ হন। এরপর বদাউনে গিয়ে মালিক হিজবর-উদ-দীন এর অধীনে নগদ বেতনে চাকুরীতে ঢুকলেও তিনি তাতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। লক্ষ্য যার আকাশ ছোঁয়ার তার কি আর এতো ছোট কাজে পোষায়? তাই কিছুদিন বাদেই সেখান থেকে অযোধ্যায় চলে যান। 

অযোধ্যার শাসক হুসাম-উদ-দীন ছিলেন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ। তিনি বখতিয়ারকে সময় নিয়ে নিরীক্ষন করে তার প্রতিভা অনুধাবন করতে পারেন। শাসক হুসাম-উদ-দীন তাকে ভিউলী ও ভাগত নামে দুটি পরগনার জায়গীর প্রদান করে মুসলিম রাজ্যের পূর্বসীমান্তে সীমান্তরক্ষীর কাজে নিয়োগ করেন। এতোদিনে বখতিয়ার নিজের মনের মতো কাজ খুঁজে পান এবং নিজের ভবিষ্যৎ উন্নতির সম্ভাবনা দেখে সেই কাজেই স্থায়ী হয়ে যান। 

বাংলার ভাবী নায়ক

ভাগত আর ভিউলী হয়ে উঠে বখতিয়ারের প্রধান শক্তির জায়গা। নিজ গুনে তিনি কিছুদিনের  মধ্যে নিজের অধীনে কিছু সৈন্য জোগাড় করে নেন। সীমান্তে অবস্থান করায় তিনি আশেপাশের হিন্দু রাজ্যগুলির সংস্পর্শে আসেন। নিজ অধীনে থাকা সৈন্যদের নিয়ে সেই হিন্দু রাজ্যগুলোতে তিনি নিয়মিত আক্রমন এবং লুট শুরু করেন। এই হিন্দু রাজ্যগুলিতে আগে থেকেই তুর্কী আক্রমণের আতঙ্ক ছিলো ভয়াবহ। আবার পাশাপাশি দেশের মধ্যে তেমন সংঘবদ্ধতাও ছিলো না। এই সুযোগেরই সৎ ব্যবহার করেছিলেন বখতিয়ার।

পর পর ধারাবাহিক আক্রমণের সুবাদে বখতিয়ারের খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। তখনকার সেই সময়ে তারই মতো ভাগ্যান্বেষীরা, বিশেষ করে খিলজী সম্প্রদায়ভুক্ত যুবকরা মহাসমারোহে আনন্দের সাথে তার দলে নাম লেখাতে থাকে। এর ফলে দিনে দিনে বখতিয়ার খলজীর সৈন্যসংখ্যা আগের তুলনায় বাড়তেই থাকে।

অবশ্য তিনি কাউকেই ফেরাতেন না। যেই এসে বলতো সে তার হয়ে কাজ করতে চায় বখতিয়ার কিছু না ভেবেই তাকে নিজের দলে নিয়ে নিতেন। আসলে তখন বখতিয়ারের চিন্তা ছিলো কিভাবে দল ভারী করা যায়, লোকবলে শক্ত হওয়া যায়। ভাগ্যও যেন সেসময় তাকে খুব সাহায্য করতে থাকলো। 

উদন্তপুর বিহার জয়

নিজ সৈন্য নিয়ে এমনি একদিন হিন্দু রাজ্যগুলোতে লুটপাট চালানোর সময় বখতিয়ারের বাহিনী একটি বৌদ্ধবিহার জয় করে ফেলে। আসলে এই বিহার ছিল একটি মহাবিদ্যালয়। বখতিয়ারের বাহিনী একে ভুল করে সামরিক দুর্গ ভেবে পুরোপুরি গুঁড়িয়ে দেয়। তখন বিহারে অবস্থানরত ন্যাড়া মাথার যত সনাতনী ব্রাহ্মণ ছিলো, সবাইকে হত্যা করা হয়। বখতিয়ারের সৈন্য সামন্তের বিহার গুঁড়িয়ে দেয়ার পর যেন হুঁশ ফিরলো। তান্ডবের পর বিহারে প্রচুর বইপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখে তাদের বোধোদয় হলো যে তারা আসলে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে ফেলেছে।

