মেঘালয় মানে মেঘের আলয় অর্থাৎ মেঘের বসবাস স্থল। ভারতের উত্তর-পূর্ব দেশ মেঘালয় রাজ্যে।মেঘ,ঝর্ণা ও পাহাড়ের রানী মেঘালয় রাজ্যে। এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা উচু উঁচু পাহাড় পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে চলা ঝর্নার প্রাণবন্ত জলধারা আর পাহাড়ের গা ঘেঁষে ভেসে বেড়ানো তুলোর মত মেঘের ভেলা সব মিলিয়ে কি অপূর্ব এক অনুভূতির রাজ্য মেঘালয়।
হাত বাড়ালেই মেঘের স্পর্শ ভাবতে পারেন কি অপূর্ব অনুভূতি? স্বচ্ছ পানির নদী বা লেক কখনো শুনেছেন এমন কথা? আবার কখনো কি শুনেছেন এমন কোন জায়গা আছে সম্পূর্ণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কোথাও এক টুকরো ময়লা নেই? হ্যাঁ এমনই এক রাজ্যের নাম মেঘালয়। যেখানে গেলে এগুলো সব আপনি নিজের চোখে দেখতে পাবেন।
অসংখ্য ঝর্ণার সমারোহ নিয়ে অপরুপ সৌন্দর্যে সজ্জিত মেঘালয়।বড় বড় উঁচু পাহাড়ের উপর থেকে ঝরনার স্রোতধারা কতটা যে দৃষ্টিনন্দিত তা এখানে না এলে আপনি জানতেই পারবেন না। আপনি যখন মেঘালয়ের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাবেন এখানকার নিয়ম-কানুন দেখে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। পরিবেশ দূষণ করা কোন যানবাহনে ধোঁয়া নেই, শব্দ দূষণ করা কোন শব্দ নেই গাড়ির হর্নের।
এখানে কিছু কিছু গ্রাম আছে তারা পরিবেশটাকে এত সুন্দরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে তা আপনি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবেন না। এত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন গ্রাম, গ্রামের রাস্তা দিয়ে চলমান কোন গাড়ি এতটাই নিয়মাবর্তিতার মাঝে চলাচল করে। অযথা কারণে এখানে গাড়ির হর্ন বাজায় না কেউ। এখানকার মানুষ খুবই আন্তরিক, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং সহজ সরল প্রকৃতির।
মেঘালয় আসবেন অথচ মেঘ না দেখে চলে যাবেন তা কি হয়? রাস্তা দিয়ে চলার সময় দেখতে পাবেন কোথাও স্বচ্ছ আকাশ আবার কোথাও একঝাঁক মেঘ এসে আপনাকে মেঘের রাজ্যে তলিয়ে নেবে,মনে হবে আপনি যেন স্বপ্ন রাজ্যের মধ্যে প্রবেশ করেছেন। এই অনুভূতি পেতে অবশ্যই আপনাকে একবার হলেও মেঘালয় আসতে হবে। মেঘালয় দর্শনীয় স্থান এবং সম্পূর্ণ ভ্রমণ গাইড নিয়ে আজকে আমাদের আয়োজন।
লোকেশন | ভ্রমণ গাইড/কিভাবে যাবেন |
স্থলপথে ঢাকা থেকে সিলেটের দূরত্ব২৪৩ কিলোমিটার। আর রেলপথে ঢাকা থেকে সিলেটের দূরত্ব ২৩৫ কিলোমিটার। সিলেট থেকে ডাউকি বর্ডারের দূরত্ব ৫৫ প্রায় কিলোমিটার। | ঢাকা ফকিরাপুল থেকে শ্যামলী পরিবহনে করে সিলেটে আসতে হবে। সিলেটের কদমতলী বাস স্ট্যান্ডে নেমে সেখান থেকে সিএনজি বা অটো যোগে তামাবিল বর্ডারে যেতে হবে।
তামাবিল বর্ডারের ইমিগ্রেশন শেষ করে ওপারে ডাউকি বর্ডারের ইমিগ্রেশন শেষ করতে হবে। ডাউকি বর্ডার থেকে আপনি মেঘালয়ের যে কোন প্রান্তে যেতে পারবেন ক্যাপ ভাড়া করে। |
১.সোনাং পেডেং গ্রাম
স্বচ্ছ পানির গ্রামের কথা মনে পড়লেই আমরা সোনাংপেডেং এর কথাই ভাবি। মেঘালয়ের মধ্য সোনাংপেডেং পর্যটন স্পট এর মধ্যে অন্যতম। এই সোনাংপেডেং এ একবার গেলে আজীবন মনে রাখবেন। ওখানের জলরাশি এতটাই স্বচ্ছ আপনি আপনার জীবনে এমন স্বচ্ছ জলরাশি খুব কমই দেখেছেন বলে আমি মনে করি। আশ্চর্য স্বচ্ছ পানির জলাশয় দেখতে প্রতিবছর এখানে লাখো পর্যটকদের ভিড় জমে থাকে।
বিভিন্ন দেশ থেকেই এখানে পর্যটকের আনাগোনা লেগেই থাকে। হাজারো পাথরের বুক চিরে বয়ে যাচ্ছে খরস্রোতা ধারা দেখতে কার না ভালো লাগে বলেন.? সাদা সাদা ছোট বড় পাথর আর নীল রঙের পানি পাথরের উপর দিয়ে বয়ে চলার দৃশ্য দেখতে কতই না সুন্দর একবার ভেবে দেখুন।
আপনি স্বচ্ছ জলরাশির দেখতে এসেছেন কিন্তু তার বুক থেকে একবার ঘুরে আসবেন না এটি কি হয়? এখানে পর্যটকদের জন্য তৈরি আছে ছোট বড় নৌকা। একটা নৌকাতে ৩ জনের বেশি উঠতে দেওয়া হয় না। আপনি যদি বোটে উঠতে চান তাহলে তিন জনের ভাড়া নেবে ৬০০ রুপি,এটা আপনাকে এপার থেকে ওপারে নিয়ে যাবে কোথাও থামাবে না।আর যদি ১০০০ রুপি রেটে নৌকায় ওঠেন আপনাকে সুন্দর করে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে।
