মানব দেহের যেসকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আছে সবগুলোই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে শরীরের জন্য। এইসব অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মধ্যে কিডনি মানব দেহের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা অঙ্গ। আমরা সবাই জানি মানুষের শরীরে দুটো কিডনি বিদ্যমান। প্রত্যেকটি সুস্থ ব্যক্তিরই উচিত শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের যত্ন নেয়ার পাশাপাশি কিডনি ভালো রেখে দেয়ার উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত জানা।কিডনি রোগ প্রত্যেকের জন্য একটি ঘাতক ব্যাধি।
কিডনীতে সমস্যা দেখা দিলে বা বিকল হতে থাকলে সেটা শরীরের উপর আগে থেকেই তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না। কিন্তু যদি টের পাওয়া যায় এটা বিকল হতে শুরু করেছে তখন আর কিছুই করার থাকে না।
তাই প্রত্যেক সচেতন ব্যক্তিরই উচিত তাদের নিজের নিজের কিডনির যত্ন নেয়া।আর কিডনির যত্ন নেওয়ার জন্য কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে তা সম্পর্কে ধারণা থাকা।
মানব দেহে কিডনির কাজ কি?
আমরা সকলেই জানি কিডনি মানব শরীরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ।সেটা ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব।কিডনি মূলত শরীরের নানা ধরনের দূষিত ও শরীরের জন্য ক্ষতিকর পদার্থ ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে শরীর থেকে বের করে দেওয়ার কাজ করে। মানব দেহে দুটো কিডনির একটিও যদি বিকল হয়ে যায় শরীরের সুস্থতা কমে যায়।তাই সকলের কিডনি ভালো রাখার জন্য কি কি করণীয় তা সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে।
কিডনি ভালো রাখতে কি করতে হবে?
কিডনি রোগ ঘাতক ব্যাধি মানব শরীরে বাসা বাঁধলে আপনার সর্বস্ব দিয়েও তা নিরাময় করতে পারবেন কিনা সন্দেহ। কিডনি রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এই রোগ যেনো শরীরে বাসা বাঁধতে না পারে সেজন্য কিডনীর সর্বাত্মক যত্ন নিতে হবে। তাহলে চলুন দেরি না করে জেনে নেওয়া যাক কিডনি ভালো রাখার কিছু টিপস-
১. পানি পান করার অভ্যাস:- অনেকেই আছেন যারা পানি খুব কম পান করেন। আর তাঁরাই মুলত এই কিডনী বিকলের সমস্যায় আক্রান্ত হন। তাই কিডনী ভালো রাখার জন্য বেশি বেশি বিশুদ্ধ পানি পান করার অভ্যাস গড়ে তুলুন। একটি সুস্থ ব্যক্তির জন্য অবশ্যই প্রতিদিন অন্তত ৮/১০ গ্লাস পানি পান করতে হবে। অনেকের কিডনীতে পাথর হয় এবং শরীর থেকে পরিশ্রম না করলেও অতিরিক্ত ঘাম ঝরে। শরীরের এসব কারণের জন্য বেশি বেশি পানি পান করুন।এতে আপনার শরীরের পানি শূন্যতা পূরণ হবে। এবং আপনি সুস্থ থাকবেন।
২.তরল খাবার খেতে হবে:- খাবারের বিষয়ে অনেকে আছেন শুকনো খাবার পছন্দ করেন। ভাজা পোড়া খাবার এবং তৈলাক্ত খাবার খেতে খেতে শরীরে কোষ্ঠ কাঠিন্য সৃষ্টি করেন।যেটা মোটেও শরীরের জন্য উপকারী নয়। তাই অবশ্যই তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে।
৩. লবণ খাওয়ার অভ্যাস কমাতে হবে:- খাবারের স্বাদ আরও বাড়ানোর জন্য কিংবা আরো মুখরোচক খাবার তৈরি করার জন্য অনেকে খাবারে অতিরিক্ত লবণ খেয়ে থাকেন। অতিরিক্ত লবণ শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। প্রতিটি শরীরের জন্য এক চা চামচ পরিমাণ লবণ খাওয়া বাঞ্চনীয়। তাই অতিরিক্ত লবণ বর্জন করে সুস্থ থাকুন আর কিডনীকে ভালো রাখতে এগিয়ে আসুন।
৪.ক্যাফেইন জাতীয় পানীয় থেকে দূরে থাকুন:- কেউ কেউ কোমল পানীয় খেতে পছন্দ করেন তাছাড়া চা,কফি অতিরিক্ত সেবন করে শরীরে ক্যাফেইনের মাত্রা বৃদ্ধি করে ফেলে। ক্যাফেইন আপনার শরীরে যখন তখন ক্লান্তি দূর করে ঠিকিই কিন্তু পাশাপাশি আপনার পানি স্বল্পতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শরীরের পানি স্বল্পতা নানা ধরনের রোগের সৃষ্টি করে যার মধ্যে কিডনী স্টোন অন্যতম। সুতরাং এইসব ক্যাফেইন জাতীয় পানীয় থেকে দূরে থাকুন।
৫. ডায়বেটিকস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে:- যারা ডায়বেটিকসে ভুগছে তাদের জন্য অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে কিডনীকে ভালো রাখতে। নিয়মিত ডায়বেটিকস নিয়ন্ত্রণ না করলে কিডনীর উপর এর প্রভাব পড়তে পারে। নিয়মিত শরীরের সুগারের মাত্রা ঠিক আছে কিনা পরীক্ষা করতে হবে। ডায়াবেটিসের মাত্রা বেড়ে গেলে মিষ্টি জাতীয় খাবার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন।