এটিই ছিলো উদন্তপুর মহাবিহার, ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীন মহাবিদ্যালয়। এই বিহার জয়ের পর বখতিয়ার দিল্লিতে যান, কুতুবউদ্দিন আইবেকের সুনজর লাভের আশায়। সাথে নিয়ে যান কাড়ি কাড়ি অর্থ ও সোনাদানা। তার এই যাত্রা বিফলে যায়নি। কুতুবউদ্দিন আইবেক তাঁকে রাজকীয় সম্মানের মাধ্যমে অভিনন্দন জানান। বখতিয়ার মূলত এই বিহার জয় থেকেই বাংলা বিজয়ের অনুপ্রেরনা পান এবং লক্ষণ সেনের পেছনে লাগেন। 

Muhammad Bakhtiyar Khalji
Muhammad Bakhtiyar Khalji

বাংলা বিজয় নিয়ে পূর্ব ইঙ্গিত

১৩ শতকের দিকে বাংলায় রাজত্ব করতেন সেন বংশের রাজা লক্ষণ সেন। সেসময় নদীয়ায় বাস করাকালীন একদিন তার রাজ দরবারে, পন্ডিতরা তাকে বললেন, তাদের প্রাচীন গ্রন্থে নাকি লিখিত আছে যে বাংলা একদিন তুর্কীদের দখলে যাবে। 

তখন তো চারিদিকে তুর্কীদের জয়জয়কার। তারা ততদিনে সমগ্র উত্তর ভারত দখল করেছে এবং বখতিয়ার খিলজিও বিহার জয় করে ফেলেছেন। 

রাজা লক্ষণ সেন উৎসাহী হয়ে ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের কাছে জানতে চাইলেন, প্রাচীন সেই গ্রন্থে বাংলা আক্রমণকারীর কোনো বৈশিষ্ঠ্য সম্পর্কে কোনো ইঙ্গিত আছে কিনা। পন্ডিতগণ তাকে জানান, যে তুর্কী বাংলা জয় করবেন, তিনি আকৃতিতে খাটো এবং দেখতে কুৎসিত হবেন, তার হাতগুলো হাঁটু পর্যন্ত লম্বা হবে। আক্রমনকারীর বৈশিষ্ঠ্য শুনে রাজার বুঝতে বাকি থাকে না, কাকে ইংগিত করা হয়েছে। তবু তিনি বিশ্বস্ত লোক পাঠিয়ে নিশ্চিত হন যে, বিহারজয়ী বখতিয়ার খিলজীর সাথে উক্ত বিবরণগুলি হুবহু মিলে যায়। আক্রমন করার মতো এতো ক্ষমতা বখতিয়ারের হবে না ভেবে লক্ষণ সেন তা আর আমলে নেননি।

উপরোক্ত ঘটনা বিখ্যাত ঐতিহাসিক মিনহাজ-ই-সিরাজ এর তবকাত-ই-নাসিরি গ্রন্থে পাওয়া যায়। তবে এই ঘটনাটি সত্যিই ঘটেছিলো কিনা তার কোনো জোরালো প্রমান নেই। 

বাংলা বিজয়

তুর্কীদের বাংলা জয় নিয়ে পন্ডিতদের ইঙ্গিত আমলে না নিলেও সেন বংশের শেষ শাসক, রাজা লক্ষন সেন যখন বখতিয়ার ভীতিতে রাজধানী নদীয়ায় দুশ্চিন্তার দিন কাটাচ্ছিলেন, অন্যদিকে তখন বখতিয়ার খলজি নিজে হাতে গড়া সৈন্য সামন্ত নিয়ে বাংলা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। 