আর এই সোনাংপেডেং এর পানি খুবই ঠান্ডা আপনার মন কে শীতল করে দেবে। অনেক উঁচু থেকে ধাপে ধাপে ঝর্নার পানি গড়িয়ে এসে পড়ছে এই সমতল ভূমিতে। এখানে অনেক রৌদ হলেও শীতল হাওয়া বয় সারাক্ষণ। এই সোনাংপেডেং এর পানি এতটাই স্বচ্ছ যে পানির নিচে পাথর ও মাছ দেখা যায়। এখানে জায়গাটা খুবই নিরিবিলি পাশে গাছপালাতে ঘেরা আবার উঁচু উঁচু পাহাড় ও রয়েছে । জয়ন্তি পাহাড়ের ঝর্ণার ঝিরি থেকে এই সোনাং পেডেংয়ের জলরাশি সৃষ্টি।
ঝর্ণার সাদা পানি এসে পড়ে সমতলে আর সেই সাথেই সেখানেই সাদা বুদবুদের সৃষ্টি করে। দেখতে খুবই অপরূপ সুন্দর লাগে। নীল স্বচ্ছ জলধারা, পেজা তুলোর মতো উড়তে থাকা মেঘরাশি, উঁচু বড় পাহাড় আর সবুজময় প্রকৃতি আর কি লাগে? তবে এখানে বোটে রাইডে উঠে ঘোরা সবথেকে মজাদায়ক। আর বোটের সব থেকে মজার ব্যাপার হলো যখন আপনি বোটে উঠবেন স্বচ্ছ জলধারার কারণে আপনার কাছে মনে হতেই পারে আপনি হাওয়ায় ভাসছেন। বিধাতার সৃষ্টি এতোটাই মনোমুগ্ধকর যে আপনাকে ভাবিয়ে তুলবে।
এই সোনাংপেডেং এর পানি ওপরে সবুজ হলেও ভিতরে নীল। বাংলাদেশের সিলেট জেলার জাফলংয়ে যে পানি টা দেখেন সেটা এই নদীরই পানি । ভারতের এর নাম উমগট নদী। এখানে এলে এই ঠান্ডা জলরাশিতে নিজেকে ভিজিয়ে নেয় প্রত্যেক ভ্রমণ ভ্রমণার্থীরা। আপনিও হতে পারেন তাদের মধ্যে একজন। সোনাংপেডেং এ গিয়ে এর বড় বড় পাথরে বসে ঠান্ডা পানিতে পা ডুবিয়ে ছবি তোলে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়াই যাবে না।
পানির ওপর স্পষ্ট আকাশ দেখা যায়, পানির নিচে ভেসে বেড়ানো রঙিন মাছ, সচ্ছ পাথর, শ্যাওলা সব যেনো ছবির মত সুন্দর দেখতে যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আপনি যে বোটে চড়ে উপভোগ করবেন সেই বোটের ছায়াও নদীর নীচে দেখা যায় ভাবতে পারেন কত টা সচ্ছ জলধারা?
অপূর্ব এই ছবির মত দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ জীবনে একবার হলেও আপনার দেখতে যাওয়া উচিত। বিশেষ করে ঝর্ণা প্রেমীদের এইটা আদর্শ স্থান হবে। ছুটির দিনগুলোতে ঘুরে আসতে পারেন পরিবার পরিজন বন্ধু বা প্রিয়জনকেসহ ।
লোকেশন | ভ্রমণ গাইড/ কিভাবে যাবেন |
সোনাংপেডেং শিলং থেকে ৯৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এবং ডাউকি বর্ডার থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। | সোনাংপেডেং যেতে হলে প্রথমে বাংলাদেশ থেকে যেতে হলে তামাবিল-ডাউকি পোর্টের ভিসা করে ডাউকি যেতে হবে। তারপর ডাউকি থেকে ট্যাক্সি বা ক্যাপে করে খুব সহজেই আপনি আপনার গন্তব্যে পৌঁছে যাবেন। |
২.মাওলিনং ভিলেজ
জনপদের জমিনটাকে যদি জল রঙের ক্যানভাস ধরি তাহলে বলতেই হয় প্রকৃতির নামে চিত্রকর্তা মনের মাধুরী মিশিয়ে সবটুকু একে রেখেছে দারুন সব ছবি। কিন্তু এই সুন্দর প্রকৃতি যেন আমাদের দায়িত্বহীনতার তাগিদে দূষণময় হয়ে পড়েছে। যেইদিকেই যাই দেখি পরিবেশ দূষণ, বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, দূষণ আর দূষণ। কেমন হয় যদি এমন কোনো স্থান পাওয়া যায় যেখানে কোনো দূষণময় প্রকৃতির লেশ মাত্র পাওয়া যাবে না? হ্যাঁ আপনি ঠিকই শুনেছেন, এমন একটি জায়গা আছে। আজ আপনাকে এমন একটি গ্রামের কথা বলবো যেখানে কোনো দূষণ নাই ।
বাংলাদেশের সিলেট জেলার সীমান্তের পার্শ্ববর্তী এশিয়ার সবচেয়ে সুন্দর ও দূষণমুক্ত গ্রাম মাওলিনং ভিলেজ। একবার নয় দুই দুইবার এই গ্রাম এশিয়ার সবচেয়ে পরিষ্কার গ্রাম হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশের সৌন্দর্যের পাশাপাশি এখানে রয়েছে আদিম প্রাচীন যুগের কিছু নিদর্শন। সেখানকার মানুষের বসবাস স্থল গাছের উপরে। কি নিশ্চিত এইটা শুনে অবাক হয়েছেন তাই না? আরো অনেক বেশি অবাক হবেন জানলে যে সেখানে রয়েছে জীবন্ত গাছের ব্রীজ।
মেঘালয় রাজ্যে কিছু কিছু গ্রামে আসলে এ ধরনের অনেক জীবন্ত গাছের ব্রিজ দেখতে পাবেন কোনোটা সিঙ্গেল আবার কোনটা ডবল। দোতালা গাড়ি দেখেছেন, বাড়ি দেখেছেন, কখনো কি ভাবতে পারেন গাছের শেকড়ের তৈরি দোতলা ব্রিজ যা কিনা জীবন তো গাছের? তাহলে অবশ্যই আপনাকে মেঘালয় আসতে হবে।
