পৃথিবীর যত বিস্ময়কর ও আকর্ষণীয় জিনিস আছে তার মধ্যে সমুদ্র অন্যতম বিস্ময়। সমুদ্র পছন্দ করে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়াই যায় না। সমুদ্রের উপরে দেখলে যেমন মনে হয় সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট অপার সৌন্দর্য চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তেমনি সমুদ্রের অথৈ জলের তলদেশে আছে আরেক পৃথিবী।যা পৃথিবীর অনেকের কাছে আজও অজানা রহস্য হয়ে আছে।
ভ্রমণ পিপাসু দর্শণার্থীরা তাই সমুদ্র ভ্রমণে কখনো পিছপা হয় না। সমুদ্র ভ্রমণ করে তারা নতুন নতুন অ্যাডভেঞ্চার ও সৌন্দর্য উপভোগ করে। সমুদ্রের অপার সৌন্দর্য দর্শনার্থীদের মন আকর্ষণ করে। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের ছন্দে তাদের মনও দুলে ওঠে। সমুদ্রের বিশালতার যেমন শেষ নেই তেমনি সমুদ্রের রহস্যেরও শেষ নেই।
সমুদ্রের অপার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয় না এমন কোন মানুষ পাওয়াই মুসকিল। সমুদ্রের তলদেশে হাজারো জানা অজানা প্রাণীর অভয়ারণ্য। বিশাল সমুদ্রের কিছু অংশ সমুদ্রের নিচের প্রাণীরা প্রজননের জন্য খুঁজে নেয়। তেমনি একটা প্রজনন স্থানের নাম সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড। এটি সমুদ্রের তলদেশে গভীর গিরিখাত ও মৎস্য প্রজনন সামুদ্রিক অববাহিকা।
সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড কি এবং কোথায় অবস্থিত?
এক কথায় বলা যায় সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড বঙ্গোপসাগরের তলদেশে অবস্থিত একটি গভীরতম উপত্যকা বা গিরিখাত। বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের তলদেশে অবস্থিত সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড একটি সংরক্ষিত এলাকা।আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এই গিরি খাতটি বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত। মংলা সুন্দরবনের দুবলার চর থেকে মাত্র ৩০/৪০ কিলোমিটার দূরে এই সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড এবং কুয়াকাটা থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
বঙ্গোপসাগরের তলদেশে এই গভীর খাদ বা সমুদ্র অববাহিকাকে মেরিন ভ্যালি বা একে আন্ডার ওয়াটার ক্যানিয়নও বলা হয়। স্থানীয় জনগণেরা এই স্থানটিকে নাই বাম বলে ডাকে। কোন পরিমাপ যন্ত্র তাদের কাছে না থাকায় তারা বাঁশের হিসাবে সমুদ্রের গভীরতা পরিমাপ করে দশ বাম বিশ বাম করে। এই স্থানটিকে তারা কোন পরিমাপ করতে পারেনি বলে একে “নাই বাম” বলে ডাকে।
আরো পড়ুন – ইরানি নওরোজ উৎসব: ইরানিদের নববর্ষ
সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ডের ইতিহাস
১৮৬৩ সালে ভারত থেকে ব্রিটেনগামী গ্যাডফ্লাই নামে জাহাজটি বিপুল সংখ্যক ধনরত্ন নিয়ে যাত্রা করার পথে ঝড়ের কবলে পড়ে ২১২ টন ওজনের ব্রিটিশ জাহাজটি সমুদ্রে গভীরে তলিয়ে যায়। সুন্দরবন থেকে ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত অনুসন্ধান করে যখন জাহাজটির সন্ধানের সম্ভাব্য জায়গা মিলল কিন্তু তখন তা আর উদ্ধারের কোন আশা রইল না। তখন থেকে এই এলাকার নাম করা হয় অতল সাগর বা সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড।
সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড খাত আকৃতির সামুদ্রিক অববাহিকার গভীরতম উপত্যকার গিরিখাত যা বঙ্গোপসাগরের মহীসোপানকে কৌণিকভাবে অতিক্রম করেছে এটি গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র,ব-দ্বীপের পশ্চিমে অবস্থিত। এটিকে গঙ্গাখাত নামেও পরিচিত সকলের কাছে।
আয়তনের দিক থেকে সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড ঢাকা মেট্রো পলিটনের ৬ গুণ। ১ লক্ষ ৭৩ হাজার ৮০০ হেক্টর জায়গা জুড়ে এর অবস্থান। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হিসাব মতে , বর্গ কিলোমিটারে পরিমাপ করলে হিসেব দাঁড়ায় প্রায় ৩ হাজার ৮০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। গভীরতা ১০ মিটার থেকে ১০০ মিটার।এর তলায় রয়েছে কাদা মেশানো বালি। এর ঘনত্ব প্রায় ১৬ কিলোমিটার।