আমলে না নিলেও বখতিয়ারের বিহার জয়ের খবরে রাজ সেনানিবাসে বখতিয়ার ভীতি কাজ করছিলো অনেক আগে থেকেই। সেন বংশের দৈবজ্ঞ ও পুরোহিতরা লক্ষণ সেনকে বারবার সতর্ক করেছিলেন যেন তিনি পর্যাপ্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। নইলে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। জানা যায়, এই সতর্কবানীর পর ঐসব পুরোহিত নিজেরাও পালিয়ে যায় নদীয়া ছেড়ে। 

নদীয়ার পশ্চিম দিক থেকে বাংলা প্রবেশের একমাত্র পথ ছিল রাজমহলের নিকট তেলিয়াগড়ের গিরিপথ। রাজা লক্ষণ সেন পরিকল্পনামাফিক সেখানেই তার প্রতিরক্ষা বুহ্য গড়ে তোলেন এবং সৈন্য নিয়োজিত করেন। এদিকে চতুর বখতিয়ার রাজাকে বোকা বানিয়ে তেলিয়াগড় হয়ে না এসে ঝাড়খণ্ডের জংগলাকীর্ণ পথ বেছে নেন।

দুর্গম সব পথ পাড়ি দিয়ে এতো দ্রুতগতিতে এবং ক্ষিপ্রতার সাথে ঘোড়া নিয়ে খর্বাকৃতির বখতিয়ার ছুটে চলেছিলেন যে মাত্র ১৮ জন সৈন্য শেষপর্যন্ত তার সাথে মিলিত হতে পেরেছিল। সৈন্যদলের বাকিরা পড়ে গিয়েছিলো বেশ পেছনে। দলের সৈন্যদের মধ্যে এই দূরত্বে একদিকে শাপে বরই হয়েছিলো। এতে করে নগরবাসী সৈন্যদলকে ঘোড়া ব্যবসায়ী ভেবে কোন রকম বাধা দেয়ার চেষ্টা করেনি।

নগর রক্ষীদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে বখতিয়ার ভেতরে প্রবেশ করেন। বৃদ্ধ রাজা লক্ষন সেন তখন দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন। আক্রমণের খবর শুনে তিনি বিচলিত হলেন না, যেন আগে থেকেই জানতেন বখতিয়ার আসছে। বখতিয়ার তেলিয়াগড়ের প্রতিরক্ষা ভেদ করে পুরো বাহিনী নিয়ে চলে এসেছে ভেবে তিনি নিজেকে পরাজিত ধরে নিলেন এবং পেছনের দরজা দিয়ে নৌপথে পালিয়ে গেলেন বিক্রমপুরে। আর এভাবেই প্রায় বিনাযুদ্ধেই মাত্র ১৭-১৮ জন সৈন্য নিয়ে বখতিয়ার নদীয়া দখল করেন এবং সেখানে মাত্র তিনদিন ধরে লুটপাট চালায় তার বাহিনি। 

নদীয়া থেকে বখতিয়ার খলজি লক্ষণাবতীর দিকে রওনা হন এবং নাম পরিবর্তন করে রাখেন লখনৌতি। লখনৌতিতেই তিনি তার রাজধানী স্থাপন করেন এবং তারপরে গৌড় জয় করে উত্তরবঙ্গ নিজ অধিকারে নিয়ে আসেন। শাসনের সুবিধার্থে তিনি অঞ্চলগুলোকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে প্রতিটি ভাগে একজন করে সেনাপতি নিয়োগ করে সেখানকার শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেন। 

তিব্বত অভিযান

গৌড় জয়ের পর তুর্কিস্তানের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যেই বখতিয়ার তিব্বত জয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন, এমনটাই ধারনা করা হয়। কিন্তু তিব্বতের পথঘাট সম্পর্কে জানা শোনা না থাকার কারনে বখতিয়ারকে বিশেষ বেগ পেতে হয়। এরপর পথপ্রদর্শক হিসেবে মেচ উপজাতির একজনের সন্ধান পান তিনি। তিব্বতের পথঘাট সম্পর্কে ধারণা নিতে বখতিয়ার খলজী তাকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন এবং তার নতুন নাম দেন আলী মেচ। পরবর্তীতে পথপ্রদর্শক এই আলী মেচের সাহায্যের উপর নির্ভর করেই তিনি তিব্বত অভিমুখে যাত্রা করেন। এ সময় তার যাত্রা সঙ্গী ছিলো দশ হাজার সৈন্য। এই বিশাল পরিসর নিয়েই তিনি তিব্বতের উদ্দেশ্যে লখনৌতি ছাড়েন। 