এই ব্রীজকে ঘিরে রয়েছে হাজারো রহস্যের জট। সেখানে গেলেই দেখতে পারবেন প্রথমেই সবুজে ঘেরা একটি গ্রাম। ঠান্ডা, নিরিবিলি ও ধূলিকণা মুক্ত এটি অপূর্ব সুন্দর পরিবেশ। ৩৫০০ সিঁড়ি বেয়ে আপনাকে নিচে নামতে হবে এর মাঝে আপনি দেখতে পাবেন কিছু কিছু গ্রাম এখানকার অধিকাংশ মানুষ খ্রিষ্টান তাই দেখতে পাবেন তাদের উপাসনালয় সুন্দর সুন্দর চার্জ।
বাঁশের কেল্লার কথা তো আমরা সবাই জানি মাওলিনং ভিলেজে বাঁশের কেল্লা না থাকলেও আছে একটি বাঁশের সেতু। বাঁশের সেতু ধরে যখন পার হবেন ওই অনুভূতি টা বলার কোনো অপেক্ষা রাখে না। আরো রয়েছে বাঁশের বাড়ি, ঘর, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি। রয়েছে বিশাল এক গাছের ওপর একটি ছাউনি যেখানে যেতে হলে বাঁশের তৈরি মই বেয়ে যেতে হয়।
জন প্রতি ২০ রুপি দিয়ে সেখানে মানুষ যায় ছবি তুলতে। গাছের উপরে পাখির বাসা হয় শুনেছেন কিন্তু গাছের উপরে যে মানুষের বাসা! এই অবাক করা জিনিস দেখতে এখানে এলে মানুষ ওই গাছের উপরের ছাউনীতে যায়। সেখান থেকে বাংলাদেশের ভিউ পাওয়া যায়। অন্য দেশ থেকে নিজের দেশকে দেখার কথা ভাবুন কতটা অনুভূতিপ্রবণ ।
এই গ্রামটি অধিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কারন এখানকার বাসিন্দারা অধিক সচেতন প্রত্যেকটি পয়েন্টে রয়েছে ময়লা ফেলার জন্য ডাস্টবিনের সুব্যবস্থা। প্রত্যেকটি ডাস্টবিন দেখতে বাঁশের ঝুড়ির মত। পুরো গ্রামটি সবুজ গাছগাছালিতে ভরপুর। রাস্তার দুই পাশের গাছ গুলো সারিবদ্ধ ভাবে সাজানো গোছানো দেখতে বেশ চমৎকার।
ছবির রং তুলিতে আঁকা ঘরগুলো যেমন ছোট ছোট আকৃতির হয়, সামনে সাজানো ফুলের বাগান, স্বচ্ছ পরিষ্কার রাস্তা, ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের দৌড়াদৌড়ি, গ্রামের বউদের নানা কাজের দৃশ্য সবকিছু এখানে আছে।ঠিক যেনো জসিম উদ্দিনের নকশী কাঁথার মতো সাজানো গোছানো পরিপাটি গ্রাম ।গ্রাম যে এতো পরিষ্কার হয় তা না দেখলে বিশ্বাস করবেন না।
এই রাস্তা দিয়ে যখন হেটে যাবেন একা কিংবা সাথীকে নিয়ে সেই ঘটনা মনের মনিকোঠায় গেঁথে রাখার মত একটি ঘটনা হবে। খ্রিস্টান ধর্মালম্বীদের জন্য রয়েছে একটি অপূর্ব উপাসনালয়।সেখানে থাকার জন্য রয়েছে অনেক গুলো হোম স্টে। দূর দূরান্ত থেকে আসা অনেক পর্যটকই সেখানে রাত্রিযাপনের উদ্দেশ্যে ভাড়া নিয়ে থাকে।
প্রত্যেকটি বাড়ির আঙিনায় সাজানো রয়েছে নানা রং বেরঙের ফুলের বাগান। নানা রঙের ফুলের গন্ধে বিমোহিত হয় সেখানে ঘুরতে আসা পর্যটকেরা। শুধু ফুল গাছ নয় ছোট ছোট নানা রকম পাতা বাহারি গাছ বাড়ির কোণে কোণে লাগানো রয়েছে। এখানে আসা দর্শনার্থীরাও এদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা দেখে নিজেরাও কোথাও ময়লা ফেলাতে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়বে।
ফুল থাকবে আর প্রজাপতি থাকবে না এটি তো হয় না। ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজাপতি দল এই ফুল থেকে ওই ফুলে ঘুরে এক রকম নৈসর্গিক সুখ আপনাকে উপহার দিবে। আর যায় হোক এখানে এলে প্রাণভরে দূষণমুক্ত সতেজ নিঃশ্বাস নিতে তো পারবেন। এই গ্রামটির আনাচে-কানাচে ক্লান্ত দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে অনেকগুলো বেঞ্চের ব্যবস্থা। কিছুক্ষণ এই শান্ত মনোরম পরিবেশে জিরিয়ে নিতে পারেন আপনিও। আসলে স্থানীয়দের এই সচেতনা বোধ থেকেই এই গ্রামটি দেশের সবচেয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন গ্রাম হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
সেখানকার মানুষের প্রধান জীবিকা হল কৃষিকাজ।মাওলিনং ভিলেজ থেকে ৫ মিনিটের দূরত্বেই রিওয়াই ভিলেজ। সেটিও একটি ছোট গ্রাম সেইখানেই অবস্থিত সেই ঐতিহাসিক ব্রিজটি নাম সিঙ্গেল রুট লিভিং ব্রিজ যেখানে রয়েছে একটি স্বচ্ছ জলধারার ওপরে নির্মিত গাছের শিকড়ের ব্রিজ যেটা প্রাকৃতিকভাবে নির্মিত হয়েছে। এই ব্রিজটি ১০০ বছর পুরনো। ব্রিজটির নিচ থেকে ঝরঝর মুখর কলরব ধ্বনিতে ঝর্ণাধারা বয়ে চলেছে যা মন কেড়ে নেয় সহজে।