ব্রিটিশরা অনেক আগেই এই এলাকাটির নাম রাখে সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড। এই গিরিখাত যেখান থেকে শুরু হঠাৎ করে সেখানে থেকে এর গভীরতা বেড়ে গেছে। ব্রিটিশরা এই খাদের গভীরতা দেখে বলেছিল এর কোন তল নেই।তাই বৃটিশ বিজ্ঞানীরা এ ধরনের নামকরণ করেছিলেন।
বিশ্বের ১১ টি গভীর খাত বা ক্যারিয়নের মাঝে সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড অন্যতম গভীর সামুদ্রিক অববাহিকা। বিশ্বের দ্বিতীয় গভীরতম খাত হিসেবে সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড খাত টিকে ধরা হয়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন ১ লক্ষ ২৫ হাজার বছর আগে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়েছিল এই খাতটি।
স্থানীয় জেলেরা নায় বাম বা তল নেই বলে জায়গাটাকে ডাকলেও সাধারণভাবে পর্যবেক্ষণ করে জানা গেছে অন্যান্য সাধারণ সমুদ্রের তুলনায় এই সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড এর তলদেশের গভীরতা ১৩৪০ মিটার, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ তাজিংডং কে পুরোপুরি ডুবিয়ে দিতে সক্ষম। ২০১৪ সালে সরকার এই স্থানটিকে রক্ষিত এলাকা ঘোষণা করে।
কেনো সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ডে ভ্রমণ করবেন?
তিমি কিংবা নানান বিরল জাতের ডলফিন দেখতে চান আপনি? তাও আবার নিজ দেশের সীমানাতে? ভাবছেন কোথায় যাবেন? সবই মিলবে আপনার আয়ত্তের মধ্যে তাহলে অবশ্যই আপনাকে যেতে হবে সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড গিরিখাতে। সুন্দরবনের দুবলার চর থেকে মাত্র ত্রিশ কিলোমিটার দূরে সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড পৃথিবীর ১১ তম সমুদ্রের তলদেশের গভীরতম গিরিখাত।
এখানে গেলে দেখতে পাবেন বিরল প্রজাতির নানা জাতের মাছ, ডলফিন, হাঙ্গর, তিমি, বিরল প্রজাতির কচ্ছপ, জেলিফিশ। বিজ্ঞানীদের মতে এখানে আছে ১০০০০ পাখি ৩০ হাজার প্রজাতির মাছ এবং আরো নানাজাতের প্রাণী। এখানে ডলফিন, শুশক ও তিমি তিন প্রকারের স্তন্যপায়ী প্রাণী একসাথে ঘুরে বেড়ায় যা আপনি পৃথিবীর অন্য কোন দেশে গেলে এটা দেখতে পাবেন না।
এখানে গেলে আরো দেখতে পাবেন ব্রীড তিমি, মিল্কি তিমি, শুশুক, ইন্দো প্যাসিফিক ডলফিন, পাখাবিহীন ইমপ্লাইস ডলফিনসহ বহু সামুদ্রিক প্রাণীর অভয়ারণ্য। বঙ্গোপসাগরের সোয়াচে এলে দেখতে পারবেন এর পানি খুবই সচ্ছ। এই পানির গুণগত মান শ্রীলঙ্কা, ভারত, মায়ানমার, মালদ্বীপের চেয়েও উন্নত। বিশেষ করে আমাদের সুন্দরবনের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ম্যারিন ভ্যালি।
এটি এই অঞ্চলের ইকোলজিক্যাল ফিল্টার হিসেবে কাজ করছে। এই সোয়াচে যে মাছ ও প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে তা সঠিক ব্যবহার করতে পারলে তা দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অগ্রসর করা সম্ভব হতে পারে আমাদের বাংলাদেশের জন্য।
কখন সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ডে ডলফিন ও তিমি দেখা যায়
বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণীর বিচরণের জন্য সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড একটা আদর্শ স্থান। সমুদ্রের মধ্যে এই স্থানটি বেশি গভীর হওয়ায় এখানে সামুদ্রিক প্রাণীদের আবাসস্থল তৈরি হয়েছে।এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য তিমি, অক্টোপাস, হাঙ্গর, পপাস ডলফিন, পৃথিবীর বৃহত্তম ইরাবতী ডলফিন, গোলাপি পিঠ কুঁজো ইন্দো প্যাসিফিক ডলফিন, মসৃণ পিঠের পাকনা বিহীন ইমপ্লাইস ডলফিনসহ নানা প্রজাতির নাম না জানা জলজ প্রাণীর একটি অভয়ারণ্য।
সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড পৃথিবীর একমাত্র স্থান যেখানে এই তিনটি সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীকে একসাথে দেখতে পাওয়া যায়। সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড হচ্ছে তিমি ও ডলফিনের প্রজননের হট স্পট। এখানে আরেকটা বিষয় লক্ষ্যনীয় আছে সী গাল পাখির অবস্থান দেখেও তিমি বা ডলফিনের অবস্থান টের পাওয়া যায়। যদি দেখা যায় সী গাল পাখি পানির কাছাকাছি উড়ে বেড়াচ্ছে তাহলে বুঝতে হবে কাছাকাছি ডলফিন বা তিমি আছে বলে অনুমান করে নিতে পারেন।
সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ডের প্রধান আকর্ষণ গুলো কি কি?
সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের চারিদিকে অথৈ জল আর দিগন্ত জোড়া নীলিমায় যেমন হৃদয় আপ্লুত হয় তেমন সাগরতলের মূল্যবান জীব বৈচিত্রের তথ্য ভান্ডার অবাক করে গবেষকদেরও। গবেষকেরা বলেছেন সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড আসলেই সাগরতলের গভীর গিরিখাত বা উপত্যকা বা মেরিন ভ্যালি। অনেক গবেষকদের মতে, মারিয়ানা ট্র্রেঞ্চের মতোই এই সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড এর অবস্থান। বাংলায় বলে অতল স্পর্শী।
এখানে পানির রং পরিবর্তিত হয়ে গাঢ় নীল রঙ ধারণ করেছে । নানা জাতের জানা-অজানা মাছ, বিশাল আকৃতির তিমি, হাঙ্গর, ডলফিন, ও সামুদ্রিক প্রাণী নিরাপদে ঘুরে বেড়ায় এই মেরিন ভ্যালিতে। তিনটি স্তন্যপায়ী প্রাণীর অবাধ বিচরণ দেখতে গেলে আপনাকে অবশ্যই সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ডে যেতে হবে। সে এক অতুলনীয় রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হবে নিশ্চয়ই আপনার কাছে।
ডুবুরিরা সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ডে ঘুরে এসে বলেছে এর গভীরে রহস্য ভরা। তারা এখানে অনুসন্ধান করে জানিয়েছে, বাংলাদেশের আর কোথাও তারা এত মাছের রাজত্ব দেখেনি।
সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ডের গুরুত্ব
সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড বঙ্গোপসাগরের তলদেশে অবস্থিত বিশ্বের গভীরতম ডুবো গিরিখাতগুলোর একটি। এই অঞ্চলটি প্রশান্ত মহাসাগরের সামুদ্রিক জীব বৈচিত্রের শ্রেষ্ঠ হটস্পট গুলোর অন্যতম। বঙ্গীয় উপ-দ্বীপের অংশ এই অঞ্চলটি। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য এক অভাবনীয় সম্ভাবনার উৎস হলেও সমুদ্র গবেষণার সীমাবদ্ধ ও অনঅগ্রসরতার কারণে সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড সদ্ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
রাষ্ট্রীয়ভাবে দীর্ঘমেয়াদী ও সুনিখুঁত কৌশল পরিকল্পনা করে রোডম্যাপ অনুযায়ী অগ্রসর হলে সামুদ্রিক জীব বৈচিত্র নিয়ে গবেষণা, পর্যটন খাত, খনিজ সম্পদ এবং সামগ্রিকভাবে দেশের ব্লু ইকোনির জন্য এটি খুলে দিতে পারে সম্ভাবনাময় এক নতুন দুয়ারের সূচনা। সমুদ্র তলদেশে অন্যতম মৎস্য ভান্ডারের নাম বাংলাদেশের সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড।
এখানে জেলেরা এত বেশি মাছ পায় যে তারা সহজেই ধারণা করে নিয়েছে এখানে মাছের গুপ্তধন লুকিয়ে আছে।
সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড ভ্রমণ গাইড /কিভাবে যাবেন
আপনি বাংলাদেশের যে প্রান্তেই থাকেন না কেনো প্রথমে মংলা বন্দরে যেতে হবে। সেখান থেকে প্রতিদিনই বিভিন্ন ধরনের মাছের ট্রলার সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ডে মাছ ধরার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। যেকোনো ট্রলারে উঠে আপনি চলে যেতে পারেন সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ডে। তবে ট্রলার ঠিক করার আগে বিস্তারিত কথা বলে নিবেন।
বঙ্গোপসাগরের সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ডে একটি নির্দিষ্ট জায়গা আছে যেখানে রাতের বেলা মাছ ধরার জন্য নৌকা বা ট্রলার গুলো অবস্থান করে। যদি রাতের সোয়াচটা উপভোগ করতে চান তাহলে এক রাত কাটিয়ে আসতে পারেন সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ডে। আর আপনি যদি কুয়াকাটা হয়ে সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ডে যেতে চান আপনাকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার সমুদ্র পাড়ি দিতে হবে।