তিব্বতে পৌছনোর আগে বর্ধনকোট নামক শহরে এসে বখতিয়ার বাহিনী প্রথম বাধার সম্মুখীন হয়। এ সময় কামরূপের রাজা বখতিয়ার খলজিকে তিব্বতের প্রতিকূল পরিবেশ সম্পর্কে সতর্ক করেন এবং তাকে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। বখতিয়ার রাজী না হলে তিনি আশ্বাস দেন, পরেরবার তিব্বত আক্রমণে তিনি বখতিয়ার খলজিকে সবদিক থেকে সাহায্য করবেন। 

কিন্তু বখতিয়ারের তখন বিজয়ের নেশা। তিনি কামরূপের রাজার কথা আমলে না নিয়ে শহরের উত্তর দিকে একটি সেতুর উপর ২ জন সেনাপতিকে পাহারাদার রেখে তিব্বতের পথে যাত্রা শুরু করেন।

১৫ দিন পর স্থানীয় তিব্বতিদের সাথে একটি খোলা প্রান্তরে যুদ্ধ হয় বখতিয়ারের বাহিনীর। এ যুদ্ধে বখতিয়ার বাহিনী জয়ী হলেও তাদের সৈন্যবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়। 

অদূরেই করমবত্তন নামক শহরে লক্ষাধিক সৈন্য প্রতিরোধের জন্য অপেক্ষমাণ- এই খবরে দিশেহারা হয়ে যায় বখতিয়ার বাহিনি। সৈন্য নিয়ে পিছু হটেন তিনি। আবারো নানা দুর্গম সব পথ পাড়ি দিয়ে সেই পাথরের সেতুতে পৌছালে তারা দেখেন সেতুটিকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে পাহাড়ী লোকেরা। হঠাৎ এই আক্রমণে দিশেহারা বখতিয়ার খলজী তার সেনাদের নিয়ে সাঁতরে নদী পার হন কোনোমতে। দশহাজার সেনা নিয়ে তিব্বতে রওনা হলেও মাত্র কয়েকজন নিয়ে ফিরতে পেরেছিলেন তিনি।  

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসে কি বখতিয়ারের হাত ছিলো?

ইতিহাসের পাতায় বখতিয়ার খলজি নামটা এলেই উঠে আসে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধবংসের ইতিহাস। তাই ইতিহাসের মুখরোচক বিষয় গুলোর একটি হচ্ছে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছিলেন বখতিয়ার খলজি। 

তবে এই মুখরোচক বিষয়টি যে একপাক্ষিক তা স্পষ্টতই বোঝা যায়। এটা শুধুই মুখের কথা নয়, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় মোট ধ্বংস হয় দুইবার। ব্রাহ্মণ্যবাদী ও বৌদ্ধদের দ্বন্দ্বই মূলত এই ধবংসের মূলে। এর মধ্যে ১ম বার, ৪৪৫-৪৬৭ খ্রিষ্টাব্দে স্কন্দগুপ্তের আমলে মধ্য এশিয়ার হান জাতি দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়, যাদের নেতা মিহিরাকুলার ছিলেন প্রচণ্ড রকমের বৌদ্ধ বিদ্বেষী। অন্যদিকে, ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজা শশাঙ্ক বৌদ্ধ অনুরাগী রাজা হর্ষবর্ধণের সাথে সর্বদাই বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত থাকতেন। পরের বার তাই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হয় রাজা শশাঙ্ক দ্বারা।