দুই তলা বিশিষ্ট এই ব্রীজটিকে ডবল ডেকার রুট ব্রীজ বলে পরিচয় করিয়ে দেয় স্থানীয় লোকজন।এখানে খাসিয়া সম্প্রদায়ের লোক বসবাস করে। এরা বেশিরভাগ সব খ্রিষ্টান। তাই এদের জন্য সুন্দর সুন্দর চার্জও তৈরি করা আছে।
জানলে অবাক হবেন ঝর্ণার জলধারা যেখান থেকে গড়িয়ে যায় সেখানেও পর্যন্ত স্থানীয় লোকেরা অধিক যত্ন সহকারে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখেন। ৪০ রুপি করে এন্ট্রি ফি সেই ঝর্না ধারা দেখতে গেলে দিতে হয়।
মাওলিনং ভিলেজের জনসংখ্যা বেশি না হলেও তারা প্রচুর বন্ধুত্বস্বরূপ আচরণ করবে আপনার সঙ্গে। মাওলিনং ভিলেজে গেলে আপনাকে অবশ্যই সেখানকার নিয়ম নীতি মেনে চলতে হবে। এখানে এলে আপনার হাতে থাকা ঘড়িটাও বুঝতে পারবে না কখন যে সময়টা চলে যাবে। অপূর্ব সুন্দর পরিবেশে এই গ্রামটি দেখতে ছুটে আসতে বাধা নেই।
ভ্রমণ পিপাসু মানুষদের ইতিমধ্যেই মন আনচান করছে নিশ্চয় এই স্থানে আসার জন্য। অবশ্যই আসবেন এই স্থানে। হলফ করে বলতে পারি আপনি প্রতিটি মুহূর্তে পাবেন রোমাঞ্চকতার অনুভব। তাই আর দেরি কিসের আজই বেরিয়ে পড়ুন মাওলিনং ভিলেজে পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে।
লোকেশন | ভ্রমণ গাইড/ কিভাবে যাবেন |
শিলং থেকে ৭৭ কিলোমিটার দূরে এবং চেরাপুঞ্জি থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মাওলিনং ভিলেজ। | আপনি যদি বাংলাদেশের থেকে যেতে চান এই মাওলিনং ভিলেজে তাহলে অবশ্যই আপনাকে তামাবিল-ডাউকি পোর্টের ভিসা করে ডাউকি যেতে পারেন। তারপর ডাউকি থেকে খুব সহজেই আপনি ট্যাক্সিতে করে আপনার গন্তব্য মাওলিনং ভিলেজে যেতে পারেন।
অথবা আপনি যদি শিলং থেকে যেতে চান সেক্ষেত্রেও আপনাকে ট্যাক্সি যোগে মাওলিনং ভিলেজে যেতে হবে। বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে চাইলে আপনাকে ট্যাক্সি রিজার্ভ করে নিতে হবে। |
৩.শিলং
শিলং মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী। মুলত এটি খাসি পাহাড়ের উপত্যকায় অবস্থিত। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১৫০০ কিলোমিটার উপরে এর অবস্থান। শিলং শহরে নেই এমন কিছু খুঁজে পাবেন না। মেঘালয় মূলত ভ্রমণ স্পট বলে শিলং শহরে হাজার হাজার টুরিস্ট স্পট নির্মাণ করা হয়েছে। শিলংকে প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড ও বলা হয়ে থাকে।
স্কটল্যান্ড এর রাস্তাগুলো যেমন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ,পাহাড়ের কোলে ঘেঁষে কখনো মেঘ এসে ঢেকে যাচ্ছে, আবার কখনো দূর থেকে ঝরনার প্রবাহ দেখতে কার না ভালো লাগে। এখানে হঠাৎ বৃষ্টি হঠাৎ রোদ,এতো মেঘের ভেলায় ভেসে বেড়ানো রাজ্যে দর্শন না করে কি বসে থাকা যায়?
শিলং শহরে সাইডসিং করতে অনেক সকালে বেরিয়ে যেতে হবে।কারণ দেরি করে বের হলে রাস্তায় জ্যামে পড়ে সময় অপচয় হবে। পাহাড়ের মধ্য দিয়ে ঘূর্ণায়মান রাস্তাগুলো দেখলে অন্যরকমের অনুভূতি সৃষ্টি হবে। মেঘালয়ের আনাচে কানাচে আছে অগনিত ঝর্ণা।এতো সুন্দর সুন্দর রং বেরঙের এর ঝর্ণার পানির রং, দেখলে মনে হবে সব পরিষ্কার পানি ।
কিন্তু পানি যখন সমতলভূমিতে এসে পড়ে তখন বোঝা যায় এর রং টা কেমন হয় কোনটা সবুজাভ নীলচে, কোনোটা লালচে সবুজ, কোনোটা কাঁচের মতো স্বচ্ছ, কোনটা সাদা নীলের সংমিশ্রণ। প্রত্যেকটা ঝর্ণার ঝিরি কাঁচের মতো স্বচ্ছ। শীতকালে এখানে এলে স্বচ্ছ পানির জলধারা দেখতে পাবেন বর্ষাকালে পানিগুলো সব ঘোলাটে আকার ধারণ করে।
শিলং শহরে দেখতে পারেন
উইমিয়াম লেক
এলিফ্যান্ট ফলস
ডন ভস্কো মিউজিয়াম
লাইটলুম
ওয়ার্ডস লেক
গলফ ক্লাব
উই সাউডং
ক্যাথিড্রাল চার্চ
উইমিয়াম লেক : শিলংয়েও আছে স্থানীয়রা যেটাকে বলে বারা পানি লেক। শিলং শহর থেকে এর দূরত্ব ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আপনার যেতে সময় লাগবে আধা ঘন্টা।তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই লেকটি বিস্তৃত। উপরে দাঁড়িয়ে বিস্তৃত লেখা আপনি খুব সহজেই দৃষ্টিগোচর করতে পারবেন।