৬.ধুমপান বর্জন করুন:- ধুমপায়ী ব্যক্তি শুধু নিজের নয় সমাজের অন্য মানুষেরও ক্ষতি করে। ধুমপানের ফলে সৃষ্ট ধোঁয়া শরীরের ফুসফুস,হৃদযন্ত্র ও ধমনীকে মারাত্মক ক্ষতি করে। এর প্রভাব পড়ে কিডনীর উপর। তাই সবসময় ধুমপান থেকে বিরত থাকুন।
৭. প্রাণিজ প্রোটিন থেকে দূরে থাকুন:- নাস্তা করতে অনেকে মুখরোচক খাবার হিসেবে দোকানের প্রক্রিয়াজাত খাবার খেতে পছন্দ করেন। বিভিন্ন ধরনের প্রাণিজ প্রোটিন যেমন- ফাস্টফুড, চিপস, লবন দিয়ে ভাজা বাদাম, নুডলস কিডনির সমস্যার জন্য দায়ী। দৈনন্দিন খাবারের রুটিনে যদি প্রোটিনের পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে তা কিডনির উপর চাপ সৃষ্টি করে।
অতিরিক্ত চাপের ফলে কিডনিতে থাকা দূর্বল কোষগুলো আরো বেশি দূর্বল হয়ে যায়। এতে কিডনি বিকল হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
৮. ব্যাথার ট্যাবলেট বর্জন করুন:- সকল ধরনের ঔষধই কিডনির জন্য কমবেশি ক্ষতির কারণ। কেউ কেউ আছেন একটু ব্যাথা করলেই ব্যাথার ঔষধ খাওয়ার বাজে একটা অভ্যাস আছে। ব্যাথার ঔষধ শুধু ব্যাথা উপশম করে এটাই নয় ক্ষতিও কম করে না। কিডনিতে থাকা দূর্বল কোষগুলো ব্যাথার ঔষধের প্রভাবে কার্যক্ষমতা লোপ পায়। তাই অবশ্যই আজ থেকেই ব্যাথা অতিরিক্ত না হলে ঔষধ সেবন থেকে দূরে থাকুন। ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত অতিরিক্ত ব্যথা নাশক ঔষধ সেবন শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক।
৯. মাত্রাতিরিক্ত ভিটামিন সি বর্জন করুন:- কোনোকিছুই অতিরিক্ত মাত্রায় শরীরের জন্য সুখদায়ক নয়। ভিটামিন শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী উপাদান।
কিন্তু যদি প্রতিদিন ভিটামিন সি ৫০০ মিলিগ্রামের বেশি গ্রহণ করা হয়, তবে কিডনীতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই অতিরিক্ত ভিটামিন সি গ্রহণ করা যাবে না।
১০. প্রস্রাব আটকে রাখার প্রবণতা:- যারা বাইরে কাজ করেন তারা অনেকেই আছেন বাইরে পাবলিক টয়লেট ব্যবহার না করার জন্য প্রসাব না করে আটকে রাখেন। চিকিৎসকদের মতে প্রস্রাব আটকে রাখার প্রবণতা অন্তত ক্ষতিকর কিডনীর জন্য। দীর্ঘদিন ধরে প্রস্রাব আটকে রাখার জন্য এমনকি কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে।
১১.অতিরিক্ত আমিষ জাতীয় খাবার বর্জন:- খাবার তালিকায় অনেকে নিয়মিত বা ঘন ঘন আমিষ জাতীয় খাবার মাংস বা চর্বি জাতীয় খাবার রাখে। চর্বি জাতীয় খাবার খেলে কিডনীর উপর এর প্রভাব পড়ে কিডনি ড্যামেজ করে ফেলে। চর্বিযুক্ত মাংসে যদি অতিরিক্ত মাত্রায় ফাইবার থাকে তাতেও কিডনীর উপর চাপ পড়ে। চর্বি জাতীয় খাবার ও মাংস কম খেয়ে শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
১২.চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে:- কিডনি ভালো রাখার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিন। যদি আপনার ডাইবেটিকস, অতিরিক্ত ওজন, উচ্চ রক্তচাপ, শরীরে অতিরিক্ত ব্যথা এবং পরিবারে অন্য কারো কিডনির সমস্যা থেকে থাকে তাহলে কিডনির জন্য হুমকিস্বরূপ। এইসকল সমস্যা যাদের আছে তারা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলার চেষ্টা করুন। নিয়মিত কিডনি পরীক্ষা করে সুস্থ থাকার ব্যাপারে নিশ্চিত থাকুন।
১৩.প্রেশার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে:- মানব দেহে স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক পরিমাণে রক্তচাপ বৃদ্ধি পেলে কিডনির সমস্যা হতে পারে। স্বাভাবিক রক্তচাপ ১৩০/৮০ এর বেশি হলে কিডনিতে এর প্রভাব ফেলে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইলে নিয়মিত ব্যায়াম চর্চার অভ্যাস করুন।
পরিশেষে
স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কিডনি ভালো রাখার জন্য টিপসগুলো মেনে চলা আমাদের সকলেরই দায়িত্ব। কিডনি চিকিৎসা ব্যয় বহুল ও কষ্টসাধ্য। তাই যদি আগে থেকেই কিডনির প্রতি যত্নশীল হওয়া যায়, তাহলে কিডনির কোনো ধরনের সমস্যা নেই বলেই চলে। সুস্থ থাকতে কে না চায়? শরীর সুস্থ রাখার জন্য সকলের সচেতনতাই পারে একটি সুন্দর জীবন গঠনে সহায়তা করতে।
আরো পড়ুন –