এর পেছনের ইতিহাসও কম জটিল নয়। সেসময়ে ব্রাহ্মণরা, বৌদ্ধ রাজা হর্ষবর্ধনকে হত্যার জন্য অনেকবার চেষ্টা করার পর একসময় সফল হয়। ব্রাহ্মণ দুর্বৃত্তের হাতে অনাকাঙ্খিত ভাবে প্রান হারান রাজা হর্ষবর্ধন। এর পর পরই একদল  ব্রাহ্মণ দুর্বৃত্তের আক্রমণে নালন্দা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তখনো পুরোপুরি ধ্বংস না হওয়ায় পরবর্তীতে নেপালের রাজার তত্ত্বাবধানে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনর্সংস্কার করা হয়। এবং ঐতিহাসিকদের মতে, এই বিশ্ব বিদ্যালয় ১৩০০ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল। 

এখন প্রশ্ন আসে, ১৩০০ সাল পর্যন্ত টিকে থাকা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় কিভাবে বখতিয়ার খলজির আক্রমনে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়? 

সোর্স – বখতিয়ার খলজীর কাহিনী ও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসে তার সম্পৃক্ততার ব্যবচ্ছেদ

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়

দেবকোটে প্রত্যাবর্তন ও বখতিয়ারের মৃত্যু

তিব্বত অভিযান ব্যর্থ হওয়ার পর বখতিয়ার খলজি জনা কয়েক সৈন্য ও সহযোগী নিয়ে তৎকালীন প্রশাসনিক কেন্দ্র তথা রাজধানী দেবকোটে ফিরে আসেন। বখতিয়ার খলজির ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে মারা যাওয়া নিয়ে একমত অধিকাংশ গবেষক। তবে গবেষনায় এটাও উঠে আসে যে স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি তার, বরং তাকে হত্যা করা হয়েছিলো। এটা নিয়েও শুরু হয় বিতর্ক। অনেকের মতে, তিব্বত অভিযান ব্যর্থ হওয়ায় বখতিয়ার মানসিক যন্ত্রণায় অসুস্থ ও শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন এবং একসময় মৃত্যু বরন করেন। অন্যদিকে, গবেষকদের কারো কারো মতে, আলী মর্দান নামে তার এক দুঃসাহসী ও দুর্ধর্ষ আমিরের ছুরিকাঘাতে তিনি মৃত্যু বরন করেন।

বখতিয়ার খলজি এর সমাধি

ইতিহাসে এটি কিন্তু প্রতিষ্ঠিত সত্য যে বখতিয়ারের মৃত্যু দেবকোটে ঘটেছিলো। দেবকোটের ঠিক কোন স্থান বা গৃহে এই বীর প্রাণ ত্যাগ করেছিলো তা নিয়ে স্পষ্ট কোনো ভাষ্য নেই। তবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের লেখকরা মনে করেন, খলজির কবর বা সমাধি পীরপাল গ্রামে অবস্থিত। বখতিয়ারের সমাধির এ স্থানটির অবস্থান প্রাচীন দেবকোটের কেন্দ্রস্থলের কাছাকাছি।

সমাধির পীরপাল দরগা শিরোনামে বখতিয়ারের পরিচয় ফলকে লেখা আছে: কথিত আছে, ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি ছিলেন দাশ বংশের প্রতিষ্ঠাতা কুতুবউদ্দিন আইবকের বিশ্বস্ত সেনাপতি। এ তুর্কি সেনাপতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হলো বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করা।

১২০৬ সালে তিব্বত আক্রমণের জন্য ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি দেবকোট শহর ত্যাগ করেন। তিব্বত অভিযানের সময় খলজি বাহিনী একটি বিধ্বংসী পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছিল এবং প্রায় এক শ জীবিত সৈন্যসহ দেবকোটে ফিরে এসেছিল। ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি ভারতে ফিরে আসার সময় যখন তিনি দেবকোটে অসুস্থ হয়েছিলেন সেই সময় আলী মর্দান কর্তৃক তিনি নিহত হন এবং দেবকোট অধুনা পীরপাল নামক স্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। সেই সময় থেকেই এই সমাধিস্থল অত্যন্ত পবিত্র ও উল্লেখযোগ্য।