যদি লেকের কাছাকাছি গিয়ে ছবি তুলতে চান কিংবা লেকটিকে আরো ভালোভাবে দেখতে চান তাহলে টিকিট কেটে লেকের কাছে যেতে হবে জন প্রতি ৫০ রুপি করে এখানকার টিকিট মূল্য।
লাইটলুম: শিলং থেকে লাইটলুম ৩৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত যেতে সময় লাগবে ঘন্টা খানেক মত। লাইট লোন যেতে টিকিট লাগবে পার পিস ১০ রুপি আর গাড়ির জন্য ১০ রুপি। লাইট লোনের দৃশ্যটা এতটাই মনমুগ্ধকর সেখানে গেলে আপনার আর ফিরতে ইচ্ছা করবে না।
এখানে আছে সুইসাইড পয়েন্ট। আপনি ভাববেন না আপনাকে সুইসাইড করার জন্য ওখানে যেতে বলছি। এখানে খাড়া পাহাড় গুলোর শেষ মাথায় দাঁড়ালে যদি হঠাৎ পা হড়কে নিচে পড়ে যান তাহলে বাঁচার আর সম্ভাবনা থাকবে না এই জন্য এটাকে সুইসাইড পয়েন্ট বলা হয়। পাহাড়ের শেষ মাথা থেকে নিচের দিকে অনেক গভীরে।
লাইটলুমের বড় বড় পাহাড়ের মধ্য দিয়ে ভেসে বেড়ানো রাশি রাশি মেঘের ভেলা ঘোলাটে করে রেখে দেয় পাহাড় গুলোকে। যদি আপনার ভাগ্য ভালো থাকে পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখে আপনি এতটা মুগ্ধ হয়ে যাবেন যে সেখানেই আপনি মহান বিধাতার অপূর্ব সৌন্দর্যের প্রশংসা না করে পারবেন না। কখনো কখনো অনেক সুন্দর অপূর্ব জিনিসের ভাষা খুঁজে পাওয়া যায় না এখানে গেলে আপনার সেটাই মনে হবে।
এখানে গেলে অবশ্যই ট্রাকিং সু অথবা ট্রাকিং স্যান্ডেল সাথে করে নিয়ে যাবেন।উঁচু পাহাড়ের কোল ঘেঁসে যখন নিচের দিকে নেমে সুইসাইড পয়েন্টে গিয়ে দূরের পাহাড়ের দৃশ্য দেখবেন তখন মূহুর্তের জন্য মনে হবে যেন আপনি স্কটল্যান্ড কিংবা সুইজারল্যান্ড চলে এসেছেন। এখানে গেলে দেখতে পাবেন হঠাৎ পরিস্কার আকাশ মুহুর্তেই কালো মেঘে ছেয়ে যাবে।
ওয়ার্ডস লেক: একটা দৃষ্টিনন্দন কৃত্রিম লেক এখানে গেলে আপনি বোর্ডিং করতে পারবেন। সময় কাটানোর জন্য একটি উপযুক্ত স্থান জন প্রতি এখানকার টিকিট ৫০ রুপী করে। এখানে
গলফ ক্লাব: গলফ ক্লাব মূলত একটি মাঠ। একসময় এখানে হয়তো গোলফ খেলা হত এখন সেটা সবুজ ঘাসে চাদর পরে মানুষের মাঝে শোভা বর্ধন করছে। মেঘালয়ের শিলংয়ে বিকেলে সময় কাটানোর জন্য গলফ ক্লাব অবর্ণনীয় সুন্দর একটি স্থান।
এলিফ্যান্ট ফলস: ১৭০ সিড়ি নীচে নেমে এলিফ্যান্ট ফলসের প্রথম ফলস টা দেখতে পাবেন। এভাবে আরো নিচে নামলে দ্বিতীয় ফলস এবং আরো নিচে নামলে প্রথম ফলস দেখে এতটা মুগ্ধ হয়ে যাবেন যে আপনি বলতে বাধ্য হবেন এত সুন্দর জায়গায় আগে কখনো আসেননি এলিফ্যান্ট ফলস মূলত তিনটা ধাপে গড়িয়ে পড়া ঝরনার ঝিরি ।
উই সাউডং:- মেঘালয়ের শিলং এর সবচেয়ে সুন্দর স্থান ওয়ে সাউডং। বিশ্বাস করতে পারবেন না এতোটা সুন্দর দেখতে সেই স্থান। চিকন সরু পথ দিয়ে একজন একজন করে নেমে যেতে হয় সেই ঝর্না দেখার উদ্দেশ্যে। যারা অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করে এটি তাদের জন্য একটি আদর্শ স্থান। পাথর কেটে ঢালুপথে তৈরি করা হয়েছে এই জলপ্রপাতের রাস্তা। রাস্তার দু’ধারে ঘন জঙ্গল এবং মাঝখান দিয়ে চলেছে জলপ্রপাত দেখতে আসা দর্শনার্থীদের সমাগম। ওয়ে সাউডং এর পথ নির্গম হওয়ায় বাঁশের সাহায্য নিলে ভালো হয়।
এই পথ পাড়ি দিয়ে পেয়ে যাবেন কাঙ্খিত ওয়ে সাউডং এর জলপ্রপাত। এই ভিউ পয়েন্ট দেখলে আপনার কল্পনাকেও হার মেনে নিতে বাধ্য করবে । বাজি রেখে বলতে পারি এইটা আপনার দেখা সবচেয়ে সুন্দর ভিউ পয়েন্টের মধ্যে একটি হয়ে উঠবে। পাথরের ধাপ গুলো পেরিয়ে ভূপৃষ্ঠে এসে পড়ে নীল জল রাশির দল। দেখতে দেখতে কখন যে নিবিশের মধ্যে সময় কেটে যাবে আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন না। নিজ চোখে দেখে আপনি সৃষ্টিকর্তার তারিফ করতে বাধ্য হবেন।
কতটা মনোরম এই দৃশ্য যা ভাষায় বলে প্রকাশ করা যাবে না। জলপ্রপাতের আশপাশ ঘিরে রেখেছে পাথরের বড় বড় স্তুপ। ঝর্নার নিচে রয়েছে বড় বড় সব পাথর। সেখানে গেলে দর্শনার্থীরা ছবি তোলে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় মনের মত করে। পুরোটাই যেন পাথুরে পরিবেশ। সেখানে নেই কোনো দূষণ, নেই কোন ধুলা মাটি তাই তো সবাই প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট জলপ্রপাত দেখতে এখানে ভিড় করে দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীরা। মেঘালয়ের শিলং এ আসলে আপনি অবশ্যই একবার এই দৃষ্টিনন্দন ওয়ে সাউডেং জলপ্রপাত দেখে আসবেন।
ক্যাথিড্রাল চার্চ: মেঘালয়ের অধিকাংশ জনবসতি খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। এখানে অনেক সুন্দর সুন্দর চার্জ আছে তাদের উপাসনার জন্য। তার মধ্যে শিলং এর চার্চ বৃহৎ আকারে একটি চার্জ। বাইরে থেকে দেখলেই বোঝা যাবে চার্চটি অনেক সুন্দর করে তৈরি করা হয়েছে। যেহেতু এটা উপাসনার একটি স্থান এজন্য এখানে কোন এন্ট্রি ফি লাগে না। কিন্তু এখানে ক্যামেরা নিয়ে প্রবেশ করা নিষিদ্ধ।
ডন ভস্কো মিউজিয়াম: মেঘালয় রাজ্যের শিলং শহরে অবস্থিত ডন ভস্কো মিউজিয়ামটি বহু যুগের ইতিহাসের ঐতিহ্য বহন করে আসছে। এখানে গেলে আপনি কি পাবেন না? সাত তলা বিশিষ্ট এই মিউজিয়ামে মেঘালয়ের সকল জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি এবং তাদের ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়েছে। শুরু থেকে পৃথিবী সৃষ্টি, সাতটি রাজ্যের ধ্যান ধারণা, মানুষের বিচিত্র বিশ্বাস, তাদের বিবর্তন, মানুষের ভাষার বিবর্তন, সব মিলিয়ে মিউজিয়ামে দেখার মত অনেক উপভোগ্য জিনিস আছে যা মিউজিয়াম প্রেমী দর্শনার্থীদের জন্য একটা আকর্ষণীয় স্থান।
মিউজিয়ামের ছাদে উঠে ভিউ পয়েন্ট থেকে সমস্ত শিলং সিটি দেখতে যে কতটা অপূর্ব লাগে তা আপনি এখানে না এলে বুঝবেন না। আরও যে কত কিছু দেখতে পাবেন তার কোন ঠিক নেই।
লোকেশন | ভ্রমণ গাইড/কিভাবে যাবেন |
ডাউকি থেকে মেঘালয় রাজ্যের শিলং এর দূরত্ব ৮৩ কিলোমিটার | ডাউকি থেকে যেকোনো ট্যাক্সি ট্যাব নিয়ে শিলংয়ে যেতে পারেন। জন প্রতি ভাড়া পড়বে ২০০ থেকে ২৫০ রুপি। |
৪.চেরাপুঞ্জি
মেঘের রাজ্য মেঘালয়ে চেরাপুঞ্জি অন্যতম আকর্ষণীয় স্থানের মধ্যে একটি। এখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করেই কাকভেজা হয়ে যেতে পারেন মনের অজান্তেই। এখানে বৃষ্টি নিত্যদিনের একটি ব্যাপার। যে কোনো সময় ঝপ করে বৃষ্টি নামে। প্রকৃতি যেন প্রাণ পায় বৃষ্টির লাবণ্য ধারায় ভিজে। প্রকৃতির সবচেয়ে সুন্দর শোভা ছড়াই বৃষ্টির কারণে। বনভূমিকে শিক্ত করে জলের মিছিল এগিয়ে চলে উঁচু থেকে নিচুতে সেই জলধারার উৎস মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি।
মূলত মেঘ, সবুজ প্রকৃতি ও বড় বড় ঝর্ণার জন্য চেরাপুঞ্জি পরিচিত। চেরাপুঞ্জি মানেই বৃষ্টি। এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে স্থানীয়দের বসতবাড়ি। চেরাপুঞ্জির পথ দিয়ে হাঁটার মতো অনুভূতি আর দ্বিতীয়টি নয়। চলার পথে সঙ্গ দেবে আশেপাশের সব সুন্দর সুন্দর পাহাড়। চেরাপুঞ্জের মধ্যেও রয়েছে অনেকগুলো দর্শনীয় স্থান। প্রতিনিয়ত ভিড় করে হাজারো দর্শনার্থীরা এই মনোরম স্থান পরিদর্শনে।
চেরাপুঞ্জি গ্রাম:- ইতিহাসে বলুন কিংবা ঐতিহ্যে, পত্নের গৌরীমা কিংবা শিল্পের সুষমা, জীবনের ব্যপ্তি অথবা জীবিকার ঐশ্বর্য, নিঃসর্গের রাজ্যপাট কিংবা বৈচিত্রের বৈভব কোন কিছুরই অভাব নেই সেখানে। যেন হাট বসেছে রূপের সবকিছুতে। চেরাপুঞ্জি মানেই রূপের রহস্যে ঘেরা একটি গ্রাম। তাইতো হাজারো মানুষের মনের চিলেকোঠায় চেরাপুঞ্জি গ্রামের কথা থাকে অনেকটা জায়গা জুড়ে। এখানে একবার কেউ এলে এর সৌন্দর্যের কথা ভুলতে পারে না সহজেই।
পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট বসতি যেন আগলে রেখেছে পাহাড় গুলোকে। শুধু বসতবাড়িই নয় আরো দেখতে পাবেন পাহাড়ের ধাপে ধাপে লুকোচুরি খেলা মেঘগুলোকে। আরো আছে চুনাপাথরের গুহা যেনো সৌন্দর্যের হাতছানি দিয়ে যাচ্ছে প্রতিক্ষণ। প্রতিদিনই প্রায় অনেক লোকজনের ভিড় গেলে থাকে এই খানে। আপনি মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে এলে একবার এখানে ঢুঁ মারতে পারেন।