বখতিয়ার খলজি এর অবদান

অফুরন্ত আশাবাদী, অসীম সাহসী এই উচ্চাভিলাষী চতুর শাসক হচ্ছেন বাংলায় মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠাতা। এই বিশেষনেই তিনি অধিক পরিচিত। ইতিহাসের পাতায় চির উজ্জ্বল ও ভাস্বর বখতিয়ার খলজির অবদানের শেষ নেই। নিচে তার কিছু অবদানের কথা উল্লেখ করা হলোঃ

  • বাংলায় মুসলিম শাসনের সূত্রপাত
  • নতুন যুগের সূচনা
  • রাজ্যসীমা
  • মুসলিম রাজ্যের সম্প্রসারন
  • সুশাসনের ব্যবস্থা
  • ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম সংস্কৃতির বিকাশ
  • শিক্ষা বিস্তার
  • তুর্কিবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি
  • ধর্মীয় সংস্কার

পরিশিষ্ট

প্রথম মুসলিম হিসেবে বাংলা ও বিহার জয় করা বখতিয়ার খলজি ছিলেন একজন দুর্ধর্ষ বীর। বাংলাদেশের বিখ্যাত কবি আল মাহমুদ তার বখতিয়ারের ঘোড়া কাব্যগ্রন্থে বখতিয়ার খলজিকে একজন দুর্ধর্ষ এবং প্রশংসনীয় বীর হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যদিও হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের কাছে বখতিয়ার খলজি শুধুই একজন খুনী এবং লুটেরার নাম। তবে সমাজ সংস্ককরনে সতেরো অশ্বারোহীর এই অধিনায়কের অবদানও তো কম নয়।  এটাও ঠিক যে, ইতিহাসের একটি অংশের ধ্বংস তার হাতে এবং একইসাথে আরেকটি অংশের সৃষ্টিও তার হাতে। তাই ইসলামের ইতিহাসে তথা সমগ্র বাংলার ইতিহাসে বখতিয়ার খলজি চির স্মরনীয় হয়ে থাকবেন।

আরো পড়ুন –

Related Post

মৃত্যু নিয়ে উক্তি

150+মৃত্যু নিয়ে উক্তি, বাণী, ক্যাপশন 2024

মৃত্যু নিয়ে উক্তি জন্মিলে মরিতে হবে আর এটাই সত্যি। মৃত্যু হচ্ছে সবচেয়ে চিরন্তন সত্যি। পৃথিবীতে প্রতিটি প্রাণীর মৃত্যুর স্বাদ অনুভব করতে হবে। সবসময় মৃত্যুর জন্য

Read More »
খুশির স্ট্যাটাস

200+ স্টাইলিশ খুশির স্ট্যাটাস | হাসি নিয়ে ক্যাপশন

খুশির স্ট্যাটাস | হাসি নিয়ে ক্যাপশন জীবনের সুন্দর খুশির মুহূর্ত আমরা সবাই বাঁধাই করে রাখতে চাই। আর এই খুশির মুহূর্তকে ধরে রাখার সবচেয়ে সহজ উপায়

Read More »

স্টাইলিশ ভালোবাসার ছন্দ | রোমান্টিক ছন্দ | Love Status Bangla

❤❤ভালোবাসার ছন্দ | ভালোবাসার ছন্দ রোমান্টিক | ভালোবাসার ছন্দ স্ট্যাটাস❤❤ ভালোবাসা হলো এক অন্যরকম অনুভূতির নাম, যা শুধুমাত্র কাউকে ভালবাসলেই অনুভব করা যায়। আমরা বিভিন্নভাবে

Read More »
মন খারাপের স্ট্যাটাস

মন খারাপের স্ট্যাটাস, উক্তি, ছন্দ, ক্যাপশন, কিছু কথা ও লেখা

মন খারাপের স্ট্যাটাস মন খারাপ – এই কষ্টের অনুভূতি কার না হয়? সবারই কখনো না কখনো সবারই মন খারাপ হয়। জীবনের ছোটোখাটো অঘটন থেকে শুরু

Read More »

Leave a Comment

Table of Contents