মৌসিনরাম:- ভারতের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত কোথায় হয়? আপনার উত্তর যদি হয় মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে তাহলে আপনি ভুল। চেরাপুঞ্জি মৌসিনরামে সব থেকে বেশি বৃষ্টিপাত দেখা যায়। অধিক ধারার এই বৃষ্টিপাতের জন্যই মৌসিনরাম পর্যটক এর মনে বেশ খানিকটা জায়গা করে নিয়েছে। চেরাপুঞ্জিকে এখন থেকে হারিয়ে দিয়েছে মৌসিনরাম।
বর্ষার মৌসুমে মৌসিনরামের প্রত্যেকটি স্থান বর্ষার ফুলে সুসজ্জিত হয়ে ওঠে। বর্ষাকাল শেষ হলেই মৌসিনরাম হয়ে উঠে ছবির মত সুন্দর একটি পর্যটন স্পট।
স্ট্যালাগ মাধই পাথরের শিবলিঙ্গ:- এই শিবলিঙ্গটি আছে একটি প্রাচীন গুহার মধ্যবর্তী স্থানে। কিন্তু এই গুহাকে নিয়ে রয়েছে হাজারো রহস্যের জট। কারণ এই গুহাটির দৈর্ঘ্য ও গভীরতা আজও মানুষের কাছে এক অজানা কাহিনী হিসেবেই রয়েছে। তাই বিভিন্ন মানুষ এই গুহাকে নিয়ে পেতেছে নানা রকম গল্পের সমাহার। রহস্যের গন্ধে হাজারো মানুষের ভিড় লেগে যায় স্ট্যালাগ মাধই পাথরের শিবলিঙ্গে। দর্শনার্থীদের মনোরঞ্জন করার তাগিদে সেখানে প্রবেশপথ টি সাজানো আছে বেশ কিছু মনোথের পিলার তোরণ।
নোহকালীকাই ফলস:- নোহকালীকাই এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম জলপ্রপাত। বর্ষার এক অপরূপ সৌন্দর্যে ভরপুর হয়ে যায় এই জলপ্রপাত ধারা। এই জলপ্রপাতের নামকরণের পিছনে রয়েছে একটি লোমহর্ষক ইতিহাস। খুবই দুঃখজনক একটি ঘটনার সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে এই জলপ্রপাত। সেখানের একটি সাইনবোর্ডে ঘটনাটি উল্লেখিত রয়েছে। তবে আপনি এই ঝর্ণা সুন্দর যেয়ে এক মুহূর্তেই পাগল হয়ে যাবেন। ঝর্নাকে লুকিয়ে রেখেছে সাদা সাদা উড়তে থাকা মেঘগুলো। ঝরনার জলের ঝরঝর আওয়াজ শুনতে খুবই মনোমধুর লাগে।
মেঘের জন্য অনেক সময় ঝর্না টাকে না দেখা গেলেও ঝর্নার পানির শব্দ যেন পর্যটকদের মন ঝর্না টিকে দেখার জন্য পুলকিত হয়ে উঠে। তবে বহু প্রতীক্ষার পর যখন অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে মেঘগুলো সরে ঝর্নার রূপ দেখা যায় তখন যেন পর্যটকদের এখানে আসার সমস্ত ক্লান্তি এক নিমিষেই দূর হয়ে যায়। সাদা সাদা তুলোর মতো উড়তে থাকা মেঘরাশি, প্রকৃতির সবুজের সমারোহ এবং মাঝখান দিয়ে পড়ছে ঝর্নার সাদা জল আর কি চাই মন ভালো করার জন্য? শীতকালে এখানে ট্রাকিং এর সুযোগও পাবেন। এই সৌন্দর্যের এক সাক্ষী হতে আপনিও ছুটে যেতে পারের চেরাপুঞ্জির অপূর্ব নোহকালীকাই ফলস দেখতে।
মৌসমাই কেভ:- মোসমাই কেভ বা গুহা হলো একটি চুনা পাথরের গুহা। এই চুনা পাথরের গুহা দেখতে প্রতিদিন সেখানে। চেরাপুঞ্জিতে সবচেয়ে বেশি ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ায় সেখানকার গুহা গুলোতে জীবাশ্ম জমে জমে এই চুনা পাথরের সৃষ্টি হয়। এই জীবাশ্মের জন্যই গুহা গুলো সবার কাছে পরিচিত হয়ে উঠে। দেখতে ছোট মনে হলেও অনেকটাই বড় এই মৌসমাই গুহাটি। দর্শনার্থীদের কথা মাথায় রেখে গুহার মধ্যে লাইটের ব্যবস্থা রয়েছে।
তবে অনেকেই গুহাটিতে প্রবেশ করতে ভয় পেতে পারে আবার অনেকেই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে সাহসের সাথে এগিয়ে যায় গুহার মধ্যে।গুহার ভেতর থেকে চলার পথে আপনি যত ভেতরে যাবেন ততই নিচু হয়ে যেতে হবে। অনেক লম্বা যারা এক সময়ে তাদের হামাগুড়িও দিয়ে যেতে হতে পারে।
এক পর্যায়ে গুহার ওপর প্রান্তের থেকে আসা আলোর ঝলকানি দেখে কারোর আর বুঝতে বাকি থাকে না এই পথ আর বেশি নেই। এই অ্যাডভেঞ্চার টাইম টা কতটা রোমাঞ্চকর হবে আপনি না গেলে বুঝতেই পারবেন না। চেরাপুঞ্জি তে এলে একবার অন্তত ঘুরে যেতে পারেন আপনিও কাঙ্খিত মৌসমাই কেভে।
সেভেন সিস্টার ওয়াটার ফলস:- চেরাপুঞ্জির মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান হল সেভেন সিস্টার্স ওয়াটার ফলস। এখানে গেলে আপনি একটি নৈসর্গের সুখ উপভোগ করবেন। সেভেন সিস্টারূ ওয়াটার ফলসে মেঘ আপনার ওপর নয় আপনি মেঘের উপর রাজত্ব করতে পারবেন। দূর থেকে ঝরনাটাকে দেখলে মনে হবে যেন কালো পাথরের উপর কেউ দুধ ঢেলে দিয়েছে।
প্রকৃতির এমন মায়াভরা দৃশ্য দেখতে প্রতিনিয়ত দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসে হাজারো ভ্রমণ প্রেমিক দর্শনার্থীরা। সেখান থেকে দূরের বাংলাদেশের ভিউ দেখা যায়। যদিও সবাই এটাকে সেভেন সিষ্টার্স ফলস বললে সমন্ধ করে আসলে এখানে অনেক অনেক ফলস আছে। দূর থেকে এই দৃশ্য দেখার মত সৌভাগ্য যদি কখনো আপনার হয়ে থাকে আপনি নিজেকে একজন ভাগ্যবান বলে মনে করবেন।
সেভেন সিস্টার নামকরণ বলেই যে সাতটা জলপ্রপাত সেখানে আছে তেমনটি কিন্তু নয় , শত শত ঝর্ণাধারা বইছে সেখানে অবিরাম। এখানে মেঘগুলো এতটাই ঘন হয় যে প্রতিনিয়ত মেঘেদের ট্রাফিক জ্যাম লেগেই থাকে। তবে আপনার ক্লান্তি দূর করতে এটি বেশ কার্যকরী। ঝর্নার পানি ধাপে ধাপে নামে দেখতে কিছুটা ছবির মত মনে হয়।
সৃষ্টিকর্তা যেন নিজ হাতে এঁকেছেন এই মনোরম দৃশ্যের ছবি। পাহাড়ের গুহা মেঘেরা ভাসে আমরা অনেক দেখেছি কিন্তু চেরাপুঞ্জির এই সেভেন সিস্টার ওয়াটার ফলসের মতো মনমুগ্ধকর অন্য আর কোনটি নেই। চেরাপুঞ্জি ঘুরতে আসলে আপনিও ঘুরে যেতে পারেন এই ছবির মত জায়গাটি দেখার উদ্দেশ্যে।
ওয়াহ-কাবা ফলস:- চেরাপুঞ্জির অন্যতম দর্শনীয় স্থান ওয়াহ-কাবা ফলস। এখানে এলে আপনার ধারনার থেকে ও বেশি সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। রাস্তা ধরে নিচের দিকে হাঁটতে হাঁটতে প্রথমেই চোখে ধরা দেবে একটি ছোট্ট জলপ্রপাত ধারা। আপনি যদি সেটিকেই ওয়াহ-কাবা ফলস ভাবেন, তাহলে আপনি মস্ত বড় ভুল করবেন । একটু এগোলেই শুনতে পাবেন ঝরঝর মুখর কলরব ধ্বনিতে ডেকে চলেছে একটি বড় জলপ্রপাত।
ঝর্নার ওপরে গেলেই বুঝতে পারবেন এর পানি কতটা স্বচ্ছ এবং কনকনে ঠান্ডা। পানের ওপর সবুজ প্রকৃতির ছায়া পড়ে সবুজ রঙের পানির মতো মনে হলেও এটি দুধের মত সাদা এবং স্বচ্ছ পানি। পাথরের উপর দিয়ে যখন গড়িয়ে এই পানি ভূপৃষ্ঠে এসে মাথা গুঁজে সেই দৃশ্যটা দেখলে আপনি একরকম মনোরম অনুভূতি অনুভব করবেন। যেমনটি আমরা সিনেমায় দেখি ঝর্না ধারা এ যেনো তার থেকে কম কিছু নয়। কল্পনার জগতে হারিয়ে যেতে আপনিও আসতে পারেন এই সুন্দর মনোরম পরিবেশ দেখতে।
জলপ্রপাত ধারার মজা লুটতে আপনিও যেতে পারেন সেখানে। একের ভিতর সব পাইবেন এই চেরাপুঞ্জি দর্শনে। আপনার মনোরঞ্জন করতে মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি যথেষ্ট বলে মনে করা যায়।
লোকেশন | ভ্রমণ গাইড/ কিভাবে যাবেন |
মেঘালয়ের রাজধানী শিলং থেকে ৫৬ কিলোমিটার দূরে চেরাপুঞ্জি অবস্থিত। | তামাবিল – ডাউকি থেকে খুব সহজে আপনি শিলং পৌঁছে যাবেন। তামাবিল সীমান্ত পার হলেই শ্রীলং বাজার সেখান থেকে আপনি ট্যাক্সি ভাড়া করে যেতে পারবেন খুব সহজেই চেরাপুঞ্জি।
চেরাপুঞ্জির যতগুলো ভিউ পয়েন্টের কথা উল্লেখ করেছি সবগুলোই চেরাপুঞ্জে মধ্যেই পড়ে। চেরাপুঞ্জি থেকে সেখানেও আপনি ট্যাক্সি বা ক্যাপ ভাড়া করে ঘুরে আসতে পারেন। |
ইতিকথা
মেঘালয় কে বলা হয় মেঘের বাড়ি। গল্পকথায় কিংবা মানুষের মুখে মুখে কতই না রূপকথার কাহিনী শুনেছেন। মেঘালয়ের মেঘের রাজ্যে এসে আপনার মনে হবে যেন আপনি সেই দেশেই চলে এসেছেন যা আপনাকে বহুদিন ধরে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। পাহাড়ে ঘেরা মেঘালয়, সবুজ বন বনানী আর অসংখ্য ঝর্নার প্রাণবন্ত জলপ্রপাত হাতছানি দিয়ে ডাকে বারবার এখানে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের। ঘুরতে আসার টুরিস্ট একবার এলে আরেক বার দেখার লোভ সামলাতে পারে না।
ছুটি কাটাতে তো কত জায়গায় গিয়েছেন কতই না অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। পাহাড়, পর্বত, নদী, ঝিরি, বন- জঙ্গল,লেক,পার্ক কোথায় না ঘুরেছেন কিন্তু কখনো কি মেঘের রাজ্যে ঘুরে দেখেছেন কেমন লাগে? পাহাড়ের বুকে দাঁড়িয়ে আছেন একরাশ মেঘ এসে আপনাকে ঢেকে দিচ্ছে এই বিশাল অনুভূতি আপনি মেঘালয় না এলে জানতে পারবেন না।
তাই এবারের ছুটিটা হোক আপনার আনন্দদায়ক ভ্রমণ।বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজন বা প্রিয়জনকে সাথে নিয়ে মেঘালয় রাজ্যের দর্শনীয় স্থানগুলোতে দর্শন করে আপনার অমূল্য সময়গুলো যে একটুও বৃথা যাবে না কথা দিচ্ছি। আসুন উপভোগ করুন ভারতের সবচেয়ে বৃষ্টি প্রধান ও মেঘের রাজ্যে মেঘালয়ে। ধন্যবাদ।
আরো পড়ুন –